নিশ্চিন্দিপুরের আকাশে-বাতাসে আশুরার মাতম!

রীতা রায় মিঠু
Published : 26 Nov 2012, 03:40 AM
Updated : 26 Nov 2012, 03:40 AM

গ্রামের নাম নিশ্চিন্দিপুর। পথের পাঁচালীর নিশ্চিন্দিপুর নয়, সাভারের নিশ্চিন্দিপুর। নাম শুনলেই মনে হয়, এখানে সকলে পরম নিশ্চিন্তে বসবাস করছে। গ্রামটির নাম আমি আগে শুনিনি, গতকাল পত্রিকার পাতায় চোখ বুলাতেই নিশ্চিন্তপুরের নামটি চোখে আটকে গেলো। ভালো কোন সংবাদ নয়, পবিত্র আশুরার রাতে নিশ্চিন্তপুরের আকাশে বাতাসে উঠেছে শোকের মাতম। একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে মারা যায় ১২৪ জন পোশাককর্মী(শেষ সংবাদ পাওয়া পর্যন্ত)। আমেরিকাতে চলছিল থ্যাঙ্কস গিভিং উৎসব, ওয়ালমার্টে চাকুরী করার সুবাদে সরকারী ছুটির দিনেও ছিলাম কর্মস্থলে, তাই নিশ্চিন্তপুরের সংবাদটি একটু দেরীতেই পেয়েছি। প্রথম খবরটি জেনেছি ফেসবুকের বন্ধুর কাছ থেকে। গার্মেন্টস ফ্যাকটরীর আগুনে পুড়ে শতাধিক কর্মীর নিহত হবার সংবাদে থ্যাঙ্কস গিভিং উৎসবের রাতেও নেমে আসে বেদনার ছায়া। উৎসব মাটি হয়ে যায়, খাবার -দাবার বিস্বাদ লাগে। মুখে খাবার, মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে আগুনে পুড়ে ঝলসে যাওয়া স্বজাতির মুখ, দুঃখী মেয়েটির ভয়ার্ত আর্তনাদ।

আগুনকে আমি ভয় পাই, খুব বেশী ভয় পাই। খুব ছোটবেলায় নাশকতামূলক আগুনে চব্বিশ পঁচিশ ঘর পুড়ে যেতে দেখেছি। বাড়ীর মালিকানা পাওয়ার জন্য বাড়ীওয়ালা সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে রাতের আঁধারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ভাড়াটিয়াদের ঘরে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে মনের ভেতর আগুন ভীতি স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। সে রাতের আগুনে পুড়ে মারা যায় এক বৃদ্ধা। সেই বৃদ্ধার কয়লা হয়ে যাওয়া দেহটি এখনও চোখে ভাসে।

নিশ্চিন্তপুরের পোশাক কারখানায় পরম নিশ্চিন্তে কাজ করে কয়েক হাজার গার্মেন্টস কর্মী। সাধারণতঃ গার্মেন্টস ফ্যাকটরীগুলোতে চব্বিশ ঘন্টা কাজ চলে এবং এই শিল্পে নারী কর্মীর সংখ্যাই বেশী। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের ক্রম বিকাশের সাথে সাথে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশের কর্ম সংস্থানের ভাল সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার পথে গার্মেন্টস শিল্প অনেক বড় ভূমিকা রেখে চলেছে। শুধু তাই নয়, দেশের তহবিলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশে তৈরী পোশাকের অনেক চাহিদা আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে। আমেরিকার সবচেয়ে বড় রিটেল স্টোর ওয়াল মার্ট, বাংলাদেশের গার্মেন্টসের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। ওয়ালমার্টে প্রতিনিয়ত যে সকল পোশাক বিক্রয় হয়, তার শতকরা সত্তরভাগ পোশাক তৈরী হয় বাংলাদেশে। প্রায়ই আমি চলে আসি 'মেন'স ওয়্যার' অথবা 'লেডিস ওয়্যার' সেকশানে।

