এলভিস প্রিসলি: মিসিসিপির গৌরব

রীতা রায় মিঠু
Published : 23 Jan 2013, 06:43 PM
Updated : 23 Jan 2013, 06:43 PM

পুরো নাম এলভিস অ্যা্রন প্রিসলি, বিশ্বে পরিচিত পপ সম্রাট, কিং অব রক এন্ড রোল, অথবা শুধুই এলভিস নামে। এলভিসের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৮ই জানুয়ারী, মঙ্গলবার। জন্মগ্রহন করেন ইস্ট মিসিসিপির টুপেলো শহরে। মিসিসিপির গৌরব, এলভিস প্রিসলীর বাবার নাম ভার্নন প্রেসলী, মায়ের নাম গ্ল্যাডিস প্রেসলী। আমেরিকার সবচেয়ে গরীব রাজ্যটির নাম মিসিসিপি, গরীব রাজ্যে প্রায় সকলেই গরীব। এলভিসের জন্মের সময় তার বাবা-মাও গরীবই ছিলেন। অনেকটাই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা ছিল তাদের। খুবই কায়ক্লেশে দিন যাপন করতেন তারা। দুই কামরার যে ছোট বাড়ীটিতে এলভিস বড় হয়েছিল, সেই ছোট বাড়ীটি এলভিসের বাবা কিনেছিলেন মাত্র ১৮০ ডলারের বিনিময়ে। টানাটানির সংসারে এলভিস ছিল বাবা মায়ের আনন্দ, বাবা মায়ের গৌরব। সেই ছোট্টবেলা থেকেই এলভিসের গলায় সুর খেলা করতো। ছেলেবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। দামী ইন্সট্রুমেন্ট কিনে দেয়ার ক্ষমতা ছিল না বলে, বাবা খুব সস্তায় একখানি গীটার কিনে দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে এলভিসের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। একসময় তার বাবা ও মা, দুজনেই অনুধাবন করতে পারে, মিসিসিপিতে থেকে ছেলে খুব বেশীদূর এগোতে পারবে না। এলভিসের যখন মাত্র তের বছর বয়স, সংসারের চাকা টানতে টানতে বিপর্যস্ত বাবা আরেকটু ভালো থাকার ঊদ্দেশ্যে টেনেসী রাজ্যের মেমফিস শহরে পাড়ি জমান। সেখানে এলভিসকে পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। স্কুলেই মিউজিক কোর্স নেয়া শুরু করে। বড় শহরে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ অনেক বেশী, এলভিসও সুযোগগুলো কাজে লাগাতে চেষ্টা করে। লেখাপড়ার পাশাপাশি তার গানের চর্চা চলতে থাকে। তখন থেকেই সে চার্চে, স্কুলে, এমন কি পাড়ার অনুষ্ঠানেও গান করতো।

হাই স্কুল পাশ করার পরেই তাকে রুটি রুজীর সন্ধানে বের হতে হয়। স্কুলপাশ ছেলেকে ভালো কোন কাজ কে দেবে! তাই সংসারের প্রয়োজনে এলভিস বিভিন্ন ধরণের অড জব শুরু করেন। বেশ কিছুদিন কাজ করেছিলেন সিনেমা হলে, কখনও বা ক্রাউন ইলেকট্রিক কোম্পাণীর ট্রাক চালিয়েছেন। সাথে সাথে গানের চর্চাও চালিয়েছেন।

তার গানের হাতেখড়ি হয়েছিল আঞ্চলিক ভাষায় ' দ্য হিলিবিলি ক্যাট' দিয়ে। পরবর্তীতে লোক্যাল রেকর্ডিং কোম্পাণীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন ১৯৫৫ সালে। রক এন্ড রোল সঙ্গীতকে বিশ্ব দরবারে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন এলভিস প্রেসলি। তার গানের শ্রোতাদের মধ্যে নানা বয়েসীরা থাকলেও, টিন এজ ছেলেমেয়েরা ছিল প্রেসলীর গানের অন্ধ ভক্ত। বিশেষ করে মেয়েরা প্রেসলির কোমড় দুলিয়ে নাচ করাকে খুবই পছন্দ করতো। যদিও ঐ সময় টিভিতে প্রিসলির কোমড়ের নীচে থেকে দেখানো হতো না, তারপরেও কোমড় দুলানোর জন্যই প্রিসলীর 'নিকনেম' হয়েছিল ' এলভিস দ্য পেলভিস'। এত বেশী গান তিনি করেছিলেন যে মৃত্যুর আগেই তাঁর গাওয়া 'সলো' এবং অ্যালবাম গানের বিক্রীত সংখ্যা ছিল ৬০০ মিলিয়নের উপরে। খেলনা গীটার দিয়েই তার গানের হাতেখড়ি, এরপর থেকে শুধুই সামনের দিকে পথ চলা, রকস্টার, রক এন্ড রোল কিং, পপ সম্রাট হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি!

