উত্তরাধিকারের রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি

স্বদেশ রায়
Published : 5 Nov 2011, 06:29 AM
Updated : 28 May 2017, 04:34 AM

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি বন্ধ্যা সময় পার করছে। ছাত্র রাজনীতির এই বন্ধ্যা সময় পার করার সবচেয়ে বড় কারণ দুটো– এক. দেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি চালু থাকবে এমন একটি আবহাওয়া থাকা এবং দুই. সিভিল সোসাইটির একাংশের ছাত্র রাজনীতির বিরোধী হওয়া।

বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির বড় অংশ সবসময় উত্তরাধিকারের রাজনীতির নিন্দা করে। অথচ ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ক্ষেত্রে তারা এবং যারা উত্তরাধিকারের রাজনীতি চালু রাখতে চান উভয়ে একই সমান্তরালে; উভয়ের উদ্দেশ্য এক।

যারা উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বিশ্বাসী তারা সবসময় ছাত্র রাজনীতি বাধা মনে করেন এই কারণে, ছাত্র রাজনীতির ভেতর দিয়ে তাদের উত্তরাধিকারের প্রতিদ্বন্দ্বী বের হয়ে আসতে পারে যে কোনো সাধারণ ঘর থেকে। সিভিল সোসাইটির লোকেরাও একই কারণে এর বিরোধিতা করেন। তারা মুখে যতই পরিশীলিত কথা বলুন না কেন, ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা করুন না কেন– তাদের আপত্তি ওই একটি কারণেই– ছাত্র রাজনীতির ভেতর দিয়ে যে কোনো মুহূর্তে সাধারণ ঘর থেকে একজন নেতা বের হয়ে আসতে পারেন।

সিভিল সোসাইটির এইসব তথাকথিত ভদ্রলোকেরা সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা নেতাদের প্রতি কতটা ক্ষুব্ধ থাকেন তা আমরা এখনও বঙ্গবন্ধুবিরোধী শিবিরের দিকে তাকালে দেখতে পাই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আমাদের এই তথাকথিত সিভিল সোসাইটির ভদ্রলোকেরাই তো ঢাকা ক্লাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন:

"চাষাটা মরেছে।"

মানুষ যদি মৃত্যুর পরেও কোনোভাবে কথা শুনতে পেত তাহলে তাদের এই গালিতে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন বঙ্গবন্ধু, তাঁর শত্রুরা তাঁকে চিনেছে! ৯৯ ভাগ কৃষকের দেশে বঙ্গবন্ধু কৃষকের পক্ষেই ছিলেন। তাই তাঁকে 'চাষা' গালি শুনতে হয়েছিল।

যাহোক, সিভিল সোসাইটির লোকেরা বিরোধিতা করেন এ কারণে যে, সাধারণ ঘর থেকে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে নেতৃত্বের 'কোয়ালিটি' নিয়ে উঠে আসার যদি সুযোগ না থাকে, তাহলে দেশের সব নেতৃত্ব এই সিভিল সোসাইটির তথাকথিত ভদ্রলোক ও ধনীর সন্তানদের হাতেই থাকবে।

ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে শুধুমাত্র যে রাজনৈতিক নেতা হন তা নয়, বাস্তবে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলীসম্পন্ন একটি শ্রেণি গড়ে ওঠে।

নেতৃত্বের গুণাবলী থাকলে শিক্ষকতায়, চিকিৎসায়, সাংবাদিকতায়, ব্যবসায়, বিচার বিভাগে, প্রশাসনসহ রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে ভালো করেন তারা। কারণ, প্রতিটি পেশায় সফলতার জন্যে, নিজেকে ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে নিজের ওপর সফল নেতৃত্ব প্রয়োগ করা যেমন প্রয়োজন তেমনি পেশার ক্ষেত্রেও ম্যানেজমেন্ট ও নেতৃত্ব প্রয়োজন।

একজন খুব ভালো অ্যাডিশনাল সেক্রেটারিকে দেখেছি। তিনি খুব বিদ্বান। তাঁর সাবজেক্টে তিনি ভালো জানাশোনা। তারপরেও তাঁর মন্ত্রী কখনও তাঁকে সচিব হিসেবে রিকোমেন্ড করেন না। ওই মন্ত্রী অনেক গুণী ব্যক্তি। তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তাঁকে কেন সচিব করা হচ্ছে ন। তিনি বললেন:

"দেখ, ওকে সচিব করলে তো আমার মন্ত্রণালয় অচল হয়ে যাবে। ও ভালো বোঝে, তবে সিদ্ধান্ত দিতে শুধু সময় নেয় না, বাস্তবে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতেই পারে না। সেই নেতৃত্বের গুণাবলী ওর ভেতর নেই।"

খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ভদ্রলোক ছাত্রজীবনে শুধু বই পড়েছেন। অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে কখনও জড়িত ছিলেন না। ছাত্র রাজনীতির ধারেকাছে যাননি। ব্যক্তিজীবনে, পেশাগত জীবনে সর্বোপরি জাতীয় জীবনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই সব থেকে বড় গুণ একজন মানুষের জন্যে। আর এটা সৃষ্টি হয় নেতৃত্বের ট্রেনিং থেকে। যে ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি অনেক বড় কাজ করে।

যেমন: কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ না হলে দেড় লাখ কোটি টাকা লোকসান হত দেশের ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল, এই দুই বছরে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ হারাত ৫০ লাখ লোক। অথচ ওই দুই বছরে কুইক রেন্টালে ভর্তুকি যায় মাত্র ৯,০০০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের পরিকল্পনা বিএনপি আমলে– সম্ভবত ২০০৪এর শেষে বা ২০০৫এর দিকে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তহীনতার ভেতর দিয়ে বিএনপি আমল শেষ হয়ে যায়। খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। শেখ হাসিনা দ্রুত বিশেষ বিদ্যুত আইন করে এ সিদ্ধান্ত দেন। দেশের উৎপাদন সচল হয়, উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ।

শেখ হাসিনা এটা পেরেছিলেন। কারণ, তিনি ছাত্র রাজনীতির 'প্রডাক্ট'। তিনি যে বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার মতো সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, তারও কারণ ছোটবেলা থেকে ছাত্র রাজনীতি তাঁকে নেতৃত্ব শিখিয়েছে। একমাত্র নেতৃত্বের গুণাবলীই মানুষকে অসম্ভব থেকে সম্ভবের দিকে যাওয়ার সাহস যোগায়।

ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে কিশোর বা তরুণ বয়সে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা গড়ে ওঠে তা জাতীয় জীবনের মোড়ও কতখানি ঘুরিয়ে দেয় তার একটি উদাহরণ কিন্তু ১৯৬৯এর ২৪ জানুয়ারি তোয়াফেল আহমেদের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত। ২৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-শ্রমিক সমাবেশের কথা ছিল। শ্রমিকদের আনার জন্যে শ্রমিক এলাকায় তাদের সংগঠিত করতে ২২ তারিখ থেকে শাহজাহান সিরাজকে পাঠানো হয়। ২৪ তারিখ শাহজাহান সিরাজ যখন মিছিলের অগ্রভাগ নিয়ে শাহবাগ হোটেলের সামনে পৌঁছে গেছেন তখনও মিছিলের লেজ তেজগাঁও।

শাহজাহান সিরাজ ছাত্রনেতা। তিনিও তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারলেন, এত লোকের সমাবেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব কি না, এ তার নেতার কাছে জানা দরকার। তিনি দৌঁড়ে গেলেন তার নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছে ইকবাল হলের ৩১৩ নম্বর রুমে। তিনি জানালেন মিছিলের লোকের ব্যাপকতা। তোফায়েল আহমেদ এক সেকেন্ডেরও কয়েক ফ্র্যাকশন ভাগ সময়ের মধ্যে, অর্থাৎ সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত দিলেন:

"মিছিল পল্টনে নাও। পল্টনে জনসভা হবে।"

ওই একটি সিদ্ধান্ত জাতীয় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল। জনসভা পল্টনে হল আর তা শুধু ছাত্র-শ্রমিকের নয়, গোটা ঢাকাবাসী ভেঙে পড়ল সেখানে। মতিউরের মতো তরুণ বুক পকেটে, 'মা, শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে যাচ্ছি'– এই চিরকুট লিখে নিয়ে এসে গুলিতে জীবন উৎসর্গ করল। দেশব্যাপী গণঅভ্যুত্থান হল। আইযুব শাহীর পতন হল।

বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে এসে রেসকোর্সের জনসভায় বললেন:

"আপনারা তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান করেছেন।"

কত বয়স ছিল তখন তোফায়েল আহমেদের? ২৬ পূর্ণ হয়নি তখনও। এমন এক তরুণের নেতৃত্বে একটা জাতির এত বড় ঘটনা ঘটে। এই তোফায়েল আহমেদ কোনো তথাকথিত সিভিল সোসাইটির ধনীর সন্তান নন। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করে উঠে আসার ফলে আজ সিভিল সোসাইটির লোকেরাও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে পারলে ধন্য হন।

