এক সময় গরু হারিয়ে যেতো এবং তা নিয়ে অনেক গল্প তৈরি হত। ওসব গল্পের ডালপালা শাঁখা প্রশাখার বিস্তারের ফলে একটি প্রবচন চালু হয়ে যায়; 'যার গরু হারায় তার ঈমান যায়'। একজন কৃষিজীবী মানুষ যখন তার সম্বল, জীবিকার অবলম্বন গরু হারায়; তখন সে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। যার কাছে যে সংবাদ পায় সেটাই সে শুনে বিশ্বাস করে সেদিকেই পাগলের মতো দৌড়ায়।
ঝাড়ফুঁক, মাধুলীপড়া, পানিপড়া নেয়া থেকে শুরু করে চোরপারা, খাল পাড়, মোড়লবাড়ি, গরুর বাঁধাই ঘর (এক ধরনের গবাদি পশুর জেলখানা, অন্যের ক্ষেত খেয়ে ফেললে গ্রামের মানুষ একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির জিম্মায় বেঁধে রাখত, মালিক এসে জরিমানা দিয়ে ছাড় করিয়ে নিতে পারতো)।
সম্ভাব্য সবখানে খোঁজা খুঁজি চলতো দিনের পর দিন। পাড়ায় পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে যেতো, "জরিনার বাপের শেষ সম্বল লাল গরুটি হারিয়ে গেছে"। গ্রাম দেশে অনেক হামদর্দি মানুষ নিজ উদ্যাগে খোঁজ খবর নিত, অসহায় মানুষটির কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো। অনেক সময় দূর গ্রাম থেকে খবর আসতো গাঙের পাড়ে একটি লাল গরু দেখা গেছে। অমনি সেদিকে দৌড়ে যায় সেই গরু হারা অসহায় মানুষটি।
কোথাও দলছুট কোনও গরু দেখলে মাতব্বরের গোয়ালে মানুষ গরুটি জমা দিতো, মাতব্বর চারিদিকে খবর দিতো। এক সময় ছুটে আসতো সেই গরুর মালিক। গরুর আকার, ধরন, গাত্রবর্ণ এমনকি দাঁতের সংখ্যা পর্যন্ত বলে যাচাই-প্রমান দিয়ে সেই গরু নিতে যেতো।
এখন হারিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বৃক্ষ, নাম ফলক । হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। গ্রাম থেকে, শহর থেকে। দিনের আলোয় কিংবা রাতের আঁধারে মানুষ গুম হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত… কে কার গরুর খবর নেয়…
… একরাতে একটা গাছ গুম হয়ে গেলো;
তখন জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো;
কেউ গা-করেনি;
সবাই ব্যস্ত।
একরাতে একটা নামফলক গুম হলো;
পরের দিন অন্য একটা লাগলো;
অনেকে লক্ষ্য করেনি;
সবাই ব্যস্ত।
একরাতে দু-টু ছেলে হারিয়ে গেল,
পাড়ার সবাই ভাবল কোথাও বেড়াতে গেছে;
ক-দিন পর নদীতে শব হয়ে ভেসে উঠে;
সবাই ব্যস্ত।
মানুষ কি পালাক্রমে এভাবে হারিয়ে যাবে? বড় নেতাদের জন্য হাঁকডাক, হরতাল হয়, জ্বালাও পোড়াও হয়। গাড়ী পোড়ে, পোড়ে অসহায় মানুষ। রাষ্ট্রীয় যান মালের ক্ষয় ক্ষতি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যায়।
এ যেন নিখোঁজ নিখোঁজ মরণ খেলা। নিম্ন বর্গ অসহায়, দলহীন মানুষ হারিয়ে যায়, তার খবর কেউ নেয় না।