ফায়ারওয়ার্কস/আতশবাজী সমাচার

রিপেনডিল
Published : 20 March 2012, 05:39 AM
Updated : 20 March 2012, 05:39 AM

চাইনীজদের মাথার গ্রে ম্যাটারটা মনে হয় স্পেশালভাবে বানানো! আমরা আজকের যুগে যে গোলা বারুদ, এক্সপ্লোশন, রকেট ইত্যাদি দেখছি এসব কিছুর হাতেখড়ি হয়েছে এই চাইনীজদের ফায়ারওয়ার্কস আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই!

ইতিহাসঃ
ধারনা করা হয় ফায়ারওয়ার্কস এর জন্ম হয়েছিল ১০ম শতাব্দীতে সঙ ডাইনাস্টি আমলে। এই সময়ে নানা রকম উৎসবে দারুন ফায়ারওয়ার্কস ব্যাবহার করা হত। খোলা বাজার থেকে সবাই কিনতে পারত। ফায়ারওয়ার্কস কারিগরদের রাষ্ট্র থেকে বিশেষ সম্মান দেয়া হত, সাধারন মানুষ তাদের বিশেষ গুপ্তজ্ঞান এর অধিকারী ভাবত! সম্রাট হুইজিং সঙ এর আমলে সেই সময়কার সবচেয়ে বড় ফায়ারওয়ার্কস এর আয়োজন করা হয়। পরবর্তিতে এই সঙদের আমলেই যুদ্ধক্ষেত্রেও এই জ্ঞানকে কাজে লাগানো হয়, কিভাবে লাগানো হয় সেটা এনিমেশন মুভি কুংফু পান্ডা -২ দেখলে বুঝবেন!

চায়নীজরা আসলে জ্ঞানবিতরনে পক্ষপাতী কখনোই ছিল না। তাই অনেককাল যাবত তাদের ফায়ারওয়ার্কস এর গোপন রহস্য কেউ জানত না। পরে আরবরা ১২৪০ সাল এর দিকে চায়না থেকে এই জ্ঞান মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে আসে (জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনে যাও!)।আরবেরা এই জিনিসের নাম দিয়েছিল চায়নিজ ফ্লাওয়ার!

আরবেদের তখন স্বর্ণযুগ চলছে। সম্রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে আরবদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও চলে আসে ইউরোপে। এই ইউরোপীয়ানরা জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা অনেক পরে হাতে পেলেও এর চর্চা তারা খুব ভালভাবেই করেছে। ১৭০০ সাল এর দিকে পুরো ইউরোপে চায়নীজ কালচারের একটা বাতিক তৈরী হয়। সব কিছুতেই তারা চায়নীজ ছোয়া লাগাতে থাকে। তাই পূর্ব এবং পশ্চিমী মিলে একটা নতুন কিছু তৈরী হয়। সেই সময়ে এই ফায়ারওয়ার্কসটাও ইউরোপে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারাও ফায়ারওয়ার্কস বানানো শুরু করে। কিন্তু ১৭০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত লেভ ইসমাইলভ চায়না থেকে বার্তা পাঠায়, "তোরা যা বানাইছস এডি চায়নীজগো তুলনায় কিছুই না! চায়নীজরা এমন ফায়ারওয়ার্কস বানায় যা তোরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবি না!"

১৭৫৮ সালে পিয়েরে নিকোলাস লে শেরন ডি ইনকারভিলে (কি নাম রে ভাই) বেইজিং থেকে ফায়ারওয়ার্কস বানানোর সব পদ্ধতি বই আকারে লিখে পাঠান আর এভাবেই বিশ্ববাসী ফায়ারওয়ার্কস এর চর্চায় মেতে ওঠে।

তবে এখনো চায়নীজরাই সারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফায়ারওয়ার্কস প্রস্তুত ও রপ্তানীকারক দেশ। চায়নীজ নিজ ইয়ার (স্পিং ফেস্টিভাল) এর একটা ঐতিহ্যই হচ্ছে রকমারী ফায়ারওয়ার্কস দিয়ে আকাশ আলোকিত করে ফেলা।

