রুগী যখন জানতে পারে, রোগটির নাম ‘ক্যানসার’!

রীতা রায় মিঠু
Published : 28 August 2012, 04:59 AM
Updated : 28 August 2012, 04:59 AM

খুব ছোটবেলায় আমরা ডাক্তার -রুগী খেলতাম। খেলার সময় গলায় মিছিমিছি স্ট্যাথোস্কোপ ঝুলিয়ে, নাকে ঝুলন্ত চশমাকে উপরের দিকে ঠেলে দিয়ে গলা ভারী করে রুগীকে আড়াল করে তার আত্মীয়কে বলতাম, ' রুগীর ক্যান্সার হইছে। বাঁচানো যাইবোনা। জানেনইতো, ক্যান্সার নো এনসার"। তখনতো জানতাম ক্যান্সার বলতে ব্লাড ক্যানসারকেই বুঝানো হয়। সিনেমাতে দেখানো হতো নায়ক বা নায়িকা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত অথবা যক্ষ্মায় আক্রান্ত। নায়ক বা নায়িকাকে মেরে ফেলতে হলে এই দুই রোগের যে কোন একটাকে দেখানো হতো। তার মানে ক্যান্সার হলে কেউ বাঁচেনা। তবে আরেকটু জানতাম, ব্লাড ক্যান্সার হলে শরীরের সব রক্ত পাল্টাতে হয়, রক্ত পাল্টালেই রুগী বাঁচে। বড় হয়ে শুনেছি নায়িকা সুচিত্রা সেনের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। বছরে দুইবার করে শরীরের রক্ত পাল্টিয়ে উনি নাকি বেঁচে আছেন।। ক্যানসার সম্পর্কে বিচিত্র সব তথ্য শুনে হঠাৎ করেই আমার মনের ভেতর ক্যানসার ভীতি দানা বাঁধতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে জানতে পারি, ক্যান্সার বলতে শুধু ব্লাড ক্যানসারকেই বুঝানো হয়না, ক্যানসার দেহের যে কোন অংশে হতে পারে।

দুরন্ত যৌবনে কেউই মৃত্যু নিয়ে ভাবেনা, অথবা মৃত্যুকে ভয় করেনা। যৌবন মানেই জীবন। তবে সমস্যা হচ্ছে যৌবনের স্থায়িত্বকাল খুবই কম। যে মানুষটি একসময় মৃত্যুকে থোড়াই কেয়ার করেছে, জীবনের এক পর্যায়ে এসে তাকেও মৃত্যুচিন্তায় পেয়ে বসে। আমার কথা আলাদা। আমি ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুকে ভয় পাই। সব সময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি," হে ঈশ্বর, যখন কেউ আমাকে আর ভালোবাসবেনা, যখন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে দূর্বিষহ মনে হবে, তখনই যেনো আমার মৃত্যু হয়। মৃত্যুটা যেন আমার অজানতেই হয়"। আর বাড়ীর সকলকে জানিয়ে দিয়েছি, আমার যদি কখনও ক্যানসার হয়, আমাকে যেন সেটা জানতে না দেয়া হয়। কারন ক্যানসার হয়েছে শুনলেই শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চিকিৎসা শুরু হওয়ার আগেই রুগী 'মরে যাব' ভয়েই অর্ধেক মরে যায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রে যতই উন্নতি হোক না কেন এমন আধামরা রুগীদের শুধু চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।