আমি চাকুরী করি ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারের কানেকশান সেন্টারে। ডিপার্টমেন্টটি ফোন সার্ভিসের হলেও মাঝে মাঝে আমি চলে আসি 'মেন'স ওয়্যার' অথবা 'লেডিস ওয়্যার' সেকশানে। থরে থরে সাজানো শার্ট, প্যান্টের লেবেল পড়ে দেখি, 'মেড ইন বাংলাদেশ' আছে কিনা। গ্রামীন চেকের শার্ট গুলোর লেবেল না দেখেই বলে দিতে পারি, শার্টটি এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বুকের ভেতর সেই গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য মমতা বোধ করি। আমার ডিপার্টমেন্টটি ফোন সার্ভিসের হলেও কিছু কিছু ক্রেতা আমাদের কাউন্টারে এসে অন্যান্য জিনিসও চেক আউট করে। শার্ট-প্যান্ট চেক আউট করার সময় আমি চট করে শার্টের কলার বা জীন্স প্যান্টের ট্যাগ থেকে দেখে নেই, মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা আছে কিনা। যদি দেখি হন্ডুরাস বা তাইওয়ান লেখা, আমার মন খারাপ হয়ে যায়। 'মেড ইন বাংলাদেশ' লেখা থাকলে, সেই ক্রেতার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে উঠি। ইচ্ছে হয় ক্রেতাকে ডেকে বলি, এই পোশাকটি তৈরী হয়েছে আমার দেশে। বলা আর হয় না, বলে কী হবে, ওরা তো জানবেও না, ধারণা করতেও পারবেনা, এই পোশাকটি তৈরীর পেছনে কত চোখের জল, কত বেদনা লুকিয়ে আছে। মন চলে যায় দেশে, চোখের উপর ভাসে, ঢাকার রাস্তায় খুব সকালে টিফিন কৌটো হাতে নিয়ে সারি বেঁধে চলেছে কিশোরী, নারীর দল। এরা যায় গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে, সারদিন সুঁই সূতোয় ডিজাইন করে চলে নকশী কাঁথায়, পায়ের চাপে সেলাই কলের চাকা ঘুরিয়ে সেলাই করে চলে জামা, শার্ট, প্যান্ট। দিন শেষে হাত গুনতি টাকা হাতে নিয়ে বাড়ী ফিরে, তবেই তাদের সংসারের চাকা ঘুরে উঠে। তবুও তাদের চোখে মুখে থাকে প্রত্যয়, স্বনির্ভর হয়ে উঠার গর্ব। আর তাদের এই গর্বিত পরিশ্রমের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চেষ্টা করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প। অথচ দুঃখের বিষয়, এই কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে গার্মেন্টস ফ্যাকটরীর মালিকেরা ভাবেনা, প্রায়ই দেখা যায়, কর্মীদের বেতনভাতা নিয়ে গন্ডগোল, উৎসব বোনাস দেয়ায় কার্পণ্য, আর দূর্ঘটনায় প্রাণহানির ব্যাপারতো আছেই।

আগুনের ধর্মই হচ্ছে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া। চিতার আগুনে পুড়ে দেহ ছাই হয়, মনের আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয় কত সংসার, '৭১ এর আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল সোনার বাংলা, শত্রুর দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয় কত সম্পত্তি, ঘর-বাড়ি, অসাবধানতার আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায় বস্তির পর বস্তি। কিন্তু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কেন আগুন লাগে? পোশাকশিল্প হচ্ছে দেশের সম্পদ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জণে পোশাক শিল্পের অবদান সবার উপরে। যে শিল্প দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনে, সে শিল্পের কর্মীদের কেন এমন দূর্দশা? কেন তাদের জীবনে নিরাপত্তা নেই, কেনই বা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে এত বেশী আগুন লাগে, আর আগুন লাগার পর কেন বের হয়ে আসার পথ থাকে না? ১৯৯০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৩ বার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগেছে, পুড়ে অথবা বিষাক্ত ধোঁইয়ার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচশ'র বেশী কর্মী, কেনো?
গার্মেন্টস ফ্যাকটরীগুলোতে নাকি প্রবেশদ্বার থাকে, বের হওয়ার রাস্তা থাকেনা। কারখানার ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই কলাপ্সিবল গেট বন্ধ করে দেয়া হয়। কর্মীরা শুধু প্রবেশ পথ চিনে, এক্সজিট জানে না। এত বড় বিল্ডিংযের প্রত্যেক তলাতেই কাজ চলে, দূর্ঘটনা ঘটে গেলে সকলের মনে ভয়ের সঞ্চার হয়, বাঁচার তাগিদে সকলেই হুড়মুড় করে একটিমাত্র চেনা রাস্তায় এসে ভীড় করে, ঠেলাঠেলি করে বের হতে গিয়ে পায়ের চাপে পিষ্ট হয়েও কেউ কেউ মারা যায়, তারপরেও যে কয়জন গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, তারাও বের হতে পারে না, কলাপসিবল গেট তালাবন্ধ থাকে। কী অমানবিক ব্যবস্থা! এ সবই শোনা কথা, কখনও নিজের চোখে দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু এমন কেন হবে? যে কর্মীদের পরিশ্রমের উপর দাঁড়িয়ে থাকে এত বড় শিল্প, সেই শ্রমিকদের সুস্থভাবে কাজ করার কোন সুযোগ থাকবে না, বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকার থাকবে না, এ কেমন মানবতা?

২০০৬ সালে স্পেকট্রাম নামের গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে কত শ্রমিকের অকালমৃত্যু ঘটেছিল। স্পেকট্রামের ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। ধারণা করা হয়েছিল, শিল্পমালিকগন আরও বেশী সচেতণ হবেন, কর্মীদের প্রতি আরও বেশী উদার হবেন। নিশ্চিন্দিপুরের ঘটনায় মনে হচ্ছে, সে গুড়ে বালি পড়েছে। গতকাল এক টকশো'তে, বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি জানিয়েছেন, গার্মেন্টস ফ্যাকটরীতে কাঠামোগত সব রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে, একটি দরজার পরিবর্তে তিনটি দরজা আছে, মাসে মাসে ফ্যাকটরী ইন্সপেকশানের ব্যবস্থাও আছে। বিজিএমইএর চল্লিশটি কমপ্লায়েন্স টিম আছে, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে ফ্যাক্টরীগুলো ঘুরে দেখে সমস্যা চিহ্নিত করা। সব রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও দূর্ঘটনা ঘটছে কেন প্রশ্নে উনি বলেছেন, প্র্যাকটিসের অভাব আছে, ম্যানেজমেন্টের গাফিলতি থাকতে পারে, আবার নাশকতামূলক ঘটনা ঘটার সম্ভাবনাও থাকে। উনার কথায় যুক্তি আছে, তবে এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কমপ্লায়েন্স টিম যেহেতু রেগুলার ইন্সপেকশানে যায়, প্রতিবারই কি তারা শুধুমাত্র ফ্যাকটরীর কাঠামোগত ত্রুটি বিচ্যুতি পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসে? ফ্যাকটরীর শ্রমিকেরা নিজের সেফটি সম্পর্কে কতটুকু সচেতন, তা কী পরীক্ষা করা হয় না? নিজেদের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরার এক পর্যায়ে উনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, আমাদের পোশাক শিল্পের নিয়মিত কাস্টমার যারা আছেন, ( যেমন ওয়াল মার্ট, সিয়ার্স) ক্রয়চুক্তি সম্পন্ন করার পূর্বে তারা তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠায় গার্মেন্টস ফ্যাকটরীগুলো পর্যবেক্ষণ করতে। কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ফ্যাকটরীর নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত না হওয়া পর্যন্ত নাকি তারা ক্রয়চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে না।

বিজিএমইএ'র প্রাক্তন সভাপতি সাহেবের প্রতিটি কথা শুনতে ভাল লেগেছে, যুক্তিসঙ্গতও মনে হয়েছে। উনার কথার মধ্যে আন্তরিকতার স্পষ্ট ছাপ ছিল, নিশ্চিন্দিপুরের গার্মেন্টস ফ্যাকটরীর আগুনে পুড়ে যারা মারা গেছেন, দগ্ধ হয়ে যারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সকলের প্রতি ছিল উনার সমবেদনা। নিজেদের অক্ষমতার দায় মাথায় নিয়ে সকলের কাছে ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করেন নি, তারপরেও সত্যিটুকু সত্যিই রয়ে গেছে। আশুরার শোকের মাতম শুরু হয়েছে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে। মাত্রই গত বছর হামিম গ্রুপের এক ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগে মারা গেছিল বিশ জন শ্রমিক। কয়েকদিন আগেই রায়ের বাজার বস্তি আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে, এক পরিবারেই জীবন্ত পুড়ে মারা গেছে আটজন, বাপের কোল থেকে ছিটকে পড়েছে ছেলে, চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়েছে, এমন প্রায়ই ঘটে চলেছে। বস্তিতে আগুন লাগার একশো টি কারণ থাকতে পারে, বস্তিতে মানুষ মানবেতর জীবন কাটায়, পরিকল্পনাহীনভাবে গড়ে উঠে বাসের অযোগ্য ঘর-বাড়ি, কিনতু কারখানাতে কেন আগুন লাগবে? কারখানা গড়ে উঠার কথা পরিকল্পিতভাবে, কারখানা হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠান, একটি কারখানার সাথে কত পরিবারের রুটি-রুজীর সম্পর্ক, কত শত পরিবারের বেঁচে থাকার সম্পর্ক, মানুষের জীবন-মরণের ব্যাপার যে প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত, সেই প্রতিষ্ঠানে এত ঘন ঘন দূর্ঘটনা ঘটবে কেন? কেনই বা ফ্যাক্টরীতে প্রবেশের রাস্তা সংকীর্ণ থাকবে? অনেক সময় দেখা গেছে, ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী সময়মত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনা, রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় একটির বেশী গাড়ী দাঁড়াতে পারেনা, ফলে একটি গাড়ীতে নিয়ে আসা অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম দিয়ে সম্পূর্ণ আগুন নেভাতে প্রচুর সময় লেগে যায়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও বেড়ে যায়।

দুঃখের কথা, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি আছে, এই তথ্যটি প্রমান করার জন্যই বোধ হয় একই সময়ে চিটাগাং এর নির্মানাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে পড়েছে, মারা গেছে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন সুস্থ মানুষ। এবং আরও বেশী দুঃখের কথা, ফ্লাইওভারের গার্ডারটি তৃতীয়বারের মত ভেঙ্গে পড়লো। আর কত বলা যায়? ভাল কিছু শোনার আশায় পত্রিকার পাতায় চোখ রাখি, টিভির পর্দায় চোখ রাখি, চোখে পড়ে শুধুই ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, অপহরণ, নাশকতা, মৃত্যু, অপমৃত্যুর সংবাদ। ভাল খবর একেবারেই থাকে না, তা নয়, তবে এত বেশী দুঃসংবাদের ভীড়ে সুসংবাদগুলো আর সংবাদ থাকেনা। আমাদের ভাগ্যটাই এমন, ছোট একটি ভাল সংবাদের পেছনে এসে হাজির হয় দশটি দুঃসংবাদ।