কি জিনিসঃ
জিনিসটা দুই ধরনের হয় একটা আকাশে ফুটে আরেকটা মাটিতেই জালানো হয়। আকাশের টা দুইভাবে আকাশে পাঠানো যায় একটা প্রপালশন টিউব আরেকটা এরিয়েল শেল। প্রপালশন টিউবে একট কাগজ বা হার্ডবোর্ড এর ডিউব এর মধ্যে মাল মসলা দিয়ে টিউব টি খাড়া করে রেখে সলতায় আগুন ধরালে টিউবে মধ্য থেকে রকেটের মত আতশবাজী আকাশে উঠে যায়। এই জিনিস থেকেই আসলে আধুনিক রকেটের উৎপত্তি। তবে বর্তমানে এরিয়েল শেল টাই বেশী জনপ্রিয়, এটা কর্মাশিয়াল উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।

ফায়ারওয়ার্কস যেসব মাল মসলা দিয়ে বানানো হয় সেগুলো কে পাইরোটেকনিক মেটেরিয়াল বলে। এর মধ্যে থাকে, ফুয়েল, অক্সিডাইজার, রঙ, বাইন্ডার বা আঠা, এবং ক্লোরিন কম্পাউন্ড যা রংটাকে আরো উজ্জ্বল করে। রঙ হিসেবে বিভিন্ন ধাতুর গুড়ো এবং তাদের লবন ব্যাবহার করা হয়, আর উজ্জলতার জন্য ব্যবহার করা হয় ম্যাগনেশিয়াম।

সারা পৃথিবীতে নানারকম ফায়ারওয়ার্কস পাওয়া যায় তবে বাংলাদেশে আমি যেগুলো দেখেছি এবং ব্যাবহার করেছি সেগুলো মোটামুটি এই রকম—

গ্রাউন্ডঃ

১) ঝরনাঃ দেখতে জন্মদিনের টুপির মত। মাটিতে রেখে মাথায় আগুন ধরালে কিছুক্ষন পরেই দৃষ্টিনন্দন আগুনের ফুলকি মাটি থেকে প্রায় ৫-১০ফুট উওর পর্যন্ত উঠে যায়, থাকে মোটামুটি ৫-১০ সেকেন্ড। এর মধ্যেও আবার নানারকম আছে, মাল্টিকালার, স্পার্ক্লিং বল ইত্যাদি। নিচে ছবি দেখেন, এইটা আমি!

২) চরকি/চক্করঃ গোল কয়েলের মত দেখতে। মাটি রেখে এর এক মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলে আগুনের ফুল্কি ছোটাতে ছোটাতে প্রচন্ড জোরে ঘুরতে থাকে।

৩) পটকা/বাজি/২৮:
এগুলোকে ফায়ারওয়ার্কস এর কাতারে ফেলা যায় না যদিও তাও সব মহলেই এটি পরিচিত। কোন আলো হয় না এগুলোতে শুধু শব্দ, বিকট শব্দ ঠাস ঠুস করে ফোটে।

৪) তারাবাতিঃ
শব-ই-বরাতে তারাবাতি জালায়নাই এমন মানুষ মানে হয় কমই আছে।

এরিয়েলঃ

১) ছোট শাওয়ারঃ
কাগজের টিউবের একমাথা বন্ধ আরেকমাথা খোলা থাকে। বন্ধ মাথার কাছে থাকে আগুন ধরানোর সলতে। বন্ধ মাথা মাটিতে রেখে টিউবটি দাড়া করিয়ে রেখে সলতেতে আগুন ধরানো হয়। ৩-৪ সেকেন্ড পরেও আলোর ফুল্কি ছড়িয়ে আরশবাজীর মূল অংশটি আকাশে উঠে যায় প্রায় ৫০-৬০ফুট পর্যন্ত এরপর সেখানে আলোর বর্নালী ছড়িয়ে বিস্ফোরিত হয়। ৪-৫ রকম রঙ এর টিউব পাওয়া যায়।

২) মাঝারি শাওয়ারঃ
এগুলোর টিউব আরেকটু বড় আর মোটা হয়। উপরে ওঠে প্রায় ৭০-৮০ ফুট আর বিস্ফোরনে বর্নালীটাও আরো বড় হয়। এগুলোও কয়েক রঙ এর আছে।

৩) বড় শাওয়ারঃ
সবচেয়ে বড় টিউব (এই দেশে যেগুলো পাওয়া যায় তার মধ্যে)।
দামও অনেক চড়া। ১০০ফুট এর বেশি উপরে ওঠে। টিউব অনেক বড় এবং মোটা সুতরাং বিস্ফোরনটাও হয় অনেক বড়। এগুলোর মধ্যে নানা রঙের তো আছেই সেই আছে একের ভেতর ২ বা একের ভিতর পাচ এই রকম ও আছে অর্থাৎ একটা টিউব থেকে যেটা উপরে উঠে ফাটবে, ফাটার পর ৫টা আলাদা টুকরো হয়ে ঐ পাচটা আবার ফাটবে!