এ কারণে যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলেন, তারা একটি অসৎ উদ্দেশ্য থেকে বলেন। '৯০ অবধি প্রকাশ্যে ছাত্র রাজনীতির বন্ধের কথা একমাত্র সামরিক শাসকরা ছাড়া আর কেউ বলতে সাহস পেতেন না। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি হন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন কোনোদিন ছাত্র রাজনীতি করেননি। জাতীয় জীবনে তাঁর কোনো অবদান কোথাও কেউ পাবেন না। আইন অঙ্গনের একটি অচলাবস্থা কাটাতে এরশাদ আমলে তিনি 'কম্প্রোমাইজ ক্যান্ডিডেট' হিসেবে প্রধান বিচারপতি হন। অফিসার জীবনে অত্যন্ত সাদামাঠা অফিসার ছিলেন, ডিসি পরীক্ষায় ফেল করে জজিয়তিতে আসেন।

যাহোক, মানুষ দীর্ঘদিন পরে একজন সিভিলিয়নকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পেয়ে খুশি হয়। মিডিয়াও তার সাদামাঠা জীবন নিয়ে অনেক রিপোর্ট করে। বাংলা ফিল্ম ও বাংলা উপন্যাস বাঙালিকে দরিদ্র ও কিছুটা অকেজো মানুষকে 'হিরো' ভাবতে শিখিয়েছে। তাই বিচারপতি সাহাবুদ্দিনও একধরনের হিরো হয়ে যান।

শেখ হাসিনাও ১৯৯৬ সালে চমক দেখাতে গিয়ে চরম ভুল করেন। যে ভুলের মাশুল তিনি ২০০১এ দেন। তিনি তাঁর দলে ও দেশে বহু ত্যাগী রাজনীতিক থাকতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের মতো একজন সামরিক শাসন-ভজা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বানান। প্রয়াত রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রায়ই বলতেন:

"আমাদের কিছু কিছু বিচারপতি আর সেনাপতি এ দেশে একই কাজ করেছেন। তারা উভয়েই রাতের অন্ধকারে ক্ষমতার পরিবর্তনে একে অপরের সঙ্গি।"

নব্বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং ছিয়ানব্বইয়ে শেখ হাসিনার সরকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ফলে সাহাবুদ্দিন তখন অনেকখানি 'ঈশ্বর' হয়ে গেছেন অনেকের কাছে। তিনিই প্রথম সিভিলিয়ান যিনি সামরিক শাসকের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি তুলে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বললেন:

"ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া উচিত।"

সাহাবুদ্দিনের এ বক্তব্য ছিল ওইদিন বাংলাদেশের ওই তথাকথিত সামরিক শাসকপন্থী সিভিল সোসাইটির ও সামরিক কালচারের একটি বড় বিজয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসিডেন্টের মুখ দিয়ে তারা এ কথা বলাতে পারে সেদিন। কারণ, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল যাদের মূল দলের আগে ছাত্র সংগঠনের জম্ম হয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের এ বক্তব্য যে একটি চক্রান্তের অংশ, সেদিন একজন সাংবাদিক হিসেবে ওই সময়ের সর্বাধিক প্রচারিত সাপ্তাহিক 'যায়যায়দিন'এ লিখেছিলাম। তবে সাহাবুদ্দিনের এ বক্তব্যের কড়া জবাব দেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুল জলিল। তিনি স্পষ্ট বলে দেন:

"সাহাবুদ্দিন সাহেব অরাজনৈতিক ব্যক্তি তিনি যেন রাজনীতিতে নাক না গলান।"

ততক্ষণে সাহাবুদ্দিন তাঁর কাজ করে দিয়েছেন। সাহাবুদ্দিনের 'ঈশ্বর' চরিত্রের ছবি এঁকে তাঁর কথাকে অমৃতবাণী হিসেবে প্রচার করা শুরু করে দেয় দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ। সেই থেকে আজ অবধি এই একই প্রচার চলছে: ছাত্র রাজনীতি খারাপ।

ওই অপপ্রচারের কারণে ভালো ছাত্ররা এখন আর ছাত্র রাজনীতিতে ওইভাবে যায় না। অন্যদিকে বড় দুটো রাজনৈতিক দল উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মন দেওয়াতে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে কেউ আর ওইভাবে ভাবেন না।

আবার জিয়াউর রহমানের আমলে 'পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশন'-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন করার যে আইন করা হয় ওই আইনে ছাত্র সংগঠনকে মূল দলের অঙ্গ সংগঠন করা হয়। যে আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে ছাত্র সংগঠনগুলো প্রথম বারের মতো তাদের স্বকীয়তা হারায়। অন্যদিকে '৯০এর গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে সিভিল সরকার ফিরে এলেও সবখানে 'মিলিটারি কালচার' থেকে যায়।

দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই তাদের ছাত্র সংগঠন যে তাদের অঙ্গ সংগঠন নয়– এমন সিদ্ধান্ত আর নেয়নি। এর ফলে ছাত্র রাজনীতি স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে নানাভাবে ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র রাজনীতিতে অছাত্র আমদানি করে। পাশাপাশি সৌদি টাকার ফলে ধর্মীয় ছাত্র সংগঠনগুলো দরিদ্র ছাত্রদের অর্থ দিয়ে কিনে নেয়। এমন হাজারটি কারণে ছাত্র রাজনীতির বর্তমান এই অবস্থা।

