নিরাপদে ধর্ম-কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের অধিকার চাই

জহিরুল ইসলাম রাসেল
Published : 17 Jan 2016, 00:26 AM
Updated : 17 Jan 2016, 00:26 AM

আপনাদেরকে আজ একটা পুরানো কৌতুক বলবো। সবাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করছি। এক বধু তার বান্ধবীর সাথে গল্পকালে তার বান্ধবীকে বলছে "তোমরা তোমাদের দেবরদের (স্বামীর ছোট ভাই) সাথে কিভাবে যে মশকরা করো, আমার ভাসুরের (স্বামীর বড় ভাই) সাথে একদিন শুইয়ে ই লজ্জায় মরে যাই"। আমাদের নারীরা কে কি ধরণের পোষাক পরলো তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার অন্ত নেই, লজ্জার শেষ নেই কিন্তু বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখে শত শত লোকের সামনে আমার বোনের শাড়ী খুলে বিবস্ত্র করেছে তাতে আমাদের কোন কথা নেই। আর কথা থাকবেইবা কেন, তার উত্তর পেয়ে যাবেন আর একটি কৌতুক শুনলেই। তবে শুনুন "এক বধু তার চাচাত দেবর কর্তৃক যৌন হয়রাণির শিকার হলে চাচার কাছে বিচার দেওয়ায় চাচা বলল, নিজের ক্ষেত নিজের গরুতে খেয়েছে তাতে সমস্যা কি?"। তাহলে আমাদের অবস্থাও আজ এই কৌতুকেরই নামান্তর নয় কি?

গত ১৪ এপ্রিল ২০১৫ পহেলা বৈশাখ ১৪২২ বঙ্গাব্দ। টিএসসি চত্বরে একাধিক নারীকে বিবস্ত্র করে নারীর সম্ভ্রমকে ছিড়েখুড়ে নগ্ন উল্লাস করেছে হিং¯্র শকুনের দল। কিশোরী থেকে মধ্যবয়সী কেউই রেহাই পাননি ওদের হাত থেকে। রাজু ভাস্কর্যের উত্তরদিকে সোহরওয়ার্দী উদ্যানের ফটকের পাশে একের পর এক বস্ত্র হরণের এক অসভ্য প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল মানুষ নামের জানোয়ারের দল। ছয় বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন এক নারী। উদ্যানের ওই ফটক দিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বখাটেরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছিনিয়ে নিয়ে যায় তার শিশুসন্তানকে। শিশুটি তখন ফুটপাথে পড়ে কান্নাকাটি করছিল। প্রতিবাদ করলে মারধর করা হয় ওই নারীর ভাইকে। বখাটেরা টেনে খুলে নেয় ওই নারীর শাড়ি। বখাটেদের আক্রমনের শিকার এক কিশোরী নির্যাতনে ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারায় বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়। কতটা বিকৃত মষিÍস্কের, কতটা মনুষ্যত্বহীন হলে এ ধরনের পশুর মত হিং¯্র যৌন হয়রানি করতে পারে তা ভাবতেই শরীর শিউরে ওঠে। এর মাঝেই আশা জাগে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি লিটন নন্দীসহ কিছু মানুষ জীবন বাজী রেখে এর প্রতিবাদ করায়, স্বপ্ন দেখি সুন্দরের। আবার হতাশ হই তখনই যখন শুনি আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে নিয়োজিত আমাদের মহান পুলিশ বাহিনী সম্মুখে থেকেও এই সংঘটিত অপরাধ নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ।

প্রত্যেকটি ঘটনা ঘটার কিছুদিন পরেই আমরা তা ভুলে যাই। এটাও হয়তো ভুলে যাব। কিন্তু আমরা এর ক্ষত যন্ত্রনা বয়ে বেড়াই বহুকাল ধরে। আমরা হয়ত ভুলে গেছি ইয়াসমিন, বাঁধন আর পূর্ণিমার কথা ও। আসুন একটু মনে করিয়ে দেই-

দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার রিকশাচালক মৃত এমাজ উদ্দিন ও শরিফা বেগমের একমাত্র কন্যা ইয়াসমিন বেগম। শহরের লালবাগ কোহিনূর স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত সে। বাবা মারা যাওয়ার পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় কিশোরী ইয়াসমিনের। সংসারে অভাবের তাড়নায় মাত্র ১২ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে ঢাকায় যায়। টানা তিন বছরে একবারও দিনাজপুরে মায়ের কাছে আসা হয়নি ইয়াসমিনের। তাই বাড়িতে আসার জন্য বিশেষ করে মাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে একাই দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়।

১৯৯৫ সালে ২৪ আগস্ট ভোরবেলা ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁও গামী 'হাছনা এন্টারপ্রাইজ' নামে রাত্রিকালীন কোচে ইয়াসমিন রাত তিনটার দিকে দিনাজপুরের দশ মাইল মোড়ে নামে। কোচের সুপারভাইজার দশ মাইল মোড়ের এক পান দোকানদার সহ স্থানীয়দের কাছে কিশোরী ইয়াসমিনকে দিয়ে সকাল হলে মেয়েটিকে দিনাজপুর শহরগামী যেকোনো গাড়িতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু এর কিছুণের মধ্যে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা টহল পুলিশের একটি পিক আপ ভ্যান সেখানে আসে। তারা মেয়েটির পরিচয় জানতে চায়। একপর্যায়ে শহরের রামনগর এলাকায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পুলিশ ইয়াসমিনকে পিক আপে তুলে নেয়। এরপর পুলিশের টহল ভ্যানটি দশমাইলের কাছে সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক স্কুলের সামনে এসে থামে এবং পুলিশ সদস্যরা ইয়াসমিনকে স্কুলের মধ্যে পালাক্রমে ধর্ষণের পর হত্যা করে। পরে তারা ইয়াসমিনের লাশ দিনাজপুর শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক অফিসের পাশে একটি আদিবাসীর বাড়ির সামনে ফেলে চলে যায়। এক পর্যায়ে আশেপাশের এলাকার লোকজন সংগঠিত হয়। প্রতিবাদী জনতা বিােভ মিছিল সহকারে কোতোয়ালী থানা ঘেরাও করে অভিযুক্ত তিন পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদ, ন্যায্য বিচার ও শাস্তি দাবি করে। হাজার হাজার জনতা কোতোয়ালি থানার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলে এবং সারারাত থানা অবরোধ করে রাখে। এসময় পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ ও ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে। এতে আট-দশজন ব্যক্তি আহত হয়।

২৭ আগস্ট শহরে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই সকাল এগারোটার দিকে ঘটনার প্রতিবাদ ও সব প্রশাসনিক কর্মকর্তার বদলি এবং দোষী পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবীতে বিুব্ধ জনতা শহরে একটি বিশাল মিছিল বের করলে মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মুহূর্তেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মিছিলকারীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ শহরের বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গুলি চালালে সামু, কাদের ও সিরাজসহ নাম না জানা ৭ জন নিহত হয়। আহত হয় প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ। পরে বিুব্ধ জনগণ শহরের ৪টি পুলিশ ফাঁড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। মামলার অন্যতম আসামী এ.এস.আই মইনুল হকও কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার কে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদনন্ড কার্যকর করা হয় ১ সেপ্টেম্বর '০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে। অপর আসামী পিক আপ ভ্যান চালক অমৃত লাল বর্মণ কে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর '০৪ মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে।

১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংরেজী নববর্ষের রাতে মডেল কন্যা শাওন আক্তার বাঁধনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল হয়েনা।

