স্বজনের বিষন্নতায় পাশে থাকুন, সাহায্য করুন বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে!

রীতা রায় মিঠু
Published : 31 Jan 2012, 07:27 AM
Updated : 31 Jan 2012, 07:27 AM

গত পরশুর প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে কাজী লিয়াকত আলীর আত্মহত্যার সংবাদটি গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়েছে। বর্তমান শেয়ার ব্যবসার ঘুর্ণিঝড়ে পড়ে সে সর্বস্বান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন দিশেহারা অবস্থাতে থেকে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ইনসেটে লিয়াকতের ছবিটি দেখলে যে কারো বুকে একটা বিরাট ধাক্কা লাগার কথা। কি প্রানবন্ত টগবগে তারুণ্য চেহারাতে। সে চলে গেলো, রেখে গেলো ছোট্ট ফুটফুটে মনীষা ও তার জীবন সাথী 'সাথীকে'। এই শেয়ার ব্যবসাতে সর্বস্বান্ত সে শুধু একাই হয়নি, আরও অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছে। কিনতু কাজী লিয়াকত এই প্রচন্ড মানসিক চাপ সামলাতে পারেনি। তার স্বজনেরা বলেছে যে কিছুদিন ধরেই সে গভীর ডিপ্রেশানে চলে গিয়েছিল। বাড়ীতে কারো সাথেই কথা বলতোনা, মনমরা হয়ে থাকতো। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

বেশ অনেকবছর আগে বাংলাদেশের টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো, " বিষন্নতা একটি ভয়ানক অসুখ" বলে। তরুণী এক মেয়েকে বিষন্নতায় আক্রান্ত দেখিয়ে অতি সত্বর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতো। খুব সম্ভব দেশের এক মাল্টিন্যাশনাল ঔষধ কোম্পাণির এন্টিডিপ্রেসেন্ট ঔষধের বিজ্ঞাপন ছিল ওটা। তখন ওষুধনীতির আওতায় পড়ে বাজার চলতি অনেক ওষুধের মত ঐ এন্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধটিও বাজারে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে 'বিষন্নতা' নামক মানসিক অসুখ (সাময়িক) ব্যাপারটিও আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়।

বিষন্নতা' বা ডিপ্রেশান শব্দটির সাথে আবার পরিচিত হতে শুরু করি মার্কিন মুলুকে আসার পরে। এখানে মেন্টাল ডিপ্রেশান বা মানসিক চাপ জনিত বিষন্নতা খুবই পরিচিত একটি সমস্যা। যা কিনা যে কোন বয়সের মানুষকেই যে কোন সময় কাবু করে ফেলতে পারে। এখানে মানসিক চাপ সব কিছুতেই। চাকুরী ক্ষেত্রে মানসিক চাপ, দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে চাপ, স্ত্রী স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে অন্য কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে অথবা স্বামী ভদ্রলোকটিও স্ত্রীকে না জানিয়ে কি করে চলেছে, যুবকের আজকে একজনের সাথে প্রেম হচ্ছেতো কালকেই সে প্রেম ভেঙ্গে যাচ্ছে, সমকামীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, শেয়ার মার্কেটে ধরা খাচ্ছে, সারাক্ষন টেররিস্টের হুমকী আছে, ড্রাগের ক্ষতিতো আছেই, এর যে কোন একটাই যে কোন দূর্বল মনের মানুষের স্নায়ুতে ভীষন চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যার ধকল সইতে না পেরে এখানে ডিপ্রেসড মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

তবে এখানে মানসিক অবসাদগ্রস্ত লোকের সংখ্যা যত বেশী, সেই তুলনায় দূর্ঘটনা তত বেশী ঘটেনা। এখানে চিকিৎসার সুযোগ আছে, ওষুধ পথ্যের প্রাচুর্য্য আছে, ব্যবসাতে নিঃস্ব হয়ে গেলে পরেও সরকারী ভাতায় খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সুযোগ আছে। আমাদের দেশেতো তা নেই। আমাদের দেশে সমস্যা আছে, সমাধান নেই। অসুখ আছে, চিকিৎসা নেই। ডাক্তার আছে, কিনতু ভিজিট বেশী, আবার ডাক্তারের ভুল চিকিৎসার পরিসংখ্যানও তুলনামূলক বেশী। ওষুধ আছে কিনতু ওষুধে ভেজালও আছে, শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা আছে কিনতু লগ্নীকারকের ন্যুনতম বুদ্ধি নেই। শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে ধারনা না থেকেও মানুষ সমানে টাকা লগ্নী করেছে। এই শেয়ার বিজনেস এক ধরনের ভাইরাস জ্বরের মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষরাতো বটেই, ঘরের মহিলারা পর্যন্ত ঘটি বাটি বিক্রী করে এখানে টাকা খাটিয়েছে। দুই বছর আগে যখন দেশে গিয়েছিলাম তখন নিজের চোখে দেখে এসেছিলাম, একেবারেই গৃহবধূও দেখি শেয়ার মার্কেট, শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কে খুব সরব ছিল। প্রথমে ব্যবসায় একটু লাভ হতেই হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়েই মানুষ নিজের জমিজমা সব বন্ধক দিয়ে এমন 'জুয়ার ব্যবসাতে' নেমে পড়েছে।

