একটি জিপিএ ফাইভ ও আমাদের হীনমন্যতা!

রিফাত কান্তি সেন
Published : 1 Jan 2018, 04:05 AM
Updated : 1 Jan 2018, 04:05 AM


তোমাকে পেতেই হবে জিপিএ ফাইভ নয়তো মান আছে যা তা যাবে মোর। জিপিএ ফাইভ মানেই জীবনের সফলতার একটা প্রথম ধাপ। এটা যেন অভিভাবক, শুভানুধ্যায়ী, সকলের প্রত্যাশা। এতে করে সমাজে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য, হীনমন্যতা আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা হলেও এখন তা অনেকটাই সার্টিফিকেট অর্জনের হাতিয়ার হয়ে গেছে। প্রথম শ্রেণি থেকেই দেখলাম অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু। প্রথম প্রতিযোগিতা, 'ভর্তি যুদ্ধ'। এরপরই প্রতিযোগিতায় নামতে হয় কে কত বেশি নম্বর পেয়েছে, কার গ্রেড কত ভাল। অনেক অভিভাবক, শিক্ষার্থী ভাবে, জিপিএ ফাইভ পাওয়া মানে ভবিষ্যতের টার্নিং পয়েন্ট। এতে করে রাতদিন মুখস্তবিদ্যা অর্জন করে জিপিএ ফাইভ পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা।

আমার এক আত্মীয় আছে যার সন্তান দামী একটি স্কুলে পড়ে। পড়ালেখার প্রতি এতো বেশি চাপ যে অনেক সময় নাকি খেতেও সময় পায় না ওনার সন্তানটি। ভোর থেকে কোচিং, প্রাইভেট আর স্কুল শেষে বাসায় ফেরে ক্লান্ত দেহ নিয়ে, আবার ভাল রেজাল্ট করার তাগিদে বই নিয়ে পড়তে বসে পরা। অনেকটা যেনো গাঁধার পিঠে বোঝা চাপিয়ে দেয়া আর গাঁধার নির্বাক-অসহায়ের মত সে বোঝা টানা।

আমরা কী একবারও সন্তানের কথা ভাবছি? আমরা চাই আমাদের সন্তান জিপিএ ফাইভ পাক, আমরা চাই না আমাদের সন্তানটা ভাল মানুষ হোক। প্রথম শ্রেণি থেকে আমাদের শিশুদের যে প্রতিযোগিতায় নামানো হয় সেটা নিয়েও আমার বড়ই ক্ষোভ মনে পোষিত হয়। যে বয়সে শিশু আনন্দে বেড়ে উঠার কথা; সে বয়সেই পড়ার চাপে ভর করে যেন জীবন যায় যায়। জোর করে মাথায় ঢুকানো হয় পড়া। অভিভাবকদের সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে বড়ই চিন্তা; সে চিন্তার মহাঔষধ 'জিপিএ ফাইভ'।

আমি একটি স্কুলে পার্টটাইম চাকরি করি। সেখানকার অনেক শিশুদের মনের ভাব আমি বুঝতে পারি। আমি চাই না তারা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামুক। ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হল। অনেকে পাস করেছে আবার অনেকে ফেল করেছে। আমার কাছে অনেক শিক্ষার্থী ফলাফল জানার জন্য উৎকন্ঠা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনেছে। সকাল সকাল একজন শিক্ষার্থী জানালো, রেজাল্ট খারাপ হলে তার বাবা তাকে অনেক বকা দেবে। সে খুবই চিন্তিত এবং মনে খুবই কষ্ট অনুভব করছে।যদি রেজাল্ট খারাপ হয়!ভাগ্যের কী লীলাখেলা সে ঠিকই রেজাল্ট খারাপ করে বসেছে। অমনি হয়তো তার পরিবারের পক্ষ থেকে বকুনি শুরু হয়ে গেছে।

আশ্চার্য একটা তথ্য পেলাম। সন্তানের রেজাল্টের উপর নাকি পরিবারের সম্মান নির্ভর করে! অনেকটা যেন জোরদারি কথাবার্তা। খুব কষ্ট লাগলো এভেবে যে প্রতিটি অভিভাবক যেন এক একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাঠ তৈরি করছে। প্রতিযোগী হিসেবে মাঠে নামাচ্ছে সন্তানদের। কেনো সন্তান জিপিএ ফাইভ পেলো না এ নিয়ে যেন সন্তানকে একটি মানসিক চাপের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।

আরেকজন তো ১০০ ভাগ শিউর হয়ে আছে যে সে খারাপ রেজাল্ট করলে বকা নির্ঘাত। লজ্জ্বার যেন সূত্রপাত একটি খারাপ রেজাল্ট। রেজাল্ট দিলো, পাসও করলো, কিন্তু মন খারাপ তার থামেনি। মন খারাপের কারণটা হল, আরো ভাল রেজাল্ট করা দরকার ছিল। এ কষ্ট থেকে তৈরি হতে পারে মানসিক কোন রোগ। আর এ রোগের মূল কারণটা কিন্তু আমরাই।

আমরা যারা এ পর্যায়টা পার হয়ে এসেছি তারা নিজেদের খুব বিদ্বান মনে করে থাকি। দাম্ভিকতার মারপ্যাঁচে আমরা ছোট করে দেখি অন্যের বিফলতাকে। আসলে আমরা সকলেই সফলতার চাদরে মুখ লুকাতে চাই। আমরা ভুলেই যাই, 'ব্যার্থতাই সফলতার চাবিকাঠি'। আমরা শিশুদের শিক্ষা দেই শুধু সফল হতেই হবে; আসলে যে ব্যার্থ হয়নি সে সফল হবে কী করে? সে বিদ্যাটা কখনোই শেখাতে চেষ্টা করিনি। যতটুকু বুঝেছি সার্টিফিকেট কামানোর জন্যই সন্তানদের স্কুলে পাঠান অভিভাবকরা। আরে ভাই সন্তান যদি ভাল মানুষ না হয় তবে ভাল সার্টিফিকেট দিয়ে কী করবেন? প্রশ্নটা রেখে গেলাম সচেতন মহলে।

আজ যারা পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় পাস করেছো তাদের জন্য অভিনন্দন। যারা অকৃতকার্য হয়েছো তাদের জন্যও অভিনন্দন।

রিফাত কান্তি সেন
শিক্ষক, কড়ৈতলী উচ্চ বিদ্যালয়।