বিনা পারিশ্রমিকে আন্তরিকভাবে সেবার মানসিকতা নিয়ে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো উন্নয়ন কর্মে কোন সংগঠন/প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকে অথবা ব্যক্তিগতভাবে কাজ করাই হলো স্বেচ্ছাসেবা। এটি হতে হবে স্বপ্রণোদিত। সহজ প্রচলিত কথায় যাকে বলা হয়, নিজের ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। স্বেচ্ছাসেবায় জড়িত হাজার হাজার মানুষ শুধুমাত্র অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে বিনে পয়সায় কাজ করে যাচ্ছে নিজের নিরেট আত্মতৃপ্তি এবং আনন্দের জন্য।
স্বেচ্ছাসেবাতে এমন একধরণের অনুভূতি আর আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় যা একমাত্র স্বেচ্ছাসেবকরাই অনুধাবন করতে পারে। কেউ কাউকে সাহায্য করার পর তারা স্বেচ্ছাসেবকদেরকে যে ধন্যবাদ জানায় সেটা একান্ত মনের গভীর থেকে আসে আর এই নির্ভেজাল ভালোবাসা ই স্বেচ্ছাসেবকদের জীবনের সবচেয়ে পরম তৃপ্তি। স্বেচ্ছাসেবকরা অন্যকে সহযোগিতা করে শুধু তাদেরকেই সুখী করেনা, নিজেও লাভ করে অনাবীল সুখ। তাই নিজেকে সুখী করে তোলার একটা উত্তম পন্থা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবা। আপনার আশপাশের অনাথ, অসহায় ও দরিদ্র নারী-পুরুষ-শিশু আছে যাদের মুখে হাসি ফুটে উঠতে পারে শুধু আপনার সামান্য সহযোগিতায়, আর সেই হাসিমুখগুলোই আপনার অন্তরকে করবে পুলকিত। আপনি হৃদয়ে অনুভব করবেন এক অজানা আনন্দ। শুধু অর্থ দিয়েই স্বেচ্ছাসেবা হয়না। শ্রমের মাধ্যমে সেবা দিয়ে বিপদে পরা, অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাড়ানোই হচ্ছে আসল স্বেচ্ছাসেবা। আর হ্যা, শুধু মানুষই নয় আমাদের আশে-পাশের পশু-পাখি, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমাজের অন্যান্য সকল বিষয়ের প্রতি আমাদের মানবিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। আপনার পছন্দমত যেকোন বিষয় নিয়ে চালিয়ে যেতে পারেন এই স্বেচ্ছাসেবা। দেশে অনেক ধরনের সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন আছে এর যে কোনো একটি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, অসুস্থদের রক্তদান, বিনামূল্যে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা, পথশিশুদের শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ ,পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, বৃক্ষরোপন প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবায় কাজ করা যায়।
চাকরির জন্যও সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে বেশিরভাগ চাকরীর ক্ষেত্রে শর্ত দেয় থাকে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা যা নতুনদের জন্য চাকরি পাওয়ার একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। সেক্ষেত্রে যে কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাকর্মী হিসেবে কাজ কাজ করলে নেতৃত্ব গুন, ধৈর্য্য, উদারতা ও পরিশ্রমের মানসিকতা সহ নানা ধরনের অভিজ্ঞতার সঞ্চার হবে এবং কাজের সুযোগ বাড়বে।
সব ধর্মে মানবসেবাকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়া হয়েছে। এ জন্য অসহায়-দুস্থ মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসা আমাদের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব। মানুষ মানুষের জন্য, এ আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। আপনাকে গোটা সমাজের দায়িত্ব নেয়ার দরকার নেই, সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তঃত একজনের একটু সহায়তায় এগিয়ে আসুন।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে, দেশে যে কোন দূর্যোগ কিংবা বিপর্যয় সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার পতাকাবাহী সাধারণ মানুষ সুন্দর সমাজ, শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তোলার প্রত্যায়ে নিজেদেরকে নিয়োজিত করে স্বেচ্ছাসেবায়। এই কর্মসূচী সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন সেবা ছড়িয়ে পরে বিভিন্ন প্রান্তে। এগিয়ে চলে সুন্দর পরিবর্তনের ধারা। যার ফলশ্রুতিতে আমরা হতাশার মধ্যে স্বপ্ন দেখি সুরভিত আগামীর, আলোকিত পৃথিবীর। চারিদিকে তখন উচ্চারিত হয়-
"মানবের তরে সহযোগিতা করে, মানব জীবন দাও আলোকিত করে"।
আপনি হয়তো ভাবছেন, এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেন করতে হবে এই কাজ। ঠিক আছে, আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি আপনার প্রিয় আর পরিচিত একটি কথা-
" আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে…"
হ্যা, আপনাকেই জাগতে হবে কারণ আপনিওতো এই সমাজেরই অংশ। আপনাকেই বাজাতে হবে পরিবর্তনের ঘন্টা। আর আপনার, আমার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই সম্ভব একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মানের।
ভালো যে কোনো উদ্যোগে স্বভাবতই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতেই হয় কারণ সবখানেই দু'একটি সুযোগসন্ধানী মুখ ওতপেতে থাকে। তারা কখনো ভালো কোন কাজ করবে না বরং ভালো কোন কাজের দোষ খুজেঁ বেড়ায় আর সমালোচনা করতে থাকে। তারা আপনার শুরুর দিকের ছোট ছোট কাজগুলোকে কখনো পাগলামী বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে। আপনি মনে রাখবেন, আপনার ভালো কাজের অসংখ্য শুভাকাঙ্খী ও উপকারভোগীর ভালোবাসার কাছে এটা কিছুইনা। আপনার ভালো ভালো কাজগুলোর জন্য যদি আপনাকে কেউ পাগল এবং আপনার কাজকে পাগলামী বলে তাহলে বলবো, এক ধরনের পাগলের পাগলামীর নাম স্বেচ্ছাসেবা। আর এধরনের পাগলামী যেন দেশে বাড়তেই থাকে কারণ দেশের পরিবর্তনে এই পাগলদের খুব প্রয়োজন। আর কিছু সুযোগসন্ধানী মুখ আছে যারা বিলাসবহুল অফিসে বসে স্বেচ্ছাসেবার নামে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের বুলি দিয়ে নানারকম ফায়দা লুটছে যার কারণে সত্যিকারের স্বেচ্ছাসেবা আজ প্রশ্নবিদ্ধ ও কলঙ্কিত।
মানবসেবার জন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় না, শুধু বিশুদ্ধ মন প্রয়োজন। অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসার মন নিয়ে তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে তবেই আপনার জীবন অনেক সুখী হবে। আর হ্যা, অবশ্যই আপনার কাজ গুলো সবার মাঝে প্রচার করুণ। প্রচারের উদ্দেশ্য হলো, সমাজে স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান ও বিভিন্ন কাজের কথা জনসাধারণ জানতে পারলে তারা আপনার কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ভালো কাজে এগিয়ে আসার সুযোগ পাবে। সবাই এগিয়ে আসলে দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির সকল শাখায় ই স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে সুন্দর পরিবর্তন সম্ভব হবে।