গত এক সপ্তাহে আমার খুব কাছের দু'জন মানুষ, রক্তের সম্পর্ক না থেকেও যারা ছিলেন আমার একান্ত কাছের, দু'জনই ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কোথায় কোন অজানার দেশে চলে গেলেন। তাঁদের একজন মারা গেলেন কলকাতায়, আরেকজন মারা গেলেন আমেরিকায়। কলকাতায় যিনি মারা গেলেন সম্পর্কে উনি আমার মেসো ( আমাকে যিনি মেয়ে জ্ঞানে স্নেহ করতেন), আমেরিকায় যিনি মারা গেলেন উনাকে ডাকতাম খালাম্মা বলে ( এই মানুষটি এই বিদেশ বিভুঁইয়ে আমাকেই একমাত্র আপনার জন ভাবতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিফোনে আমার কাছে জীবনের না বলা কথাগুলো বলতেন)। এই দুজনের প্রত্যেককেই শুরুতেই ডাক্তারগন জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের রোগটির নাম 'ক্যানসার'। জানিনা, রোগের নাম জানিয়ে দিয়ে ডাক্তারগন চিকিৎসায় কতটুকু সফল হতে পেরেছেন! ক্যানসার হয়েছে জানার আগে দুজনেই হেঁটে হেঁটেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন, 'আপনার ক্যানসার হয়েছে' জানার পরে দুই দিনের মধ্যেই তাঁরা শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার রোগ সম্পর্কে জানানোটাই যদি নিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দেশের রুগীকে 'মরনরোগ' সম্পর্কে জানতে না দেয়ার পুরাতন পদ্ধতিকেই আমি সমর্থন করি। মেসো ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিলেন মেয়ের বাড়ীতে বেড়াতে, ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার আগে আমার সাথে ফোনে তাঁর কথা হয়। বেড়াতে যাচ্ছেন বলে খুব ফূর্তির মুডে ছিলেন, ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার দশদিনের মাথায় বোনের কাছ থেকে সংবাদ পাই, পেটে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে 'খাদ্যনালী অ পাকস্থলীর সংযোগস্থলে ক্যানসারের' কথা শুনে মেসো ভেঙ্গে পড়েছেন। সেই যে মানসিকভাবে উনি ভেঙ্গে পড়লেন, পরবর্তী ছয়মাসের মধ্যে আর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারলেননা। উনাকে দেখতে গিয়েছিলাম, দেখে মনে হয়েছে না দেখাই ভালো ছিল। বেঁচে থাকা অবস্থায় যে মানুষ মরে গেছে, তাঁকে দেখার মধ্যে কোন আনন্দ নেই।

খালাম্মা থাকতেন মেয়ের কাছে। অসুস্থ মেয়েকে দেখাশোনা করতেন। এই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে উনার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, টেলিফোনে। সেদিন উনি আমাকে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের আরেক ভদ্রলোকের মৃত্যু সংবাদ, যিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সেই ভদ্রলোকের ক্যানসার হয়েছিল এবং উনাকে তা জানানো হয়েছিল। আমেরিকায় উন্নত চিকিৎসা পেয়েও দুই বছরের বেশী উনাকে বাঁচানো যায়নি। সেই দুই বছরে উনি আসলেই কি বেঁচেছিলেন? মনে তো হয়না। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বিয়ের ছবি দেখেছি, মেয়ে, নতুন জামাইয়ের পাশে সবার সাথে উনিও দাঁড়ানো। সবার মুখে প্রানবন্ত হাসি, উনার মুখে জোর করে আনা হাসি। উনার নিশচয়ই তখন সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছিল। উনি জীবিত থাকতে থাকতে যেন মেয়ের বিয়েটা দেখে যেতে পারেন, এটাই ছিল বিয়ে আয়োজনের মূল ঊদ্দেশ্য। কিনতু যাঁর জন্য এত আয়োজন, তাঁর মনে তখন কী তোলপাড় চলছে তা উনিই বলতে পারতেন। আমি আবারও অসমর্থণ করি, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার মৃত্যুরোগ সম্পর্কে অবহিত করার এই নিষ্ঠুর এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারটিকে।
যে কথা বলছিলাম, যেদিন খালাম্মা আমাকে ঐ ভদ্রলোকের মৃত্যুসংবাদ দিলেন, উনি সাথে এটাও বলেছিলেন, কিছুদিন ধরেই উনার পেটে প্রচন্ড ব্যথা, অসুস্থ মেয়েকে নিয়েই এত ব্যস্ত যে নিজের কথা মনে থাকেনা।

মেয়েকে সেবা করতে হলেও নিজেকে সুস্থ রাখা দরকার' বললাম খালাম্মাকে। ডাক্তারের কাছে যেতে পরামর্শ দিলাম, চারদিন পরে খালাম্মার মেয়ে জামাই আমাকে ফোন করে জানালো, খালাম্মার কোলনে ক্যানসার ধরা পড়েছে এবং উনাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। সেই যে খালাম্মা হাসপাতালে গেলেন, তিনদিন আগে মেয়ের মায়া, ছেলের মায়া, পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে কোথায় চলে গেলেন! খালাম্মা ফোনে কত গল্প করতেন আমার সাথে, আমার এখনও ভাবতে অবাক লাগছে, আমার সাথে উনার শেষ কথা হয়েছিল, নাজির সাহেবের ক্যান্সারে মৃত্যু নিয়ে, খালাম্মাও আমার সাথে একমত ছিলেন যে ক্যানসার হয়েছে শুনলে পরে এমনিতেই মানুষ অর্ধেক মরে যায়। সেই খালাম্মাই যখন দুই দিন পরে নিজের ক্যানসার হয়েছে জানতে পেরেছিলেন, তখন কি উনার কাছে মনে হয়েছিল যে ডাক্তার সাহেব খুব নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর ডাক্তার কেমন সহজে বলে দিতে পারলেন তাঁরও ক্যানসার হয়েছে। সেই যে উনি জীবনের আনন্দ থেকে, বেঁচে থাকার আনন্দ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, তখনইতো তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তিনদিন আগে শুধু উনার দেহটাও মারা গেল।

অনেক আগে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একখানা লেখা পড়েছিলাম। উনার স্ত্রী অধ্যাপিকা জেসমিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর লেখাটা কোন এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। উনি লিখেছিলেন, উনার স্ত্রী যখন জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর ক্যানসার হয়েছে, তারপর থেকেই উনি চুপ হয়ে গেছিলেন। প্রায়ই উনাকে দেখা যেত, জানালার শিক ধরে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। অসুখ যখন ভয়ানক হয়ে উঠে, উনি ধীরে ধীরে চেতনার বাইরে চলে যান এবং একসময় জীবন থেমে যায়। লেখাটা পড়ার পরেই আমার মনে হয়েছিল, আহারে, মৃত্যুর আগে যে কয়টা দিন উনি বেঁচেছিলেন, উনার আশেপাশের জীবন দেখে নিশ্চয়ই তাঁর কান্না পেতো। নিশ্চয়ই তাঁর মনে হতো, 'সবাই থাকবে, সবই থাকবে, শুধু আমিই থাকবোনা"। উনি জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে কী ভাবতেন? উনি কি ভাবতেন, " এই পৃথিবীর সকল সুন্দর ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাবো তা তো জানিনা। গন্তব্য জানা থাকলে আসন্ন মৃত্যুটাকে মেনে নিতে সহজ হতো। এমন অজানার পথে পা বাড়াতে আমার ভয় লাগছে। আমি কেনো বেঁচে থাকলামনা, বেঁচে থাকলে আরও কত কী করতে পারতাম, কত কী দেখতে পেতাম"! এগুলো সবই আমার কল্পনা, আমি নিজেকে অধ্যাপিকা জেসমিন চৌধুরীর স্থানে বসিয়ে কল্পনা করেছি।

আমেরিকায় আছি গত বারো বছর ধরে। যে বয়সে এদেশে এসেছি, সেই বয়সে নতুন করে কিছুই শেখার নেই। মানিয়ে চলাটাই এই বয়সের ধর্ম। ইতোমধ্যে অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে শিখেছি আবার কিছু কিছু ব্যাপার মানতেই পারিনা। যেমন এখানে অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার অবলীলায় রুগীকে তার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলে দেন। রোগটি যদি হয় ক্যানসার অথবা এইডস, তাতেও কোন ভ্রূক্ষেপ করেননা। ইমোশনাল ব্যাপারগুলো এদেশে নেই বললেই চলে। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক যুক্তি দাঁড় করাতে পারলেও আমার মন কোন যুক্তিই মানতে চায়না। আমার শুধু মনে হয়, আমার ভয়ানক রোগ সম্পর্কে কিছু না জেনেই আমি মারা যেতে চাই। রোগের নাম জেনে কী হবে, আমি কি পারবো ঢাল তলোয়ার নিয়ে 'ক্যানসার' এর গলা কেটে দিতে? অনেকেই যুক্তি দেখান, রোগ সম্পর্কে রুগীকে জানানো হলে, রুগী মৃত্যুর আগেই যতখানি সম্ভব জীবনের অসমাপ্ত কাজগুলো সেরে যেতে পারে। বাপরে! কী ভয়ানক সব যুক্তি! আমি মরে যাব মানে তো মরেই যাব, আমার আবার অসমাপ্ত কাজ কী? আমার জীবন যেখানে অসমাপ্ত রেখে সারা জীবনের তরে চলেই যাচ্ছি, তাহলে আমাকে দিয়ে মৃত্যুর আগে অসমাপ্ত কাজ করতে দেয়াটা, অনেক বেশী নিষ্ঠুর মনে হয় না? কী জানি, হয়তো আমার ভাবনায় অনেক ভুল আছে, আসলে আমি খুব ভীতু বলেই হয়তো মহৎ কিছু চিন্তা করতে পারিনা, আমি পারিনা মৃত্যুকে মেনে নিতে।

