জিপিএ ফাইভমুখী ‘সৃজনশীল’ শিক্ষাব্যবস্থা

সঞ্জয় দে
Published : 7 Sept 2011, 09:00 AM
Updated : 1 June 2016, 11:40 AM

আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের একটি হল ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছয় বছরের শিক্ষকতার সময়টুকু। ২০০৪ সালে প্রথম যেদিন ক্লাসে যাই, সেদিনের কথা এখনও পরিষ্কার মনে করতে পারি। নতুন শিক্ষক হিসেবে আমাকে পাত্তা দিতে খুব একটা আগ্রহী ছিল না কোনো শিক্ষার্থী। বুঝতে পারছিলাম ওদের রাজ্যে আমার প্রবেশ অনেকটা অনাহুত ব্যক্তির মতো। কলেজে পড়ার প্রায় দেড় যুগ পর আবার কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করে অনুভব করছিলাম এই সময়ের ব্যবধানে কতটা বদলে গেছে তারুণ্যের মনোজগত, তাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তার ধারা। পরিবর্তনের এই ধারা বাইরে থেকে হয়তো কিছুটা অনুভব করা যেতে পারে, কিন্তু প্রজন্মের রূপান্তর কোনোভাবেই তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না থেকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা অসম্ভব।

আমার শিক্ষকতা জীবনের পরের কয়েকটি মাস শুধু কেটেছে নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে। তারুণ্যে পা দেওয়া শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের চেষ্টার এই সময়গুলো একদিকে যেমন ছিল খুব কঠিন, অন্যদিকে দারুণ উপভোগ্য। ব্যক্তিগত জানা এবং ক্লাসে জানানোর পদ্ধতি যে একেবারে আলাদা সেটি আমাকে শিখতে হয়েছে। এই পরীক্ষায় উৎরাতে গিয়ে নিজের কাছে সবচেয়ে যে পদ্ধতি আকর্ষণীয় ও কার্যকর মনে হয়েছে সেটি হল, নিজেরও ছাত্র বনে যাওয়া এবং ক্লাসে একটি পারস্পরিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা।

ছয় বছরের শিক্ষকতা জীবনে আমি মেধাবী, তুখোড় ও অনবদ্য অসংখ্য সদ্য তরুণের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাদের সবাই আমাকে গ্রহণ করেছে কি না জানি না, তবে অনেকেই আস্থায় নিতে পেরেছে বলে আমার ধারণা। সবচেয়ে বড় কথা, এই পুরোটা সময়ে দারুণভাবে শেখার সুযোগ ঘটেছে আমার।

প্রথম দিকের একটি কথা মনে পড়ছে। সাহিত্যের ক্লাসে মনোযোগ তৈরির জন্য নানান বিষয়ে গল্প শোনানোর ফন্দি বের করতাম। একদিনের পরিকল্পনা ছিল, 'হৈমন্তী' গল্পটি পড়ানোর সময় ক্লিওপেট্রাকে আলোচনায় রাখব। আলোচনা শুরুর জন্য প্রশ্ন রেখেছিলাম, সর্বকালের সেরা সুন্দরী হিসেবে কাদের বিবেচনা করা হয়। যে ছেলেটি তখনও আমাকে নাস্তানাবুদ করার পায়তারায় ছিল, তাৎক্ষণিক তার জবাব, ''স্যার, যে যাকে ভালোবাসে সেই তার কাছে সর্বকালের সেরা সুন্দরী।''

আকস্মিক এই জবাবের জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, এর চেয়ে ভালো জবাব আর কিছু হতে পারে না। সেই ছেলের সঙ্গে আমার দারুণ সম্পর্ক সেই থেকে গড়ে ওঠে, ও খুব চঞ্চল ছিল কিন্তু বশ মানানোর পদ্ধতিও আমি জেনে গিয়েছিলাম।

শিক্ষকতা জীবনের প্রথম চার বছর যাদের একাদশ শ্রেণিতে পেয়েছি তারা সবাই মাধ্যমিকে সাধারণ শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে এই পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তবে শেষ দুই বছর যাদের পেয়েছি তারা কয়েকটি বিষয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে। এই পদ্ধতি চালুর পর যাদের পেলাম তাদের ক্ষেত্রে খুব পরিষ্কার একটি পরিবর্তন দেখা গেল। এই শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রেই মনে হচ্ছিল তাদের বিশ্লেষণী ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে। কোনো একটি বিষয়ের নানা দিক নিয়ে বোঝায় তাদের অনাগ্রহ বাড়ছে, অনেকরই ঝোঁক কী করে নম্বরপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

এর মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও কিছু পরিবর্তন ঘটছিল, পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা 'উদারভাবে' নম্বর দেওয়ার 'পরামর্শ' পাচ্ছিলেন, এই 'পরামর্শ' মেনে না চললে মৃদুমন্দ শাস্তিও পাচ্ছিলেন অনেকে। পরীক্ষায় পাসের হার 'সন্তোষজনক' না হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থাগ্রহণ জোরদার হচ্ছিল।

