যে ছবি কথা বলছে, যে ছবি কথা বলবে!

রীতা রায় মিঠু
Published : 10 Dec 2012, 01:13 PM
Updated : 10 Dec 2012, 01:13 PM

অনলাইনে সংবাদপত্র পড়া আমার অনেক দিনের পুরাণো একটি নেশা। শত ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বের করে, আর কিছু না হোক, খবরের শিরোণামগুলো দেখে রাখি। খুঁটিনাটি পড়িনা , কারণ পত্রিকার আট পাতা জুড়ে থাকে দূর্নীতি, অপহরণ, দূর্ঘটনা, চুরী, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী পাচার, বিদেশ থেকে শ্রমিক ফেরত, পদ্মা সেতু নিয়ে দূর্ণীতি, দুদক, বিশ্বব্যাঙ্ক, অর্থমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী, রেল মন্ত্রী, কালো বিড়াল, সাদা বিড়ালের গল্প। প্রথম পাতা, শেষ পাতায় তো এ সমস্ত খবর থাকেই, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, জেলা সংবাদেও একই বিষয় নিয়েই নাড়াচাড়া হয়ে থাকে। এতদিনে আমি পাকা রাঁধুণী হয়ে গেছি, হাঁড়ির ভেতরের একটি ভাতে টিপ দিয়েই বুঝে ফেলি, অন্য ভাতের কী অবস্থা!

তবে ডিসেম্বার মাসে খবরাখবরে মাঝে মাঝে একটু আধটু চমকও থাকে। এ বছরের ডিসেম্বারে চমক যেনো অন্যবারের তুলণায় বেশীই মনে হচ্ছে। চমকও বেশী, তাই হই হই রই রইও বেশী। যদিও যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুকে ঘিরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, অবশ্য দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বলার চেয়ে, উত্তপ্ত করা হচ্ছে বলা ভাল। তার পরেও ভাল খবরও এ মাসেই শোনা যাচ্ছে। যেমন ক্রিকেটের কথাই ধরি না কেন, ডিসেম্বারেই তো বাংলাদেশ টীম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ জিতে ক্রীড়াঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করে দিল। ব্যাপারটিতে উত্তাপ না থাকলেও দারুণ উত্তেজনা তো আছে। শোনা যাচ্ছে, এই মাসেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বের হবে, এই নিয়েও সারাদেশে নয় শুধু, পৃথিবীর সর্বত্রই, যেখানেই বাংলাদেশীদের বসবাস, সেখানেই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কারো গায়ে লাগছে শীতের উষ্ণতা, আর কারো শরীর জ্বলছে গ্রীষ্মের দাবদাহে।

যাদের শরীর গ্রীষ্মের দাবদাহে জ্বলছে, তারাই গতকালকে সারাদেশে অবরোধ ডেকেছে। কাকে অবরোধ, কেনই বা অবরোধ, তা একমাত্র অবরোধকারী পক্ষ এবং অবরুদ্ধ পক্ষের মানুষের জানার কথা। একইরকমভাবে একই কায়দায়, অবরোধকে প্রতিরোধ করার নামে আরেক দল তৈরী হয়েছে। আমজনতার এই সমস্ত অবরোধ-প্রতিরোধ নিয়ে চিন্তা করবার সুযোগ কম। আর সেই জন্যই পুরাণো ঢাকার বিশ্বজিত তার দর্জিব্যবসার 'লক্ষ্মীরূপী' গ্রাহকের ডাকে সাড়া দিতে পায়ে হেঁটে দোকানের দিকে যাচ্ছিল। তরুণ ব্যবসায়ীর মাথায় ব্যবসা সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনা থাকার কথা, অবরোধ, হরতালের জোস থাকার কথা না। অবরোধ আর প্রতিরোধের জোসে যারা উত্তপ্ত হয়েছিল, দর্জি দোকানে যাওয়ার পথে 'বোকা দর্জি' ঐ উত্তপ্তদের মধ্যিখানে আটকা পড়ে গেছিল। বোকাদেরও প্রাণের ভয় থাকে, তাদেরও বাঁচার অধিকার থাকে, আর তাই প্রাণের ভয়ে বিশ্বজিত দৌড়ে পালাতে চেয়েছিল। অবরোধ-প্রতিরোধ বাহিণীর গলায় ছিল 'হা রে রে রে' গর্জন, হাতে ছিল দা, চাপাতি, যে দর্জির হাতে থাকে সুঁই-সূতো, সে তো চাপাতি, দা, বটি হাতে মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় দেখলে ভয় পাবেই। ভয় পেয়েই সে ঐ বিপদ থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। পারেনি বাঁচতে, পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি বলে দিচ্ছে, বিশ্বজিতের মরণ হয়েছে। মরণ হয়েছে অবরোধ প্রতিরোধ বাহিণীর কর্তা ব্যক্তিদের হাতে। আরও পরিষ্কারভাবে, সংবাদ পত্রের বরাত দিয়ে বললে বলতে হয়, সরকারী ছাত্র সংগঠন, ছাত্রলীগের কিছু ' কাপুরুষের' হাতে বিশ্বজিতের মরণ হয়েছে।