আমেরিকাতে এসে আমি শখের বশে নার্সিং পড়তে গিয়েছিলাম। তৃতীয় সেমিস্টারে ( এই সেমিস্টারে এসেই আর মাত্র একটি সেমিস্টার বাকী থাকতে টীচারের উপর রাগ করে পড়া ছেড়ে চলে এসেছিলাম) মাঝে মাঝেই অতিথি স্পীকার আসতেন নানা বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখতে। একদিন এলেন এক মহিলা, কোন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। উনি এসে আমাদের নিজের জীবনের গল্প শুনালেন।

ধরে নিলাম উনার নাম ক্যাথি। ক্যাথির বয়স যখন ৪৫, একদিন সে ডাক্তারের কাছে গেল। কারন তার মনে হয়েছে সে তার ব্রেস্টে লাম্প টের পেয়েছে ( এদেশে নিজে নিজে ব্রেস্ট একজামিন করার কৌশল সব মেয়েকেই শেখানো হয়, সচেতন মাত্রেই তা করে থাকে)। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা ( দুই দিন ধরে) করে তাকে জানালো, তার ধারনা সঠিক। লাম্প যেটা সে টের পেয়েছে, সেটা ক্যান্সারে পরিনত হয়েছে এবং এটা ফোর্থ স্টেজ এ চলে গেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্রেস্ট রিমুভ করতে হবে, কঠিন কেমোথেরাপী দিতে হবে এবং এর পরেও সে বাঁচবে কিনা তা ডাক্তাররা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেনা। ক্যাথি অনেকটাই পাগলের মত বাড়ী ফিরে যায়। বাড়ীতে তার প্রিয়জনদের মুখের দিকে তাকায় আর বুক ঠেলে কান্না বের হয়ে আসে। আড়ালে কাঁদে, ঘর সংসারের দিকে তাকিয়ে বুক ভেঙ্গে যায়। ক্যাথি স্বামী বা সন্তান কাউকেই বলতে পারেনি তার এই অবস্থার কথা। ডাক্তারের কাছে অপারেশান করতে যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেছে যে সে কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে।

ডাক্তারের কাছে এসে সে নিজ দায়িত্বে অপারেশান করানোর কথা বলে। অপারেশানের পরে যেনো তার স্বজনদের খবর দেয়া হয়, এমন কথা নিয়ে সে অপারেশান টেবিলে যায়। অপারেশান ভালোভাবেই হয়, এরমধ্যেই তার স্বজনেরা খবর পেয়ে যায়। তারপর তাকে কেমোও দেয়া হয়। বাকীটুকু বলা বাহুল্য, দুই ব্রেস্ট হারিয়ে , ক্যান্সার নির্মূল করে সে আমাদের মাঝে এসেছে বক্তব্য রাখতে। কারো কোন প্রশ্ন আছে কিনা জানতে চাওয়ায় অনেকের সাথে আমিও হাত তুলেছি।

ক্যাথীর কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, " তোমাদের দেশে রোগীকে জানিয়ে দেয়া হয় তার রোগ সম্পর্কে। ক্যানসার যে মরণ ব্যাধি, তা আমরা সকলেই জানি। তোমাকে যখন জানানো হলো, তোমার ক্যানসার, তুমি অনেক কেঁদেছো গোপনে। বলেছ স্বজনদের দিকে তাকিয়ে তোমার মনে হয়েছে সবাই থাকবে, শুধু তুমি থাকবেনা। মৃত্যুভয়ে তুমি অস্থির হয়েছো। ঈশ্বরের কৃপায় তুমি বেঁচে গেছো। আমারও খুব ভালো লাগছে তোমাকে এখানে দেখতে পেয়ে। আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। এখানে কেনো রোগীকে জানিয়ে দেয়া হয়, যদি রোগটা হয় ক্যানসার। ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে চলে যাওয়া মানেই শতকরা পাঁচ ভাগ বাঁচার সম্ভাবনা। যে রোগী কিছুদিন পরেই মারা যাচ্ছে, তাকে ক্যানসারের কথা জানানো মানেই মৃত্যুটাকে তরান্বিত করা। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন খুবই মনোকষ্টে থাকা। ধরে নিলাম চিকিৎসার সুবিধার্থেই রুগীকে ক্যানসারের কথা বলা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ক্যানসার না বলে কি অন্যভাবে বলা যায়না? অনেক ক্ষেত্রে রোগী যদি বুঝতেও পারে তার ক্যানসার হয়েছে, তবুও ডাক্তার যদি বলে যে এটা ক্যানসার নয়, এক ধরনের কঠিন ইনফেকশান যা কিনা রেডিও থেরাপী বা কেমো থেরাপী দিয়ে সারানো যায়। আমি বিশ্বাস করি রোগী এতে করে মানসিক বল অনেক বেশী ফিরে পাবে, তার চিকিৎসা করা অনেক সহজ হবে এবং চিকিৎসায় সুফলও আসবে। আর কিছু না হোক অন্ততঃ মৃত্যুর আগের কয়েকটা দিন রোগীকে মৃত্যু ভয় গ্রাস করবেনা"।

