কৃষির ভূবনে আমার পথচলা -১

জহিরুল ইসলাম রাসেল
Published : 15 Jan 2016, 01:30 AM
Updated : 15 Jan 2016, 01:30 AM

২০০৩ সালের কথা। আমি তখন বরিশাল বি.এম. বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের গনিত বিভাগে অধ্যায়নরত। পারিবারিক একটা সমস্যার কারণে ফরম ফিলাপের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে পরীক্ষায় অংশগ্রহন না করেই বাড়ীতে চলে যাই। এরপর আমার জীবনটা অকেটা এলোমেলো হয়ে যায়। অনেক মানসিক যন্ত্রনায় আমার দিনগুলো অতিবাহিত হতে থাকে। লেখাপড়ার প্রতি খুব অনীহা চলে আসে। চিন্তা করতে লাগলাম চাকরী না করে নিজে কিছু একটা করার জন্য। বলে রাখি আমাদের বাড়ীতে তখন ৪/৫ জন লোক রেখে নিজেদের জমিতে ধান, ডাল, মরিচ, খিরাই চাষ করা হত। লোকের অভাবে একসময় তা বর্গা দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমি ব্যবসা করি এটা আমার পরিবার কখনোই চায়নি। কিন্তু কিছু করতে গেলে অবশ্যই টাকার প্রয়োজন। কোথায় পাব টাকা এ নিয়ে মহা চিন্তায়। চেষ্টা করতে লাগলাম কিভাবে নিজের প্রচেষ্টায় কিছু করে পরিবারকে দেখাবো।

এলাকায় যাওয়ার পরে কবির ও মাহবুব নামে দুটি ছেলের সাথে ভালো সখ্যতা গড়ে ওঠে, ওদের সাথেই ওঠাবসা। আমার সেজ খালার পরিবার খালুর চাকরীর সুবাধে তখন যশোরে থাকে। একদিন বেড়ানোর উদ্দেশ্যে চলে গেলাম ওখানে। হঠাৎ একদিন কবির ফোন করে জানালো আমাদের বাড়ীর পাশে এক লোক একটি মাছের ঘের করেছিল যিনি পরিবার নিয়ে খুলনায় থাকতেন ওনি ওই ঘেরটি লীজ দিবে আমরা ওই ঘেরটি নিয়ে মৎস্য চাষ শুরু করতে পারি কিনা। আমি ওকে বললাম, আমি বাড়ীতে এসে আগে দেখি তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আমি দ্রুত বাড়ীতে চলে এসে ওদেরকে নিয়ে ঘেরটি দেখতে গেলাম। আমার পছন্দ হল।

কিন্তু মাছ চাষে তো কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমার পরিবারসহ কেউই আমাকে এ ব্যাপারে সম্মতি দেয়নি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি মাছ চাষ করবোই। কথা বললাম ঘের মালিকের সাথে। মোটামুটি সবকিছু ঠিক হল এখন প্রয়োজন লীজের প্রথম বছরের ১০,০০০ টাকা। বাবার সেই একই কথা এ জন্য টাকা দিবেনা। আমিও হাল ছাড়লামনা ব্যবস্থা করলাম একজনের কাছ থেকে লোন নিয়ে। ঘের মালিকের কাছ থেকে চুক্তিপত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম কৃষি কাঝে। এইতো শুরু আমার কৃষির ভ'বনে পথচলা।

কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা থেকে মৎস্য চাষ বিষয়ক কিছু বই নিয়ে শুরু করলাম লেখাপড়া। গ্রামে একটা নেতিবাচক ধারণা ছিল যা এখনও আছে, শিক্ষিত মানুষেরা কেন কৃষি কাজ করবে। আমি চিন্তা করলাম, আমি কৃষি কাজ করবো কিন্তু আমার ফর্মটি হবে একটু ব্যতিক্রম, যা মানুষের এই নেতিবাচক ধারণা পাল্টে দেয়। প্রথমে আমি একজন লোক নিয়োগ করলাম তারপর পুরো ঘেরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে সাজালাম। লোক থাকার জন্য একটি সুন্দর করে ঘর তৈরী করলাম। ঘরের সামনে বসার জন্য বেঞ্চ দিলাম কিছু ফুল গাছ লাগালাম। মাছের খাবার তৈরীর জন্য পাত্র গুলো সুন্দরভাবে স্থাপন করলাম আর স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

এলাকার দু একজন লোক দেখতে আসতে শুরু করল কেউ কেউ প্রশংসা করলো। প্রথমে গলদা আর সাদা মাছের মিশ্র চাষ ও ঘেরের পাশে বরবটি দিয়ে শুরু করে দিলাম। আমার উপড় রাগ করে আমার পরিবারের কেউই আমার ফার্ম দেখতে আসেনি। কিছুদিন পরে ঘেরে মাছের অবস্থান পরীক্ষা করে দেখে আরো উৎসাহিত হলাম। সবচেয়ে অবাক আর খুশি হলাম বরবটির ফলন দেখে। একদিন জানতে পারলাম আমাদের ঘেরে যে লোকটি কাজ করে, ও আমার বাবাকে ঘেরে নিয়ে আসলো এই বলে যে একটু এসে দেখে যান কি করেছে। এরপর বাবা প্রত্যেকদিনই আসতো আর আমি বুঝে গেলাম আমি স্বার্থক আমার কাজের স্বীকৃতি পেয়ে গেছি। আর আমার এটাই দরকার ছিল। এবার অন্যভাবনা।

আমার বাড়ীর ভিতরে ১৩০ শতাংশের মত জায়গা ছিল যেখানে কলাগাছ ও বিভিন্ন গাছপালা ছাড়া প্রয়োজনীয় কিছু ছিলনা। আমি চিন্তা করলাম ওই জমিগুলো ডেভেলপ করে ওখানেই শুরু করবো আমার ফার্ম। এরই ধারাবাহিকতায় আমার বাবার সহযোগিতায় প্রথমে পরিত্যাক্ত একটি ২০ শতাংশের জলাশয়ে পুকুর কেটে গলদা চাষ শুরু করলাম এবং পুকুরের চারপাশে লাগালাম পর্যায়ক্রমে লাউ করল্লা ও বেগুন। লেখাপড়ার জন্য এবার চলে এলাম ঢাকায়। আমার মন পরে রইলো আমার ছোট্ট ফার্মে। নিয়মিত বাবার সাথে যোগাযোগ করতে থাকি এবং ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করতে থাকি। একদিন বাড়ি গিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম কত কি বিক্রি করতে পেরেছেন। বাবা জানালো, মাছ মোমুটি ভালোই বিক্রি করেছি (কত বলেছিল আজ তা মনে পড়ছেনা) আর লাউ করল্লা ও বেগুন মিলিয়ে ওই বছরে ১২০০০০ টাকার উপরে বিক্রি করেছে, আমি শুনেতো অবাক। আরও উৎসাহিত হলাম। ভালোই লাভ তাই না….লোকসানের খাতাও খুলেছিলাম পরবর্তীতে, বন্ধও করে দিয়েছিলাম ফার্মের কাজ তবে তা লোকসানের জন্য নয় । তা একটু পরেই বলি….