বিশ্ব নারী দিবসে পৃথিবীর সকল নারীদের প্রতি শুভেচ্ছা!

রীতা রায় মিঠু
Published : 7 March 2015, 07:38 PM
Updated : 7 March 2015, 07:38 PM

আজ ৮ই মার্চ, বিশ্বনারী দিবস। পৃথিবীর সকল নারীর জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন, অত্যন্ত সম্মানের দিন। নারীর সাফল্যের স্বীকৃতির দিন। তবে দিনটি শুধু নারীকে সম্মানিত করার মাধ্যমে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, সম্মানের ভাগ পুরুষকেও সমানভাবেই দেয়া হয়েছে। নারীর সকল সাফল্যের পেছনে পুরুষের অবদান কোনভাবেই কম নয়। কারণ, নর'কে বাদ দিয়ে নারী নয়। পৃথিবীর সকল সৃষ্টির পেছনে আছে নর এবং নারীর সমান অবদান। একটি নতুন প্রাণ সৃষ্টি থেকে শুরু করে, প্রতিটি সৃষ্টিশীল কাজে নর এবং নারীকে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে হয়। জন্মদাতা পিতা যেমন সত্যি, গর্ভধারীণি মাতাও তেমনই সত্যি। একটি শিশুর বৃদ্ধিতে যেমন স্নেহময় পিতাকে পাশে থাকতে হয়, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখা পর্যন্ত মা'কে পাশে থাকতে হয়। এভাবেই ঈশ্বর এই পৃথিবীর সকল কল্যানে নর ও নারীর ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন এই পৃথিবী, সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখী থেকে শুরু করে প্রতিটি ধূলিকনা, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর চালিকাশক্তির প্রধান ভূমিকায় রেখেছেন মানুষকে। মানুষ এসেছে নর এবং নারী হয়ে, 'আদম এবং ঈভ' এর রূপ ধরে। আদম এবং ঈভ আমাদের পিতা ও মাতা। পৃথিবীর কোটি কোটি ছেলে-মেয়ে তাঁদের সন্তান। সৃষ্টির আদি থেকেই পৃথিবী নামক গাড়ীর চাকা ঘুরছে নর ও নারীর যৌথ প্রচেষ্টায়। আর তাই 'নারী' কবিতায় কবি গেয়েছেন,

"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"

বছরের একটি বিশেষ দিন, ৮ই মার্চ 'বিশ্ব নারীদিবস' হিসেবে পালন করা হয়। কেন শুধু নারীদের জন্যই আলাদা করে 'নারীদিবস' পালন করা হয়, তার পেছনের ইতিহাস জানতে হলে খুব বেশীদূর যেতে হয় না। সৃষ্টির কাঠামোতে নর আর নারীকে সমান দক্ষতায় আঁকা হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতেও নারীকে নিয়ে কোন সুন্দর কাব্যগাঁথা রচিত হয় নি, পুরুষশাসিত সমাজে সংসারে নারীর ভূমিকা ছিল শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনে অংশগ্রহণ, সন্তান লালন-পালন এবং সংসার প্রতিপালনেই সীমাবদ্ধ। তাদের জন্য অনুকূল শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল না, বাইরের পৃথিবীকে জানার কোন সুযোগ ছিল না। নারীকে রামায়নের 'লক্ষ্মণ গন্ডী'র ভেতর রাখা হয়েছিল। এমন কি 'লক্ষ্মণ গন্ডী'র ভেতরে থেকেও নারী যে সৃষ্টিশীল কাজগুলো করে গিয়েছেন, তার কোন স্বীকৃতিও ছিল না। এভাবেই নারীকে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছিল। সেই কোনঠাসা নারীদের মধ্যে থেকেই একজন, দু'জন করে নারী সমাজের সকল বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেছে, সেই একটু একটু চেষ্টা দিনে দিনে বেড়ে নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সমগ্র নারী জাতিকে উৎসাহিত করেছে। এভাবেই নারী 'লক্ষ্মণ গন্ডী' থেকে বের হয়ে বাইরের দুনিয়ায় পা রেখেছে। সংসারের শ্রীবৃদ্ধিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাইরের কাজে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে। সংসারের পাশাপাশি দেশের উন্নয়ণেও নারীর অংশগ্রহণ দিনে দিনে বেড়েছে। আর এভাবেই নারীর মনে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী হয়েছে, সচেতনতা থেকে তৈরী হয়েছে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলনই নারীকে আজ এতদূর নিয়ে এসেছে। যদিও পুরুষ আর মহিলার সম অধিকার চাওয়া আর পাওয়াতে বিস্তর ফাঁক রয়ে গেছে, তারপরেও সচেতন নারীর প্রাপ্তির ঝোলায় অর্জন একেবারে কম নয়। সেই অর্জনেরই একটি হচ্ছে, আজকের এই 'বিশ্ব নারী দিবস'।

অতীতে ৮ই মার্চ মূলতঃ 'বিশ্ব শ্রমজীবি নারী দিবস' হিসেবে পালিত হতো। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই 'শ্রমজীবি নারী দিবস' হিসেবে দিনটি পালন করা হতো। এই দিনটি প্রথমদিকে সোস্যালিস্ট পলিটিক্যাল ইভেন্ট হিসেব পালিত হতো পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া এবং পূর্ববর্তী সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্লকে। পরবর্তীতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দিবসটি রাজনৈতিকভাবে পালিত না হয়ে পুরোপুরি সামাজিকভাবে পালিত হতো। এই দিনে নারীকে তার পুরুষের পক্ষ থেকে জানানো হয় সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, বিনয় বা প্রেম। অনেকটাই মাদার্স ডে বা ভ্যালেনটাইন'স ডে'র আদলে দিনটি উদযাপিত হয়ে থাকে। পরবর্তীতে জাতিসংঘেও সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে নারীর জীবন সংগ্রাম, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি খুব জোরালো সমর্থণ পেয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ই মার্চ 'বিশ্ব নারী দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

জাতীয়ভাবে নারী দিবস প্রথম উদযাপিত হয়েছিল ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে। তৎকালীন সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকা নারীকে তার কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সম্মাননা জানাতে দিনটি নির্বাচিত করে। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে 'নারী দিবস' উদযাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ঐ সম্মেলনে জার্মান সমাজবিদ লুইস জিৎস আনতর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব করেন, তাঁকে সমর্থন জানান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন। ১৭টি দেশ থেকে সম্মেলনে আগত ১০০ জনেরও অধিক ডেলিগেট আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁদের ইতিবাচক মতামত ব্যক্ত করেন। সম্মেলনে আগত সকলে একমত হয়েছিলেন দিবসটির উপযোগীতার কথা চিন্তা করে। তাঁদের সকলেই মনে করেছেন, এই দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে নারীর শ্রমের মর্য্যাদা, পরিবারে এবং পরিবারের বাইরে নারীর ন্যায্য অধিকার, এবং নর-নারীর সম অধিকারের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে।

পরবর্তী বছর ১৯১১ সালের ১৮ই মার্চ, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানী, সুইৎজারল্যান্ডের এক মিলিয়নের অধিক জনগন প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পক্ষে মত দেয়। এই দাবী ধীরে ধীরে নারীর সম অধিকার দাবী'র আন্দোলনে রূপ পায়। আন্দোলনে নারীর ভোটাধিকার, কর্মসংস্থানের দাবী, কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী শ্রমিকের সমান মজুরী, পেশাগত জীবনে পুরুষ নারী পেশাজীবিদের মধ্যেকার সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষ্যমের অবসান চাওয়া হয়। তাদের মূল দাবী ছিল, 'নারী'কে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে হবে। আমেরিকায় তখনও ২৮শে ফেব্রুয়ারীতেই 'নারী দিবস' জাতীয়ভাবে পালিত হতো। কিন্তু রাশিয়ায় ১৯১৩ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন আয়োজনের উদ্যোক্তারা লক্ষ্য করেছেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যে দিনটি ২৮শে ফেব্রুয়ারী হিসেবে চিহ্নিত, সেই দিনটিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ই মার্চ হিসেবে চিহ্নিত আছে। সেই থেকেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ৮ই মার্চ বিশ্বনারীদিবস পালিত হয়ে থাকে।

কমিউনিস্ট দেশগুলোতে আনতর্জাতিক নারী দিবস যথাযোগ্য মর্য্যাদায় উদযাপিত হলেও, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে এর ব্যাপ্তি ছিল না। এমনকি আমেরিকাতেও আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি পালিত হতো কমিউনিস্ট দেশগুলোর আদলে। মাত্র ৩৬ বছর আগে, ১৯৭৭ সালে যখন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সকল সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, ৮ই মার্চ দিবসটিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ব শান্তি দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য, সেই থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস জনপ্রিয়তা অর্জন করে, এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে মহা সমারোহে, জাতীয়ভাবে 'নারী দিবস' পালন করার প্রতি জনগণের উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়।

পশ্চিমা বিশ্বে যখন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে এত আন্দোলন চলে, আমাদের এশিয়া মহাদেশে নারীর হাতে থাকে দেশ শাসন করার ক্ষমতা। প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী, মাভৈ শ্রীমতি বন্দরনায়েকে, বেনজীর ভুট্টো থেকে শুরু করে মায়ানমারের অং সান সুচীর ( উনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী বীর নারী) কথা নারীদের বিজয়ের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। ভারতের বর্তমান রাজনীতিতে সোনিয়া গান্ধীর ক্ষমতা সর্বজনবিদিত, আর পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জীর দাপটে সারা ভারত কাঁপে। অবশ্য পরম পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকায় আজ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে কোন নারীকে দেখা না গেলেও একজন হিলারী ক্লিন্টন অথবা একজন কন্ডোলিৎসা রাইস নারীনেতৃত্বকে উজ্বলই করেছেন। একই সাথে প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের নাম উল্লেখ না করলেই নয়।

নারীদের এই বিজয় মিছিলে বাংলাদেশের নাম আছে সবার উপরে। আমাদের দেশে গ্রাম থেকে শুরু করে দেশের রাষ্ট্রিয় কাঠামো পর্যন্ত নারী পেয়েছে সর্বময় ক্ষমতা। গত ২২ বছর ধরে পালা করে দেশ শাসন করছেন দুই নারী, তাঁদের একজন যখন প্রধান মন্ত্রীত্ব করেন, অপরজন করেন বিরোধী দলের নেতৃত্ব। পোশাক শিল্পের উত্থানের পেছনে নারী শ্রমিকদের অবদান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগীতায় শক্ত অবস্থান এনে দিয়েছে, গ্রামের সরল, সহজ গৃহবধূটি যখন ব্যাংক ঋণ নিয়ে হাঁস-মুরগীর খামার, মৎস খামার গড়ে তোলেন, নিজের সংসারের আয়-বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখেন, সময়মত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করে ঋণদাতাদের আস্থা অর্জন করেন, এর প্রতিটি সাফল্য সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে গতিময় করে তোলে। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া আছেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আছেন, আছেন কবি সুফিয়া কামাল, আছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এমন সব কৃতী নারীর সন্তান আমরা সবাই, তাই আমাদের পূর্বসূরীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে বাংলাদেশেও 'বিশ্বনারী দিবস' যথাযোগ্য মর্য্যাদায় পালিত হয়ে থাকে।