এটাও প্রমাণিত, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল এখন যেভাবে চলছে তাতে ছাত্র রাজনীতিকে নার্সিং করে একটি সুস্থ ধারায় আনার পক্ষে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করবে না।

এই উত্তরাধিকারের রাজনীতির ভেতর, এই সিভিল সোসাইটিসহ সমাজের নানা স্তর থেকে আসা প্রতিবদ্ধকতার ভেতর দিয়েও ছাত্র রাজনীতিকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন প্রজম্মকে এ কাজটি করতে হবে তাদের ভবিষ্যতের জন্যে। মনে রাখা দরকার যে, প্রজম্মের কাজ ওই প্রজম্মকেই করতে হয়। পূর্বসূরিরা করে দেয় না। যেমন: আজ পশ্চিমা বিশ্বে বয়স্ক রাজনীতিকরা 'গ্রিন হাউস ইফেক্ট' নিয়ে অত ভাবেন না, তরুণরা শতকরা ৮০ ভাগের ওপর এ বিষয়ে খুব সজাগ। তারা জানেন, আগামীতে যে বিশ্বে তারা নেতৃত্ব দেবেন সেখানে এর প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। এ ক্ষতি তাদের জীবনের ওপর পড়বে।

তাই আমাদের তরুণদের ছাত্র রাজনীতির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে তাদের নিজেদের জন্যে, তাদের ভবিষ্যতের জন্যে। এ পথে এগোতে গেলে প্রথমত দুটি কাজ করতে হবে–

এক. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক স্বাধীন ছাত্র ফোরাম গড়ে তুলতে হবে। তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে হবে। জাতীয় রাজনীতিতে যার সঙ্গে তাদের আদর্শের বেশি মেলে তারা জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্র বিশেষে তাদের সমর্থন করবে।

দুই. ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আমাদের যে ধারার ছাত্র রাজনীতি গড়ে উঠেছিল ওই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন দেশের ছাত্র রাজনীতি করতে হবে।

স্বাধীন দেশের ছাত্র রাজনীতি, অর্থাৎ সমাজের যে কোনো পেশায় নেতৃত্ব দেওয়ার 'কোয়ালিটি' যাতে ওই রাজনীতির ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে সেই ধরনের কর্মসূচি নিতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের তরুণদের ফোরাম বা সংগঠনগুলোর সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হবে। যেহেতু তাদের প্রতিযোগিতা শুধু দেশে নয়, আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রেও। তাই তাদের অবশ্যই বিশ্বমানে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে যারা উত্তরাধিকার রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে আছে তাদের নেতাদেরও ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হবে। তারা যেন তাদের সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের নেতা তৈরি করতে পারে। রাজনীতিতে যেন শূন্যতা নেমে না আসে সেদিকটি তরুণদের ভাবতে হবে, যেহেতু ভবিষ্যৎ দেশটি তাদের।

আজ প্রতিটি দলের সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনো দলের কোনো সংসদ সদস্য মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বা সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। এ ধারা চলতে থাকলে যোগ্যতার শূন্যতা এসে যাবে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক যোগ্যতাই রাজনীতিতে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই দুই থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র স্থানীয় পর্যায়ের তরুণ জনপ্রিয় নেতৃত্ব। সে নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি থেকে।

পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতিকে অবশ্যই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার জন্যে কাজ করতে হবে। অনেক বেশি পড়াশোনার মধ্য দিয়ে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে হবে। স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের শিক্ষার মান যে নেমে যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নেমে যাচ্ছে, এ বিষয়গুলো সংশোধনে ছাত্র রাজনীতিকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাস্তবে এ কাজ খুব কঠিন নয়, শুধুমাত্র সাময়িক প্রাপ্তিকে বড় মনে না করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের দিকে তাকালেই এ কাজ করা যায়।

বর্তমান প্রজম্মকে ভাবতে হবে, আমাদের পূর্বসূরিরা যদি নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে স্বাধীনতা এনে দিতে পারে, সামরিক স্বৈরাচার দূর করতে পারে, তাহলে আমরা কেন একটি ভালো ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করতে পারব না?

বর্তমানের তরুণরা যদি এ কাজ না করে তাহলে ভবিষ্যতে আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নেতৃত্বে শূন্যতা নেমে আসবে। নানা ধরনের মৌলবাদী বা পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী ওই সুযোগে রাষ্ট্র দখল করবে।

আধুনিক বাংলাদেশ রক্ষা করতে হলে স্বাধীন দেশের স্বাধীন ছাত্র রাজনীতি তরুণ প্রজম্মকে করতেই হবে।