এতে পরীক্ষায় ফলাফলে ব্যাপক 'উন্নতি' ঘটতে শুরু করে এবং যারা এই ফলাফল নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে আসছিল তাদের মধ্যে 'বিবর্ণতার' মাত্রা ছিল চোখে পড়ার মতো। সৃজনশীল 'প্রকল্প' নিয়ে গালভরা কথার বন্যা বইলেও বাংলাদেশে এটা সত্যিই কতটা কার্যকর হচ্ছে, সে বিষয়ে আমি তখন থেকেই সন্দিহান।

পাশাপাশি 'রাজনৈতিক' ফলাফলে সরকার কতটা লাভবান হয় জানি না, কিন্তু এর ভয়াবহতায় এ কালের তারুণ্যের শক্তি যে ধ্বংস হচ্ছে, সেটি বোধহয় সরকারের আমলে নেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীরা পরিণত হচ্ছে সমাজবিচ্ছিন্ন সত্তায়। 'ভালো' ফলাফলের ঢলের প্রভাব দুধরনের শিক্ষার্থীর ওপরেই পড়ছে। প্রথমত, এক দল পরিশ্রম ছাড়াই এই ফল লাভ করছে; অন্যদিকে পরিশ্রমী শিক্ষার্থীও আগ্রহ হারাচ্ছে পড়ালেখার 'কষ্ট' করার প্রতি।

আর একটি সমস্যা যেটি অনেকেই মানতে চাইবেন না সেটি হল, ভর্তিপরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেওয়া। এ বিষয়ে সরকারের প্রধান যুক্তি, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করা। কোচিং-বাণিজ্য আদতে বন্ধ হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই, বিভিন্ন ফর্মে সেটি বরং আগের চেয়ে জোরদার হয়েছে। উল্টোদিকে ভর্তিপদ্ধতি তুলে দেওয়ার ফল হল, যেসব প্রতিষ্ঠান আগে ভালো শিক্ষাদানের জন্য পরিচিত ছিল তারা এখন ফলাফলের ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে।

এর ফলে এখন ক্লাসে পরিশ্রমী জিপিএ ফাইভধারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তি হচ্ছে পরিশ্রমবিমুখ অনাগ্রহী শিক্ষার্থীরাও। এই অনাগ্রহীরা ভালো প্রতিষ্ঠানের পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হোক, এটা বলার উদ্দেশ্য আমার নেই, বরং সুযোগ পেয়ে তারা ভালো করলে ভালোই হত। বাস্তব চিত্র হল, অনাগ্রহীদের সঙ্গে ক্লাসে থেকে আগ্রহ হারাচ্ছে পরিশ্রমীরাও। ফলে উত্তরপত্রে উদার নম্বর দেওয়ার 'পরামর্শ' অব্যাহত থাকার পরেও এসএসসি এবং এইচএসসির ফলাফলে মাত্রাগত পরিবর্তন ঘটছে।

দিন যতই যাচ্ছে শিক্ষাক্রম বাজারমুখী করার ফলও ভোগ করছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকতার ছয় বছরেই দেখেছি বইয়ের আমূল পরিবর্তন। ইরেংজি বই থেকে উধাও হয়েছে গল্প-কবিতা, সেখানে এখন শেখানো হয় শুধু কথা বলার উপায় (সম্প্রতি অবশ্য কয়েকটি আবার যুক্ত হয়েছে)। বাংলা বইয়ের যে মানবিব গল্প– 'সৌদামিনী মালো' পড়ে শিক্ষার্থীরা উদ্দীপ্ত হত সেটি বাদ পড়েছে ওই সময়েই। পরে হারিয়ে গেছে হৈমন্তী, শকুন্তলা, একটি তুলসী গাছের কাহিনীর মতো গল্প। বাজারমুখী এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী 'এককেন্দ্রিক' হয়ে পড়লে দায় তার নয়, বরং এর দায় রাষ্ট্র ও রাজনীতির। বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থেই তারুণ্যকে হেয় ও সঙ্কীর্ণ করার এই ব্যবস্থাপনার পুনর্মূল্যায়ন দরকার।

সম্প্রতি শিক্ষার মান নিয়ে একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকতার নৈতিকতা কতটা অনুসরণ করা হয়েছে, তা নিয়ে চলছে তুমুল বিতর্ক। এ বিতর্ক চলুক, কিন্তু শুধু এই বিতর্কেই আটকে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার সংকটটি চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আমাদের এ-ও মনে রাখা দরকার যে, সংবাদ মাধ্যমে কোনো প্রতিবেদন হোক বা না হোক লাখো কিশোর-তরুণ শিক্ষাব্যবস্থায় যে অমর্যাদার ঝুঁকিতে রয়েছে তা নিয়ে পর্যালোচনার সময় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে।