কত হাজার মরলে পরে মানবে তুমি শেষে

রাসেল পারভেজ
Published : 11 April 2011, 05:37 PM
Updated : 11 April 2011, 05:37 PM

র‌্যাবের সপ্তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাজধানীর বেশ কয়েকটি রাস্তার মোড়ে র‌্যাবের বিশালাকৃতির বিজ্ঞাপন ঝুলছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে র‌্যাবের ভুমিকা যতই প্রশ্নবিদ্ধ হোক না কেনো আইনের প্রতি ন্যুনতম শ্রদ্ধা বিহীন এই বাহিনীর জন্য বিশেষ বরাদ্দের পরিমাণ কমে নি, তাদের উন্নততর প্রশিক্ষণ, তাদের উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র, তাদের জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থা টেলিফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা, এতসব সুযোগ সুবিধা পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি গত সাত বছরে প্রায় হাজার খানেক বিচারবহির্ভুত হত্যার বাইরে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে কি ভুমিকা পালন করেছে আমার জানা নেই।

'ক্রস ফায়ার' পর্ব শেষ হওয়ার আগেই র‌্যাব প্রাথমিক ভাবে বিতর্কিত হয়েছিলো অর্থনৈতিক লেনদেনের অসততায়, শুধুমাত্র রাজধানী নয় বরং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও র‌্যাবের চাঁদাবাজি উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছিলো , ব্যবসায়ীর কাছে জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় জাতীয় বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত র‌্যাব অর্থনৈতিক এবং পারিবারিক কোন বিষয়ে জড়িত হবে না, এমন নির্দেশনা দেওয়া আছে র‌্যাবের অফিসের সামনে।

র‌্যাব পয়সার জন্য হত্যা করছে, পয়সা দাবী করছে এসব অভিযোগ অনেক দিন ধরে উত্থাপিত হলেও র‌্যাবের কয়েক জন সদস্যকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার বাইরে র‌্যাব দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এমনটা গণমাধ্যমে আসেনি। বরং র‌্যাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্য একটি র‌্যাব সদস্যকে হত্যার অভিযোগ করেছেন নিহত র‌্যাবের সদস্যের স্ত্রী, তার অভিযোগের তদন্ত হয়েছে কি না, তিনি তার নিখোঁজ এবং সম্ভবত খুন হওয়া স্বামীর শেষ সংবাদ পেয়েছেন কি না, তা আমরা জানতে পারি নি, আমাদের গণমাধ্যমে এত বেশী অঘটন এবং অপরাধের সংবাদ প্রকাশিত হয় যে সকল অপরাধের ফলো আপ রাখা এবং নিয়মিত তা প্রকাশ করতে পারে না সংবাদপত্রগুলো।

যশোরের সীমান্তে র‌্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর সদস্য এবং স্থানীয় এমপি ও তার পূত্রের বিরুদ্ধে মাদকব্যবসা থেকে বখরা নেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছিলেন একজন মাদক ব্যবসায়ী, অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার দুই দিন পরে র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে খুন হন সেই মাদক ব্যবসায়ী এবং তার ভাই। স্থানীয় এমপি এবং তার পূত্রের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়েছে পরবর্তীতে, এমপি পুত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি বিরোধী দলীয় একজনকে প্রকাশ্যে খুন করেছেন, পুলিশ এমপি পুত্রকে আটক করলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়।

সাভারের একটি গ্রামে চাঁদাবাজি কিংবা জোরজুলুম করতে যাওয়ার পর র‌্যাবের গাড়ী আটকে রেখেছিলো বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী, সাতক্ষীরায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাসায় র‌্যাব অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গিয়েছিলো, গভীর রাতে বাইরের গ্রীল দিয়ে অস্ত্র ছুড়ে দিয়েছিলো র‌্যাবের সদস্যরা, সে অস্ত্র উদ্ধার করে তাকে অভিযুক্ত করবার প্রক্রিয়াটি বাধাগ্রস্ত হয় স্থানীয় জনতার বাধায়। পরবর্তীতে সেই টহল দলকে উদ্ধার করে আনা হলেও এই অভিযুক্তের কি শাস্তি হয়েছে তা আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পারিনি।

স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে এ বছর, অন্য সময় বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অঘটন ঘটালেও র‌্যাবের বিরুদ্ধে ক্রস ফায়ারের অভিযোগ ব্যতীত অন্য কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয় নি। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পরবর্তী প্রেস ব্রিফিং এবং প্রেস রিলিজ নিয়ে দেশজুড়ে ঠাট্টা তামাশা হলেও রসবোধ বিহীন নিরেট নির্বোধ র‌্যাবের প্রেস রিলিজের ভাষ্য বদল হয়নি। এ বছরের প্রথম থেকেই র‌্যাবের নতুন কর্মসূচি হচ্ছে যেকোনো মানুষকে আটক করে তার পরিবারের কাছে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দাবী করা এবং নির্ধারিত অর্থ না পেলে অভিযুক্তকে আহত করা কিংবা হত্যা করা।

সাভারের জুতা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শ্যামল, কলেজ ছাত্র অনীক, এবং বর্তমানের আলোচিত লিমন, প্রত্যেকের ঘটনাই একই রকম। প্রত্যেককে আটক করা হয়েছিলো এবং পরবর্তীতে তাদের হাঁটুতে গুলি করা হয়েছে। র‌্যাব কর্মকর্তা এবং এদের পরিচালকদের ধারণা তাদের কোন তথ্যই আমাদের মনে থাকবে না, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে তারা দেশের সবাইকে যেভাবে খুশী আহত নিহত করবে এবং সবাই প্রাতিষ্ঠানিক পোশাকী এই খুনীর দলের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ লিপি পাঠাবে না। তথ্য প্রযুক্তির যুগে সকলের সকল হত্যার সংবাদ এখন রয়ে যায় নেটের পাতায়।

