রোহিঙ্গা এখন শাখের করাত

রিয়েল আবদুল্লাহ আল মামুন
Published : 2 Oct 2017, 07:41 AM
Updated : 2 Oct 2017, 07:41 AM

মানবিক বিপর্যয় নিয়ে পুনঃ যে ভুলটা হলো অর্থাৎ-বাংলাদেশের নোবেল প্রাপ্তির আশায় যে ভুলটা হলো তা অনুধাবনের ক্ষমতা হয়তো আমার নেই, কিন্তু এটুকু বুঝছি চালে একটা বিশাল ভুল হয়ে গেলো। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে কোন মতেই অভিপ্রেত নয়। ক্ষতি হয়ে গেলো আমাদের এই দেশটার। দীর্ঘমেয়াদী একটি যুদ্ধের সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে আসলাম।

বাংলাদেশ এখন এতিম দেশ, যার পাশে এখন আর কেউ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। জাতিসংঘেরও কোন যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত আসেনি। চীন, ভারত, রাশিয়া, মায়ানমার সবাই একসুরে কথা বলছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রও হয়তো তাদের পাশে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের পাশে থাকেও তাতেও কোন ফায়দা আসবে না। আর পাশে উনারা কোনদিন ছিলেনও না ভবিষ্যতেও থাকবে কিনা সন্দেহ আছে।

মানবতা নিয়ে আমরাই কেবল চিৎকার করে যাচ্ছি। আসলে মানবতা নিয়ে সবাই চিৎকার করছি। বাঙালিদের কথা ভাবছি না। বাঙালি যে বিপদে পড়ে গেছে তা ভাবছি না। বাঙালিদের যে সম্মুখে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় অপেক্ষা করছে তার জন্য কারও ভাবনা নেই। এই রোহিঙ্গাদের ভার কেউ নিতে চাইছে না। কোন দেশ নয়। এমনকি ভারতও না। সবাই চাইছে সামগ্রিক চাপ বাংলাদেশের উপর চাপাতে। আর সবাই রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। ইতোমধ্যে তারা একও হয়েছে। তারা একদিকে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুনী রাজনীতিবিদদের তথা সরকারকে বলছে উদ্বাস্তু ঢুকাও অন্যদিকে মায়ানমারকে বলছে সাথে আছি। তারা সাপোর্টও দিয়ে যাচ্ছে। যা কিনা খুব ভয়ংকর। বাংলাদেশের জন্য মর্মান্তিক ও মর্মস্পর্শী।

বাংলাদেশ সরকার ভয়ে হোক আর অপারগতায়ই হোক বা লোভে পড়েই হোক তারা ফাঁদে পা দিয়েছে। যা এখন ধীরে ধীরে তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কাঁটা এমন জায়গায় আটকে যাচ্ছে যে তা এখন খোলাটাই অসম্ভব।

তুরস্ক থেকে এরদোগান পত্নী এলেন- এদের তার দেশে অল্পহলেও নিয়ে যাবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারতেন- তা করেননি। সহায়তায় এগিয়ে এসেছে ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ অথচ তারাও চুপ। অন্যান্য দেশ উদ্বাস্তুদের জন্য সহায়তা পাঠাচ্ছেন কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে অল্প হলেও নিয়ে যাবার কথা ভাবছেন না কেন? সব দায় কি তবে বাংলাদেশের? বাংলাদেশের ভেতরে পুরো মিয়ানমারের লোক রিফুজি বানিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাতেও কোন অসুবিধা নেই। মানবতায় বাংলাদেশ এগিয়ে।

এই রিফুজিদের গ্রহণ করে বাংলাদেশ নিজে যে একটা অসুস্থ দেশে পরিণত হচ্ছে। রোগ শোক নানা সমস্যা তো আছেই। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রোষানলে পড়ছে। এখন সে এই উদ্বাস্তুদের সরিয়ে বা ফিরিয়ে দিতে সে কোন ব্যবস্থাই নিতে পারবে না। মায়ানমারের মতো এদের উপর অত্যাচারও করতে পারবেনা। পুশব্যাক অসম্ভব তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এখন সারাবিশ্ব ভাববে এই উদ্বাস্তুদের তো বাংলাদেশে ঢুকেই গেছে। এ নিয়ে পরে ভাবলেই চলবে এমনেকটা চিন্তা তাদের। তাই তারা তেমন জোর দিচ্ছে না ব্যাপারটি নিয়ে। বর্তমানে তারা মুখে মুখে বালাদেশের ভাল চায়। আসলে তারা সত্যিকারের ভালো কখনোই চায়নি। বাংলাদেশের দরিদ্রতম দেশের তকমা মুছে যাক তা তারা কখনোই চায় না।

এমনিতেই স্বাধীনতার সময়কার দেড় লাখ বিহারী যারা দেশের বিপক্ষ খেটেছেন-তারা আছেন। তা ক্রমাগত বাড়ছেই। তার উপর ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা যা একসময় বড় জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে। এখন যেমন হাসিমুখে তাদের জন্য বাসস্থান গড়ে দিচ্ছি। একটা সময় তা স্থায়ী হয়ে যাবার চেষ্টা করবে যেমন বিহারীগণ কখনোই আর পাকিস্তান ফিরে যাবার চিন্তায় নেই।

