পুরোনো প্রতিক্রিয়া

রাসেল পারভেজ
Published : 2 Feb 2011, 05:37 PM
Updated : 2 Feb 2011, 05:37 PM

জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ 'দরজার ওপাশে' উপন্যাসে মাননীয় বিচারকের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করবার জন্য আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সে উপন্যাসে হুমায়ুন আহমেদের নির্মিত চরিত্র মন্তব্য করেছিলো আদালতের বিচারকেরা ঘুষ খাওয়ার জন্য কাতল মাছের মতো হা করে থাকে। সেই মন্তব্য আমাদের স্পর্শ্বকাতর বিচারকদের আত্মসম্মানকে আহত করেছিলো।

২০ শে জানুয়ারী সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানা যায় একজন তরুণ হাকিম তার সহকর্মীর ব্যক্তিগত জীবনে আড়িপাতবার জন্য তাদের কক্ষে গোপনে ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন। আদালত সেই ভিডিও ক্যামেরার ধারণকৃত ছবি দেখে নিশ্চিত করেছে অভিযুক্ত হাকিম অভিযোগকারী ব্যক্তির স্ত্রীর শয়নরত অবস্থায় কিছু দৃশ্য রেকর্ড করেছেন।

২২ আগস্ট, ২০১০ অভিযুক্ত হাকিমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনেন মুখ্য বিচারিক হাকিম, তিনি তার আদেশে উল্লেখ করেন অভিযুক্ত হাকিমের এই আচরণ নীতিবিবর্জিত, বিকৃত রুচির ও হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থমূলক।
একই দিন সুপ্রীম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় আই বি জরিপ ফলাফল মূল্যায়নের লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টের ৫জন বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত পর্যালোচনা কমিটি তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। এই প্রতিবেদনে তারা মেনে নিয়েছেন বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার মাণ নিম্নগামী।

এ বছর টিআইবি জরিপে রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রদানকারী সংস্থাগুলোর ভেতরে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হয়েছে বিচার বিভাগ। জরিপের ফলাফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই টিআইবির উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হয় কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের আদালতে। পরবর্তীতে টিআইবির উর্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে জরিপের নথি চেয়ে পাঠিয়েছিলো বিচার বিভাগ। জরিপে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিগত তথ্যাদি মুছে সে জরিপের ৬৫০টি নমুনা বিচারপতিদের পাঠিয়ে দিয়েছিলো টিআইবি। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি টিআইবির কর্মকর্তাদের চা পানের আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। সেখানে তাদের কাছে জরিপ ও ফলাফল সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

টিআইবি'র দেওয়া তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় গত ৩০ ডিসেম্বর বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে সভাপতি কর পাঁচজন বিচারপতিকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। সে প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে
টি আই বি'র প্রতিবেদনটি এক কথায় প্রচারমূলক প্রতিবেদন ব্যতীত আর কিছুই নয়। ইহা "পর্বতের মূষিক প্রসব" এই প্রবাদকেই স্মরণ করিয়ে দেয়।

বিচারপতিগণ আশা করেছিলেন টি আই বি'র প্রতিবেদনে হাইকোর্ট এবং বিভিন্ন জেলা আদালতের অভিযুক্ত বিচারকদের শণাক্ত করা যাবে এবং এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা সম্ভবপর হবে।

টিআইবি কেনো প্রতিটি মামলার নথি পর্যালোচনা করে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করলো না এটা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা অনর্থক, কিংবা টিআইবি জরিপে কেনো অভিযোগকারীর অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো বন্দোবস্ত রাখা হয় নি এ প্রশ্নটাও অমূলক। টিআইবি জনগণের আস্থা ও অবস্থা যাচাই করতে জরিপ পরিচালনা করছে বিকল্প আদালত কিংবা অনুসন্ধানী প্রতিবেদক হিসেবে বিচারকদের চিহ্নিত করে বিচার ব্যবস্থা শুদ্ধিকরণ আন্দোলন পরিচালনা করছে না। শুদ্ধি অভিযান ও অপরাধী নির্মূল অভিযান পরিচালিত হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে এবং যেহেতু দেশের বিচার বিভাগের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পরিচালনা কওরে সুপ্রীম কোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বিচার বিভাগে দুর্নীতি অনুসন্ধানে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো টি আই বির কর্মপরিধির সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রদানকারী মাননীয় বিচারকদের ন্যুনতম ধারণাটুকুও নেই। কোনো ধারণা না থাকাটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না কিন্তু জনসাধারণের অংশীদারিত্ব ও সক্রিয় অংশগ্রহনের ভিত্তিতে সামাজিক সমতা স্থাপন ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রপরিচালনার কাজে সহযোগিতা করতে চাওয়া একটি সংস্থার কাছ থেকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আশা করাটা নেহায়েত মুর্খতার পর্যায়ে পড়ে। টি আই বি তার সেবাখাত ও লক্ষ্য সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ দিয়েছে ১৯৯৮ সাল থেকে তারা সামাজিক ও সেবাখাতের দুর্নীতির খতিয়ান লিপিবদ্ধ করছে এবং বিভিন্ন সূচকের সমন্বয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ আন্দোলনে বাংলাদেশের অবস্থান এবং অগ্রগতি যাচাই করছে। টি আই বি মনে করে যদি জনসাধারণকে সচেতন করা হয় এবং যদি প্রাতিষ্ঠানিক সচ্ছতা বজায় থাকে তবে প্রতিটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠা জনস্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেদের কর্মকান্ড পরিচালনা করবে এবং তাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।

