তথ্য চুরির ফাঁদে- আনন্দদায়ক, অস্বস্তিকর, বিপদজনক!

সুপ্তবিবেক
Published : 28 Sept 2012, 06:32 AM
Updated : 28 Sept 2012, 06:32 AM

ব্যস্ততার কারণে বেশ অনেকদিন ধরে লিখতে পারছি না ব্লগে। কিন্তু সবসময়ই ইচ্ছা থাকে ব্লগে কিছু লিখি।

এর মাঝে ইন্টারনেট বিষয়ক বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। বিষয়গুলো কারো কারো কাছে আনন্দদায়ক হলেও আমার জন্য অস্বস্তিকর এবং বিপদজনক।

কিছুদিন আগেই আমার একজন অপরিচিত হিতাকাংখি, আমার একটি ইমেইল এড্রেসের পাসওয়ার্ড বদলে নিজের করে নিয়েছেন। যেহেতু ইমেইল এড্রেসটি খুব বেশী ব্যবহার করা হত না, তাই বিষয়টি সেখানেই ভুলে গিয়েছিলাম।

বেশ কয়েক মাস ধরে অপরিচিত কিছু ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে আপত্তিকর ইমেইল পাচ্ছিলাম। অস্বস্তির সৃষ্টি হলেও, খুব একটা আমলে নেইনি বিষয়টি।

কিন্তু কিছুদিন পূর্বে একটি ইমেইল পেলাম সাথে একটি ছবি। ছবিটি আমার খুব আপনজনের। ছবিটি আপত্তিকর। সাথে ছোট্ট একটি মেসেজ, "টাকা দিলে সব ছবি পাবেন, না দিলে সব ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।"

সচরাচর এই ধরনের ছবি দেখে সম্পর্কের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। আমার মাঝেও যে একদমই অস্বস্তির সৃষ্টি হয় নি, তা বলব না। আমি খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করলাম ছবিটি, খুবই নিঁখুত! আমি দেরি না করে আমার আত্মীয়কে মেইলটি ফরওয়ার্ড করলাম।

বেশ কিছুদিন পর আবার একটি আপত্তিকর মেসেজ পেলাম। এবার আমি কৌতুহল বোধ করলাম। আমি আমার কিছু কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলাম এবং দ্বিতীয় মেইলটি পাঠিয়ে দিলাম।

এর কিছুদিন পর আরো কয়েকটি মেসেজ পেলাম পর পর, কিন্তু লক্ষ্য করলাম এই মেইলগুলো পাঠানো হয়েছে ফেসবুক ব্যবহার করে। সেই নাম অনুসরণ করে ফেসবুকে আমার অপরিচিত হিতাকাংখির চেহারাটি দেখার আগ্রহ হল। আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকা পরীক্ষা করে দেখলাম, এই নামটি নেই সেখানে। তাই সেই নাম ধরে সন্ধান করলাম, পেয়েও গেলাম, বন্ধু না হয়েও যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে অবাক হবার পালা, সেই আত্মীয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে ফেসবুক এলবামে। দায়িত্ব বোধ থেকে ফেসবুক এর একটি স্ক্রিনশট নিয়ে পাঠিয়ে দিলাম সেই আত্মীয়ের ঠিকানায়।

বিষয়টি জানালাম স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে। ওদের তিনজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ আমার বাসায় এসে প্রয়োজনীয় সফটওয়ার ইনষ্টল করে দিল এবং তিনটি টেষ্ট মেইল পাঠালো। মেইলগুলো ট্রেকিং এ রাখল এবং বলল যখনই মেইলগুলো ওপেন করা হবে ব্যবহারকারির কম্পিউটার থেকে কিছু তথ্য চলে আসবে আমার ইমেইল এড্রেস এ।

আমি তাদেরকে নিয়ে আমার বাসার কাছেই এক কফি শপে ঢুকলাম। কফি খেয়ে গল্প করে কিছুক্ষণ পর বাসায় এসে দেখলাম প্রথম মেইল খোলার তথ্য চলে এসেছে আমার ইমেইল এ। প্রযুক্তিবিদগণ তা খতিয়ে দেখা শুরু করল।

