হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ভালে: পেটার হান্ডকে-র জীবন ও সাহিত্য

দেবব্রত চক্রবর্তীদেবব্রত চক্রবর্তী
Published : 9 Dec 2019, 04:35 AM
Updated : 9 Dec 2019, 04:35 AM


৬ ডিসেম্বর ১৯৪২-এ তাঁর জন্ম৷ সদ্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হবার পর ১০ ডিসেম্বর ২০১৯ তিনি থাকছেন নোবেল পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে৷

মনে হয় গত শতকের সত্তরের দশকে তাঁর নামটাই শুনেছি, বিশেষ জানতাম না কিছু তাঁর সম্বন্ধে৷ আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা বড়, কিন্তু তখনই তাঁর বেশ নাম ডাক হয়েছে৷ এতটাই যে আমাদের মত অর্বাচীনের কাছেও তিনি পৌঁছে গিয়েছেন৷ যে ছবিটা আমার মনে পড়ে তাঁর, সেটা হল লম্বা চুল, একটা রোদ চশমা পরা তাঁর ছবি৷ জার্মান কিছুই জানি না তখনও, ইংরেজীতে তাঁর ওপর কোনও বইও পাওয়া যায় না, তাই দূর থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে৷ পরে যখন জার্মান ভাষাটা একটুখানি শিখেছি, তখন একদিন দেখলাম তাঁর একটি উপন্যাস গ্রন্থাগারে, অবশ্য ইংরেজী অনুবাদেই, A Sorrow Beyond Dreams – কি জানি হয়তো এমনও হতে পারে যে ওটা দেখিনি, দেখেছিলাম ফাল্কেনষ্টাইন-এর লেখা তাঁর একটা জীবনী৷ স্মৃতি সতত সুখের যে নয়, সে এই সংশয়িত বেদনা জাগানো তথ্যসচেতনতা থেকেই বোঝা যায়৷ উচাটন সারাক্ষণ মনের মধ্যে খচখচ করে৷
অত কম বয়সের পেটার হান্ডকে নামক যুবকের জীবনী? ভাবাই যায় না৷ কিন্তু যদি প'ড়েই থাকি, তাহলে আজ আর মনে নেই কী পড়েছিলাম সে বইতে৷
এখন যখন ভাবি যে ১৯৫৯-এ গ্যুন্টার গ্রাস মাত্র ৩২ বছর বয়সে রাতারাতি তাঁর কী বিপুল খ্যাতি, তখন তাঁকে দেখে তত বিস্মিত হই না, যত বিস্মিত হই তাঁর টিন ড্রাম প'ড়ে৷ ওই বয়সে লেখা ওই উপন্যাসের মধ্যে যে পরিপক্কতা, তা দেখলে মনে হবে যে যেন লেখকের চেয়ে লেখকের রচনাই বেশী প্রবীণ৷ মূল রচনা আর অনুবাদ মিলিয়ে গ্রাস যে ত্বরিত বিশ্বজনীন জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, তার জন্য তাঁকে নোবেল পেতে হয়নি৷ গ্রাস-এর প্রথম দিকের বইগুলি Ralf Mannheim ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন, পেটার হান্ডকে-র ওই বই A Sorrow Beyond Dreams -ও তাই৷ আর তাঁর বয়সটাও ওই তিরিশের মধ্যেই ছিল, যখন তাঁর খ্যাতি বেশ পাকাপোক্ত ভাবে গেড়ে বসতে চলেছে৷ তিরিশ বত্রিশে তাঁর পাঠকেরাও প্রতি বছরই প্রত্যাশা করছিলেন তিনি নোবেল পাবেন, তবুও তাঁর জনপ্রিয়তা মূলত ইউরোপ আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল৷ সারাটা জীবন ইউরোপের চৌহদ্দিতে বাস ক'রে এত পরে যে তাঁর আন্তর্জাতিক বোধন হল, তার জন্যই তিনি বোধ হয় বেরিয়ে আসতে পারলেন আঞ্চলিকতার স্রোত থেকে আচমকা সাগরের মোহনায়৷ যোগ্যতায় এবং স্বমহিমায়৷
তাঁর লেখা বই পড়বার বা না পড়বার, কিংবা পড়লেও তা মনে না রাখবার স্মৃতিটুকু যে ছোট্ট কুলুঙ্গিতে রাখা ছিল, আজ তাঁর নোবেল পুরষ্কার পাবার আবহে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়েছে৷ কেমন একটা তান কর্তব ভেসে আসছে৷
তাই যেটুকু মনে আছে তাকে মনে রেখেই এগিয়ে চলতে হয়৷ স্মৃতির ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের ওপর রাগ ক'রে তো আর কপালে হাত দিয়ে ব'সে থাকা যায় না!


তাঁর জন্ম ১৯৪২-এর ৬ ডিসেম্বর, অস্ট্রিয়ার করিন্থিয়া (Kärnten) বা কেয়ার্নটেন প্রদেশের গ্রিফেন অঞ্চলের ৬ আলটেনমার্কট-এ, জায়গাটা ক্লাগেনফুঅর্ট শহর থেকে উত্তর পশ্চিমে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে৷ দাদামশায় গ্রেগর সিভেক (Gregor Sivec)-এর বাড়িতে তাঁর জন্ম৷ দুদিন পরই অপ্সুদীক্ষা হয় গ্রিফেন-এর ক্যাথলিক গীর্জায়৷ মায়ের নাম মারিয়া (১৯২০-১৯৭১), তিনি করিন্থিয়া-র স্লোভেনীয়৷ পেটার-এর বাবা আসলে এরিখ শ্যোয়নেমান (Erich Schönemann), ষ্পারকাসে বা ব্যাংক-এ কাজ করতেন, পরে সৈন্যবাহিনীতে যান৷ কিন্তু তাঁর জন্মের কিছুদিন আগে তাঁর মা বিয়ে করেন বার্লিনের ট্রাম-চালক অন্য একজন ব্রুনো হান্ডকে-কে, আর এই হান্ডকে পদবীতেই পেটার-এর খৃষ্টদীক্ষা হয়৷ এরপর পূবের বার্লিনে মা তাঁর নবজাতককে নিয়ে যান, কিন্তু সেখানে এই ভদ্রলোকের মদ্যপানের উৎপাতে সংসার ক্রমশ অচল হতে শুরু করে৷ সোভিয়েত দখলীকৃত পূর্ব বার্লিনের পানকভ জেলায় ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত তাঁরা বসবাস করেছিলেন, সেখানেই পেটার-এর একটি সৎ বোনের জন্ম হয় ১৯৪৭-এ৷ নানান কারণে এবং মূলত আর্থিক দৈন্যের ফলেই ১৯৪৮-এ আবার ওই গ্রিফেন-এ তাঁদের ফিরে আসতে হয় এবং পেটার-এর বাবারূপী ওই ভদ্রলোক তাঁর শ্বশুরের ছুতোর কারখানায় ছুতোরের কাজ করতে শুরু করেন৷
বালক পেটার-এর বাল্যকাল চলছে শাঁখের করাতের মধ্যে, একদিকে সঙ্কীর্ণ দুই কামরার ঘর, আর অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত সুরাসেবনের তাড়সে মা-বাবার অসহ্য সম্পর্ক, যদিও তাতে পরিবার সংখ্যাবহুল হয়ে উঠতে বাধা পায়নি৷ এদিকে এতদঞ্চলের পাহাড়ী এলাকার প্রকৃতিই পেটার-এর কাছে একটা বাড়তি আকর্ষণ হয়ে উঠেছে, আর তার মধ্যে সে তার একমাত্র মুক্তি খোঁজার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু প্রকৃতির সুধা পান যে তার কাছে অন্য মানুষের তুলনায় অনেক সীমিত রয়ে গেছে, সে হয়তো জানে তখন, তার কারণ সে সম্পূর্ণ বর্ণান্ধ, আজও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সাদা-কালোয়৷
অন্যদিকে বাধানিষেধের বেড়াজাল প্রবলভাবে নিয়ামক হয়ে উঠেছে তার৷ মায়ের কাছ থেকে না হোক, ওই ঘিঞ্জি ঘর আর বিপিতার কাছ থেকে পলায়ন তার কাছে একটা অবশ্যকরণীয় কর্তব্য ব'লে মনে হচ্ছে৷ গ্রিফেন-এর উচ্চবিদ্যালয়ে সে পড়ছেই, তবে এর মধ্যে ১৯৫৪-তে তাকে পাঠানো হল বিশপীয় মানবিকী বালক-সেমিনারি-র ইস্কুল "মারিয়ানুম"-এ, ভর্তি হল দ্বিতীয় শ্রেণীতে (2nd Class)৷ এটা ক্লাগেনফুঅর্ট-এর কাছে টানৎসেনবেয়ার্গ-এর একটা বোর্ডিং স্কুল৷ এখানে এসেও সহপাঠীদের সঙ্গে মিশতে পারল না বালক৷ একটা অবহেলিত অবস্থাতেই শেষের সারিতে বসা৷ নিছক খেলার ছলে ভুলে যাওয়া প্রথম বছরের লাতিন হেলায় শিখতে শিখতে প্রাথমিক স্তরের লাতিনটা পাশ করে ফেলল৷ এটা শিক্ষকদের মধ্যে কারও ঠিক চোখে না পড়লেও পড়ল একজন শিক্ষকের, তাঁর নাম রাইনহার্ড মুসার (Reinhard Musar), পেটার-এর প্রতিভাটা তিনি সম্ভবত সনাক্ত করতে পেরেছিলেন এবং তিনিই হয়ে উঠলেন তাঁর প্রেরণাদাতা৷ এই বোর্ডিং স্কুলের একটি পত্রিকা ছিল, তার নাম ফাকেল (Fackel), সেখানে পেটার তার প্রথম গল্প ও পুস্তক সমালোচনা লিখল৷ সমালোচনাগুলি আধুনিক লেখকদের রচনার, বিশেষ ক'রে ফকনার (William Cuthbert Faulkner, ১৮৯৭-১৯৬২ )-এর বইয়ের৷ পছন্দ করত সে ফকনার৷ কিন্তু এই বোর্ডিং স্কুলের হাওয়াও তার খুব দমবন্ধ মনে হতে লাগল৷ ক্লোস্টার-সুলভ পরিবেশ গোটা সমাজ থেকেই বিচ্যুত, লেখা ও পড়ার মধ্যেও নানান বিধিনিষেধ৷ প্রিফেক্ট হিসাবে আবিষ্কার করল ছেলে যে হায়, যে গ্রাহাম গ্রীন (Graham Greene, ১৯০৪-১৯৯১)-এর The Heart of the Matter (1948) বইটির জার্মান অনুবাদ Herz aller Dinge (1949)পড়বে ব'লে সে নিয়েছিল, সেটার জন্যই তাকে সতর্ক করা হল, বইটি পড়া যাবে না, কারণ ওখানে বেশ্যালয়ের প্রসঙ্গ আছে৷ এইভাবে "মারিয়ানুম"-এর পুরোহিত হওয়া যার একেবারে অবধারিত ছিল, সে পলায়ন করল আবার সেই পুরোনো পরিবেশে৷ ১৯৫৯-এ টানৎসেনবেয়ার্গ-এর স্কুলে ফিরে এসে সে দু বছর পর ম্যাট্রিকুলেশন বা মাটুরা পরীক্ষা দিল, পাশও করল৷ মাষ্টারমশায় রাইনহার্ড মুসার তাকে কিন্তু বললেন আইন পড়তে৷ বলেছিলেন যে সফল হলে সাহিত্যচর্চার জন্য সে অনেকটা সময় দিতে পারবে৷ গুরু শিষ্যের সম্পর্ক ছিল অতি মধুর, সে দুই একটি চিঠি পড়লেই বোঝা যায়৷
গ্রিফেন ত্যাগ ক'রে তাই পেটার চলে গেলেন গ্রাৎস শহরের ষ্টাইয়ারমার্কট-এ আইন পড়তে৷ এখানে এসেই এখানকার সাংস্কৃতিক সংস্থা "ফোরুম ষ্টাডপার্ক" (Forum Stadtpark)বা "নগর-পার্ক-এর ফোরাম"-এর সদস্য হলেন, আর যোগ দিলেন "গ্রাৎসার গ্রুপে" (Grazer Gruppe, ১৯৭৩) বা "গ্রাৎস গোষ্ঠী" নামক সাহিত্য সংগঠনে৷ এই সংগঠনের পরিচালক ছিলেন আলফ্রেড কোলারিচ (Alfred Kolleritsch : জন্ম ১৯৩১), তিনি তাঁর সাহিত্য, শিল্প ও সমালোচনা বিষয়ক "manuskripte" পত্রিকায় Handke Texte প্রকাশ করলেন, এমন কি ষ্টাইয়ারমার্কট-এর স্টুডিও-র সাহিত্য বিভাগের পরিচালক আলফ্রেড হোলৎসিঙার (Alfred Holzinger: ১৯১৮-১৯৭৯)-এর কাছ থেকেও প্রভূত সাহায্য এল বেতারে পাঠ করবার৷
ছাত্রাবস্থায় গ্রাৎস-এ পেটার হান্ডকে এখন অনেক স্বাধীন, যুগোস্লাভিয়াতে বেড়াতে যাচ্ছেন, যাচ্ছেন রুমানিয়ায়, বীটদের সঙ্গীত উপভোগ করছেন, সিনেমায় যাচ্ছেন, সব রকমের ছবি দেখতে পারছেন সেখানে৷ চিত্রশিল্পী পেটার পোনগ্রাৎস (Peter Pongratz: জন্ম ১৯৪০)-এর সঙ্গে পরিচয় হল গ্রাৎস-এ, মঞ্চের অভিনেত্রী "সাংকট ফাইট আন ডেয়ার গ্লান" (করিন্থিয়া-র একটি জায়গার নাম) -এর লিবগার্ট শ্ভার্ৎস (Libgart Schwarz: জন্ম ১৯৪১)-এর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলেন এবং আরও মুগ্ধতা এল ব্যক্তিগত পরিচয়ে, ১৯৬৬-তে যার নীট ফল হল বিবাহ – এই গ্রাৎসবাসীর প্রথম দিককার জীবনে লিবগার্ট-ই হলেন তাঁর পরিবারের সুখ ও স্বস্তি৷



১৯৬৫ সালটি তাঁর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল৷ সুয়ার কাম্প ফেয়ারলাগ (Suhrkamp Verlag) বা সুয়ার কাম্প প্রকাশনের পরিচালক সীগফ্রিড উনসেল্ড (Siegfried Unseld: ১৯২৪-২০০২) গ্রাৎস-এর স্পানঞল বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদক রোটবাউয়ার(Anton Maria Rothbauer)-এর সুপারিশে পেটার হান্ডকে-র উপন্যাস "হরনিসসেন" (Hornissen) প্রকাশ করলেন৷ "হরনিসেন" বা "ভীমরুল", এই হল তাঁর প্রথম উপন্যাস, এখানে উপন্যাসের জন্মকথাই লেখা আছে৷ একজন লোক অনেক কাল আগে একটা বই পড়েছিল৷ কিংবা হয়তো পড়েনি, কেউ হয়তো তাকে এই গল্পটা বলেছিল৷ এবার একদিন, মানে এক গ্রীষ্মে সেই কথা ভেবে ভেবে, অর্থাৎ সেই অন্ধ নায়কের জীবনে কি ঘটেছিল তার কথা ভেবে মনে হল যে সেটা যদি ওর নিজের জীবনেই ঘটত, আর এইভাবে ভুলে যাওয়া ঘটনাটা মনে পড়তেই তার মনে হল যে এ গল্পটা অনেক কাল আগে সে নিজেই পড়েছে, বারবার পড়েছে৷ একটা বিশ্বাস তৈরি হতে লাগল যে ওই গল্পের ভাঙা টুকরো তার স্মৃতিতে এসে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে, শব্দ এসে ঢুকছে, বাক্য আসছে, টুকরো টুকরো ছবি ভেসে আসছে স্মৃতিতে, আর এইভাবে একটা গোটা উপন্যাসের নির্মাণ হচ্ছে অন্তরে বাহিরে – ঠিক করতে পারছে না যে এই "নতুন" উপন্যাসে সেই পুরোনো "নায়ক"-ই নায়ক, নাকি তার নিজের চিন্তার সুতোয় বোনা একটা নতুন তাঁতে গড়ে তোলা সে নিজেই নায়ক? হান্ডকে এখানে সরাসরি একটা স্পর্শগ্রাহ্য বাস্তব তৈরি করলেন, একেবারে স্থূল বাস্তব বা "গেগেনষ্টান্ড" ও ঘটনাক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে তার বীজটাকে বার ক'রে বাইরে নিয়ে এলেন, দেখালেন "প্রাণহীন বস্তু কেমন সঞ্জীবিত হয়ে উঠতে পারে প্রাণস্পর্শে৷" আধুনিক লেখকদের লেখায় এই ভাবনা তখন প্রায় অকল্পনীয়৷ একটা পুরোপুরি খোলা রূপকথার ভাবনা, কোথাও শক্ত হয়ে যাচ্ছে না, আবার তরল হয়ে এলিয়েও পড়ছে না, পাঠকও সেজন্য গল্পের মধ্যে তার সম্ভাব্য জীবনের আাদর্শ খুঁজে নিতে পারছে৷ উপন্যাসের এই ভাবনাটুকুই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল৷
পেটার এই সময়টায় আইন পড়া ছেড়ে দিলেন, পুরোপুরিই আত্মনিয়োগ করলেন সাহিত্যে, যদিও ইতিমধ্যেই আইনের দুটি পরীক্ষাতে তিনি ভালভাবেই পাশ করেছেন৷ ১৯৬৬ সনও তাঁর পক্ষে ভালই সাব্যস্ত হল৷ অস্ট্রিয়া ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে চ'লে গেলেন ড্যুসেলডর্ফ-এ, সেখানে একটি নতুন কাজ তিনি পেয়েছেন৷ এখান থেকেই আমেরিকা যাবার সুযোগ এল, যে দেশ বীটলদের দেশ, ফকনার-এর দেশ৷ তাঁর চুলও তখন বড় বড় ক'রে রাখা৷ প্রিন্সটন-এ গ্রুপে-৪৭ –র সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলেন৷ ব্যাপারটা হল এই যে ওই গোষ্ঠীর প্রধান হান্স ভেয়ার্নার রিষটার সুয়ার কাম্প ফেয়ারলাগ-কে একটা ফ্রি টিকেট দিয়েছিলেন, সেটা উনসেল্ড তাঁর তরুণতম লেখককে দিয়ে বললেন একটা নতুন অভিজ্ঞতার ভাগীদার হতে৷ আসলে এই লেখকের লেখায় তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত৷ সম্মেলনে গিয়ে কিন্তু পেটার এই গ্রুপে-র বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন৷ জার্মানির সাহিত্যরথীদের বিরুদ্ধে তিনি এত অগ্নিবর্ষী মন্তব্য করেছিলেন যে সেখানে তাঁর নিজের উপন্যাস Der Hausierer-এর গদ্যাংশ পাঠের চেয়ে তাঁর ওই বিতর্কনৈপুণ্যই মিডিয়ার কাছে অনেক বেশী আকর্ষণীয় হয়েছিল এবং সংবাদমাধ্যমেও তা ছড়িয়ে গিয়েছিল যথারীতি ও দ্রুত৷ রিষটার যদিও সর্বসমক্ষে শীতলকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে এই গ্রুপে-৪৭ কারও স্লোগান দেবার জায়গা নয়, তবু দেখা গেল যে অনেক শ্রোতার এতে প্রীতি উৎপাদিত হয়েছে৷ এই বজ্রকন্ঠ ঘোষণার ফলেই পেটার যেন সকলের চোখে প'ড়ে গেলেন৷
ড্যুসেলডর্ফ-এ খুব বেশীদিন রইলেন না আর তিনি, একটা শহর থেকে অন্য শহরে স'রে যেতে লাগলেন ক্রমশ৷ ১৯৬৮-তে বার্লিন, ১৯৬৯-এ সেখানে তাঁর কন্যা আমিনা জন্মাল৷ তারপর ওই বছরেই চ'লে গেলেন প্যারিস-এ এবং ১৯৭১-এ ক্যোলন-এ৷ কোলারিচ-এর সঙ্গে ১৯৭১-এ এইবার দ্বিতীয় আমেরিকা সফরে গেলেন, বিভিন্ন কলেজে পড়লেন তাঁর রচনা৷ ১৯৭২-এ ফ্রাংকফুর্টার থিয়েটার আম টুর্ম (Das Theater am Turm বা TAT, ১৯৫৬ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ছিল ফ্রাংকফুর্ট আম মাইন-এর নগর নাট্যশালা)-এ তাঁর স্ত্রী যোগ দিলে তাঁর প্রীতি উৎপাদনের জন্যই ক্রোনবেয়ার্গ-এ তাঁকে একটা খুব বিলাসবহুল বাংলো কিনে দেন৷ ক্রোনবেয়ার্গ-এর পরে তিনি যান প্যারিসে বাস করতে, তারপর যান আমেরিকা (১৯৭৮-১৯৭৯), তারপর সালৎবুর্গ (১৯৭৯-১৯৮৮)৷ ১৯৯০-থেকেই তিনি প্যারিস-এর কাছে শাভিল (Chaville)-এ বসবাস করতে থাকেন. স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ১৯৯৪ সালে৷ পরের স্ত্রী সোফি সেমিন, তাঁকে বিয়ে করেন ১৯৯৫-এ৷ তিনিও অভিনেত্রী৷
১৯৭৩-এ পেয়েছেন গেয়র্গ ব্যুইখনার পুরষ্কার, ১৯৮৭-তে ভিলেনিকা আন্তর্জাতিক পুরষ্কার৷ ইতিমধ্যে শুধু এই দুটি পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন৷ এর পর থেকে পেটার-এর শুধুই উত্থান …

স্মৃতিকে তোয়াজ করলে যে সে কিছুই দেয় না এমন তো নয়৷ ফাঁক ফোকর দিয়ে কখন কি একটা পারিপার্শ্বিক এসে হাজির হয়, তাতে স্মৃতি জেগে ওঠে৷ এখানে তো তারই একটা পরীক্ষা হয়ে গেল৷ আর এত কিছু হল ব'লেই ভেতরে ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করলাম পেটার হান্ডকে সম্পর্কে সত্যিকারের কিছু তথ্য জোগাড় করতে৷ দেখলাম আমার গল্পের প্রস্থানবিন্দু সব টাটকা ইনটারনেট-এ সাজানো রয়েছে৷ অতীতচারী মানুষের একটা গোটা খনিজ ভাণ্ডার কেউ যেন আগলে ব'সে আছে আমার জন্যেই৷
"পেনাল্টির আগে গোলরক্ষকের উদ্বেগ"(Die Angst des Tormanns beim Elfmeter, ১৯৭০) লিখেই পেটার সাড়া জাগিয়েছিলেন৷ জার্মানভাষী খেলাপ্রমী মানুষের কাছে এই শীর্ষক বেশ অনেক বছর একটা মজার কথা হিসাবে চালু ছিল৷ যদিও এর গল্পটা স্বতন্ত্র৷ এর মধ্যে ছিল ইয়োসেফ ব্লখ নামে এক মনোরোগীর নিঃসঙ্গতার কথা৷ ইয়োসেফ ব্লখ, এই প্রাক্তন গোলরক্ষক ও রাজমিস্ত্রীর একদিন মনে হল যে কাজে গিয়ে সে দেখছে তার চাকরি চ'লে গেছে৷ তখন সে একটা খুন করল৷ এরপর সে শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল দক্ষিণের সীমান্তে – বোঝাই যায়, শহরের নাশমার্কট থেকে যাচ্ছে যখন, তখন শহরটার নাম ভিয়েনা এবং যাচ্ছে যেখানে সেটা হল বুর্গেনল্যান্ড-এর ইয়েনার্সডর্ফ৷ দৃশ্য ও চরিত্র সব সত্যিকারের রোল মডেল নয় এবং বাস্তব থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ও বানানো৷
আসলে হান্ডকে-র এই রচনার মধ্যে তাঁর স্থায়ী পরিচয়পত্র তখনও পাকা হয়নি৷ দীর্ঘ বিদায়ের সংক্ষিপ্ত চিঠি (Der kurze Brief zum langen Abschied, ১৯৭২)-র মধ্যে প্রথম মনে হল তিনি তাঁর শৈলীর একটা খোঁজ পেয়েছেন৷ এক অস্ট্রীয় যুবক আমেরিকাতে পাড়ি দিয়েছে, আসলে পালিয়েছে সে এবং তার উদ্দেশ্যও হল যে সে তার স্ত্রী ইউডিথ-কে খুঁজে বার করবেই৷ সে পৌঁছয় গিয়ে রোডস আয়ল্যান্ড-এর রাজধানী প্রভিডেন্স-এ, সেখানে তার স্ত্রী ইউডিথ-এর কাছ থেকে একটা চিঠি পায়, "আমি নিউ ইয়র্ক-এ রয়েছি৷ আমাকে খুঁজো না, আমাকে খুঁজে পেলে তা খুব শোভন হবে না৷" এই সফর তার উদ্বেল হয়ে ওঠে ওই খোঁজা ও আতঙ্কের একটা তাড়না নিয়ে৷ এর মধ্যে একদিন সে শিলার-এর ডন কার্লোস নাটক দেখতে গিয়ে পরিচিত হয় ক্লেয়ারে ব'লে একটি মেয়ের সঙ্গে এবং তার সঙ্গে মঞ্চ ও বাস্তবতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠে…
গদ্যের একটা নমুনা দেওয়া যাক:
"জেফারসন স্ট্রীট প্রভিডেন্স শহরের একটা নির্জন রাস্তা৷ ব্যবসায়িক এলাকার চারদিক ঘুরে ঘুরে রাস্তাটা শহরের দক্ষিণের একটা মোড়ে এসে পৌঁছেছে, এটা হল নরউইচ স্ট্রীট, এখান থেকে বেরিয়েই নিউ ইয়র্ক-এর দিকে যাবার পথ৷ এখানে ওখানে বার্চ আর মেপল গাছের নিচে ছোট ছোট জায়গা, তারই একটার গায়ে ওয়েল্যান্ড স্কোয়্যার, সেখানে বেশ বড়োসড়ো ইংরেজদের কান্ট্রিহাউস শৈলীতে তৈরি একটা বাড়ি হল হোটেল ওয়েল্যান্ড ম্যানর৷ এপ্রিলের শেষে এই হোটেলটাতে এসে পৌঁছতেই হোটেলের অভ্যর্থনা বিভাগের কর্মী আমায় চাবির তাক থেকে বের ক'রে এনে চাবিটা দিল, আর সেই সঙ্গে দিল একটা চিঠিও৷ লিফট তখনও খোলা, লিফটম্যান তখনও অপেক্ষায়, তার মধ্যেই খামটা খুলতে লাগলাম, খামের ধারগুলোয় আঠা ভাল বসেনি৷ সংক্ষিপ্ত চিঠি, লেখা আছে: "আমি নিউ ইয়র্ক-এ আছি৷ খুঁজো না আমায়, আমাকে খুঁজে পেলে সেটা খুব শোভন হবে না৷"
"পুরোনো স্মৃতির যতখানি হাতের নাগালে পাই, দেখি যে বিভীষিকা আর আতঙ্ক দুইই যেন আমার জন্মসহোদর৷ আমেরিকান বোমারুদের হাত থেকে বাঁচাতে যখন আমায় ঘরে পৌঁছে দেওয়া হল, তার পর দেখতে পেলাম কাঠের গুঁড়ি অনেকটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বাইরের উঠোনে তাদের গায়ে রোদের আলো এসে পড়েছে চুপচাপ৷ ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে পাশের দরজা দিয়ে ওঠবার সিঁড়িতে, সপ্তাহান্তে ওখানে কাটা হয়েছিল খরগোশগুলি৷ গোধূলির অন্ধকারে তো আরও ভয়ানক অবস্থা, রাত হয়নি, তাতেই এই; তখন আমি টলমল করতে করতে এলানো দুই হাত হাসির খোরাকের মত দুলিয়ে দুলিয়ে চৌপাট হয়ে যাওয়া বনটার ধার বরাবর চলেছি, পথের পাশের গাছের গুঁড়িগুলির গায়ে ছত্রাক সব চকচক করছে, আর আমি মাঝে মাঝে কাউকে ডাকব ব'লে চেঁচিয়ে উঠছি, কিন্তু সেই মুহূর্তেই আবার থমকে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি, অসহায়ের মত লজ্জায় চুপ, ফের গরগর করছি, আত্মার গভীর থেকে একটা গর্জন বেরিয়ে আসছে, এবার আমি আর বিভীষিকায় লজ্জিত হচ্ছি না, বনের মধ্যে এমন একজনকে ডাকতে শুরু করেছি যাকে আমি ভালবাসি, যে সকালবেলায় বনের মধ্যে চলে গিয়েছে, অথচ ফিরছে না এখনও, আবার সেই অনেকটা দূর পর্যন্ত আশ্রয়হীন মুরগীগুলোর গা থেকে ফেঁসোর মত পালকের আঁশ বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, দেওয়ালের গায়ে পর্যন্ত গিয়ে এঁটে ব'সে গেছে, রোদের আলোয় চারদিকে উড়ছে৷
"বৃদ্ধ কালো মানুষটা ডাকতেই লিফট-এর ভেতর গিয়ে উঠলাম, আমার উচিত দেখা যাতে পদক্ষেপ ঠিক থাকে, কেবিনের মেঝের উঁচু জমিতে উঠতে গিয়ে পাটা একটু টলমল ক'রে উঠল, কালো লোকটা হাত দিয়ে লিফট-এর ঢেউ-গরাদ দরজাটা টেনে দিল এবার আমার সামনে, একটা লিভার ঠেলে আবার চালু ক'রে দিল লিফট৷" (মূল জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ)

১৯৬৫-তে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করলেন হান্ডকে : একদিন একটা, অন্যদিন আর একটা ক'রে পরে বিয়াল্লিশটা কবিতা নিয়ে একটা সঙ্কলন হল ১৯৬৯-এ যার নাম বহির্জাগতিক অন্তর্বিশ্বের অন্তর্বিশ্ব (Innenwelt der Aussenwelt der Innenwelt) একই বছরে বেরোল "জার্মান কবিতা" (Deutsche Gedichte) নাম দিয়ে কুড়িটা 'কবিতা অথবা না-কবিতা৷' ১৯৭২-এ বোরোল কবিতা ছাড়া জীবন (Leben Ohne Poesie) স্যুডডয়েচে ৎসাইটুঙ কাগজে৷ এই নাম দিয়েই পরে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়৷ ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত এর বেশী কিছু না, কিন্তু পেটার অবিরাম পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন, একটা আভাঁতগার্দীয় আধুনিকতা উঠে আসছিল তাঁর কবিতা থেকে, বড় কবিতা, ছোট কবিতা, অক্ষরের খেলা, সঙ্গে কখনও আসছে ছবি, ঐতিহ্যানুসারী কবিতা নয় তারা মোটেই, এলিজি, ওড – এসবের ধারে কাছেও নেই কিছু৷ দ্বিতীয় অন্তর্বিশ্বটার সঙ্গে বহির্জগতের কি সম্পর্ক? অথবা প্রথম অন্তর্বিশ্বের সঙ্গে বহির্জগতের? এই অন্তর্বিশ্ব তো বহির্জগৎ ছাড়া অমিল, আর সেই সঙ্গে অন্তরতম অন্তর্বিশ্বও, তাই এদের সীমারেখাগুলিও খুব শিথিল, অনির্দিষ্ট, শীর্ষকটি বস্তুত তাই দোলাচলে৷ কথাগুলির উত্তর তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা আমি থাকি গজদন্তমিনারে (Ich bin ein Bewohner des Elfenbeinturms, Suhrkamp Taschenbuch 56, S. 22)-বইটিতে দিয়েছেন৷ বালক বয়সে যে ছেলেটা বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হল, সেই তিনিটা আর কেউ নন, সেটা বহির্বিশ্ব; এই বহির্বিশ্ব আবার একটা বোর্ডিং স্কুলও বটে, আর সেইজন্যই তা কোনও বহির্বিশ্ব নয়! এই যে একটা দোলাচল দ্বিচারিতার সম্পর্ক, সেটাই কবিতাগুলির বিষয়ের ভিতরে গিয়ে গেড়ে বসেছে: ভাষার যে বহির্বিশ্ব সেটাই কি সামগ্রিক বাস্তবতা? ভাষাকে বাদ দিয়ে কি বাস্তবতা হয় না? বহির্বিশ্ব ছাড়াই কি একটা অন্তর্বিশ্ব হয়? হান্ডকে এই প্রশ্নগুলির উত্তর দার্শনিকতায় মুড়ে দেননি৷ সমস্যাটাই তাঁর কাছে গুরুত্বের, দর্শনটা নয়৷
বইটি আসলে সমস্ত রকম জাঁর-এর রচনার একটা মোজাইক, হান্ডকে-র যাবতীয় মোটিফের একটা চিত্রোপলশিল্প৷ সঙ্কলনের ৩৮ নম্বরের এই কবিতায় একটা জ্বলন্ত সর্বনাম "আমরা" শেষের দিকে বেরিয়ে এল মূল কথাটার আঙ্গিক হিসেবে:
দায়িত্বজ্ঞান চৌপট হয়ে গেলে আমরা তাকে
নাল লাগানো বুট ব'লে ডাকি
হতভম্ব হয়ে গেলে আমরা তার নাম দিই
হোটেলের ঘর…
হয়রান ক'রে দিই আমরা চৈতন্যকে…
শব্দের প্রান্তরেখা কবিতাটিতে সমাসবদ্ধ প্রান্তরেখা শব্দটি নিয়েই একটা ব্যাপ্তি রচনা করা হল; শেষে এক বিরল মুহূর্ত, সেটাই নেমে আসতে থাকে একটা ছবির রূপরেখা হয়ে:
শব্দের প্রান্তরেখা যেখানে থাকার কথা ছিল, সেখানে
চাকায় চাকায় পুড়তে শুরু করেছে শুকনো পাতারা, আর
শব্দরা অনন্ত মন্থরতায় কুঁকড়ে যাচ্ছে নিজেদের ভেতরে :
"এই তো শোকের প্রান্তরেখা!"
এই প্রান্তরেখা শোকের৷
এখানেই শব্দরা থেমে যায়, শুরু হয় শোক৷
১৯৭২-এ বোরোল তাঁর কন্যা আমিনা-কে উৎসর্গ করা কবিতার বই কবিতা ছাড়া জীবন৷ লম্বা কবিতা সব আকৃতিতে, অনেক খোলামেলা, প্রায় গদ্যের গা ঘেঁষে৷ প্রায় ব্যালাড-এর মত দীর্ঘ কবিতার আকৃতিতে, যেমন "নতুন অভিজ্ঞতাগুলি" ব্যক্তিগত সুর সরাসরি "আমি"-র হাত ধ'রে যেন আগের চেয়ে আরও দৃঢ় প্রত্যয়ে বেরিয়ে এল৷

নতুন কিন্তু নরম স্বর:

হেমন্ত এইবার আমাকে ছাড়াই চলে গেল
জীবন থমকে গেল সেকালের মত
যখন হতাশা নিয়ে টাইপিং শিখতে চেয়েছিলাম…

বিষণ্ণ এবং নরম একটা পরিবেশ ছড়িয়ে রয়েছে এখানে চারপাশে৷ আছে খুশি, বই, সংবাদপত্র, দূরদর্শন, প্রতিবেশী, ফ্রাংকফুর্ট স্টেশনটা, হেমন্তের রঙ – লোকে কথা বলছে এইসব নিয়েই, – আর এই কথাগুলি কথক একটা মুগ্ধতা নিয়ে বিচার করছেন, রয়েছে স্মৃতি এবং তাঁর চার বছর বয়সের শিশুকন্যার বর্তমান, তার প্রতি ভালবাসাটাই যেন এখানে পরম আকাঙ্ক্ষিত হয়ে রাজত্ব করছে, আর সব কিছুই এই বিষয়টাকে নিয়ে ঘূর্ণ্যমান -আমার জীবন কত থমকে দাঁড়িয়ে ছিল (Mein Leben stand so still)- প্রতিফলিতও হয়ে চলেছে কবিতার সারাটা জমিতে:

প্রতিদিনই দেখা যেত পর্ণমোচী গাছে গাছে
নকশার ছবি
এমন গভীরভাবে জ্বলে উঠেছিল যার ফলে ভয় হল পাছে না এ
ধরাধাম ধ্বংস হয়ে যায়

(কবিতার অংশগুলি সবই মূল জার্মান ভাষা থেকে অনূদিত)


ঠিক এই বছরেই তাঁর মায়ের আত্মহত্যা নিয়ে তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রকাশিত হল: "ইচ্ছাহীন বিষাদ" (Wunschloses Unglück/ A Sorrow Beyond Dreams)৷ তার মধ্যে খুব সরল, সহজ ও স্পষ্ট কন্ঠস্বরে বেরিয়ে এল তাঁর নিজেরই বেদনা, মনে হল যেন গদ্য নয়, বিশুদ্ধ লীরিক গড়িয়ে এসে স্থান নিয়েছে গদ্যের চৌরাস্তায়৷
১৯৭১-এর ১৯ ও ২০ নভেম্বর-এর মাঝরাত্তিরে পেটার-এর মা মারিয়া হান্ডকে আত্মহত্যা করলেন৷ দীর্ঘ হতাশা ও বিষণ্ণতার শিকার ছিলেন তিনি৷ ১৯৭২-এ এই মাকে নিয়েই তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয় ইচ্ছাবিহীন বিষাদ (Wunschloses Unglück, ১৯৭২), যা ১৯৭৪-এ চলচ্ছবিতে রূপায়িত হয়৷ পেটার-এর মা ছিলেন একজন সামান্য গ্রামের মেয়ে৷ লেখাপড়া শেখার ইচ্ছে থাকলেও তা তাঁর হয়নি৷ তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে একটি হোটেলে রন্ধনিকার কাজ নেন তিনি৷ সেখানেই এরিখ শ্যোয়নেমান-এর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়৷ এই ভদ্রলোক ছিলেন বিবাহিত, বয়স্ক, এঁর সঙ্গে সহবাসের ফলে তিনি সন্তাসম্ভবা হন এবং পেটার-এর জন্মের আগে তার একজন বৈধ পিতা প্রয়োজনীয় ব'লে তিনি ব্রুনো হান্ডকে-র শরণ নেন৷ ব্রুনো অতি সাদাসিধে লোক, যুদ্ধের কারণেই তার কোনও উচ্চাশা ছিল না, সে ছিল যুদ্ধের সামান্য কর্পোরাল৷ যুদ্ধের সময়টা পেটার-এর মা গ্রামেই ছিলেন, এর পর যুদ্ধ শেষ হলে চলে যান বার্লিনে তাঁর স্বামীর কাছে৷ অতিরিক্ত প্রসব মায়ের চক্ষুশূল হয়েছিল, যেজন্য মারিয়া শেষবার গর্ভপাত করান৷ এতে এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল, তার ফলেই তিনি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং পরে গ্রামে ফিরে গেলেও তাঁর শারীরিক উন্নতি কিছু হয়নি৷ পড়াশুনা ভালবাসতেন, ছেলের সঙ্গে বই পড়তে শেখেন এবং এইভাবে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করবার ক্ষমতা তাঁর হয়৷ কিন্তু ক্রমশ বিষণ্ণ হয়ে পড়েন, চিকিৎসা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর কোনও উন্নতি দেখা যায় না৷ বাঁচতে চাইতেন না, অথচ মরতে ভয় পেতেন৷ আত্মহত্যার আগে অনেককে চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন তিনি৷তাঁর আত্মহত্যার পর পেটার কিন্তু তাঁর মাকে এর জন্য প্রশংসাই করেছেন, অন্তত এইজন্য যে তিনি পুরোনো মূল্যবোধ ভাঙতে পেরেছেন এবং স্বাধীনভাবে তাঁর নিজের বেছে নেওয়া পথকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন৷ পেটার-এর এই রচনার অভিমুখ "বাস্তবোচিত", "রিয়েলিস্টিক অ্যাপ্রোচ", প্রথাগত উপস্থাপনার বিপরীতমুখী৷ নিজের লিখনশৈলীকেও তিনি এখানে বদলেছেন৷ বলাই বাহুল্য যে চিন্তা ভাবনার দিক থেকেও তখনকার সামাজিক সংস্কার অগ্রাহ্য ক'রে তিনি মায়ের এই তথাকথিত "অধঃপতন"-কে মানবিক মূল্যবোধের অংশীদার করেছেন৷

পুনরাবৃত্তি বা ভিডারহোলুঙ (Die Wiederholung, ১৯৮৬)উপন্যাসে রিংকেনবেয়ার্গ (করিন্থিয়া)-এর যুবক ফিলিপ কোবাল তার বাবার দেশ কম্যুনিস্ট যুগোস্লাভিয়াতে যায় আত্মপরিচয় উদঘাটনের জন্যে, সেখানে পঁচিশ বছর পর সে তার ভাষার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে নতুন ক'রে আর বুঝতে শেখে যে তার এই ঘরে ফেরার তাৎপর্যটা নতুন ক'রে তার নিজের জায়গায় নিজেকে পাওয়া হয়ে উঠছে৷ এ যেন তার "নবম দেশ৷" স্লোভেনীয় ভাষায় এই নবম দেশের অর্থ রূপকথার দেশ, দেশীয় মানুষের স্বদেশের ভাবনায় মোড়া একটা ব্যাকুলতার নাম৷ গোড়ার খানিকটা অংশ শোনা যাক৷

"শতাব্দীর চার ভাগের এক ভাগ কিংবা একটা দিন মাত্র যেন চলে গেছে ব'লে মনে হয়, সেই সময় আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের খোঁজে এসে হাজির হলাম ইয়েসেনিৎসে-তে৷ কুড়ি বছর বয়স হয়নি আমার তখনও, ইস্কুলের শেষ পরীক্ষাটা সবে মাত্র শেষ করেছি৷ মুক্তির স্বাদ তো এখনই নেবারই কথা, কারণ পড়াশুনা নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ব্যস্ত থাকবার পর এখন গরমের ছুটির গোটাটাই আমার সামনে৷ তবে একটা দ্বিধায় পড়েই বেরিয়েছি : রিংকেনবেয়ার্গ-এর বাড়িতে বুড়ো বাবা, অসুস্থ মা আর হতবুদ্ধি বোন৷ এছাড়া আমি গত বছর পবিত্র একটি বোর্ডিং স্কুল থেকে ছাড়া পেয়ে ক্লাগেনফুঅর্ট শহরের ইস্কুলে পা রেখেছিলাম, মেয়েরা এখানে সংখ্যায় এত বেশী, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেলাম সেখানে, আার এখন তো আামি একেবারেই একা৷ দল বেঁধে অন্যেরা যখন গ্রীস-এর বাসটায় উঠছিল, তখন আামি একা একা যুগোস্লাভিয়া-র বাসটায় গিয়ে উঠেছিলুম(আসল কথা হল সকলের সঙ্গে যাবার জন্যে যে রেস্ত দরকার সে আমার ছিল না)৷ আর একটা কারণ হচ্ছে অস্ট্রিয়ার বাইরে কোনওদিন যাইনি, যদিও দক্ষিণ করিন্থিয়া-র গ্রামের মানুষের পক্ষে স্লোভেনীয় ভাষা জানাটা কোনও ব্যাপার নয়, তবু ভাষাটায় আমার প্রায় দখল ছিল না বললেই চলে৷
"ইয়েসেনিৎসে-এর সীমান্তরক্ষী আমার নতুন তৈরি অস্ট্রীয় পাসপোর্ট দেখেই নিজের ভাষায় কথা বলল৷ আমি না বুঝতে পারায় জার্মান ভাষায় বলল, কোবাল তো একটা স্লাভ নাম, "কোবাল" কথাটার মানে হল পা ফাঁক করা, পা ফেলে এমনভাবে দাঁড়ানো, যাতে আমরা দেখি একটা লোক দুপায়ের মাঝখানে অনেকটা ব্যবধান রেখে দাঁড়িয়ে আছে৷ এইজন্য আমার এই পদবীটা সীমান্তরক্ষীর সঙ্গেই বেশী মানানসই৷ পাশে সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বয়স্ক আধিকারিক, সাদা চুল, ফ্রেমহীন গোল চশমায় একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব, একটু হেসে তিনি শব্দটাকে আর একটু এগিয়ে দিলেন, ব্যাখ্যা ক'রে বললেন যে ক্রিয়াপদ হিসাবে তার মানে হতে পারে কোনও কিছু বেয়ে ওঠা বা নামা কিংবা চড়া, আর আমার যে নামটা ফিলিপ, তার মানে তো অশ্বপ্রেমী, সুতরাং কোবাল পদবীটা ফিলিপ-এর সঙ্গেই ঠিক যায়; ভদ্রলোক নিশ্চিত হলেন যে আমি একদিন নিশ্চয় আমার নামের মর্যাদা রক্ষা করতে পারব (সেই থেকে আমি মাঝে মাঝেই লক্ষ করেছি, এই তথাকথিত প্রগতিশীল দেশের আধিকারিকেরা, মানে যাঁদের দেশটি আগে এক বড়সড় রাজতন্ত্রের শরিক ছিল, তাঁদের লেখাপড়ার বহর খুব হকচকিয়ে যাবার মত)৷ কিন্তু আচমকাই তিনি নির্বাক তৎপরতায় আমার সামনে এক পা এগিয়ে এসে গম্ভীর হয়ে চোখে চোখ রাখলেন: আমাকে জানতে হল যে এক হাজার বছরের এক চতুর্থাংশ আগে এদেশে এমন একজন লোকনেতা ছিলেন যাঁর নাম কোবাল৷ সন ১৭১৩-তে টলমিন-এর কাছে নদীর উৎসভাগে – নিচে ইতালীতে গিয়ে ওই নদীটাই ইসোনজো বা সোচা নামে পরিচিত হয়েছে – গ্রেগর কোবাল নামে এই লোকটি বর্তমান ছিলেন, ওখানে তিনি কৃষকদের বিশাল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়ে পরের বছর নিজের অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে মস্তকচ্যুত হন৷ তিনিই বলেছিলেন, এবং স্লোভেনীয় রিপাবলিক-এ সেটা হল তাঁর "প্রগলভ" ও "গর্বোদ্ধত" বিখ্যাত উক্তি, যে 'খোদ কাইজারও একজন "সেবক" মাত্র, মানুষের উচিত নিজের হাতে এই দেশের ভার নেওয়া৷' খবরটা অবশ্য আমার জানা ছিল, কিন্তু তা হলেও জ্ঞানটি গ্রহণ ক'রে নাবিক ব্যাগটিকে ঘাড়ে নিয়ে, নগদ টাকাকড়ি দেখাতে বাধ্য না হয়ে সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সীমান্ত স্টেশনটি ত্যাগ করলুম, পা বাড়ালুম উত্তর-যুগোস্লাভীয় শহরের দিকে, যেটা সেসময়কার ইস্কুলের মানচিত্রে ইয়েসেনিৎস-এর কাছে বন্ধনীতে পুরোনো অস্ট্রীয় 'আসলিং' ব'লে অভিহিত ছিল৷"
(মূল জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ)
"গান বাজানোর বাক্স নিয়ে একটা তৎপরতা" (Versuch über die Jukebox, ১৯৯০)একজন মানুষ, আসলে লেখক নিজেই, স্পানঞল-এর প্রাদেশিক শহর সোরিয়া-তে গেছেন৷ গেছেন আইবেরিয়া উপদ্বীপে, সেটা ডিসেম্বর মাস, "স্তব্ধ নীরব" শহর৷ নিজে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে লিখবেন, সেটা হল গান বাজানোর বাক্স বা জিউকবক্স (Jukebox)৷ যদিও তিনি বলছেন যে পূব ও পশ্চিমে যে রাজনৈতিক উথাল পাথাল চলছে, তা নিয়ে না লিখে থাকতে পারা যায় কই ? তবু সোরিয়া-তে জিউকবক্স নিয়ে তাঁর চেষ্টাটা বিফলেই যায়৷ তিনি যেটা খুঁজে পান তা হল একটা শহর, আর তার মধ্যেই ডুবে যান তিনি, আর অতি সম্ভাব্য হিসাবে খুঁজতে থাকেন সাহিত্যের একটা নতুন আকৃতি (Form)৷


ইচ্ছাহীন বিষাদ ১৯৮১-তে দূরদর্শনের ছবি হিসাবে রূপায়িত হয়৷ নাটক, চিত্র পরিচালনা, দূরদর্শনের জন্য কাজ করেছেন হান্ডকে৷ – অনুপস্থিতি (Abwesenheit, ১৯৯২), বাঁ-হাতি মহিলা (Die linkshändige Frau, ১৯৭৮) এই দুটি ছবি তাঁর নিজের পরিচালনায়৷ ভিম ভেন্ডার্স-এর ফিল্মের জন্য চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন৷ "পেনাল্টির আগে গোলরক্ষকের উদ্বেগ"(Die Angst des Tormanns beim Elfmeter), ও "বার্লিনের আকাশ" (Der Himmel über Berlin)ভিম ভেন্ডার্স (Wim Wenders) তৈরি করেছিলেন বটে, কিন্তু এগুলি তাঁর চিত্রনাট্যে তৈরি হয়েছিল৷ নিজস্ব উপকরণে নিজেই চারটি ছবি তৈরি করেন৷ দুটি দূরদর্শনের জন্য ছবি, দুটি "থিয়েট্রিক্যাল ফিচার্স৷" তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র হয় অবশ্য ২০১৬-তে৷ করিনা বেলৎস(Corinna Belz) যে ছবিটি করেন সেটা হল: পেটার হান্ডকে: অরণ্যে আছি৷ হয়তো দেরী হবে… (Peter Handke – Bin im Wald. Kann sein, dass ich mich verspäte…)৷ এখন অবশ্য তাঁকে নিয়ে আরও কতকগুলি ছবি হয়েছে৷ ইউ টিউব-এ তা দেখে নেওয়া যেতে পারে৷
তাঁর নাটক গোড়া থেকেই ষাটের দশকের প্রচলিত নাটকের আকৃতি ও বিষয়বস্তুকে খারিজ ক'রে দিয়েছিল৷ ব্রেষট-এর এপিক থিয়েটার ও তার তথ্যভিত্তিক এবং শিক্ষামূলক অভিমুখের একেবারেই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর নাটক৷ আাসলে হান্ডকে চেয়েছিলেন থিয়েটার সম্পর্কেই চিন্তাভাবনাকে উন্নত করতে৷ কুশীলব ও দর্শক, এইখানেই তাঁর আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়৷ ধরা যাক কুশীলব ঢুকছে মঞ্চ থেকে নয়, শ্রোতাদের মধ্যে থেকে৷ একাঙ্ক নাটক "জনগণের ভর্ৎসনা" (Publikumsbeschimpfung, ১৯৬৬), "কাস্পার" (Kasper, ১৯৬৭), শব্দহীন একাঙ্ক নাটক – "অপরিচয়ের প্রহরে" (Die Stunde, da wir nichts voneinander wußten, ১৯৯২), "অবিরাম ঝড়" (Immer noch Sturm, ২০১০)ইত্যাদি নাটকগুলি তাঁর বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে৷ বিট মিউজিক-এর ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ৷
তাঁর প্রাপ্ত পুরষ্কারের সংখ্যাও কিছু কম নয়৷ তার তালিকা এই:
১৯৭৩- গেয়র্গ ব্যুইখনার পুরষ্কার
১৯৮৭- ভিলেনিকা আন্তর্জাতিক পুরষ্কার
২০০০- কারিচ ভাইদের পুরষ্কার
২০০২- আমেরিকা পুরষ্কার
২০০২- সাম্মানিক ডি লিট, ক্লাগেনফুঅর্ট বিশ্ববিদ্যালয়
২০০৩- সাম্মানিক ডি লিট, সালৎসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়
২০০৮-টোমাস মান পুরষ্কার
২০০৯- ফ্রানৎস কাফকা পুরষ্কার
২০১২- ম্যূলহাইমার ড্রামাটিকার পুরষ্কার
২০১৪- আন্তর্জাতিক ইবসেন পুরষ্কার
২০১৮- নেস্ট্রয় থিয়েটার পুরষ্কার – সারাজীবনের কৃতিত্বের জন্য
২০১৯- নোবেল পুরষ্কার৷

স্মৃতি দিয়ে শুরু ক'রে পরে বইপত্তর ও ইনটারেনেট ব্যবহার ক'রেও যখন সুরাহা হল না, তখন ডাকাডাকি শুরু করলাম৷ জার্মানি থেকে লুডভিগ হাত বাড়াল, ভিয়েনা থেকে ই-মেল ধ'রে উজিয়ে এসে মানফ্রেড, নিকোলে আর উরসুলা ভালবেসে আমায় দু হাত ভ'রে তুলে দিল টাটকা টাটকা হাতে-গরম লিংক৷ এমন এমন সব লিংক পাঠাতে লাগল যা দেখে চক্ষু চড়ক গাছ, পেটার-এর কীর্তি ও কেলেঙ্কারির যুগপৎ নিশানসূর্য, কিছু আমার নেটে দৃশ্য নয়, পেটার হান্ডকে-র দেশেই দৃশ্য৷ কথা হল যে পেটার হয়তো থাকেন ফ্রান্স-এর শাভিল-এ, কিন্তু তিনি তো অস্ট্রীয়? তাই তাঁর দেশের কাগজে, দলিল দস্তাবেজের ভেতর থেকে একটা আলাদা গন্ধ, স্বাদ ফুটে বেরোতে লাগল৷ এই তো এমনই একটা লিংকে মাউস ঠুকতেই দেখলাম, অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট অলেকসান্ডার ভ্যান ডেয়ার বেলেন, যিনি আসলে কিনা গ্রীন পার্টির লোক, মানে যিনি মানবিকতার সপক্ষে, নারী অধিকারের সহায়, এমন কি শান্তি ও বহুসাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পতাকাবাহী, স্বাগত জানিয়েছেন অস্ট্রিয়ার সাহিত্যের এই নোবেলজয়ীকে, বলেছেন, "অস্ট্রিয়ার সাহিত্যের আজ খুশির দিন, খুশির দিন আজ সাহিত্যেরও৷" চ্যান্সেলার ব্রিগিটে বীয়ারলাইন বলছেন, "এ এক যথাযোগ্য অর্জন৷" আর উদ্বাস্তুদের আইনজীবি ও লেখক ইউলিয়া রাবিনোভিচ যিনি কিনা অস্ট্রিয়ার ইহুদী অথচ রাশিয়ায় জন্মেছেন, টুইট ক'রে বলেছেন যে ফুটবলপ্রেমীরা তাদের নিজেদের পক্ষের দল জিতলে যেমন উদ্বাহু হয়ে ওঠে, আজ আমারও সেইরকম অবস্থা হয়েছে৷
নোবেল পুরষ্কারের জন্য নির্বাচিত ক'রে জুরি পেটার হান্ডকে সম্পর্কে লিখেছেন, "…an influential work that with linguistic ingenuity has explored the periphery and the specificity of human experience."
কিন্তু পেটার হান্ডকে-র এই সবচেয়ে বড় জয় তাঁর সবচেয়ে বড় পরাজয়ও বটে৷ নোবেলজয়ের পরদিনই আমি পেন আমেরিকার অফিস থেকে একটা মেল পাই, সেখানে বলা হচ্ছে, "We are dumbfounded by the selection of a writer who has used his public voice to undercut historical truth and offer public succor to perpetrators of genocide, like former Serbian President Slobodan Milosevic and Bosnia Serb leader Radovan Karadzic." বসনিয়ার যুদ্ধে সার্বিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসোভিচের নেতৃত্বে সার্ব বাহিনী ১৯৯৫ সালের ১১ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত বসনিয়া-হার্জেগোভিনা-য় আট হাজারের বেশি মুসলমান পুরুষ ও ছেলেশিশু হত্যা করেছিল। নারীদের বন্দিশিবিরে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে পেটার হান্ডকে-র একটি নেতিবাচক সহযোগিতা ছিল৷ তিনি ছিলেন 'বলকান কসাই' নামে কুখ্যাত সার্ব নেতা স্লোভোদান মিলোসোভিচের ঘনিষ্ঠ লোক৷ তাঁর মৃত্যুর সময়ও তিনি তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় (১৮ মার্চ ২০০৬) যোগদান ক'রে শোকজ্ঞাপনের ভাষণ দিয়েছিলেন (যুগোস্লাভিয়া ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার পর ছয়টি ফেডারেল রিপাব্লিক আলাদা হয়ে ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়৷ এর মধ্যে ছিলো বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ম্যাসিডোনিয়া, মন্টেনেগ্রো ও স্লোভেনিয়া)৷ আমরা তো জানি এই গণহত্যাটা কি, ১৯৪৭-এ আমাদের দেশভাগের সময়, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গণহত্যা, ব্যাপক নারী ধর্ষণ একটা বিরাট জনগোষ্ঠীকে কি মর্মান্তিক ভাবে ধ্বংস ক'রে দিয়েছিল৷ তার রেশ এবং ক্লেশ কিন্তু এখনও যায়নি৷ আমি ডাখাউ-এর হত্যাশিবির দেখেছি, টেরেজিন ও আউশভিৎস-বিয়ার্কেনাউ দেখেছি, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে বলা যায় না যে ইতিহাসের পাঠ নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব, এমন কি বাচ্চা মেয়েদের ঢাল হয়ে থাকা কাটা-বিনুনি দেখে বলা যায় না, ওগুলো গল্পকথা৷ একটা কথা বলুন তো, আপনি স্রেব্রেনিকার ভয়াবহ হত্যালীলা থেকে বেঁচে ফিরেছেন, কিন্তু আপনার ভাই, আপনার স্বামী, আপনার ছেলে জেনারেল রাটকো ম্লাদিচ-এর কম্যান্ডো-র অধীনে বসনীয় সার্ব-দের দলের হাতে অন্য আট হাজার মুসলমানদের মত সুচিন্তিত উপায়ে কচু কাটা হয়েছে(জালিয়ানওয়ালাবাগ এর কাছে নস্যি)- আপনার প্রতিক্রিয়া কী হবে? কোনও উপদেশ কাজ করবে কি? আমাদের দেশে এই যে এখনও একটা মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রশাসন চলছে, এনার্সির জুজু দেখিয়ে দেশের অর্থভাণ্ডার লুঠ ক'রে বিভীষিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলেছে, আমাদেরও কিন্তু জানবেন, এখন শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের স্রোত নামছে প্রতিদিনকার জীবনে৷ আপনি আপনার জীবনের একটি সেকেন্ডও যা ভুলতে পারছেন না, তাই ভুলে যাবার জন্যে আপনাকে যখন হুঁশিয়ারি দেওয়া হবে, আপনার সামনের সমস্ত আলো যখন কেউ গিলে খেয়ে নিচ্ছে ব'লে মনে হবে, সেই সময় যদি একজন লেখক এসে শান্তির ললিত বাণী শোনাতে শোনাতে সিংহাসনে উঠে বসেন, তখন আপনার কি মনে হবে? বসবেন তো বটেই, কারণ পুরষ্কারটা তো রাজনীতির নয়, সাহিত্যের!
১৯৯৬-এ হান্ডকে "ড্যানিয়ুব, সাভা, মোরাভা ও দ্রিনা নদীর শীত সফর অথবা সার্বিয়ার প্রতি ন্যায়বিচার" (Eine winterliche Reise zu den Flüssen Donau, Save, Morawa und Drina oder Gerechtigkeit für Serbien) নামে একটি ভ্রমণবৃত্তান্ত লেখেন, যার ফলে একটা বিশেষ বিতর্ক শুরু হয়৷ এখানে সার্বিয়াকে তিনি যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধে অন্যতম অত্যাচারিত ব'লে বর্ণনা করেন এবং সেই সূত্রে পশ্চিমের মিডিয়াকে আক্রমণ করেন এই ব'লে যে তারা যুদ্ধের কারণ ও পরিণামকে ভুল ভাবে পরিবেশন করেছে৷ পরে ২০০০ সনের মাঝামাঝি হান্ডকে যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলোসেভিচ-কে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন, যিনি কিনা সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের ট্রাইবুনালে যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধাপরাধী ব'লে সাব্যস্ত হয়েছেন৷ ২০০৬-এ পশ্চিমের মিডিয়া এই ব্যক্তিটিকেও অপরাধী ব'লেই বিবেচনা করে এবং সেই সঙ্গে তারা মিলোসেভিচ-এর অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার সময়কার হান্ডকে-প্রদত্ত ভাষণ (এর খানিকটা সার্বিয়ান-এ লেখা)এই অভিযোগের সঙ্গে জুড়ে দেয়৷ হান্ডকে যখন আন্তর্জাতিক ইবসেন পুরষ্কার পান, তখন জুরি-কে পদত্যাগ করবার ডাক দেওয়া হয়েছিল এবং নরওয়েজীয় মিডিয়া যুদ্ধাপরাধী হিসাবে পেটার হান্ডকে-কে ফাসিস্ট ব'লে অভিহিত করেছিল৷ নোবেল পুরষ্কারের সংবাদে কসোভো, বসনিয়া ও হেয়ার্জগোভিনা, আলবানিয়া ও ক্রোয়াশিয়ার মানুষ কেউ খুশি হতে পারেনি৷ কোনও কোনও রাজনীতিক, পণ্ডিত, অভিনেতা, সাংবাদিক, মিডিয়া ও অন্যান্য অ্যাকটিভিস্ট এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন৷


রূপান্তর তো একটা চলছেই, সর্বক্ষণের৷ হাসির পর কান্না, সুখের পর দুঃখ, চক্রবৎ পরিবর্তন চলছে একটা, যাকে গাল ভারি ক'রে চওড়া অভিব্যক্তিতে আমরা ইংরেজীতে বলছি "মেটামোরফোসিস৷" কবি শিল্পীদের মধ্যে সেটা পরিদৃশ্যমান হচ্ছে হয়তো অনেক বেশী৷ আমরা যারা একজন শিল্পীর পরিবর্ত্যমান জীবনের জলছবি ফুটিয়ে তুলছি, তারা দেখছি এই পরিবর্তনটা ঘড়ির দোলকের মত শিল্প ও বিশ্ব, এই দুটির মাঝখানে কেমন চলাচল করছে৷ মানুষটার সাহিত্যের যে মুখোশ, তার তুলনায় সে যাদের সঙ্গে কথা বলে, অর্থাৎ আমরা, বা তাঁর পাঠক বা তাঁকে নিয়ে যাঁরা লেখেন সেই রচনাকার – তাদের মুখও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ হ্যাঁ এটা ঠিক যে জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কিছু বলতে গেলে তথ্যাদির প্রয়োজন আছে৷ যেমন ধরা যাক যে এত দূর দেশে ব'সে আমি বিভিন্ন উৎস থেকে পেটার হান্ডকে-র জীবনের ঘটনাগুলি যে হাতড়ে হাতড়ে সংগ্রহ করছি (যদিও সামান্যই তুলে আনতে পেরেছি সেসব এবং তার সামান্যই পরিবেশন করতে পেরেছি; তাঁর অনেক কাজের উল্লেখও করতে পারিনি যথারীতি) – তবু সেগুলি কিন্তু মামুলি কাজ, কারিগরের কাজ৷ কিন্তু জীবনপঞ্জী কারও জীবন ও সাহিত্যের কোনও দিগন্ত তুলে ধরে না, যেমন রক্তমাংস ছাড়া নরকঙ্কালটাকে মানুষ বলা যায় না৷ পেটার তাঁর "নেই-উপসাগরের তীরে আমার বছর" (Mein Jahr in Niemandsbucht, ১৯৯৪)উপন্যাসে বলছেন, "আমি যখন ভাবি যে আমার এই জীবনে এ পর্যন্ত কি অভিজ্ঞতা আমি অর্জন করেছি, তখন দেখি যে সে অভিজ্ঞতা আমার শৈশবে চলাকালীন যুদ্ধ নয়, রাশিয়া থেকে অস্ট্রিয়ায় পালিয়ে আসবার ঘটনা নয়, বোর্ডিং স্কুলে আটক থাকা সেই ছেলেটা নয়, এমন কি অনেক জ্বরজারির শেষে জ্বর ছাড়বার সেই নিস্তেজ শান্ত মুহূর্তও নয়, যখন আমার উপলব্ধি হচ্ছে যে আমি পথ চলা এক পথিক, আমার সঙ্গে রয়েছে হয়তো একজন স্ত্রী বা আমার সন্তান; অভিজ্ঞতা থেকে আমার অর্জন হয়েছে কিন্তু এক এবং অদ্বিতীয় সেই জিনিসটাই, রূপান্তর৷" পেটার সেই বিরল সংখ্যক লেখকদের একজন, যিনি তাঁর জীবনকে আমূল তাঁর বৃত্তির সঙ্গে মানানসই ক'রে তৈরি করেছেন৷ একজন লেখক তো শুধু তাঁর কর্মকাণ্ডটিরই রূপসাধন করেন না, তাঁর অজান্তে তাঁর নিজের জীবনটাও ওই কর্মকৃতির আকৃতি নিয়েই গড়ে ওঠে৷ "আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন পরে বাঁধা সবার কাছে৷" যেমন দেশের আইনকানুন তো সামাজিক গতি প্রকৃতিকে বর্ণনা করে না, কিন্তু ওই আইনের বলেই সমাজের নিয়তি প্রভাবিত হয়৷ হান্ডকে তাঁর নৈরাজ্যে ঘেরা অনিশ্চয় অস্তিত্বকে লেখক হিসাবে উপস্থিত হবার অনেক আগে থেকেই একটা নিয়মের দড়িদড়ায় বেঁধে ফেলেছেন, এর মধ্যে তাঁর কোনও ভুল কিছু হল কিনা সেটা তিনি নিজে বুঝতে পারতেন যদি তিনি একটা তৃতীয় ব্যক্তির হাত দিয়ে বড় কিছু একটা পেতেন বা নিতেন, একটা উপদেশ কিংবা একটা দৃষ্টিকোণ…
শিল্প আর বিশ্ব এই দুইয়ের মধ্যে চলাচল করছে লেখকের মন৷ একটা নিস্তরঙ্গ জীবন সে তো তাঁর নয়, তাঁর আছে হাজার গুণিতক সময়ের কাজ, চিন্তা, ভাবনা, ব্যাকুলতা, বেদনা, এমন কি পাগলামি, তৃষ্ণা, আর তার পরিমাণ এতই বিপুল যে সহস্রহস্তে তাঁকে তা সামলে চলতে হয়৷ আর এইভাবেই ঋতুর পর ঋতু চলেছে, নানান ছন্দে তালে ভাল মন্দের উথাল পাথাল চলছে, কিন্তু কোনও জায়গায় তার কোনও অস্বীকার নেই, দেবার এবং নেবার অভিব্যক্তি এখানে কপটতাহীন৷ তাঁর জীবন নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে লিখতে গেলে সেই কথাটাই বিবেচনা করতে হয়, জীবনের উচ্চাবচতা, সে তো আছেই, আর সেটা থাকাই স্বাভাবিক, কীর্তি নয়, কেলেঙ্কারী নয়, কিন্তু আরও একটা বিপন্ন যে বিস্ময় তাঁর অন্তর্গত রক্তের মধ্যে খেলা ক'রে চলেছে তাকে খুঁজে বার ক'রে আনাই আমাদের আরাধ্য হয়ে ওঠে৷ একটা মানুষের গোটা ইতিহাসের মধ্যে আর একটা ইতিহাস খেলা করে, যার কোনও পোশাক নেই, প্রচলিত প্রথা নেই, কোনও পার্থক্য বা স্তরভেদ নেই – আছে শুধু পথ চলা, হাসি কান্না হীরা পান্না সবই তার অলঙ্কার৷

Courtesy: Dr. med. Ludwig Zwack, Herr Nicole Kiefer u.a.