তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল: বিরোধী দলের জন্য আরেক ফাঁদ

নাজমুল হুদা
Published : 7 Jan 2011, 01:46 PM
Updated : 10 May 2011, 03:27 PM

কিছুদিন আগে সংকটটা ছিলো কেমন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। আর এখন বলা হচ্ছে এটা বাতিল। প্রথম সংকটে মনে হয়েছিলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার আগে নির্বাচন কমিশনকে আগে শক্তিশালী করতে হবে। স্বাধীনভাবে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনের সবগুলো শর্ত বিরাজমান থাকতে হবে। যাতে করে কোনভাবেই এই নির্বাচন কমিশনও পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে যায়।

যেমন একজন বিচারপতির কোন দলের প্রতি পক্ষপাত থাকতেই পারে বা কোন দলের হতে পারে, তাঁকে বিচারপতির পদে নিয়োগও দেয়া যেতে পারে যদি তাঁর অন্য কোন অযোগ্যতা না থাকে। কিন্তু যখনই তিনি বিচাপরতি হবেন তখন তাঁকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে।

কিন্তু বিচারপতি হওয়ার পর যদি তিনি তাঁর দলের স্বার্থে কাজ করেন তখন তিনি ঐ পদে থাকার সংবিধানিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবেন। একজন গভমেন্ট সার্ভিস হোল্ডার রাষ্ট্রের সেবক, রাষ্ট্রের সেবক মানে জনগনের সেবক। এজন্য এদেরকে বলা হয় পাবলিক সার্ভেন্ট। কিন্তু এরা পাবলিক সার্ভেন্ট না থেকে গভমেন্ট সার্ভেন্ট হয়ে সরকারী নির্দেশ পালন করতে থাকেন। জনগনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন না করে, জনগনের থেকে সে দূরে চলে যায়।

কিছু দিন আগে এই সরকারের পক্ষে আদালতের রায় হলো এই যে নব্বই দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব না হলে, তা অটোমেটিক্যালি পূর্ববর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ক্ষমতা ন্যস্ত হবে। এটাকে আমি স্রেফ তাদের মতামত হিসেবেই গ্রহন করেছি। এটাকে কোনভাবেই আইন হিসেবে গ্রহনযোগ্য বলে মনে করি না।

আমি যখন তথ্যমন্ত্রী ছিলাম তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটা ফরমুলা দিয়েছিলাম। ফরমুলাটি ছিলো এ রকম: আপিল বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব পালন করার অধিকার। সেটা তখন গ্রহণ করা হয়নি। তখন আমি এই কারণে ব্লাকশিপ হয়ে গেলাম। পার্টিতে আমার অগ্রহণযোগ্য চলে এলো। কারণ ঐ প্রস্তাবটা পার্টির বিপক্ষে গিয়েছিলো। ফলে পাটি থেকে আমাকে পদত্যাগ করতে হলো। এখনও পর্যন্ত যেটা চলে আসছে সেই ধারণাটাই পার্টিসহ অন্য দলগুলো গ্রহণ করলো, কিন্তু আমারটা গ্রহণ করলো না।

এখন প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় যদি ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিই হন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী তাহলে সেখানে পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকবে। যদিও সংবিধানে এই পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার কথা বলা নেই। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যান বলেই এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত আর কার্যকর থাকে না।

আমি মনে করি সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এই প্রস্তাব দিয়ে একটা রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রথমে তারা হুমকি দিয়েছে যে নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব না হলে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার ক্ষমতা চলে আসবে।

এই হুমকির ফলে বিরোধীদল যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটিকেই মেনে নেয়– এটাই তারা চান। আমরা যাতে এই ফাঁদে পা দেই এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নেই। তবে আমরা এই ফাঁদে পা দিতে চাইনি।

যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। আওয়ামী লীগ এর কোন দিকেই না গিয়ে এখন ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে আরেকটি ফাঁদ তৈরি করতে চাচ্ছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল ঘোষণার কোন অর্থ নেই। কারণ সুপ্রীম কোর্টের কোন অধিকার নেই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার। যে পর্যন্ত না সংসদে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে এ ব্যবস্থা বাতিল হবে সে পর্যন্ত তা বাতিল বলে রায় দেওয়ার এক্তিয়ার কারোর নেই। সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগকে সংবিধান এই ক্ষমতা দেয় নাই। সুতরাং এই রায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা: সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রী।