৪) ঝরনা + শাওয়ারঃ
কম্বিনেশন। এর এক অংশ ঝরনয়ার মত মাটিতেই আলো ছড়ায় আর একটা পার্ট আকাশে উঠে ছট শাওয়ার এর মতই বিস্ফোরিত হয়।

৫) রকেটঃ
শাওয়ারটিউবগুলোর মতই একটা টিউব থাকে তবে এই টিউব এর সাথে একটা লম্বা কাঠি লাগানো থাকে। কাঠিটা একটা খালি বোতলে ঢুকিয়ে টিউব এর ফিতায় আগুন ধরালে এই রকেট তীব্র গতিতে উপরে ছুটে যায়, ছুটে যাওয়ার শব্দটা সুন্দর তবে বিস্ফোরনের বর্নালীটা ছোট হয়।

এই হচ্ছে মোটামুটি অবস্থা। যা যা আইটেম এর নাম দিলাম এগুলোর দাম পড়বে ১০০-৪০০০টাকা পর্যন্ত।

বাংলাদেশে ফায়ারওয়ার্কস এর ব্যাপারে কিছু নিয়ম কানুন আছে। প্রথমত এগুলো সরাসরি খোলা বাজারে বিক্রি করা নিষেধ। বিভিন্ন পার্টি যেমন বিয়ে, হলুদ, মেলা, ঈদ, এসব ক্ষেত্রে ফায়ারওয়ার্কস ফুটানতে কোন সমস্যা নেই, তবে যথাযত সতকর্তা গ্রহন করতে হবে। এজন্য আলাদা কোন পুলিশ পার্মিশন ও লাগে না। তবে আপনি যদি বড় আকারে করতে চান সেক্ষেত্রে অনুমতি লাগবে।

কোথায় পাবেনঃ
বাংলাদেশে ফায়ারওয়ার্কস বিক্রি করে কিছু ব্যাবসায়ী। তারা মূলত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য। তবে আপনি নিজের জন্যেও নিতে পারবেন। খোলা বাজারে যেহেতু বিক্রি হয় না তাই ওদের সাথে মেইল বা ফোনে যোগাযোগ করে অর্ডার দিতে হবে।
আমি যেখান থেকে নেই তাদের মেইল আইডিঃ fireworksbd@gmail.com
ফেইসবুক পেইজঃ https://www.facebook.com/fireworksbd

সতর্কতাঃ
ফায়ারওয়ার্ক্স প্রোডাক্টগুলো অবশ্যই বাচ্চাদের হাতে দেবেন না আর ফুটানোর সময় বাচ্চাদের বেশ দূরে রাখবেন। আশে পাশে দ্রাহ্য কোন পদার্থ আছে কিনা দেখবেন আর কোন বদ্ধ যায়গায় করবেন না, খোলা যায়গায় করবেন। অযথা ফায়ারওয়ার্ক্স ফুটিয়ে শব্দ করে আশেপাশের মানুষদের বিরক্ত করবেন না। কোন অনুষ্ঠান ছাড়া ফুটাবেন না। অগ্নিনির্বাপনের ব্যাবস্থা করে রাখা ভাল।

বাংলাদেশের কিছু ফায়ারওয়ার্কস ইভেন্টঃ
বড় ফায়ারওয়ার্কস ইভেন্ট বলতে আসলে গত ক্রিকেট বিশ্বকাপ এবং সাফ গেমস এর উদ্বোধনীতে দেখানো হয়েছে। এগুলো এয়ারশেল কমার্শিয়াল ফায়ারওয়ার্ক, সাধারন মানুষের জন্য উন্মূক্ত নয়। এছাড়া প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে নিউ ইয়ার উদযাপন, পুরানো ঢাকার সাকরাইন উৎসব এই দুটিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অনেক আতশবাজী ফুটানো হয়। গত ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকা উইনিভার্সিটি মোটামুটি বড় আকারের ফায়ারওয়ার্কস ইভেন্ট করা হয়েছিল। বিয়ে, হলুদ এসব অনুষ্ঠানে ফায়ারওয়ার্কস নিয়ে আনন্দ করা এটা পুরান ঢাকার ট্রেডিশন। বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজ, যেমন জিপি, চ্যানেল আই, বাংলাভিশন এরা তাদের বর্ষপূর্তি সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দৃষ্টিনন্দন ফায়ারওয়ার্কস ইভেন্ট করে প্রায়ই।

ফায়ারওয়ার্কস এর আরো কিছু ছবিঃ