জানতে পারলাম মেইলটি বাংলাদেশ থেকে ওপেন করা হয়েছে। এরপর ওরা নিজেরাই আশ্চর্য হয়ে বলল ব্যবহারকারি বাংলাদেশে বসে ফ্রান্সে আমার বাসার কম্পিউটার (আইপি অ্যাড্রেস) ব্যবহার করে ফেসবুক ওপেন করে মেইলটি পড়েছে। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। ওরা আরও জানাল, ব্যবহারকারি এর আগেও বেশ কয়েকবার আমার কম্পিউটার (আইপি অ্যাড্রেস) ব্যবহার করে ফেসবুক একাউন্টটি থেকে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করেছে। আমি জ্ঞান হারানোর অবস্থা। এও কী সম্ভব! তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, আমার মত সাধারণ একজনকে কেন টার্গেট করা হল। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, আমার বাসার কম্পিউটারটি ২৪ ঘণ্টাই ইন্টারনেটে যুক্ত থাকে, অলসতা বশতঃ প্রায়ই বন্ধ করা হয়ে ওঠে না।

বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে উন্নতমানের তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তৈরি হচ্ছে এতে বাঙ্গালী হিসেবে আমি গর্বিত।

কিন্তু মেধার সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কি?

উন্নতমানের তথ্যপ্রযুক্তিবিদ না হলে বাংলাদেশে বসে এখানকার নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙ্গে ফ্রান্সে আমার বাসার কম্পিউটার (আইপি অ্যাড্রেস) ব্যবহার করে আমার কাছেই অর্থ চাওয়ার মত কঠিন একটি কাজ এত সহজে কেউ করতে পারত না। কাজটি এত সূক্ষভাবে করা হয়েছে, যেন আসল ব্যবহারকারি কোনোভাবেই ধরা না পড়ে, বরঞ্চ দিন শেষে মনে হবে আমিই আমার কাছে টাকা চেয়েছি!

এই সেপ্টেম্বর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি ওয়েবসাইট বিকল করে দিয়েছিল বাংলাদেশের বাংলাদেশ গ্রে হ্যাট হ্যাকারস (বিজিএইচএইচ) নামের হ্যাকাররা।

এই বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ-ভারত সাইবার-যুদ্ধ হয়ে গেল। প্রায় ২৬ হাজার ওয়েবসাইটে আক্রমণ চালিয়েছিল বাংলাদেশী হ্যাকাররা। এই সাইবার আক্রমণের পিছনে বাংলাদেশের তিনটি হ্যাকার-দল, যারা নিজেদেরকে বিডি ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার্স, বাংলাদেশ সাইবার আর্মি এবং এক্সপায়ার সাইবার আর্মি নামে পরিচয় দেয়, নিজেদের কৃতীত্ব স্বীকার করে। এই দল-তিনটি তাদের সাথে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হ্যাকার-দল অ্যানোনিমাস-এর সম্পৃক্ততার কথাও উল্লেখ করে।

হ্যাকিং বিষয়টি হয়ত হ্যাকারদের কাছে একটি আনন্দের বিষয়। হয়ত অনেকটা নেশার মত।

কিন্তু বিষয়টি আমার কাছে অস্বস্তিকর কারণ, যে আত্মীয়ের আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে টাকা চাওয়া হচ্ছে, সে আমার জীবনসঙ্গী এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে অধ্যয়নরত।

বিষয়টি বিপদজনক সামজিক প্রেক্ষাপট থেকে, আপনজনেরা যখন জানতে পারবে, এই ধরণের কাজ তাদেরই কারো কম্পিউটার (আইপি অ্যাড্রেস) ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়েছে, তখন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

আজ হয়ত ছোট পরিসরে আমি ব্যক্তিগত ভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, কাল আপনিও হতে পারেন, এরপর সমাজের অন্যান্যরা। আসুন হ্যাকিংকে অনুৎসাহিত করি।