মোদীর বক্তৃতার রাজনৈতিক তাৎপর্য

গৌতম রায়
Published : 9 Jan 2012, 07:12 AM
Updated : 21 March 2020, 10:21 AM

করোনাভাইরাস জনিত বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিজ্ঞান অপেক্ষা অপবিজ্ঞান, সংকীর্ণ রাজনীতির আবেগঘন পরিবেশ তৈরি করে তাকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার, সর্বোপরি অর্থনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতিকে একদম উহ্য রেখে বিপদ মোকাবেলার কথা বলতে পারেন, এটা এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে মোদীর জাতির উদ্দেশ্যে বক্তৃতার ভেতর দিয়ে আমাদের গোটা দেশবাসীকে দেখতে হল। করোনাভাইরাস জনিত লাগামহীন বিপত্তি গত বেশ কয়েকদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একটা বড় রকমের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো একদিকে যেমন বিপদগ্রস্থ হয়েছে, অপরদিকে তারা এই বিপদের মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে অপবিজ্ঞানের হাত না ধরে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং আর্থিক পরিবেশ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গোটা বিপত্তির মোকাবিলায় আত্মনিবেদন করেছে। সেখানে ভারতবর্ষের শাসকেরা, কেন্দ্রের শাসক কি রাজ্যের, এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে প্রশাসনিক স্তরে কার্যত উদাসীন থেকেছে।

তার পাশাপাশি তারা যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক, অবিবেচনাপ্রসূত অপবিজ্ঞানকে এই মারণব্যধি মোকাবিলার অস্ত্র হিসেবে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন এই মারণব্যধির মোকাবিলায় বিভিন্ন রকমের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অবলম্বন করছে তখন ভারতের শাসক দল বিজেপির হাজারো রকমের সঙ্গী সাথীদের পক্ষ থেকে গোমূত্র, গোবর ইত্যাদিই হচ্ছে করোনাভাইরাসের একমাত্র উপযুক্ত প্রতিশোধ এটা অত্যন্ত বাগাড়ম্বরের সাথে প্রচার করা হচ্ছে।

কেবলমাত্র বিজেপির নেতাকর্মীরাই এই প্রচারটি করেনি। তাদের দলের জনপ্রতিনিধিরাও প্রকাশ্যে এই ধরনের অপবিজ্ঞানের প্রচারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন। এমনকি বিজেপি যে রাজ্যগুলোতে ক্ষমতায় আছে সেই রাজ্যের মন্ত্রীরা পর্যন্ত এ ধরনের অপবিজ্ঞানের শরিক হিসেবে নিজেদেরকে সংযুক্ত করেছেন। অপরপক্ষে আরএসএস-বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও অপবিজ্ঞানের বিরুদ্ধে একটি শব্দ উচ্চারিত হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের বুকে সরাসরি বিজেপি বা তার সঙ্গী সাথীরা করোনা বিপর্যয় মোকাবিলা করতে গোমূত্র পান, গোবর গায়ে মাখা – এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক, অপবিজ্ঞানের কথা প্রকাশ্যে বলেছে। সেগুলো সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল এমনকি খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অপবিজ্ঞানের বিরোধিতা করে একটি শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের যে বন্দোবস্তী এবং বোঝাপড়া নারদা-সারদা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পর্বত প্রমাণ সীমাহীন আর্থিক কেলেঙ্কারির জেরে তার বাধ্যবাধকতা বুঝতে পারা যায়। কিন্তু করোনাভাইরাস জনিত ভয়াবহ আন্তর্জাতিক বিপর্যয় যখন গোটা মানবজাতির অস্তিত্বের সংকট ডেকে আনতে পারে, সেই বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশ্নে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, চরম প্রতিক্রিয়াশীল, আরএসএস এবং তার সঙ্গী সাথী ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সঙ্গে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এই গাঁটছড়ার বিষয়টি আমাদের ভাবনার জগতকে যেন একটা ভয়ঙ্কর আতঙ্কের পরিবেশের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।

এই পরিবেশের ভয়াবহতায় দেশের প্রধানমন্ত্রী তার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের ভেতর দিয়ে গোটা দেশবাসীর মধ্যে সংক্রমিত করলেন যে, বিজ্ঞানের থেকেও আবেগই প্রধান। একটি ভাইরাসজনিত রোগের মোকাবিলাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দ্বারা কী ধরনের কর্মসূচি কার্যপদ্ধতি দেশের সরকার গ্রহণ করেছে, সেই সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ না করে প্রধানমন্ত্রী সেই বক্তৃতার ভেতর দিয়ে, 'সংযম' ইত্যাদি যে প্রশ্নগুলোর অবতারণা করলেন তার থেকে এই বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, এই ভয়াবহ বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশ্নে সংকীর্ণ, নগ্ন, দলীয় রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মসূচির বাইরে যেতে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এক পা-ও পারছে না।

