মানুষের কাছে হাত পেতে চলছে পঙ্গু চাঁন মিঞার জীবন

রিফাত কান্তি সেন
Published : 15 Dec 2016, 02:02 AM
Updated : 15 Dec 2016, 02:02 AM

পা নেই, তবু জীবন থেমে নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে সংসার ও চিকিৎসা খরচ চালান চাঁনমিঞা মুন্সি। চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর গ্রামের মুন্সি বাড়ির আবদুল গফফুর মুন্সির ছেলে চাঁনমিঞা মুন্সি। আজ থেকে সতেরো বছর আগে ডোবায় জাল মারতে গিয়ে ডোবায় পড়ে থাকা মরিচাযুক্ত 'গজাল' তার পা দিয়ে ডুকে যায়। ততক্ষণাৎ টিটিনাস ইনজেকশণ না দেয়ার কারণে তার পেট, পা সহ সমস্ত শরীর ফুলে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা করান চাঁনমিঞা।

পেট অপারেশন করতে পারলেও তার পা কে আর রাখা যায় নি। কেটে ফেলতে হয় ডান পা! আর সে থেকেই নতুন এক জীবন যুদ্ধে নামতে হয় চাঁনমিঞাকে।

"বাজান খুব কষ্ট কইরা জীবন চালাই। শরীর একটা অঙ্গ না থাকলে ক যে কষ্ট বুঝাইতে পারুম না। 'মানুষের কাছে হাত পাততে খুবই লজ্জা লাগে। কিন্তু কি করমু চিকিৎসা খরচ চালাইতে গিয়া আমার সয়-সম্পদ সবই বিক্রি কইরা দিছি। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থিকা টাকা উঠাই। বউ, পোলা, মাইয়া লইয়া খুবই কষ্টে আছি বাজান। আমাগো কথা কেউ হুনে না। গরীবের কথা কেউ হুনতেও চায় না। প্রতিবন্ধী ভাতা পনের'শ টাহা পাই। তা দিয়া, খুঁইজা, মানুষের কাছে ছোট হইয়া সংসার চালানোর তাগিদে হাত পাতি।"

"এক ছেলে, এক মেয়ে আমার। মাইয়াডারে এসএসসি পরীক্ষা দেয়াইছিলাম। পাস করে নাই! পরে বিয়া দিয়া দিছি। জামাইর অবস্থা ভালা না। শেখের বেটি দশ টাকা সেরের চাল দিছে সেই কার্ড মাইয়ারে দিয়া দিছি। গরীবের শান্তি নাই বাজান। বউডার শরীর বেশি ভালা না। অনেক রোগ শরীরে। ডাক্তার কইছে উন্নত চিকিৎসা করাইতে হইবো। কই পামু অত টাকা?"
"কত মানুষ কত মন্তব্য করে। বাজান এই প্রথম কেউ আমার জীবনের গল্প হুনতে চাইলো। আপনেরে আল্লায় বাঁচাক" বলেই কেঁদে ফেললো পঙ্গু চাঁন মিঞা।

ছেলেকে বেশীদূর পড়ালেখা করাতে পারেন নি চাঁনমিঞা। অর্থের অভাবে ছোটকাল থেকেই সংসারের হাল ধরতে কাজে লেগে পরেন ছোট্ট ছেলে রাসেল। কখনো সিএনজি কখনোবা পরের দোকানে কাজ করে সংসারে বাবার সাথে হাল ধরার প্রাণবন্ত চেষ্টা করে চলেছেন ছোট্ট রাসেল।

চাঁনমিঞা বলেন, "আমাকে যদি প্রশাসন কিংবা কোন বিত্তশালী ব্যক্তি কিছু সাহায্য করে একটি ব্যবসায়ের ব্যবস্থা করে দেন তবে আমি আর মানুষের কাছে হাত পাতবো না। গত ১৭ বছর ধরে লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে কত মানুষের নিকট হাত পেতেছি। এবার নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারলেও মানুষিকতার পায়ে দাঁড়াতে চাই।"


'প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে, জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে।' পত্রিকার পাতায় প্রতিদিনই কত খবর আসে যায়। হয়তো আসে না ছুটে চলা এসব নিরীহ মানুষের জীবনের অকৃতিম সংগ্রামের গল্প। পঙ্গু শরীর নিয়ে আর পারছেন না মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ঘুরতে। ক্লান্ত শরীর এখন আর চলে না।

জন এন্ডারসন তার এক বিখ্যাত বাণীতে বলেছেন, "যে নিজেকে অক্ষম ভাবে, তাকে কেউ সাহায্য করতে পারে না।"

চাঁনমিঞা কখনো নিজেকে অক্ষম ভাবেন নি। ছুটে চলেছেন আপন গতিতে। পঙ্গু হয়েও নিজেকে অক্ষম না ভাবা চাঁনমিঞার দিকে বিত্তবানদের যেমন এগিয়ে আসা উচিত, তেমনি প্রশাসনেরও উচিত চাঁনমিঞার মত এমন পঙ্গু মানুষের পাশে সেবার হাত বাড়িয়ে দেয়া।