মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ এবং জামায়াতের পদক্ষেপ

রাসেল পারভেজ
Published : 20 May 2011, 08:58 AM
Updated : 20 May 2011, 08:58 AM

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আন্তর্জাতিক অপরাধ(ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে, প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করতে সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে।

সে সুপারিশগুলোর ভেতরে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ(ট্রাইব্যুনাল) আইনে

যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার আরও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে

অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনাল আইন ও এর সদস্যদের নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ

অভিযুক্তদের সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষণ

বিচারক ও সরকারপক্ষের আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের পাঁচ জন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে এই বিশেষ আদালতে অভিযোগ গঠনের প্রক্রিয়া চলছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী " আল বদর" বাহিনী গঠনের কথা স্বীকার করেছেন, তিনি স্বীকার করেছেন আল বদর বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে যুক্ত ছিলো।

একাত্তরে দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা মহানগর শাখার প্রধান আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ অবশ্য তদন্ত কমিটির কাছে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেননি।
দেলোয়ার হোসেন সাঈদী মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নিজের নাম পরিবর্তন করলেও তিনি সরাসরি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্বীকার করেননি।

অভিযুক্তদের স্বজন ও উকিলদের উপস্থিতিতেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং সে সময়ে তাদের উপরে শারিরীক নির্যাতন করা হয়নি। অন্তত স্বীকারোক্তি গ্রহনের প্রক্রিয়ায় মতিউর রহমান নিজামীর উপরে কোনো শারিরীক নির্যাতন করা হয়নি, তিনি তার সামনে উপস্থাপিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই তার আল বদর বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন, তার সামনে উপস্থাপিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই তিনি স্বীকার করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে আল বদর বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিলো।

গত বছর ২৩শে জুন যুক্তরাজ্যের হাউস অফ লর্ডসে অল-পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ এর সহায়তায় 'বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ : আন্তর্জাতিক মান বিচার' শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে অল পার্টি পার্লামেন্টারি হিউম্যান রাইটস গ্রুপ স্বীকার করে তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে এমন একটি গ্রুপের সহায়তায় তারা বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে হাউজ অব লর্ডসে সেমিনারটি আয়োজন করেছে ।

জামায়াতে ইসলামী দাবি করছে গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের কেউই মানবাধিকারবিরোধী কোনো তৎপরতায় জড়িত নন। আওয়ামী লীগ একান্তই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করার কৌশল হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

এই তিনি জন আইনজীবী হলেন এল আর স্টিভেন কে, টবি ক্যাডম্যান এবং জন কমেহ । টবি ক্যাডম্যান অবশ্য হাউস অফ লর্ডসে অনুষ্ঠিত সেমিনারেও তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।

গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ে বিশেষ একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেও কয়েকজন আইনজীবী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবেই জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করছে এমন অভিযোগ উত্থাপন করেন।

জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে নির্দিষ্ট যে অবস্থান নিয়েছে তার ভিত্তিতেই তাদের বর্তমানের ভারপ্রাপ্ত আমির এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের বিভিন্ন বক্তারা রাজনৈতিক কর্মী সমাবেশে কিংবা গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করছেন, এরই ধারাবাহিকতায় পল্টনের একটি রেস্তোঁরায় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেছেন

'৪০ বছর আগের হাড়গোড় জোগাড় করে টেবিলে আনা হয়। এই হাড্ডি কোনটা কার বাপের, তা কে ঠিক করবে? এগুলো যে নিজামী-মুজাহিদ করেছেন, তা কি হাড্ডির গায়ে লেখা আছে?'

তারা অন্তত এটুকু প্রমাণ করতে চাইছেন তারা একক ভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের অনেক নির্বাচিত এমএনএ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং তাদের অনেককেই দালাল আইনে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো, তারা এভাবে বিষয়টিকে উপস্থাপন করার ফলে আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক ভাবেই জামায়াতে ইসলামীকে হয়রানি করতে চাইছে এমনটা প্রতিভাত হচ্ছে।

যুদ্ধকালীন সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সদস্য ইয়াহিয়া খানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন, রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা বন্ধ করা এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিও জানিয়েছিলেন, তাদের এ তৎপরতার বিবরণ পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিভিন্ন টেলিগ্রামে।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন টেলিগ্রামে আওয়ামী লীগের এম এন এ'দের পরামর্শ, গণহত্যা বিষয়ে তাদের উদ্বেগ এবং গণহত্যা বন্ধে কি ধরণের রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া বাঞ্ছনীয় সে বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শও তারা দিয়েছেন ইয়াহিয়া খানকে। তাদের সকল পরামর্শের প্রধানতম বক্তব্য ছিলো "শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তাকে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে তার সাথে আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করতে হবে, তিনি যদি শিথিল ফেডারেশনের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তাহলে ছয় দফার ভিত্তিতে তেমন শিথিল ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতা বন্ধ করতে হবে।

