আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনঃ জীবনের প্রথম ভোটটি কাকে দিতে পারি!

রীতা রায় মিঠু
Published : 28 Sept 2012, 04:43 PM
Updated : 28 Sept 2012, 04:43 PM

আগামী ৬ই নভেম্বার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আমেরিকার ৫৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারের নির্বাচন আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারন এবারই আমি প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করেছি। নাগরিকত্ব পেয়েছি গত বছর, তাই সেই সুবাদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের মত প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছি।

কিনতু আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা কোন প্রার্থীকে আমার ভোটটি দেবো। দেশে থাকতে জীবনে একবারই জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেছিল, জীবনের প্রথম ভোটটি এভাবে নষ্ট হয়ে গেল বলে। তাই এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমার প্রথম ভোটটি নষ্ট হতে দেবো না। েমন একজনকে ভোটটা দিতে চাই, যিনি আগামী চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। আমি আমেরিকান রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনা, আমার কাছে ভাল লাগে দেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করতে। দেশের সবকিছুতেই এক ধরনের হৈ হৈ, রৈ রৈ ব্যাপার থাকে, আমেরিকানদের মত এমন ম্যাড়ম্যাড়ে ভাব নেই আমাদের মধ্যে। এই যে এত বড় একটা নির্বাচন হতে যাচ্ছে, আমেরিকার রাস্তা-ঘাটে, হাটে বাজারে কোথাও কোন টুঁ শব্দটিও নেই! অথচ আমাদের দেশে নির্বাচনের এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় নির্বাচন নিয়ে নানারকম কড়চা। পত্র পত্রিকায় তো বটেই, গ্রামের মেঠোপথের ধার ঘেঁষে নড়বড়ে যে চায়ের দোকান থাকে, সেখানেও ঘর ফিরতি হাটুরেদের রাজনীতি, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে দেখা যায়। এমনকি আমেরিকান নির্বাচন নিয়েও বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই শোরগোল পড়ে গেছে, অথচ খোদ আমেরিকার জনজীবনে এর বাহ্যিক কোন প্রভাব নেই। যে যার মত রুটিনমাফিক কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের দেশের নির্বাচনে কারো ভোট দেয়ার সুযোগ না থাকলেও নির্বাচন নিয়ে যে ডামাডোল সৃষ্টি হয়, চারদিকে থাকে উৎসবের আমেজ, মানুষের সেই উন্মাদনা দেখেও সুখ।

আমি থাকি আমেরিকার দক্ষিনী রাজ্য মিসিসিপিতে। মিসিসিপি আমেরিকার সবচেয়ে গরীব রাজ্য। জনগোষ্ঠীর অর্ধেক বা তার কিছু কম-বেশী হচ্ছে আফ্রিকান আমেরিকান। কালো জনগোষ্ঠির সকলেই ওবামার সমর্থক। যদিও মিসিসিপি রাজ্যের গভর্ণর রিপাবলিকান এবং মিসিপির গভর্ণর পদে আজ পর্যন্ত কোন ডেমোক্র্যাটকে নির্বাচিত হতে দেখা যায়নি। এই হিসেবে মিট রমনির গ্রহণযোগ্যতা আমাদের এখানে বেশী হওয়ার কথা। আমি চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে, যেখানে মিসিসিপির নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সাধারন মধ্যবিত্তেরাই আসা-যাওয়া করে। উচ্চ মধ্যবিত্তরাও আসে বাজার করতে, তবে তাদের সংখ্যা খুব কম। সেই হিসেব মাথায় রেখেই আমার সহকর্মী এবং পরিচিত কিছু গ্রাহকের মধ্যে থেকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল, সাদা এবং কালো মিলিয়ে কুড়িজনের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ওবামা এবং মিট রমনির মধ্যে কার জয়ের সম্ভাবনা খুব বেশী?

কালো আমেরিকানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আমাদের বাঙ্গালীদের অনেকাংশেই মিল আছে। বাঙ্গালী যেমন হৈ হৈ করতে ভালোবাসে কালোরাও সারাক্ষন হৈ চৈ, আনন্দ ফূর্তির মেজাজে থাকতে ভালোবাসে, এদের গলার জোরও অনেক বেশী। ব্ল্যাকদের সকলেই খুব উঁচু গলায় বলেছে, তারা ওবামাকে সমর্থন করে। ওবামার সমর্থক বুঝানোর জন্য অনেকেই ওবামার হাসিমুখের ছবি সম্বলিত টি শার্ট পড়ে থাকতে ভালোবাসে।

যে কয়জন হোয়াইট আমেরিকানকে প্রশ্ন করেছি, তাদের মধ্যে মতভিন্নতা পেয়েছি। দুইজন বলেছে, তারা ভোট দিতে যায় না। তাদের আগের প্রজন্ম থেকে এই রীতি চলে আসছে। ভোট দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব স্বীকার করেও ভোট দেয়ার মধ্যে তারা কোন সার্থকতা খুঁজে পায়না। তাদের মতে, 'যে যায় লংকা, সে-ই হয় রাবণ'। ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান, যে-ই জয়ী হোক, সাধারণ জনগনের কোন লাভ নেই। তাদের সেই উঁচু মূল্যে গ্যাস কিনতেই হয়, অগ্নিমূল্যে নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস কিনতেই হয়, অসুস্থ হলে হাসপাতালের উচ্চমূল্যের চিকিৎসা খরচের বিল মাসে মাসে পরিশোধ করতেই হয়, অথচ চাকুরীতে বেতন বাড়ে না, যে কোন সময় চাকুরী হারাবার ভয় থাকে। কাজেই নির্বাচন নিয়ে তারা ভাবে না।

আরেক হোয়াইট লেডী ওবামাকে ভোট দেবেনা তা জোর গলায় বলেছে এবং সেই সাথে এটাও বলেছে যে যারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেয় তারা গাধার বেহদ্দ। এমন কথা শুনে পাশে থাকা ওবামার সমর্থক কালো মেয়ের মুখটি আরও কালো দেখায়। কিনতু সহকর্মীর সামনা সামনি কিছুই বলার সাহস না পেলেও, আড়ালে গিয়েই বাকী কালো বন্ধুদের একসাথে জড়ো করে শুরু করে দেয় ফিসফাস, সমালোচনা। তবে ব্যাপারটা আর বেশীদূর গড়ায়নি।

আরেকজন বলেছে, সে ওবামা বা রমনি, কাউকেই ভোট দেবেনা। রমনিকে সে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনে করেনা বলেই রিপাবলিক দলের সমর্থক হয়েও তার মূল্যবান ভোটটি অপছন্দের ব্যক্তিকে দিবেনা। কৌতুহল থেকেই জানতে চাইলাম, সারা আমেরিকাবাসী ওবামা আর রমনি থেকে একজনকে বেছে নিবে, আর তোমার মত কিছুলোক ভোট না দিয়ে নিজের ভোটটা জলে ফেলতে চাচ্ছ কেন? উত্তরে সে বললো যে অধিকাংশ আমেরিকানদের মাথায় ঘিলু বলে কিছু নেই। তারা অলস, বুদ্ধি বিবেচনা বলে একটা বস্তু যা ওর পোষা কুকুরের মাথায়ও আছে, তার ছিটে ফোঁটাও অলস আমেরিকানদের মাথায় নেই। তার ভোট জলে যাক অসুবিধা নেই, কিনতু তার বিবেক তো জলে যাচ্ছেনা।

আমি সর্বমোট বিশজন আমেরিকানকে প্রশ্ন করেছিলাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে তারা কি ভাবছে! বিশজনের মধ্যে ১২জন (সকলেই আফ্রিকান-আমেরিকান) ওবামাকে ভোট দিবে, ৪ জন (হোয়াইট) রমনিকে ভোট দিবে, একজন (কালো) বলেছে 'আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশী তাকে দেবো' আর বাকী তিনজন (হোয়াইট) ভোটই দিবেনা।

সাধারন আমেরিকানদের মতামত শুনে সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি বলেই প্রবাসী বন্ধুদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম। প্রথম ব্যক্তিটি আমার স্বামী। আমেরিকান নাগরিক হিসেবে জীবনের প্রথম ভোটটি ওবামাকে দিবেন, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। গত ইলেকশানে আমার স্বামী ও দুই কন্যা ওবামার সমর্থনে ক্যাম্পেইন করেছিল। আমি ছিলাম হিলারী ক্লিন্টনের সাপোর্টার। প্রার্থী নির্বাচনে হিলারী হেরে যেতেই নির্বাচন নিয়ে আমার সকল উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল। মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, আমি যাকে সমর্থণ করি, সে শেষ পর্যন্ত হেরে যায়।

হিলারী ক্লিন্টনকে আমি সমর্থন করেছিলাম অনেকগুলো কারনে। তাঁর মত এমন সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা, স্মার্ট এবং বুদ্ধিমতী নারী আমার জীবনে আমি দেখিনি। স্বামী বিল ক্লিন্টনের 'মনিকা' সম্পর্কিত কেলেংকারী যেভাবে উনি ট্যাকল করেছিলেন, আমি জানিনা আমেরিকার অন্য ফার্স্ট লেডীরা ওই অবস্থায় পড়লে কি করতেন। তাছাড়া হিলারীতো শুধুই ফার্স্ট লেডী ছিলেন না, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার মত সকল যোগ্যতা তাঁর ছিল। এমনকি হিলারী ক্লিন্টন প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকার যুদ্ধবাজ পলিসিতেও অনেক পরিবর্তন আসতে পারত। যাই হোক, আমেরিকান জনগন কোন নারীকে দেশের প্রধান হিসেবে দেখতে চায় না। তারা নারীকে ফার্স্ট লেডী হিসেবে, স্বামী সোহাগীনি হিসেবে দেখতে ভালোবাসে, নেত্রী হিসেবে চায়না। এই একটা ব্যাপারে আমরা আমেরিকানদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী দুজনেই নারী, ভারতে ইন্দিরা গান্ধী তো ছিলেন রূপে গুনে, বিদ্যা-বুদ্ধিতে অতুলণীয়, পাকিস্তানেও বেনজীর ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছিল পাকিস্তানী জনগন অথচ গনতন্ত্রের দেশ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে কোন মহিলাকে নির্বাচিত হতে দেখেনি বিশ্ববাসী।

প্রবাসী বন্ধুদের সকলেই উচ্চশিক্ষিত, মোটামুটি স্বচ্ছল। সকলেই ওবামার সাপোর্টার। ওবামার মধ্যে সকলেই নিজেদের জীবনের মিল খুঁজে পায়। অধিকাংশই মনে করে, মিট রমনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন, দারিদ্র্য বা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা সম্পর্কে তাঁর কোন ধারনাই নেই। সেই তুলনায় ওবামার জীবনটাই ছিল এক বিশাল সংগ্রামের। তাঁকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে বড় হতে হয়েছে। একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন মধ্যবিত্তের নিত্য জীবনের যন্ত্রনা। সকলেই মনে করে, রমনি শুধু বড় বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়ন কিভাবে করবেন সেই সম্পর্কে কোন ধারনাই দিচ্ছেননা, যেখানে ওবামা স্বপ্নও দেখাচ্ছেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাব্য পথগুলিও দেখাচ্ছেন। ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে চার বছরের অভিজ্ঞতা আছে যেখানে রমনি একেবারেই নতুন। ওবামা বিরোধীদের মতে, ওবামা প্রথমবারের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। ওবামা সমর্থকের উত্তর তৈরী, যে জঞ্জাল জর্জ বুশ রেখে গেছিলেন, এক টার্মে সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করা সম্ভব হয় নি, সেই জন্যই ওবামাকে আরেক টার্মের জন্য নির্বাচিত করা উচিত।

অবশ্য দুজনের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কারো মনে কোন প্রশ্ন নেই, দুজনেই বিখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করেছেন। দাম্পত্য জীবনেও দুজনকেই সুখী মনে করে সকলে, পিতা হিসেবেও দুজনই ভাল। দুজনেই সুদর্শন এবং স্মার্ট। তবে বয়সের দিক থেকে তরুণ ওবামা এগিয়ে আছেন। সাধারন জনগনের মতে, ওবামা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি, রমনি উচ্চবিত্তের প্রতিনিধি। জনগন যদি নতুন কিছু পাওয়ার আশায় পরিবর্তন চায় তাহলে রমনি হচ্ছে যোগ্য ব্যক্তি, আর অনিশ্চিতের পথে না গিয়ে পরীক্ষিত প্রতিনিধি চাইলে ওবামাই হচ্ছে যোগ্য প্রার্থী।

তাহলে কে জয়ী হবেন আসন্ন নির্বাচনে? আপাততঃ সরল হিসেব অনুযায়ী ডেমোক্র্যাট ভোট দিবে ওবামাকে, রিপাবলিকান ভোট দিবে রমনিকে, প্রবাসীদের অধিকাংশই ভোট দিবে ওবামাকে। বাকী থাকে নীরব ভোটার এবং নির্দলীয় ভোটার। তারা অপেক্ষা করছে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য ডিবেটটির জন্য। ওবামা সমর্থকদের দৃঢ় বিশ্বাস, তুখোড় বক্তা ওবামার মনোমুগ্ধকর বক্তব্য শুনে নীরব ভোটারদের অধিকাংশই ওবামাকেই ভোটটি দিবে। আর রমনির সমর্থবৃন্দ মনে করে, আমেরিকান জনগন চার বছর ওবামার শাসন প্রত্যক্ষ করেছে। আমেরিকাবাসী সব সময়ই পরিবর্তন চায়। তাই রমনিকেই তাদের ভোটটি দিবে।

আর আমার মত নির্দলীয় ভোটাররা অপেক্ষা করবো আসন্ন ডিবেটটি দেখার জন্য। সেদিনই আমেরিকার আগামী প্রেসিডেন্টের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।