আমি ঘাতক!

সুমনা শারমিন
Published : 5 Oct 2016, 05:23 PM
Updated : 5 Oct 2016, 05:23 PM

আমাকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে, থানায়। অপরাধ গুরুতর, মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হতে যাওয়া ছোট্ট শিশুটাকে মেরে ফেলার অপরাধ। আমার শরীরে এখনও বাচ্চাটার রক্ত লেগে আছে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব। থানায় আনার পর থেকে আমাকে দাড় করিয়ে রাখা হয়েছে থানার বাইরের ফাকা জায়গাটায়, একটা গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছে লোহার শেকল দিয়ে, যেন আমি পালিয়ে যাব, বোকা সবাই, পালাতে পারলে কি আমাকে ধরা যেত? আমার চোখে এখনও স্পষ্ট ভাসছে বাচ্চাটার মুখ, কি তুলতুলে কি সুন্দর, মায়ের হাত ধরে কি নিশ্চিন্তেই না রাস্তায় নেমেছিল, পার হচ্ছিল রাস্তা, আমি তো অনেক আগে থেকেই দেখেছিলাম, চিৎকার করে অনেকবার বলেছিলাম, ধীরে চলো ধীরে সামনে দুজন মানুষ, কিন্তু কে শোনে কার কথা, ব্যাটা তখন প্রতিযোগিতায় মগ্ন, আগে তাকে যেতেই হবে, তাতেই যা হবার হল, নিষ্পাপ প্রান ঝরে পরল, রাজপথ রক্তাক্ত আরও একবার। আমার আর কিইবা করার ছিল, চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলেছিলাম শেষ মুহূর্তে, অসহনীয় যন্ত্রণায় বাচ্চাটার করে ওঠা চিৎকার আমার কান ভেঙে খানখান করে দিয়েছিল, আমিও বুঝি হারিয়ে ফেলেছিলাম জ্ঞান, সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিলাম মানুষের চিৎকারে আর কিছু লোক যখন আমার শরীরটা লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিল, কেও কেও আবার কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো, পুলিশ না এলে কি হত কে জানে। দেখলাম রাস্তায় পরে আছে রক্তাক্ত বাচ্চাটা, পাশেই আহাজারিতে ব্যাকুল মা, সবাই আমাকে পেটানো নিয়ে ব্যস্ত, কেও এগিয়ে বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নেবার কথা ভাবছেই না। সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি যতক্ষণে পৌঁছালো ততক্ষনে বাচ্চাটা আর শ্বাস নিচ্ছে না, সব কিছুর উপরে পৌঁছে গেছে ও। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তখন, আমার শরীরের কষ্টগুলো আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। সবাই আমার উপরেই রাগ উগড়ে দিচ্ছে, যেন আমিই প্রকৃত অপরাধী। কাল সমস্ত খবরের কাগজে শিরোনাম হবে "ঘাতক বাস কেড়ে নিলো কচি প্রান অথবা আবারও রাজপথে প্রান নিলো ঘাতক বাস" ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল সে তো পগাড় পার, গাড়ি চালানোর চেয়ে ওরা সময়মত গাড়ির জানালা দিয়ে পালানোটা আরও ভালো করে শেখে। খবরের শিরোনামে নয় তার নামটা আসবে ভেতরের খবরে, নন্দ ঘোষের মত যত দোষ আমার কাধেই। যে ড্রাইভার আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল তার টিকিটাও কেও ধরতে পারবে না আর পারলেই বা কি, ঠিক আইনের মারপ্যাঁচে বের হয়ে আবারও শুরু করবে একই কাজ, আর শাস্তির যা বিধান বর্তমান সেটা গুরু পাপে লঘু দণ্ডের মতই, যেটাকে ভয় পাবার কোন কারন আসলেই নেই। ব্যাটা কেবল গরু গাধা চেনে, আইনও চেনে না মানুষও না, আমাকে চালানোর জন্য যে বয়স, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা, সাবধানতা জ্ঞান থাকা দরকার তার কোনটাই ওর ছিল না, এমনকি ড্রাইভারের লাইসেন্সটা কিভাবে পেলো সে এক বিরাট রহস্য আমার কাছে। ওর আর কি, ইচ্ছামত গাড়ি চালায়, দানবের মত হা করে ছুটে চলে রাস্তায় রাস্তায়, কোন পরোয়া নেই, না তার যাত্রীদের প্রানের না পথচারীদের প্রানের। নাড়ির টানের এবারের ঈদ যাত্রায় বাড়িতে যেতে আবার কর্মস্থলে ফিরতে কত মানুষের প্রান চলে গেল পথেই, হিসেবটা লম্বা হতে থাকে প্রতি বছরই, এগুলো কি শুধুই দুর্ঘটনায় মৃত্যু নাকি হত্যা? যারা ভাবার তারাই ভাবে না আমি আর এতো ভেবে কি করব, আমিতো সামান্য একটা বাস, কোন পরিবর্তন তো আর আমি করতে পারবনা, কেবল প্রকৃত অপরাধীর অপরাধ বয়ে বয়ে বেড়াব।