দেশের মাঝরাত, আমেরিকার মধ্যদুপুরে অনলাইনে গিয়ে সংবাদের শিরোণাম দেখছিলাম, পত্রিকার হোম পেজে বিশ্বজিতের যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তা দেখে একটুক্ষণ স্থির হয়ে বসে ছিলাম। ছবিটি দেখে বুঝতে পারছিলাম না, কোনজন বিশ্বজিৎ! একদল ছেলে একসাথে দাঁড়ানো, দেখে মনে হয়, পাড়ার পরিচিত ছেলের দল, কিছু একটা নিয়ে বচসা করছে। এরমাঝেই যে একজন বিশ্বজিত, যে কিনা এর কিছুক্ষণ পরেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, ঠিক বলিনি, এদের মধ্যেই একজন ছিল বিশ্বজিত, যাকে কাপুরুষেরা কুপিয়ে কুপিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে, তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। পত্রিকার বর্ণনানুসারে যার পরণে কালো ডোরা শার্ট, ভেতরে লাল গেঞ্জী, সে-ই বিশ্বজিৎ। ছবিতে কালো ডোরা শার্টে একজনকেই দেখা যাচ্ছিল, যার চোখে মুখে কিছুটা ভয় ও বিস্ময় ছিল। ভয় ছিল কারণ কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে তাকেই কেনো সবাই জাপটে ধরলো, এবং বিস্ময়ও একই কারণে। এগুলো বিশ্বজিৎ আমাকে বলে নি, বিশ্বজিতের ছবি বলছে যে! তবে পত্রিকার ছবিটি খুব বেশী ভয়ংকর দেখাচ্ছিল না, কারণ বচসা করছে মনে হলেও ছবিতে বিশ্বজিৎকে তরতাজা প্রাণের যুবকের মতই দেখা যাচ্ছিল, সেখানে মৃত্যুর গন্ধ ছিল না। বয়স কতই বা হবে, আমার সন্তানের বয়সী হবে। এই ছবি দেখে কোনভাবেই আন্দাজ করা যাবে না, সদ্য যুবকটিকে সবাই চারদিক থেকে ধরে রেখেছে যেন কোথাও পালাতে না পারে! এই ছবিটির দিকে তাকালে বিশ্বাসই হতে চায় না যে একটু পরেই এই কালো ডোরাকাটা শার্ট পরিহিত ছেলেটি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে না, রক্তাক্ত নিথর দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে!