কাজী লিয়াকতের এই অপমৃত্যুতে সকলের কষ্ট লাগার কথা। একটা তরতাজা প্রাণ, মুহূর্তেই শেষ! প্রাথমিকভাবে সব রাগ বর্তমান সরকারের উপর গিয়ে পড়বে। ইতিমধ্যেই এটা একটা প্রচলিত ব্যাপার হয়ে গেছে, মানুষের ব্যক্তিগত ব্যর্থতার দায়ও সরকারের কাঁধে চাপানো হয়। এর পেছনে কারনও আছে, এই সরকারের আমলেই পর পর দুইবার শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নেমেছে। '৯৬ তেও একই অবস্থা হয়েছিল। এবারেও তাই হয়েছে। সাধারন মানুষ কেউ ভেতরের খবরের ধার ধারেনা, সাদা চোখে যা দেখে তাই বিশ্বাস করে নেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, গতবারের মত দূর্যোগ আসবেনা, মানুষও বিশ্বাস করেছিল। যদিও লিয়াকতের মত আরও অনেকেই একলাফে বড়লোক হওয়ার আশায় নিজেদের দায়িত্বে এমন ঝুঁকীপূর্ণ কাজে হাত পুড়িয়েছে, যদিও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এখানে সরকারের কিছুই করার নেই, তারপরেও সরকারের দায় থেকে যায়। বাংলার সরল সোজা মানুষ এই ব্যবসা সম্পর্কে কিছুই জানেনা, তাছাড়া '৯৬ তে একবার মানুষের চরম সর্বনাশ হওয়ার পর সরকারী মহল থেকেই প্রচারনা থাকা উচিত ছিল শেয়ার ব্যবসার ঝুঁকী সম্পর্কে, যাতে করে কেউ সরকারকে দোষারোপ করতে না পারে। এমন ধ্বসের পেছনে যারা দায়ী, যাদেরকে সাধারন মানুষ চিহ্নিত করতে পেরেছে দোষী হিসেবে, অথচ সরকার তাদের ধরতে পারেনা, এটাতো কেউই মানবেনা। সরকার থেকে উচিত ছিল সেই দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া, এবং বাস্তব অবস্থা কি বা এই ব্যবসায় লগ্নীকারকদের কিভাবে সাহায্য করা যায়, তার দিক নির্দেশনা সরকার থেকেই আসা উচিৎ ছিল। সাধারন মানুষের সেন্টিমেন্ট বুঝতে হয়, সিন্ডিকেট এর ধূয়া তুলে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবেনা। সাধারণ মানুষ জানেনা সিন্ডিকেট গঠিতই হয় কিভাবে , আর একবার গঠিত হলে তাকে ভাঙ্গাই বা গেলোনা কেনো! এই সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিলে সাধারন মানুষতো সান্ত্বণা পেতো এই ভেবে যে সরকার তার জনগনের জন্য ভাবে, দোষীকে ঠিক সাজা দেয়।

কালোবাজারীতে সারা দেশটাই সয়লাব হয়ে গেছে। এই কথা সবাই জানি। তবে শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা সোজা জিনিস নয়। আমেরিকাতেও শেয়ার বিজনেসে অনেকেরই ভরাডুবি হয়েছে। কিনতু আমেরিকাতে কেউ সরকারকে দায়ী করতে পারেনা বাংলাদেশের মত করে। তাছাড়া আমেরিকানদের একটা সুবিধা আছে, সর্বস্বান্ত হলে সরকারী ভাতার উপর নির্ভর করতে পারে, কিনতু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতো আমেরিকার মত না। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর অর্থনীতিতেই অস্থিরতা চলছে। আর আমাদের দেশেতো কথাই নেই, যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রন করে, তাদের মধ্যে সততা কতটুকু আছে, অপরের জন্য মমতা কতখানি আছে তা বিচার্য্য বিষয়। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের অনেকের মধ্যেই কাউকে দেবোনা আমি নিজেই একা খাবো মনোভাব খুবই প্রবল হওয়ার কারনে সিন্ডিকেট নামক এক বিশেষ প্রভাবশালী গোষ্ঠি তৈরী হয়েছে, যারা সব একাই সাবাড় করে দিয়ে সোজা সরল মানুষগুলিকে পথে বসিয়েছে।

তবে এই মুহূর্তে বলাটা ঠিক না হলেও বলতেই হচ্ছে, লিয়াকতের মত এমন স্মার্ট ছেলে কি করে জমিজমা বন্ধক দিয়ে একেবারে ৭৫ লাখ টাকা এমন এক ঝুঁকীপূর্ণ ব্যবসায় খাটালো। পুরোটা এই অস্থিতিশীল ব্যবসায় না খাটিয়ে, অর্ধেকও যদি খাটাতো আর বাকী অর্ধেক যদি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখতো, তাহলেও এমন হতচ্ছাড়া অবস্থা হতোনা। এতবড় এক ঝুঁকীপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে বাড়ীর সকলকে জিজ্ঞেস করলেও মুরুব্বীরা নিশ্চয়ই তাকে বাধা দিতো। তারপরেও ব্যবসাতে লাভ-লোকসান আছে। লোকসান হওয়াতে স্ত্রীর পরামর্শ চাইতে পারতো (তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে সে স্ত্রীর সাথে এই ব্যাপারে আগে থেকে কিছু বলেনি)। তার স্ত্রী একটি স্কুলের শিক্ষিকা, কাজেই বাইরের জগত সম্পর্কে সেও কিছু কিছু খবর ঠিকই রাখে। তার স্ত্রীর এখন চরম দুঃসময়, চরম শোকের সময়, শোক সামলে উঠার পরে তার নিজের কিছু কিছু ভুল নিজের কাছেই ধরা পড়বে। আত্মহত্যার আগে বেশ কিছুদিন লিয়াকত মুষড়ে পড়েছিল, চুপ হয়ে গিয়েছিল, তাছাড়া তারা সকলেই জানতো যে সে ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে এই কাজটা করেছে। তখন যদি তাকে বাধা দিতো, অথবা সর্বস্বান্ত হওয়ার পরেও যদি তার বিষন্ন সময়ে মনে সাহস দিত অথবা ডাক্তারের শরনাপন্ন হতো,(হয়তো তার সবই করা হয়েছিল, তারপরেও কিছুই ঠেকানো যায়নি), তাহলে হয়তো এই দুঃসহ ব্যাপারটি ঘটতোনা। ব্যবসার ফন্দী ফিকির না জেনে অনেকেই এই ব্যবসাতে টাকা লগ্নী করেছিল খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার জন্য। কিনতু যে জিনিস এত সহজে হাতে চলে আসে, সে জিনিসে একটা না একটা কিনতু থেকেই যায়। শেয়ার মার্কেটের বিজনেসেও এটাই হয়।

পরিশেষে বলিঃ এই ব্যবসার কিছুই না বুঝে আমিও সোপার্জিত কিছু টাকা খাটিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম যা লাভ হবে তা থেকে জনহিতকর কাজে টাকাটা লাগাতে পারবো। আমার তিল তিল করে সঞ্চয়ের টাকা সবটুকুই জলে গেছে। জনহিতকর কাজ করার বাসনাটুকুই শুধু রয়ে গেছে তলানী হিসেবে, হাতের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। কষ্ট যে লাগেনি তা নয়, কষ্টও যেমন লেগেছে আবার নিজের বোকামীর জন্যও মনে এক ধরনের অস্থিরতা টের পেয়েছি। তারপরেও আমি মনে করি, বেঁচে থাকাটাই প্রথম এবং একমাত্র কথা। আমি বেঁচে থাকলেই আরেকভাবে চেষ্টা করতে পারবো জীবনে আবার উঠে দাঁড়াবার, মরে গেলেতো গেলই। এক জীবনে হতাশা যেমন আছে, আশাও থাকে। হতাশার সময় আপনার পাশের মানুষটির সাহায্য চান, আপনার নিকট যে জন, সে-ই আপনাকে হতাশার অন্ধকার থেকে টেনে নিয়ে আসবে আলোর দিকে। যে চলে গেছে সে চলেই গেছে, যারা এখনও হতাশায় নিমজ্জিত আছেন, তাদেরকে অনুরোধ, আত্মহত্যাই জীবনের শেষ কথা নয়, আর আত্মহত্যা তারাই করে, যাদের মন খুব দূর্বল, স্নায়ু দূর্বল, এমন স্নায়ু দূর্বল মানুষদের এমন ঝুঁকীপূর্ণ কাজে হাত না দেয়া ভালো, যেমন আমি আর কোনদিন এই ধরনের ব্যবসাতে টাকা লগ্নী করবোনা।