কোলকাতা থেকে যে কয়জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলারের আলোচনা হয় তারাও গণহত্যা বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহন দাবী করেছিলেন এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছিলেন। বিদেশী পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত আচরণ করবে এমনটাই তাদের প্রত্যাশা ছিলো, বিদেশী পর্যবেক্ষক দল ১৯৭১ এ বাংলাদেশের ১২টি জেলায় ভ্রমন করে তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিলেন এখানে গুরুতর ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের এমন তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ১৯৭১ এ পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পর্যায়ে আওয়ামী লীগের এম এন এ এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় নির্বাচিত সকল সদস্যদের শেখ মুজিবের মুক্তি এবং গণহত্যা বন্ধের দাবিতে ঐক্যমত ছিলো এমনটা নিঃসংশয়ে বলা যাবে না তবে অধিকাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিই ছয় দফার ভিত্তিতে শিথিল ফেডারেশন গঠনের প্রশ্নে একমত ছিলেন। তাদের সকলের ভেতরেই গণহত্যা নিরসনে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহনের দাবিটা উচ্চকিত ছিলো।

তবে এটুকু নিঃসংশয়ে বলা যায় পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী ছয় দফার ভিত্তিতে শিথিল ফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব থেকে পিছু হটেছিলেন ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসেই, এর পর থেকেই তারা দলগত ভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করবার উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় মূলত জামায়াতে ইসলামীর অনুগত কর্মীদের নিয়েই আল বদর বাহিনী গঠিত হয়, তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র মজলিসের নেতা গিয়ে বক্তৃতা প্রদান করছেন এবং দুষ্কৃতিকারীদের দমন করে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আল বদরের প্রশিক্ষিত সদস্যদের উদ্বুব্ধ করেছেন।

জামায়ত মনোনীত বিদেশী আইনজীবিদের দুই জন টবি ক্যাডম্যান এবং জন কমেহ ফেব্রুয়ারী মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল বিষয়ক এম্ব্যাসেডর-এট-লার্জ স্টিফেন যে র‍্যাপের সাথে সাক্ষাত করেন, এ বছর ১৩ই জানুয়ারী স্টিফেন র‍্যাপ এসেছিলেন বাংলাদেশে, সে সময় তিনি সাংবাদিকদের সাথে মতবিনময়ের সময় জানান

যুদ্ধাপরাধের ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে। আর এ অপরাধের বিচারে আইন হয়েছে ১৯৭৩ সালে। ২০০৯ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য। আইসিসির রোম সংবিধি অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আইন দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে হবে। এ জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে।

তিনি বিচারটির রাজনৈতিকীকরণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেন

বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকেই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আমি বলতে চাই, বিচার যেন সুষ্ঠু হয়। একজন ব্যক্তি কোনো সংগঠনের সঙ্গে অতীতে জড়িত ছিলেন বা এখন আছেন, সে বিবেচনায় নয়, ব্যক্তিগতভাবে তিনি অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি-না তা বিচারের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত।

তিনি বাংলাদেশে পুনরায় এসেছিলেন গত ১লা মে, সে সময় প্রথম আলোর কার্যালয়ে তার সাথে মতবিনিময়ের সময় তাকে জানান হয় ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চায় বাংলাদেশ। তবে এই সুযোগে কোনো দেশের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

জামায়াতে ইসলামী মনোনীত আইনজীবীগণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী বিভিন্ন সংস্থার কাছেই অভিযোগ উত্থাপন করছে তাদের প্রতি রাজনৈতিক বিদ্বেষ থেকেই আওয়ামী লীগ তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকবার অভিযোগ উত্থাপন করেছে, এবং তারা এভাবেই রাজনৈতিক দমন নীতি পরিচালনা করছে। সেসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কিংবা যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিভিন্ন কমিটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের বিভিন্ন পরামর্শ পাঠাচ্ছেন। সেসব ক্ষেত্রে সুপারিশে বিচারটি যেনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণতার নিদর্শন না হয়ে উঠে সেটা নিশ্চিত করবার পরামর্শ আছে।

জামায়াতে ইসলামী তদন্ত কমিটির সদস্য মনোনয়নে আপত্তি জানিয়েছেন, তাদের ধারণা এইসব তদন্ত কমিটির সদস্যের জামায়াতে ইসলামীর প্রতি অহেতুক রাজনৈতিক বিদ্বেষ রয়েছে, তাদের অভিযোগ এই অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের প্রধান বিচারকও এমনই রাজনৈতিক ধারণার বশবর্তী হয়েই তাদের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ হবেন। সুতরাং তারা এটা নিরসনে দুটো পরামর্শ প্রদান করেছে কিংবা তাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রস্তাবিত সুপারিশে এই বিষয়গুলো উঠে আসছে-
প্রথমত মনোনীত বিচার বিভাগীয় কমিটির প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সুযোগ এবং অভিযুক্তদের ট্রাইব্যুনাল আইন ও এর সদস্যদের নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ , একই সাথে তারা সেসব সদস্যদের প্রশিক্ষণের দাবিও উত্থাপন করছেন। যেন তারা নিরপেক্ষ থেকে তাদের মতামত কিংবা রায় প্রদান করতে পারেন।