টিআইবি দুর্নীতিসূচক পরিমাপ কওরে দুর্নীতি নিরসনে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রকাশ করছেন গত ১২ বছর ধরেই। টি আই বি তার ঘোষিত কর্মপরিধির বাইরে গিয়ে নতুন কিছু করে নি বরং নিজের কর্মপরিধি সম্প্রসারিত কওরে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবাখাতের সেবা প্রদানের মাণ যাচাইয়ের জন্য জরিপ করেছে।
বিভিন্ন জরিপ সংস্থার জরিপে প্রমাণিত হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সেবাখাতের সেবার মাণ ও দক্ষতা নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক ক্ষুব্ধ। তারা মাণসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য সরকারী হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারী বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের উপরে বেশী আস্থাবান। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে তারা সেবা গ্রহন ও অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে অনাগ্রহী। এরই ধারাবাহিকতায় বিচার বিভাগে নিজের উপরে অবিচারের প্রতিকার চাইতে গিয়ে তারা যেসব হয়রানির শিকার হচ্ছেন তা যাচাইয়ের একটা উদ্যোগ নিয়েছিলো টিআইবি। তাদের জরিপ ফর্মের অবয়বে সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সেখানে প্রশ্ন ছিলো জরিপে অংশগ্রহনকারী ব্যক্তি বিচার বিভাগ থেকে কোনো সেবা গ্রহন করেছিলেন কি না গত ১ বছরে? আদালত থেকে সেবা গ্রহন করবার সময় তারা কোনো হয়রানির শিকার হয়েছিলেন কি না? যদি তারা মনে করেন তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন তাহলে সে হয়রানির ধরণ কি রকম ছিলো? হয়রানির ধরণ চিহ্নিত করবার জন্য জরিপ ফর্মে বলা হয়েছিলো ঘুষ প্রদান, আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্বারা হয়রানি, উকিল ও উকিলের সাথে সংশ্লিষ্ঠ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা হয়রানি, এবং ডকুমেন্ট উত্তোলন সংক্রান্ত হয়রানি ও অন্যান্য বিষয়াদি। যদি অভিযুক্ত এসব হয়রানি এড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঘুষ প্রদান করেন তাহলে কি ধরণের সেবা পেতে এই ঘুষ প্রদান করেছেন, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা, দ্রুত শুনানী, নথিপত্র গায়েব করা সহ বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিলো ঘুষ প্রদানের সাম্ভাব্য কারণ হিসেবে। ঘুষ গ্রহীতার পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছিলো জরিপ ফর্মে- বিচারক, উকিল, আদালতের কর্মকর্তা কর্মচারি, মুহুরী এবং দালালদের সাম্ভাব্য ঘুষ গ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।

৬৫০টি জরিপ পর্যালোচনা করে কমিটি তাদের উপস্থাপিত প্রতিবেদনে লিখেছেন ৩১জন বলেছেন তারা বিচারকদের ঘুষ প্রদান করেছেন তবে জরিপের কোথাও বলা হয় নি বিচারক সরাসরি এই ঘুষ গ্রহন করেছেন। যেহেতু জরিপে এমন কোনো তথ্য জানতে চাওয়া হয় নি সুতরাং সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয় বলে বিচারকদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায়। বিচারকদের একাংশ তাদের নৈতিকতা অর্থের বিনিময়ে বিপণন করছেন এবং সেবাগ্রহীতাদের ভেতরে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছে উপযুক্ত সম্মানী প্রদান করলে আদালতে বিচারের রায় নিজের পক্ষে আসবে।

বিচার বিভাগ নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়, অনেক আগে থেকেই বিচারকদের দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে, অর্থের বিনিময়ে রায় প্রভাবিত করা, ন্যায়বিচার বিলম্বিত করা এবং অনেকক্ষেত্রে আদালতের বাইরে মামলা নিষ্পত্তিতে বাধ্য করবার মতো অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে বিচারকদের বিরুদ্ধে। তবে টিআইবি জরিপ ফলাফল গত ১ বছরের প্রদত্ত তথ্যের বিনিময়ে নিশ্চিত করেছে আমাদের বিচার ব্যবস্থার সামগ্রীক মাণ হতাশাব্যাঞ্জক। মানুষে প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা হারাচ্ছে এবং যদি এমনটা অব্যাহত থাকে তবে বিচার বিভাগে অভিযোগ নিষ্পত্তি না করে অন্য কোনো বিকল্প উপায়ে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করবে সাধারণ জনগণ।

বিচারপতিগণও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের প্রতিবেদনে। বিচার ব্যবস্থা জনগণের আস্থা হারালে একই সাথে বিচার বিভাগও জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, যদিও অধিকাংশ অভিযোগকারীই মামলা পরিচালনার জন্য নিযুক্ত উকিল, মুহুরী ও দালালদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ করেছেন এবং তারা সরাসরি বিচার বিভাগের সাথে সংশ্লিষ্ঠ না হলেও এইসব ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়েই বাংলাদেশের ন্যায় বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত হয়। সুতরাং সরাসরি বিচারক ও আদালতের কর্মকর্তাগণ অভিযুক্ত না হলেও সামগ্রীক ভাবে বিচার ব্যবস্থার মাণের অবনতির নিশ্চিত প্রমাণ টিআইবির সাম্প্রতিক জরিপ। এই জরিপ এর ফলাফল যাচাই করে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ এবং অনাস্থা ও আক্ষেপ নির্ধারণ কওরে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করলে বিচার বিভাগের উপরে জনগণের আস্থা পূণর্স্থাপিত হবে এবং বাংলাদেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ পরিস্কার হবে।