বিশ্বজিত দেশে মায়ের কাছে যায়নি অনেকদিন। তার মা শরীয়তপুরে পূজা কাটিয়েছে ছোট ছেলেকে ছাড়াই। তবুও মায়ের মনে হয়তো সান্ত্বণা ছিল, ছেলে পূজা আর ঈদে কাজের অর্ডার পেয়েছে প্রচুর, অর্ডার ঠিকমত সাপ্লাই দিতে পারলে সংসারের আয় উন্নতি হবে, গৃহ উপচে উঠবে ধানে-ধনে! আহারে! মায়ের মন রে! বাকী জীবন পত্রিকার পাতায় ছেলেকে দেখতে পাবে, জীবন্ত ছেলে, শার্ট-প্যান্ট পড়ে দোকানের পথে যাচ্ছিল, এই ছবিটাই মনে গেঁথে থাকবে। এই ছবিই কথা বলবে, মাত্র চব্বিশ বছরেই ছেলে তার পেশার প্রতি যত্নশীল, গ্রাহকের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠেছিল, এই ছবিই বলে দিবে, দা চাপাতি নিয়ে শুধু ইসলামী ছাত্র শিবিরের পান্ডারাই ঘোরে না, ছাত্রলীগের আতি পাতি নেতাদের হাতেও দা-চাপাতি থাকে! এই ছবিই বলে দিবে, দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মানুষ হত্যা করার কাপুরুষতা শুধু একাত্তরের রাজাকার আল-বদরেরাই করেনি, শুধু ছাত্র শিবিরের বীর পুরুষেরাই করে না, ছাত্রলীগের ছেলেরাও করে! এই ছবিই বলে দিবে, এককালের তুখোড় ছাত্র সৈনিকের উত্তরসুরীরা আজ দা, চাপাতি দিয়ে খেটে খাওয়া যুবককে রাস্তার উপর কুপিয়ে মারে!

এ ছবিই বলে দিবে, এ দেশকে অন্ধকার যুগের দিকে টেনে নেয়া হচ্ছে। এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। একচল্লিশ বছর আগেও দেশের অবস্থা এমন ছিল না। একত্রিশ বছর আগেও দেশের অবস্থা এমন ছিল না, এমনকি একুশ বছর আগেও এমন অনাচার ছিল না দেশে, দেশে গণতন্ত্র আসার সাথে সাথে সবাই গণতন্ত্রী হয়ে গেলো!

ডিসেম্বার মাস আমাদের মহান বিজয়ের মাস! এ মাসে কিসের অবরোধ! কার বিরুদ্ধে অবরোধ! এ মাসে কিসেরই বা প্রতিরোধ, কার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ! বছরের এগারো মাসই তো রাজনৈতিক হানাহানি, রাজনৈতিক চুলোচুলি, দূর্ণীতির কিসসা চলছেই, এই একটা মাত্র মাস, যে মাসে আমাদের দেশটির আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হয়েছে, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিজয় এসেছে, এ মাস তো আমাদের বিজয়ের মাস! তার সম্মান রক্ষার্থেও কী আমরা পারতাম না, অবরোধ, প্রতিরোধ, হরতালের এই বিশ্রী খেলা বাদ দিতে? রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের সকলেরই সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনী আছে, তাঁদের মনে কী একবারও বিশ্বজিৎ নামের অতি সাধারণ কিন্তু স্বাবলম্বী ছেলের ভয়ার্ত, করুণ মুখের ছবি ভেসে উঠবে না? বিশ্বজিতের মায়ের বুকফাটা আর্তণাদ যদি অভিশাপ হয়ে বর্ষায়, সকল রাজনীতিবিদের উপর, সেই ভয়ও কী তাদের মনে জাগে না!

বিশ্বজিতের মায়ের প্রতিঃ মাগো! আমিও সন্তানের মা, সন্তানের গায়ের উত্তাপ একটু বাড়লেই আমি কাতর হয়ে পড়ি, ফোন করে দূরে থাকা সন্তানের গলার আওয়াজ না শুনতে পেলে পাগল হয়ে যাই, তারপরেও আপনার ব্যথা পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই। আপনার ছেলেটিকে, আপনার তরতাজা ছেলেটিকে অহেতুক, বিনা কারণে, বিনা দোষে কিছু 'বীরপুরুষ' দা দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে!! মাগো, আপনার বুকে যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে, যতক্ষণ তার তাপ আমাদের কারো গায়ে না লাগবে, ততদিন আমরা আপনার কষ্ট বুঝবো না। আমরা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবো, আমাদের মত নিরুত্তাপ প্রাণীদেরকে আপনি ক্ষমা করুণ। আপনি কাঁদুন মা, হাহাকার করে কাঁদুন, বুক চাপড়ে কাঁদুন, যাদের কারণে, যাদের দ্বারা আপনার জীবনের এই চরম সর্বনাশ ঘটে গেছে, আপনার কান্না, আপনার দীর্ঘশ্বাস যেনো ঐ সকল অকাল কুষ্মান্ডের গায়ে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। আমি ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থণা করি।