লিমনকে গুলিবিদ্ধ করবার পর ফেসবুকে এক বন্ধু আমার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জানালো বিএনপি র‌্যাবের জন্ম দিয়েছে, সুতরাং র‌্যাবের সকল অপকর্মের দায় বিএনপির। কথাটা মিথ্যা না, বিএনপির সময়ে সন্ত্রাস দমনের চুড়ান্ত ব্যবস্থা হিসেবে র‌্যাব গঠিত হয়েছিলো, কিন্তু তারপর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক হত্যা, নির্বিচার হত্যা এবং অপরাধে লিপ্ত হয়েছিলো। মাঝে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় র‌্যাবের বিচারবহির্ভুত হত্যা আলোচিত ও বিতর্কিত হলেও আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার র‌্যাবের কার্যক্রম স্থগিত করবার সাহস দেখাতে পারেননি।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ওয়াদা করেছিলো তারা বিচারবহির্ভুত হত্যা সমর্থন করবে না, র‌্যাবের লাগাম টেনে ধরতে পারবে তারা। তবে তাদের ক্ষমতাসীন হওয়ার কয়েক মাসের ভেতরেই খোদ সংসদ ভবনের সামনেই একজনকে গুলি করে হত্যা করে র‌্যাবের। র‌্যাবের সদস্যদের অনুমান ছিলো নিহত বালক ব্যাগ থেকে বন্দুক বের করতে যাচ্ছে, আত্মরক্ষার্থেই র‌্যাব গুলি ছুড়েছে সবসময়, নিহত ব্যক্তির পায়ে ডান্ডা বেড়ী থাকলেও, তার হাতে হাতকড়া থাকলেও সে ব্যক্তি র‌্যাবের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে যায়, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র একজন মানুষ ব্যাগের চেন খুলে যদি গ্রেনেড বের করে ছুড়ে মারে এমন আশংকায় তারা কলেজ ছাত্রকে খুন করে ফেলে।

আওয়ামী লীগ বিএনপির অতীত সব ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, জিয়া বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা খরচ করে, ভাসানী নভো থিয়েটারের নাম বদলে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার করেছে, যদি মুন্সীগঞ্জের মানুষ প্রতিবাদ করে বুকের রক্ত না ঢেলে দিতো রাজপথে তাহলে বঙ্গবন্ধুর নামে এয়ারপোর্ট নির্মানের জন্য প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা অপচয় করে ফেলতো তারা , এতসব ভুল সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও খালেদা জিয়া এবং বিএনপির এই ভুল সংশোধনের কোনো আগ্রহ নেই ক্ষমতাসীন দলের।

র‌্যাবের নিয়ন্ত্রন থাকলে নিজেদের নিরাপত্তাবোধ বৃদ্ধি পায় সম্ভবত। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী রাস্তায় নামলে তার গাড়ী বহরের আগে মাইক হাতে ছুটতে থাকে র‌্যাবের ভ্যান। সানগ্লাস আর কালো ফেট্টি বাধা আমাদের কমান্ডো বাহিনীর সাথে সাথে পুলিশও ক্রসফায়ার শিখেছে।

প্রথম থেকেই র‌্যাবের ক্রসফায়ার সমর্থন করছেন সমাজের কিছু বুদ্ধিজীবী, প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই, আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ততার বিষয়ে তারা সংশয় বিহীন, তারা নিশ্চিত জানেন এভাবে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা যাবে না, সুতরাং খুন করে যতটা সম্ভব অপরাধী নির্মূল হয় ততই লাভ। এভাবে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে র‌্যাবের জবাবদিহিতার অপ্রয়োজনীয়তা আমরা নিশ্চিত করেছি।

এখন আশে পাশে যা ঘটছে সেটা আমাদের অতীত ভুলের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আমরা এভাবেই অপরাধী তৈরি করছি। হাইকোর্টে র‌্যাবের হত্যাকান্ডের বিষয়ে বিশেষ রিট আবেদন করা হয়েছে, সেটার কোনো জবাব এখনও আসে নি। নির্যাতন সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা হাইকোর্ট প্রদান করলেও সেটা কিভাবে বাস্তবায়িত হবে এটা নিয়েও কোনো দিক নির্দেশনা দিতে পারেনি রাষ্ট্র।

সামনে আরও হত্যা ঘটবে, লিমন, অনীক শ্যামলের মতো আরও অনেকে প্রান দেওয়ার পর হয়তো সরকারের টনক নড়বে, কিংবা সরকার এটা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে যে তাদের প্রশ্রয়ে এবং সহযোগিতায় একদল অস্ত্রধারী মানুষ নির্বিচার হত্যার অধিকার পেয়েছে এবং এটা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটাবে।

র‌্যাব বিচারবিভাগীয় তদন্তের ঘোষনা দিয়েছে, আজ র‌্যাবের একজন পরিচালক অবশ্য জানিয়েছেন লিমন ঘটনার শিকার হতে পারে।

আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন পড়বার প্রয়োজন নেই, আমরা জেনে গেছি এই তদন্ত প্রতিবেদনে কি বের হোয়ে আসবে এবং কি কি পরামর্শ ও সুপারিশ থাকবে সেখানে। এমন কপি পেস্ট চোথা বাজ বাহিনীর জয় হোক। র‌্যাব দীর্ঘজীবী হোক আমরা বরং প্রতিটি হত্যার জন্য তাদের পুরস্কৃত করি।