এটা আসলে আমার প্রশ্ন ছিলনা। নিজেই প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দেয়ার মত। পিন পতন নীরবতায় সকলেই সকলের কথা শোনে। আমার কথা শুনে ক্যাথীর চেহারায় একটু পরিবর্তন দেখলাম। সে শুধু বললো, " তোমার ভাবনার সাথে আমিও একমত। তবে এদেশে এটাই রীতি, চিকিৎসা বলো, অথবা অন্য যে কোন পেশা বলো, নিজেকে স্বচ্ছ রাখাটা কাজের একটি অঙ্গ। তবে ক্যানসারের রুগীর ব্যাপারে তুমি যে মূল্যবান মতামত দিলে আমি তা পূর্ণ সমর্থন করি। কারন আমাকে এর ভেতর দিয়ে আসতে হয়েছে।"

গত বছর হুমায়ুন আহমেদের ক্যানসার ধরা পড়লো, উনাকে জানানো হলো উনার শারীরিক অবস্থার কথা। উনাকে না জানানো হলেও উনার মত জ্ঞাণী মানুষ ঠিকই বুঝতে পারতেন। তবে ক্যানসার ফোর্থ স্টেজে চলে গেছে না জানালেই ভালো হতো। সেকেন্ড স্টেজে আছে বলেও যদি চিকিৎসা করা হতো, উনার নিশচয়ই মনের জোর আরও বেশী থাকতো। উনি শেষের দিকের এক সাক্ষাৎকারে যদিও বলেছেন যে মৃত্যু নিয়ে উনি বিচলিত নন, তারপরেও উনি প্রায় প্রতিদিন কাঁদতেন ( দৈনিক আমাদের সময়ে 'গাজী কাশেমের' লেখাতে আছে)। কেনো কাঁদতেন উনি? নিশচয়ই দুই শিশু পুত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবতেন, কিছুদিন পরে এদের ছেড়ে কোথায় চলে যাবো কে জানে! মরন যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় শাওনের নাম ধরে ডেকেওছিলেন, " কুসুম আমাকে বাড়ী নিয়ে যাও, এরা আমাকে মেরে ফেলবে" বলে। মুখে বললেও মৃত্যুকে কে পারে সহজে মেনে নিতে? মাঝখান থেকে জীবনের শেষের দিনগুলো কতই না মনোকষ্টে কেটেছে উনার।

আমার দেশের অনেক কিছুই এখনও পুরানো দিনের ধ্যান ধারনায় চলছে। উঠতে বসতে আমাদের দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গাল-মন্দ করি। কথায় কথায় আমেরিকা ইউরোপের নানা দেশের রেফারেন্স টেনে কথা বলি। একেক সময় মনে হয়, আমাদের দেশের রাষ্ট্র, সমাজ সর্বত্র আমূল পরিবর্তন না আনলে বুঝি আর চলেনা। পরিবর্তন একেবারেই আসছেনা সেটাও পুরোপুরি সত্যি নয়। আমাদের দেশটাও অনেক দিক দিয়েই এগোচ্ছে, ধীরে ধীরে হলেও। আমি চাই সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাক আমার দেশ, শুধু একটা জায়গা বাদ থাকুক। তা হলো আমাদের ইমোশান। বাঙ্গালী ভীষন আবেগপ্রবণ। এই আবেগ অনুভূতিগুলো অপরিবর্তিত থাকুক। ক্যানসারের রুগীকে 'ক্যানসার' হয়েছে জানতে না দেয়ার মধ্যে কতখানি মমতা, ভালোবাসা, আবেগ জড়িয়ে থাকে, তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্বীকৃতি না পেলেও অসুবিধা নেই। আধুনিক রাষ্ট্রে থেকে, সকল রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা পেয়েও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় রুগীকে তার যে কোন অনিরাময় যোগ্য রোগ সম্পর্কে পূর্ণ তথ্য প্রদান করার আধুনিকতার নিকুচি করি।