ইয়ামুসুক্রুর কুমির, কুমিরের ইয়ামু সুক্রু

রেজাউল মাসুদ
Published : 21 Nov 2012, 07:04 PM
Updated : 21 Nov 2012, 07:04 PM

আবিদজান হলো আইভরিকোষ্টের পলিটিকাল রাজধানী আর ইয়ামুসুক্রু হলো ইকনমিক্যাল রাজধানী,যদি প্রশ্ন করা হয় আইভরি কোষ্টের রাজধানী কোনটি,তাহলে উত্তর হবে ইয়ামুসুক্রু।এই ইয়ামুসুক্রুতই রয়েছে বিশ্বের সর্বঃবৃহৎ ব্যাসেলিকা নটরডেম দো লা পে (ব্যাসলিক দি পিস অফ আ্উয়ার লেডি) এই ব্যাসলিক সম্পর্কে অন্যদিন লেখার পরিকল্পনা রয়েছে।এখানে রয়েছে নান্দনিক ডিজাইনের তারকা বিশিষ্ট বহু হোটেল রেস্টুরেন্ট,মনোমুগ্দকর কারুকার্যঃময় পার্লামেন্টারী ভবন,একটু অদুরে স্বর্ণের খনি ইউরেনিয়াম খনি,বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, সুবিশাল গলফ খেলার নান্দনিক মাঠ ও ব্যানএফপিইউ২ সহ আরোও বহু দর্শঃনীয় পর্যঃটন স্হান ।

ভ্রমণ বিলাসী লোকদের কাছে এ রাজধানী শহর আরো যে কারণে পছন্দের প্রথম তালিকায় থাকে তা হল প্রেসিডেন্ট প্যালেস আর সাথে ক্রোকোডাইল ফার্মঃ ইয়ামুসুক্রু সিটির আকর্ষঃনের মূল কেণ্দ্রবিন্দু এই প্রেসিডেন্ট প্যালেসটি শহরের কেণ্দ্রস্হলে ৮২০ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত।গরীর দেশের এই প্রেসিডেন্ট প্যালেস দেখলে মনে হবেনা এখানে কোন দারিদ্রতার ছাপ আছে,হয়তবা এটাও ফ্রান্সের একধরনের পলিসি,শাসন কর্তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে তাদেরকে ভোগবিলাস ও আরামে রাখতে হবে।পুরো প্যালেসের চারদিকে ১০ ফুট উচু বাউন্ডারী এবং তা হেটে একবার ঘুরে আসতে দেড় ঘন্টা সময় লাগে এবং দুরত্ব হয় ৬.৩ কিমি ,পুরো প্যালেসের নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে আইভরিয়ান এফ আর সি আই রিপাবলিক গার্ডঃ।এখানে প্রেসিডেন্ট থাকেন না ,তিনি থাকেন আবিদজান শহরে,জানা যায এ প্রসাদ প্রথম প্রেসিডেন্ট বগ্নী এর সময় তৈরী করা হয়েছিল।এই প্যালেসের সামনের পুরো অংশ জুড়ে রয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যের নজর কাড়া লেক,মাঝের একটি রাস্তা লেককে দুই ভাগে ভাগ করে আরও দৃষ্টিনন্দন করেছে।

এই রাস্তা দিয়েই মূল প্যালেসে ঢুকতে হয়।এই প্রেসিডেন্ট প্যালেস আরও যে কারণে ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের কাছে আকর্ষণীয় তা হলো লেকে অবস্হান করা হাজার হাজার কুমির।পুরু লেক জুড়ে চাষ করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির শত সহস্র কুমির। এখানটায় আসার আগেই এই কুমিরের গল্প শুনেছি,এত বিশাল আয়তনের একটা লেক হবে আর সেখানে এত বেশী সংখ্যক কুমির থাকবে এটা ভাবনার অতীত ছিল।

প্রেসিডেন্ট প্যালেসে ঢুকার মুখেই দেখা মিলবে এই লেকের,আর যে কেউ খুব সহজে দেখতে পাবে শত শত কুমির পানি ছেড়ে ডাঙায় উঠে আছে, একেকটা বিশাল আকৃতির ও প্রকান্ড সাইজের বিভিন্ন কালারেরও দেখা যায়।অনেক সময় বাচ্চা কুমির সহ পুরো ফ্যামিলি উপরে উঠে আসে,তবে দল বেধে পানি ছেড়ে উপরে উঠতে তা আবহাওয়া ,খাওয়া প্রাপ্তি ও তাদের মেজাজ মর্জির উপর অনেকটা নির্ভর করে।পর্যঃটকদের ভাল ভাবে দেখা ও নিরাপত্তার জন্য লেকের চতুর্পাশে মোটা গ্রীল দিয়ে নান্দনিকতায় সাজানো আছে।পুরো লেক জুড়েই এরকম কুমির দেখতে পাওয়া যাবে।তবে প্রসাদের একদম গেটের মুখে যেখানে পর্যটকদের ভীড় সবসময় লেগেই থাকে ওখানে নাকি সবচেয়ে বেশী কুমির সবসময় দেখা যায়।