এই অভিযোগ রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা আওয়ামী লীগের কর্মী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ত থাকবার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তারা হুমকি দিয়েছেন প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী ও তাদের আত্মীয় স্বজনদের ভেতরে যারা যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো তাদের তালিকাও প্রণয়ন করা হবে।

তাদের দাবী ১৯৭১ এ তারা একক ভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিলেন না, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও তাদের সাথে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিলেন, তারা একক ভাবে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে আল বদর বাহিনী তৈরি করেছিলেন কিন্তু সে সময় রাজাকার বাহিনীরও উপস্থিতি ছিলো এখানে।

১৯৭১ সালে অক্টোবর/নভেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একজন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠানোর সময় তার বক্তব্যে বলেছিলেন বিভিন্ন জেনা শহর ও মফঃস্বল থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে রেজাকার ও অন্যান্য আধা সামরিক বাহিনীর হাতে সেখানকার নিরাপত্তার দায়িত্ব সমর্পণ করবার পর সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন না থাকায় স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার কিংবা এমন পদস্থ যেকেউ সামান্য অভিযোগেই যেকোনো কাউকেই হত্যা করতে পারে।এমন হত্যাকান্ডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে তিনি সামগ্রীক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

রেজাকার বাহিনীতে অনেকেই পয়সার লোভে যোগ দিলেও আল বদর আল শামস বাহিনী গঠিত হয়েছিলো রাজনৈতিক বিবেচনায়, সেখানে স্থানীয় জামায়াত নেতাদের সুপারিশেই কর্মী নিয়োগ করা হতো। সেসব ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা প্রয়োজন।

আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাতে আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আমাদের বিচারকদের যোগ্যতা এমন কি আমাদের তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিরপেক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও আমাদের গোচরে আসে নি।

হাইকোর্টের বিচারকই বিশেষ আদালতের বিচারক নিযুক্ত হয়েছেন , তদন্ত কমিটির বেসামরিক সদস্যদের বাইরে যারা তদন্ত কাজ পরিচালনা করছেন তারা সবাই প্রশাসনের সদস্য। জামায়াতে ইসলামী একই সাথে বিচার বিভাগ এবং এ দেশের প্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাছাড়া তাদের কল্পিত মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ স্পর্শ্ব করছে এখানে থেকে যেতে বাধ্য হওয়া ৬ কোটি মানুষকে। যারা এখানে বসবাস করেছেন, প্রাণভয়ে পালিয়েছেন,তাদের সবাই সরাসরি প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হন নাই, জামায়াতে ইসলামীর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তার অভিযোগটা তাদের বিরুদ্ধেও যায়, বেসামরিক প্রশাসনের সদস্য হিসেবে যারা ৯ মাস বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তাদের সবার বিরুদ্ধেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মদত দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করেছে জামায়াতে ইসলামী।

রাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ায় জামায়াত আশা করছে আওয়ামী লীগ বিব্রত হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে।

আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রাক্তন নেতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতার অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে, ব্যক্তিগত ভাবে অনেক ব্যক্তিকেই সে সময়ে পরস্ব হরণের অভিযোগে অভিযুক্ত করা সম্ভব। লুটপাট এবং লুণ্ঠনের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হবে তাদের বিচারের বন্দোবস্তও করতে হবে এই আদালতকে। এই আদালত নৈতিক ভাবে দলমত নির্বিশেষে মানবতাবিরোধী যেকোনো অপরাধের বিচার করতে দায়বদ্ধ, সুতরাং জামায়াতে ইসলামী যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকবার অভিযোগ উত্থাপন করবে এবং এর সপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবে আদালতে তাদের সবার বিরুদ্ধেই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকবার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা উচিত এবং জামায়াতের উচিত আদালতকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করা।

জামায়াত নিজেদের নেতাদের বিচার রুখতে অযথা রাজনৈতিক বক্তৃতা না দিয়ে তাদের ভাষ্যমতে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ও অরাজনৈতিক লোকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও তার প্রমাণ সংগ্রহ অব্যাহত রাখুক , তারা সেসব উপস্থাপন করলে যদি আদালত সেসব অভিযোগ আমলে না নেন তখন এ বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে।

তার আগ পর্যন্ত এ বিচার বিভাগকে কোনো রকম রাজনৈতিক বিতর্কের মুখোমুখি করে এদের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কিংবা এদের কর্মকান্ডে কোনো রকম আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ন্যায়বিচারের স্বার্থেই পরিহার করা উচিত। আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন নেতা কিংবা তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে এমন সম্ভাবনায় কি আওয়ামী লীগ এ বিচার প্রক্রিয়া থেকে পিছু সরে আসবে? যে তরুণেরা মানবতাবিরোধী অপরাধের ন্যায়বিচারের দাবিতে ২০০৮ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছিলো, সেসব তরুণেরা বিভিন্ন ভাবেই ১৯৭১ এ ঘটে যাওয়া নৃশংসতার ন্যায়বিচার দাবী করছে, সেসব পরিবার এই বিচার হওয়ার সম্ভাবনায় আশায় বুক বেধেছেন আওয়ামী লীগ সরকার কি তাদের সবার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করবেন?