তারা নিজেদের স্বার্থটা অবশ্যই আগে দেখবে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একসময় খুনাখুনি করতে দ্বিধা করবে না, কারণ তারা সেই খুনাখুনির গঙ্গা পেরিয়েই এসেছ। কেউ হারিয়েছে বাবা, কেউ হারিয়েছে মা, কারোও বোন হারিয়েছে সম্ভ্রম, স্ত্রী হয়েছে গণধর্ষিত। যদি তারা দেশে ফিরে যেতে না পারে বাংলাদেশেই তাদের থাকার স্থান। এখান থেকে কোনপ্রকার উচ্ছেদ তারা কষ্মিণকালেও মেনে নেবে না। রক্ত দিয়ে হলেও অস্তিত্ব রক্ষা করতে চাইবে। এভাবে দীর্ঘসময় থাকলে তারা যে একসময় তারা নিজেদের আবাসভূমিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসবে। তারা যদিও মায়ানমারে তা পারেনি। এখানে পারবে তার কারণ-

১. শান্তিবাহিনী তাদের সাথে হাত মেলাতে পারে,
২. আভ্যন্তরীণ যারা দেশের স্বাধীনতাকে চায় না বা যারা একাত্তর বিরোধী বা যারা দেশের ভেতরে ইস্যুতে ইস্যুতে গোলযোগ সৃষ্টি করেন
৩. যারা অধিক মানবতাবাধী বা মৌলবাদী —তারা তাদের সাথে হাত মেলাতে পারে। আর

৪. মায়ানমারের পাহাড়ী অঞ্চল আর আমাদের পাহাড়ী অঞ্চল দিনে-রাতে বেশকম। আমাদের পাহাড়ি অঞ্চল তাদের গোলযোগের পাথেয় হতে পারে। যদিও তাদের এ আশা কোনদিন পুরণ হবার নয়।

রোহিঙ্গাদের ভয়াবহ সমস্যায় বাংলাদেশ পাশে দাঁড়িয়েছে। এ উনাদের জন্য আশার কথা। কিন্তু তারা কতটা মান রাখবে? প্রশ্ন থেকে যায়। বিশ্ব পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে-যেভাবে রোহিঙ্গাদের পুশইন করা হচ্ছে- মোড়লেরা যেভাবে আরাকান অঞ্চলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে- যেভাবে বারবার মায়ানমার উষ্কানীমূলক মহড়া দিচ্ছে এর ফলে মনে করুণ একসময় যুদ্ধটা লেগেই গেলো। মায়ানমার বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধের একপর্যায়ে কি রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পক্ষে আসবে? না আসবে না। কারণ তারা চাইবে তাদের ভূমি ফেরত পেতে। তারা তাদের ভূখন্ড উদ্ধারে একসময় মায়ানমারের পক্ষ নেবে বাংলাদেশ যে এতোটা সাহায্য তাদের করেছে তা তারা মনে রাখবে না।

আরেকটি ব্যাপার তারা মায়ানমারে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারলেও এখানে পারবে। মায়ানমারের ভয়ে তাদের কেউ অস্ত্র সরবরাহ করেনি। বাংলাদেশের শত্রু অনেক। উনারা নিজের মনে করে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র সরবরাহ করবে।

তাদের জন্য যেভাবে ত্রাণ যাচ্ছে। সেভাবে তাদের জন্য ফান্ডও তৈরী হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সরকার ফেরাতে পারবে না। তারা যে পারবেনা তার বড় কারণ বাংলাদেশে ঠিক কতজন রোহিঙ্গা আছে বাংলাদেশ সরকার তা জানে না। বিশাল জনগোষ্ঠী এই জনগোষ্ঠীর হিসাব রাখা জরুরি ছিলো। সরকার তা করেনি।

মাননীয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ চীন ভারতের আচরণ নিয়ে আক্ষেপ করেন। অথচ আজ যদি বাংলাদেশের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না দেয়া হতো, নোম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষায় রাখা হতো, ওখানেই মানবতা পালনে যা যা করার করা হতো তাহলে একথেকে দেড়মাস চলে যেতো না- সারাবিশ্বে আলোড়ন হতো জাতিসংঘ অনুসিদ্ধান্ত নিতে পারতো, রোহিঙ্গারা তাদের দেশে দ্রুত ফিরে যাবার পথ পেত। তা হলো না। এ আমাদের কূটকৌশলের মারাত্মক ভুল। এটা অবশ্যই আমাদের ভুল।

আমরা যে ভুল করেছি তার মাশুল আমাদেরই দিতে হবে। শাখের করাত কাধে নিয়েছি এযে দু'দিকেই কাটবে। এখন শুধু রক্ত ঝরার জন্য অপেক্ষা। দেখা যাক কি হয়। তবে এও মনে করছি বাংলাদেশ প্রস্তুত আছে যাবতীয় সমস্যা দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা করার। জয় হোক বাংলাদেশের।

  • কবি ও সম্পাদক