জানা যায় এখানকার কুমির গুলো খুবই শান্ত প্রকৃতির।বদ্ধ পানি ,সময় মত খাবার প্রাপ্তি ,কেয়ারটেকারদের টেক কেয়ার ও পর্যঃটকদের প্রত্যাশা মিটানোর জন্যই হয়তবা এরকম হয়ে থাকে।আমরা যখন প্রথম এই কুমির দেখার প্রজেক্ট হাতে নিই ,মনে মনে একটা ভয় ও উত্তেজনা কাজ করছিল, তার কারণ ছিল নিজ হাতে নাকি কুমির কে খাবার খাওয়ানো্ যায়,অনেকটা চিটাগাংএ বায়েজীদ বোস্তামীর মাজারের কাছিম এর মত অথবা আমাদের জামালপুরের শৈলেরকান্দা পীরের বাড়ীর দীঘি তে মাছ দের খাবার খাওয়ানের মত।

আমরা যথারীতি প্যালেসের মূল গেটে গেলাম কুমির কে খাওয়ানোর দৃশ্য দেখার জন্য,দেখলাম কুচ কুচে কালো ও একটু মোটা টাইপের একটা লোক একদম লেকের ভিতরে কুমির দের একেবারে কাছে চলে গেল ,আর তার হাতের একটা লাঠি দিয়ে কি যেন ইসারা করল সাথে সাথে দল বেধেঁ সব কুমির পানিতে নেমে গেল ।পরে জানতে পারলাম এই লোকটিই এখানকার কেয়ারটেকার ,উনাকে সব কুমির নাকে চেনে।আবার ইসারা ও একধরনের বিশেষ শব্দ করলে কুমির গুলো নাকি ডাঙায় উঠে আসে।

যাই হউক কুমির কে খাওয়ানের দৃশ্য দেখতে হবে,এখন কথা হলো কুমিরদের খাবার কি, আমরা সেটা দেখার জন্য আরোও ভিতরে গেলাম,ওখানে এন্ট্রির নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্হা করা আছে ,যে কেউ ভিতরে ঢুকতে পারবেনা তাকে ঢুকতে হলে দুই থেকে আড়াই হাজার ছিপা (আইভরি মুদ্রার নাম/বাংলাদেশী তিনশ/সাড়ে তিনশ টাকা) য় একটা পুলে কিনতে হবে এবং তা হবে জ্যান্ত,আর এই পুলে গুলোই হল কুমিরের খাবার,

জ্যান্ত পুলে গুলো কুমির দের উপর ছুড়ে ফেলে আর তা তারা সাথে সাথে মিষ্টি খাওয়ার মত এক ঢুকে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্নঃ হয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকে ,এদিকে পুলে গুলোও বাচার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা আর ছুটোছুটি করেও শেষ রক্ষা হয়না।কি করুন দৃশ্য একজনের উদরপূর্তি আর অপরজনের বাচার আকুতি ও মরণ খেলা,আর আমরা পর্যঃটক গনও তা দেখার আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠি এবং মজা করে এ দৃশ্য উপভোগ ও ক্যামেরা বন্দী করে রাখি।

সেদিনের ইয়ামুসুক্রুর প্রেসিডেন্ট প্যালেস আর ক্রোকো ডাইল ফার্মের কুমিরের খেলা দেখে কিছুটা আনন্দ ও অনেকটা বিষাদভরা মন নিয়ে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসি,কিন্ত গত ২০ আগষ্ট কুমিরের যে খেলার খবর শুনলাম তা শুধু বিষাদেরই নয় কষ্টের দুঃখের এবং নির্মঃম ও ভয়াবহ পরিণতি বাবা হারানো এক সন্তানের করুন আর্তঃনাদের আর তা হলো সেই ৭০বছর বয়স্ক আইভরিয়ান যিনি আমাদের ইউ এন অফিসার হিসাবে ছিপা ছাড়াই খুব কাছ থেকে কুমিরের মুরগী খাওয়ার খেলা দেখার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন এবং যিনি ৩০ বছর যাবৎ এই কুমির গুলোর দেখভাল ও শত শত পর্যঃটকদের খেলা দেখিয়ে আনন্দ দিতেছিলেন তিনি ঐ দিন কুমিরগুলোকে খাবার দেওয়া ও খেলা দেখানোর সময় হাজার হাজার মানু্ষের সামনে নিজেই সেগুলোর খাদ্য হয়ে গিয়েছিল,কি করুন পরিণতি বাচাঁর শত চেষ্টা করেও তিনি শেষ রক্ষা পায়নি এবং তাকে দাফন করার মত এক টুকরা মাংস পিন্ডও কুমির গুলো অবশিষ্ট রাখেনি।

(মুহাঃ রেজাউল মাসুদ)