আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না

রাসেল পারভেজ
Published : 6 Jan 2011, 10:18 AM
Updated : 6 Jan 2011, 10:18 AM

আমি যে বাসায় ভাড়া থাকি সেটা পুরোনো ধাঁচের বাসা, বাসার সামনে এক চিলতে উঠান, আর পেছনে সামান্য ফাঁকা জায়গা আছে, তার পেছনে একটা রাস্তা, আজ শেষ বিকেলে হঠাৎ কারো পড়ি-মরি ছুটে আসবার শব্দ শুনলাম, তার পেছনে আরও কয়েকজন ছুটছে, জানালা দিয়ে ডেখলাম ইউনিফর্ম পরা দুজন এক মেয়েকে বলছে চল, আগে তুই ঐদিকে চল।

মেয়েটি সামনের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের কোনো একটি বাসার গৃহপরিচারিকা এবং ইউনিফর্ম পরিহিত লোক দুজন সেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের দারোয়ান। এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে ১০টি বড় বড় আপার্টমেন্টে প্রায় ২০০ পরিবার থাকে, নিরাপত্তার জন্য অন্তত ৬ জন দারোয়ান আছে, প্রতিদিন দুপুরে কিংবা বিকেলে যখন গৃহপরিচারিকারা বাসায় ফিরে যায় এরা প্রতিটি মেয়ে ও মহিলাকে জেরা করে, কোনো বাসা থেকে কিছু চুরি গেলো কি না, কোনো সন্দেহ হলে বাসায় ফোন করে জিজ্ঞাসা করে, আজকের মেয়েটির বিষয়েও এমনই চুরির সন্দেহ তাদের। এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নীচ তলায় গ্যারেজে, সেই গ্যারেজে সংক্ষিপ্ত পঞ্চায়েত বসলো- ফলাফল আর নজর করে দেখি নি।
গৃহপরিচারিকারা নিম্নবিত্ত এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সবাই সাম্ভাব্য চোর, তারা গৃহস্বামী কিংবা গৃহবধূকে লুকিয়ে হয়তো কয়েকটি আলু, একটু তেল, কয়েকটি মরিচ চুরি করে নিয়ে যায়, হয়তো তারা সামান্য তরকারী শাড়ির আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে যায়, সেসব কারণেই সারা দিন রাত পাহারার ব্যবস্থা এবং সদা তটস্থ দারোয়ানও সবার আঁচল দেখে রাখে।

বাংলাদেশ এ বছর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১২তম স্থান অধিকার করেছে, গত বছর দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৩, অর্থ্যাৎ বাংলাদেশ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর ভেতরে ১২তম স্থান অধিকার করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্নীতিকেই এরা আমলে আনে দুর্নীতি জরিপে। একজন গৃহ পরিচারিকার গৃহস্বামীর অজ্ঞাতে কোনো কিছু নিয়ে যাওয়া অবশ্যই চুরি কিন্তু এইসব চুরি আমলে আনে না টিআইবি। তারা যাদের দুর্নীতির পরিমাপ করে সেসব ব্যক্তির আর্থ সামাজিক অবস্থান মধ্যবিত্তের উপরে এবং এইসব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মানুষের দ্বারাই বাংলাদেশের আর্থিক দুর্নীতির ৯৫ শতাংশের অধিক সংঘটিত হয়। আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এরাই সমাজের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত অংশ, এরা নিতান্ত বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে দুর্নীতি করে না বরং অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জনের জন্যই এরা আর্থিক ও নৈতিক দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়।

আমার এক পরিচিত গত ঈদের সময় কোরবানীর হাটের একটি ঘটনা বলেছিলো। সন্ধ্যে বেলায় যখন ও কেবল গরুর হাটে ঢুকবে হঠাৎ খেয়াল করে দেখলো কে যেনো ওর মানিব্যাগ নিয়ে টান দিয়েছে। সাথে সাথেই হাত চেপে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো একটা ছোট ছেলে , বয়েস হয়তো ৯/১০ বছর। বললো বিশ্বাস করেন ভাই মেজাজটা প্রচন্ড খারাপ, একটা ভালো নিয়ত করে আসছিলাম এইখানে। সেই টাকা পকেটমারির চেষ্টা করতেছে, মনে হইলো পিটায়া ওর হাড্ডি গুড়াগুড়া করে ফেলবো। তখন ওর হাতের দিকে চোখ গেলো, কিচ্ছু বলতে পারলাম না ভাই। কি বলবো, ওর হাতের ৩টা আঙ্গুল কাটা। কিন্তু ওর সাহস দেখেন ভাই, পাবলিকে ৩টা আঙ্গুল কেটে ফেলছে কিন্তু ওর স্বভাব বদলাইতে পারে নাই।

আমরা নিয়মিতই আমাদের নিজস্ব বিচারিক মানদণ্ড অপপ্রয়োগ করি, হয়তো এই চকিত বিচারে অপরাধী আদৌ অপরাধী কি না সেটা যাচাই না করেই অনেক সময় শাস্তি প্রদান করে ফেলি এবং আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এই দানবের বসবাস। অনেকের ভেতরেই অনেক রকম ক্ষোভ কিংবা হতাশা। কিন্তু এমন না যে প্রত্যেকেই এমন ভাবে কোনো না কোনো সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকা শহরের কোথাও একজন ছিনতাইকারী ধরা পড়লে গণপিটুনিতে তার মৃত্যু প্রায় অবধারিত। এমন কি ছিনতাইকারীকে জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারবার একটি প্রচেষ্টাও দেখেছি আমি। কেনো মানুষ এমন নৃশংস এবং জিঘাংসু সেটার উত্তর পাই নি কোথাও। অনেকের অভিমত যে মানুষটা ছিনতাইকারী দেখলে এমন জিঘাংসু হয়ে যায় সে হয়তো অতীতে কোনো সময় ছিনতাইকারীর কাছে সর্বস্ব হারিয়েছে, সেই ক্ষোভটুকু ওসুল করে নেয় এই সুযোগে। কিন্তু একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ যাকে দেখলে স্থিতধী এবং বিবেচক মনে হয় তিনি যখন ধরাশায়ী ছিনতাইকারীর মাথা থেঁতলে দেওয়ার জন্য আধলা ইট খুঁজেন ব্যগ্র হয়ে তখন মনে হয় এটা নিছক ফ্যান্টাসি। কারো মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেওয়ার অসভ্য ফ্যান্টাসী নিয়ে সে ঘুরেছে অনেক দিন। এই ভিড়ের ডামাডোলে সে হয়তো নিশ্চিতই জানে তার অপরাধ নিছক জনতার প্রতিহিংসা বিবেচিত হবে সে কারণেই নিজের খেয়াল চরিতার্থ করতে চাইছে সে। এইসব মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক রাস্তাঘাটে ধ্যানী গেরস্থের মতো ঘুরে বেড়ায় এবং সে কারণেই মনে হয় ঢাকার রাস্তা নিরাপদ নয় দিনের কোনো সময়ই।