উল্লাপাড়া হামিদা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থিনী পূর্ণিমা। ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর পনেরো বছর বয়সের ছাত্রী পূর্ণিমা গণধর্ষণের শিকার হয়। পূর্নিমা সেই রাতে বাড়িতেই ছিল। মায়ের সামনেই ধর্ষন করলো তাকে। এত মানুষ দেখে পূর্নিমার মা বলছিলো "বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো, মরে যাবে।" আসলেও তাই, ওতটুকু মেয়ে, ১০-১২ জনের এক দল যদি পালাক্রমে ধর্ষন করে, তবে তার বাচার আশা করা যায়। অসহায় বাবা দেখলেন মেয়ের ধর্ষন।

এভাবেই বাড়তে থাকে আমাদের যৌন দৈত্যের অশুভ তৎপরতা। এই সকল নেকড়ের যৌন থাবায় অসংখ্য মা-বোনের স্বপ্নগুলোর বলিদান হয়ে কফিন বন্দী হয়ে সামাজিক ও মানসিক যন্ত্রনায় ছটফট করতে থাকে নীরবে নিভৃতে। কিন্তু কেন বারবার ঘটছে এই দূর্ঘটনা। অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে তাই। আমি কোন দল বা দলের নেতা কর্মী বলে কাউকে অভিযুক্ত করব না কারণ এই আপরাধীদেরকে আমি কোন দলের নয় এক ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ত বলে বুঝি। অপরাধী যে দলের বা যত বড়ই হোক তার বিচার হওয়াটাই সবার কাম্য। অভিযুক্ত করার ও বিচারের দায়িত্ব প্রশাসনের। আমার জানামতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাটিতে মেয়েদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে, সেখানে সিসি ক্যামেরা ছিল। তার মানে অপরাধীদের সনাক্ত করা মোটেই কঠিন কোনো কাজ নয়। কিন্তু বিচারের নামে প্রহসনের সেই পুরোনো রীতি যদি চলমান থাকে তবে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনাও চলমান থাকবে।

যেকোন অনুষ্ঠানে যে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে এটা অস্বাভাবিক নয় আর সেজন্যইতো পুলিশ প্রশাসন এধরনের পরিস্থিতিতে আলাদাভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকেন। তবে কেন এই ব্যর্থতা ? আর কতদিন মা-বোনেরা তাদের সম্ভ্রম বিসর্জন দিবে ? অভিজিত লাশ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকবেন ? অনেক মা-বোনের সম্ভ্রভ আর জীবনের বিনিময়েইতো কিনেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার নিজস্ব একটি দেশ। যে দেশে আমি স্বাধীন ভাবে বসবাস করতে, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে, স্বাধীনভাবে সামাজিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে না পারবো সে দেশটি কেমনে আমার হয়? তবে বসবাসতো করছি এই স্বাধীন বাংলাদেশে। তবে কি আমি ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছি ? আমি কি বাংলাদেশের ভাড়াটিয়া নাগরিক? আমার কি নিজের একটা দেশ হবে না? আর কতদিন অপো করতে হবে আমার কাঙ্খিত সেই নিজের দেশটিতে বসবাস করার জন্য ?

আর কত দিন – অমার মা, বোন, সন্তানদের উপর শক্তিশালী শকুনেরা ঝাপিয়ে পড়ে খুন করবে ? পাশবিক কায়দায় যৌন নির্যাতন করবে ? শত শত লোকের সামনে বাঙালীর সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখে আমার বোনের শাড়ী খুলে বিবস্ত্র করবে? পুলিশ সামনে থেকে লাঠিপেটা করলেও হিং¯্র শকুনদের নিবৃত্ত করতে পারবে না ? আর কতদিন শুনতে হবে অপরাধীদের সনাক্ত করে আটকের চেষ্টা করছেন ?

রক্তদামে কেনা এই দেশটা আমার। এই দেশে স্বাধীনভাবে নিরাপদে ধর্ম, কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের অধিকার আমার আছে। আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমি নিরাপত্তা চাই আমার মা-বোন সহ সকল নাগরিকের।