নরেন্দ্র মোদী দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন। সেই দীর্ঘ বক্তৃতায় দেশবাসীর কাছে অনেক সময় তিনি চাইলেন। যেমন তিনি চেয়েছিলেন নোট বন্দির কালে। করোনার এই সময়কালে তার সরকার বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে কী কী প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করবেন, সেই সম্পর্কে কিন্তু নরেন্দ্র মোদী একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না। কেবল দেশের মানুষ তাদের 'সংযম' দেখালে এবং গৃহবন্দী হয়ে থাকলেই কি সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব? সমস্যার সমাধান সম্ভব? করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলা সম্ভব? এর জন্য কি কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান জনিত পদক্ষেপ, সর্বোপরি দেশের প্রশাসনের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি নয়?

এই প্রশ্নে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির সামনে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষেত্রে যে হীমশীতল নীরবতা অবলম্বন করেছেন তার থেকে এটা পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে যে, গোটা বিপর্যয় মোকাবিলায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নানা ধরনের ভাববাদী কথাবার্তাই বলবেন, সেই ধরনের আচরণই করবেন। কিন্তু গোটা বিপর্যয় মোকাবিলার লক্ষ্যে একটিও প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সর্বোপরি সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না। এটা মোদীর বক্তৃতার ভেতর দিয়ে কিন্তু খুব পরিস্কার হয়ে গিয়েছে।

অদ্ভুতভাবে ১৯৮৩ সালে আসামে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে আজকের বিজেপি পরিচালিত নীতিহীন সুবিধাবাদের জোট এনডিএ-এর অন্যতম শরিক অসম গণপরিষদের ছাত্রসংগঠন 'আসু' যে গণপ্রতিরোধের নাম করে, 'জনতার কারফিউ'য়ের কথা বলেছিল, সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী।

মোদী আগামী ২২ মার্চ দেশের সমস্ত জনসাধারণের কাছে জনতার কারফিউ পালন করবার আবেদন জানিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, কাদের কাছে তিনি আবেদন জানাচ্ছেন? দেশের মানুষের একটা বড় অংশকে যে মোদী বা তার প্রশাসন এবং তার দল ভারতীয় জনতা পার্টি আদৌ নাগরিক বলে স্বীকার করেন না, তাদের কাছে জনতার কারফিউ পালন করবার আবেদন জানাচ্ছেন মোদী?

দেশের নাগরিকদের একটা বড় অংশকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করবার লক্ষ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের নামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার নাম করে মোদী যে ধরনের মানবতাবিরোধী, চরম ফ্যাসিবাদী আচরণ করে চলেছেন তার প্রেক্ষিতে সেই জনগণের কাছেই মোদী আবার অনুরোধ করছেন, জনতার কারফিউ পালন করবার জন্যে? দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই যে পারস্পরিক দ্বৈততা, স্ববিরোধপূর্ণ আচরণ তার ভেতর দিয়েই বোঝা যাচ্ছে যে, বিপর্যয় মোকাবিলা কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা তার সরকার বা তার রাজনৈতিক দল বিজেপির এক এবং একমাত্র লক্ষ্য নয়। বিপর্যয় মোকাবিলার নাম করে কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজনমূলক অভিসন্ধি নিয়েই কিন্তু নরেন্দ্র মোদী তার এই তথাকথিত,  'জনতার কারফিউ' কর্মসূচির ভেতরে নেমেছেন। জনতাকে বিচ্ছিন্ন করবার লক্ষ্যে জনতার ভেতরে কারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন, আর কারা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন না, জন্মসূত্রে হিন্দু হয়েও রাজনৈতিক হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন না, দেশের হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে মানুষ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুত্ববাদী সম্প্রীতির আদর্শে বিশ্বাস করেন এই সামাজিক মেরুকরণ তাকে স্পষ্ট করবার লক্ষ্যে পরিচালিত হবে না কি?

অতীতে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময় গুজরাটে হিন্দু-মুসলমানকে চিহ্নিত করবার লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদী সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নানাভাবে হিন্দুর বাড়ি আর মুসলমান বাড়িকে আলাদাভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত আগে মোজাফফরনগরের দাঙ্গার সময় আমরা দেখেছি, বেছে বেছে মুসলমানেদের বাড়িগুলোর সামনে এমন কিছু চিহ্ন বা স্মারক আরএসএস-এর কর্মী-সমর্থকদের পক্ষ থেকে লটকে দেয়া হয়েছে, যার দ্বারা বুঝতে পারা যাচ্ছে ওই বাড়িগুলো মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের বাসস্থান।

সেদিকে লক্ষ্য রেখেই পরবর্তীকালে গণহত্যা এবং দাঙ্গা পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হিন্দুরা ওই সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজনদের বাড়িঘরগুলোর উপর সবার আগে আক্রমণ চাগিয়ে তুলেছিল। আর যখন জনতার কারফিউয়ের নাম করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আগামী ২২ মার্চ বিকেল বেলায় দেশবাসীর কাছে ঘন্টা, থালা, হাততালি ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর অবতারণার মধ্যে দিয়ে করোনাভাইরাস তাড়ানোর কথা বলছেন, তখন তার পিছনে কি আরো বড় কোনো ধরনের গুঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে?

আগামী ২২ মার্চ তথাকথিত জনতার কারফিউকে কেন্দ্র করে কোন কোন এলাকায়, কোন কোন মানুষ রাজনৈতিক হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন, আর কারা রাজনৈতিক হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন না, ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী দর্শনে বিশ্বাস করেন, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করেন, সম্প্রীতির ভারতবর্ষের প্রতি আস্থাবান – তা চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে হিটলার ও মুসোলিনীর গেস্টাপো বাহিনীর মতোই কি আরএসএস-বিজেপির পক্ষ থেকে বাহিনী নামিয়ে দেয়া হবে, যারা চিহ্নিত করবে যে, অমুক অমুক বাড়িতে হাততালি দেওয়া হয়েছে। ঘন্টা বাজানো হয়েছে। থালা বাজানো হয়েছে। আর অমুক অমুক বাড়িতে এগুলো করা হয়নি। যে বাড়িতে এগুলো করা হয়নি, সেগুলো চিহ্নিত করা হবে তথাকথিত রাষ্ট্রবিরোধী বলে? যেটা আরএসএস-বিজেপির, তথাকথিত 'রাষ্ট্রবাদী' চিন্তা-ভাবনার মূল লক্ষ্য?

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতবর্ষের নাগরিকদের একটা বড় অংশ জন্মসূত্রে মুসলমান। এই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি অনুযায়ী, স্বাধীনভাবে কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে কোনো হুমকির কাছে মাথা না নুইয়ে, নিজেদের পবিত্র ধর্ম অনুসরণ করার অধিকারী।

মুসলমান সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের মানুষদের কাছে ধর্মীয় আচার-আচরণের সঙ্গে কোনো রকম বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। সেই অংশের মানুষদের কাছেও কী করে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘন্টা বাজানোর অনুরোধ করতে পারেন? প্রধানমন্ত্রীর এই অনুরোধ সার্বিকভাবে ভারতবর্ষের সংবিধানের মূল পরিকাঠামোতে যে ধর্মাচরণের মৌলিক অধিকারের কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের সমতুল্য নয়?

দেশের প্রধানমন্ত্রী কোনো অবস্থাতেই একজন বিশ্বাসী মানুষকে যিনি ধর্মে বিশ্বাস করতে পারেন, নাও করতে পারেন, যিনি ধর্মের যেকোনো ভাবধারাই অবলম্বন করতে পারেন কিন্তু তার উপর প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের প্রতীক হিসেবে ঘন্টা বাজানোর মতো ধর্মীয় আচরণ চাপিয়ে দেওয়ার ফরমান কী করে জারি করেন? দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই হেন আচরণ শুধু ভারতবর্ষের সংবিধানকে অবজ্ঞা, অসম্মান, অমর্যাদাই নয় গোটা ভারতবর্ষের সমস্ত ধরনের মানবিক, সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী।

তৃতীয় প্রশ্ন হলো, ভারতবর্ষে যারা প্রচলিত হিন্দু আছেন, তাদের একটা বড় অংশের কাছে থালা হলো খাদ্য সামগ্রীর একটি অন্যতম প্রতীক। সেই হিসেবে তারা দেবী লক্ষীর প্রতীক হিসেবেই থালাটিকে ব্যবহার করে থাকেন। এই অংশের বিশ্বাসী মানুষের কাছেও থালা বাজানোর মতো বিষয়টি ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, বোধবুদ্ধি, চিন্তাচেতনা বিরোধী। নরেন্দ্র মোদীর যে হিন্দুত্ব সেই হিন্দুত্ব যে প্রচলিত ভারতের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার ভেতর দিয়ে সঞ্জীবিত হিন্দু চিন্তাচেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী তা এই থালা বাজানোর কর্মসূচির ভেতর দিয়ে খুব পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