এলভিস শুধু সঙ্গীতেই পারদর্শী ছিলেন না, কারাটে তে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। অভিনয়েও কোন অংশে কম ছিলেন না। ১৯৫৬ সালে 'দ্য ডরসী ব্রাদার্স' নামে স্টেজশো'তে এলভিস ছয়বার উপস্থিত হয়েছি্লেন। যে ৩৩টি মুভীতে উনি অভিনয় করেছিলেন, তাদের মধ্যে ১৯৫৬ সালে তৈরী ছবি' লাভ মি টেন্ডারই' ছিল তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি। তাঁর অভিনীত ছবিগুলো সমালোচকদের কাছ থেকে আশানুরুপ সাড়া না পেলেও বক্স অফিসে সাড়া জাগিয়েছিল। ছবিগুলো থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশী আয় হয়েছে। ষাটের দশকের সকল বিখ্যাত অভিনেতাদের সাথে অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতেন।
তার কর্মময় জীবন ছিল নানা রঙে আঁকা। গানপাগল মানুষটি ১৯৫৮ সালে মিলিটারীতে যোগ দেন। সৈনিক জীবনের শুরুতে জার্মানীতে অবস্থানের সময় চৌদ্দ বছরের প্রিসিলা ওয়াগনারের প্রেমে পড়েন এবং ১৯৬৭ সালের ১লা মে তার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরের বছর ১লা ফেব্রুয়ারী, তাদের একমাত্র কন্যা সন্তান লিসা ম্যারী প্রেসলীর জন্ম হয়।

'৭০ দশকের গোড়ার দিকেই প্রেসলী পুরোদমে লাইভ কনসার্ট করা শুরু করেন। লাসভেগাস কনসার্টগুলোর সবগুলোই অগ্রিম বিক্রী হয়ে গেছে। আমেরিকার সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন এই পপ সম্রাট, পাঁচশ'র বেশী লাইভ কনসার্ট করেছিলেন, যে সমস্ত কনসার্টের অধিকাংশই অগ্রিম বিক্রী হয়ে গেছিল। জীবনে প্রচুর এওয়ার্ড পেয়েছেন, শুধুমাত্র গসপেল মিউজিকের জন্যই তিনবার গ্র্যামী এওয়ার্ড জিতেছিলেন।

ছয় ফিট উচ্চতার প্রিসলী দেখতে ছিলেন সুদর্শন, ছেলেবেলায় ব্লন্ডেড হেয়ার থাকলেও বড় হতে হতে মাথার চুলগুলো কালো হয়ে যায়। এলভিস সম্পর্কে আরেকটি মজার তথ্য আছে। আমেরিকায় সবার বাড়ীতেই পোষা প্রাণী আছে, বেশীর ভাগ আমেরিকানের পছন্দ কুকুর অথবা বেড়াল। এলভিসের পোষা প্রাণীটি ছিল 'স্ক্যাটার' নামে এক শিম্পাঞ্জী।

তার বেশ কিছু গানের এলবাম মাল্টিপ্ল্যাটিনাম সেল হয়েছে, বারোটি এলবামের দুইশ কপি বের হয়েছে।. হার্টব্রেক হোটেল, আই ওয়ান্ট ইউ আই নিড ইউ আই লাভ ইউ, হাউন্ড ডগ, ডোন্ট বী ক্রুয়েল, লাভ মী, আই বেগ অফ ইউ, জেইলহাউজ রক সহ প্রচুর এলবাম বিলবোর্ডের এক নাম্বার চার্টে সপ্তাহের পর সপ্তাহ শোভা পেতো। তাঁর কত যে অনুরাগী ছিল, তার কোন হিসেব নেই। ১৯৬৫ সালে বিটলস এসেছিল আমেরিকাতে, তারা একজন মাত্র ব্যক্তির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, সে এলভিস প্রেসলী। প্রেসলী এবং বিটলস একসাথে একটি পুরো দিন কাটিয়েছে ক্যালিফোর্ণিয়ায় নিজের বাড়ীতে।

সকল ভালোর পেছনে খারাপও আসে, প্রেসলির বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।'৭৩ সালের ৯ই অক্টোবার, প্রিসিলার সাথে এলভিসের ডিভোর্স হয়ে যায়। স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স, পৃথিবীর সর্বত্র প্রোগ্রাম করার জন্য ছুটোছুটি, ধীরে ধীরে শরীরের ওজন বৃদ্ধি, সব মিলিয়ে এলভিসকে কাবু করে ফেলে। ১৯৭৭ সালের ১৬ই অগাস্ট, মঙ্গলবার, মাত্র ৪২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এলভিস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু পরবর্তি অটপসী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রেসলী ড্রাগ নিত, কারণ তাঁর রক্ত কনিকায় ড্রাগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।পাওয়া গেছে।

প্রেসলীর মিসিসিপির বাড়ীটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এই বাড়ীটিতেই একদিন জন্মেছিল এলভিস নামের ছোট শিশু, দুই কক্ষের মূল বাড়ীটিকে অক্ষত রেখেই বাকী অংশে মিউজিয়াম করা হয়েছে। বাড়ীর বাইরের বিশাল এরিয়া জুড়ে করা হয়েছে 'এলভিস প্রেসলী পার্ক'। প্রতি বছর গড়ে পঞ্চাশ হাজার দর্শণার্থী আসে তাদের প্রিয় শিল্পীর জন্মস্থানটি দেখে যেতে। টেনেসী রাজ্যের মেমফিস শহরের বাড়ীটিতেও প্রতি বছর, প্রতি দিন প্রচুর মানুষ আসে, কারণ মিসিসিপিতে জন্ম নিলেও মৃত্যু টা হয়েছে মেমফিসে। কাকতালীয়ভাবেই তারিখ ভিন্ন হলেও প্রেসলীর জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছে মঙ্গলবার।

ছেলেবেলায় দারিদ্রের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠা প্রিসলী জীবনে অনেক কিছু পেয়েছেন, আরও অনেক কিছুই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সর্বনাশা মৃত্যু তাঁকে বড্ড কম বয়সে নিয়ে গেছে। মৃত্যুরই বা দোষ কি! কয়েক বছরের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি, স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স, পৃথিবীর সর্বত্র প্রোগ্রাম করার জন্য ছুটোছুটি, ধীরে ধীরে শরীরের ওজন বৃদ্ধি, সব মিলিয়ে এলভিসকে কাবু করে ফেলে। ১৯৭৭ সালের ১৬ই অগাস্ট, মঙ্গলবার, মাত্র ৪২ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এলভিস মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যু পরবর্তি অটপসী রিপোর্টে তাঁর রক্ত কনিকায় ড্রাগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জিনিয়াসদের জীবন খুব বেশী দীর্ঘ হয় না, মাত্র ৪২ বছর বয়সে এলভিসের মৃত্যু তা আরেকবার প্রমান করে। আবার একমাত্র জিনিয়াসরাই মরে গিয়ে নতুনভাবে সবার মাঝে ফিরে আসেন। ভক্ত অনুগ্রাহীরাই তাঁদেরকে হারিয়ে যেতে দেয় না। গুণীজন তাঁদের কর্মের মাঝেই সকলের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন। এলভিস প্রেসলিও তেমনই বেঁচে আছেন সকলের মাঝে। তাঁর মৃত্যুর পরে অনেক তারকা শিল্পী তৈরী হয়েছে, তারপরেও এলভিস প্রেসলী একজনই। মৃত্যুর এত বছর পরেও এলভিসের গানের সিডির চাহিদা একই রকম আছে।

৮ই জানুয়ারী ছিল এলভিস প্রিসলীর ৭৮তম জন্মদিন! সারা বছরই তার মিসিসিপির বাড়ী ও মেমফিসের বাড়ী লোকে লোকারণ্য থাকে, আর ৮ই জানুয়ারী তাঁর জন্মদিন বলে কথা! পপ সম্রাটকে মিসিসিপির মানুষ প্রান দিয়ে ভালোবাসে, এলভিস প্রিসলী মানেই মিসিসিপি, মিসিসিপি মানেই এলভিস প্রিসলী!