চতুর্থপ্রশ্ন হল, দেশের নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ প্রবীণ নাগরিক। আজও ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার দরুণ এই প্রবীণ নাগরিকদের একটা বড় অংশ কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল। কায়িক শ্রমের ভিত্তিতে দিন আনা দিন খাটার উপর নির্ভর করে একটা বড় অংশের প্রবীণ নাগরিকদের আজও পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়। নরেন্দ্র মোদীর মতো মানুষ, ভাত দেবার মুরোদ যার নেই, তিনি এই জনতার কারফিউয়ের নাম করে কিল মারার গোঁসাই-এর ভূমিকায় কী করে অবতীর্ণ হন? দেশের প্রধানমন্ত্রী যে জনতার কারফিউয়ের কথা বলছেন, সেই দিন দেশের প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষুন্নিবৃত্তি কী করে হবে তার কোনো সংস্থান তিনি দিতে পারলেন না। কেন এই জনতার কারফিউয়ের দিন প্রবীণ নাগরিক থেকে শুরু করে, দেশের নিম্নবিত্তের, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজন কি খাবেন, তাদের দিন কিভাবে চলবে, তার কোনোরকম দিশা প্রধানমন্ত্রীনরেন্দ্র মোদী দিতে ব্যর্থ হলেন?

করোনাভাইরাস জনিত বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য দরকার, সরকারের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক কর্মসূচি, পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছা। তার কোনো কিছুই যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নেই, সে কথা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে তার এই বক্তৃতার ভেতর দিয়ে। সেই কারণে নরেন্দ্র মোদীর স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর এই, 'জনতার কারফিউ' বা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ ইত্যাদি চটকদারি কর্মসূচির ভেতরে যে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিচয় নেই, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কোনো নাম-গন্ধ নেই, এ সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করছেন না।

করোনার মত একটি জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা করার লক্ষ্যে বামপন্থী দলগুলো যখন সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতাকে পাশে সরিয়ে রেখে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের প্রতি সমস্ত রকমের সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহী। এই রকম সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সেই হাত ধরার জন্য বিন্দুমাত্র কোনো উদ্যোগ বা আয়োজন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।

বিপর্যয় মোকাবিলার লক্ষ্যে কেরলে বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীন সরকার দীর্ঘদিন ধরে জান কবুল করা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই লড়াই মমতার মতন বাগাড়ম্বরের লড়াই নয়। মোদীর মতন আবেগঘন গলার কন্ঠস্বরের ওঠানামার ভেতর দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবার লড়াই নয়। সেই লড়ায়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচি আছে। মানুষকে সর্তকতা অবলম্বন করতে বলেই কেরল সরকার কিন্তু তার দায়িত্ব পালন শেষ করছেন না। সর্তকতা অবলম্বনের সময় বিত্তবান থেকে শুরু করে নিম্নবিত্তের মানুষ তারা কী খাবেন, কী পরবেন, স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়লে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তার বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে কেরল সরকার সুনির্দিষ্ট আর্থিক পদক্ষেপ এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।

তেমন কোনো পরিকল্পনা কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের অন্য কোনো রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়নি। দেশের কেন্দ্রীয় সরকার তা গ্রহণ করেইনি বরং প্রধানমন্ত্রী তার এই বক্তৃতার ভেতর দিয়ে যেভাবে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছেন, সেই আতঙ্কের ফলে গোটা দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর রকমভাবে কালোবাজারী বৃদ্ধি পেয়েছে।

১৯৪৩ সালের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে যেভাবে কালোবাজারি, মজুমদারেরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে গোটা দেশে একটা ভয়াবহ কৃত্রিম খাদ্য সংকট তৈরি করেছিল, দেশকে একটা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছিল ঠিক সেভাবেই নরেন্দ্র মোদী গোটা দেশকে আজ করোনাভাইরাসকে ঘিরে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে সেই আতঙ্ক মোকাবিলার লক্ষ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সদিচ্ছা এবং পদক্ষেপে ধার পাশ দিয়ে না গিয়ে, একটা ভয়াবহ কালোবাজারির দিকে ঠেলে দিলেন।

একই অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও। পশ্চিমবঙ্গে হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর মাস্ককে ঘিরে যে কালোবাজারি শুরু হয়েছিল, সেই কালোবাজারি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়িত্বজ্ঞানহীন, অনৈতিক, স্বার্থন্বেষী আচরণের জন্যে আজ ধীরে ধীরে খাদ্য সংকটের আকার ধারণ করবে কিনা এই আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। বিপর্যয় মোকাবিলার লক্ষ্যে নরেন্দ্র মোদী আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কার্যত একে অপরের পরিপূরক শক্তি হিসেবে নিজেদেরকে মেলে ধরছেন।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার মন্ত্রিসভার সহকর্মীরা এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সর্বস্তরের দলীয় সতীর্থরা যেভাবে অপবিজ্ঞান, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতা দিয়েই করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধের সংকল্পের নাম করে, নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে পা বাড়াচ্ছেন তা একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় সামাজিক অপরাধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে।