‘সেরাজ তালুকদার’, ‘কানকাটা রমজান’ অথবা ‘শ্যামল ছায়ার’ সেই মুক্তিযোদ্ধা’!!

রীতা রায় মিঠু
Published : 13 Feb 2012, 05:01 PM
Updated : 13 Feb 2012, 05:01 PM

দেশের সাথে আমাদের সময়ের পার্থক্য ঠিক ১২ ঘন্টা। দেশে যখন সোমবারের সকাল দশটা, আমার এখানে রবিবারের রাত দশটা। হুমায়ুন ফরিদী যখন মারা গেলেন, দেশেও অনেকের ঘুম ভাঙ্গেনি, আমেরিকাতেও ততক্ষণে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার মত কিছু নিশাচর, যারা রাত জেগে নেটে বসে থাকে, তারাই শুধু আধুনিক তথ্য প্রবাহের সুবিধাটুকু পেয়ে থাকে। সবার আগে সব খবর জানতে পারার মধ্যে যেমন আনন্দ আছে, তেমনি ব্যথাও কম নেই! খুশীর খবরে একা একা নেচেও সুখ নেই, দু:খের খবরে কষ্টটাকে একা একা বয়ে বেড়ানোতেও সুখ নেই। আমি গতরাত পৌণে এগারোটা থেকেই কষ্টটা নিজের মাঝে চেপে রেখেছি। রাতের নিঃস্তব্ধতা ভাঙ্গার কোন সুযোগই ছিলোনা! হুমায়ুন ফরিদী মারা গেলেন সকাল দশটায়, নেটে খবরটা চলে এসেছে সকাল সাড়ে দশটার দিকেই।

ফেসবুক ওপেন করতেই দেখি, প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপনের স্ট্যাটাসে লিখা ছিল হুমায়ুন ফরিদীর চলে যাওয়ার কথা, আমি বুঝতেই পারিনি হুমায়ুন ফরিদীর পৃথিবী ত্যাগের কথা! বুঝবো কিভাবে, আমিইতো দুইদিন আগে আমার স্বামীকে বলছিলাম, "সেলিব্রিটি হতে পারলে কত মজা, আজকেই পত্রিকার হেডিং এ দেখলাম 'হুমায়ুন ফরিদী এখন সুস্থ আছেন' নামে একটি খবর। খবর পড়ে দেখি ঘটনা তেমন কিছুনা, শ্যুটিং এ থাকাকালে উনি নাকি দূর্বল বোধ করছিলেন, তাই উনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো, এখন দূর্বলতা কেটে গেছে, উনি সুস্থ। সেলিব্রিটি বলেই না এমন সাধারন একটি ব্যাপারও 'খবর' হয়ে যায়!" তো হাসপাতাল থেকে সুস্থতার সার্টিফিকেট পাওয়া মানুষ কিভাবে দুই দিন পরেই মরে যাবে, এটা কি সম্ভব নাকি? এইজন্যই আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে এই হুমায়ুন ফরিদী আর স্বপন ভাইয়ের স্ট্যাটাসের হুমায়ুন ফরিদী একই মানুষ।

হুমায়ুন ফরিদীকে আমি সামনাসামনি দেখিনি কিনতু উনার কথা প্রথম শুনেছি অন্যভাবে। আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। জাহাঙ্গীরনগরে নাট্যজগতের আরেক কিংবদন্তী সেলিম-আল-দীন স্যারের কি জনপ্রিয়তা! সব ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে উনাকে নিয়ে আলোচনা হতো, কারন ঐ সময়টাতেই জাহাঙ্গীরনগরে মুক্তমঞ্চে থিয়েটার হতো। আমাদের দুই একজন বন্ধু বান্ধবী ঐ থিয়েটারে অভিনয় করতো, ফলে তাদের মুখ থেকেই ঐ জগতের শিল্পীদের কথা কানে আসতো। হুমায়ুন ফরিদী বা শহীদুজ্জামান সেলিমের নাম বিশেষভাবে জানতাম, তাদের বৈবাহিক জীবনের সূত্র ধরে। হুমায়ুন ফরিদী বিয়ে করেছিলেন যাকে, সেই আপুর ভাই ছিলো আমাদেরই ইয়ারমেট। হুমায়ুন ফরিদী ও সেই আপু বিয়ের জগতে 'বিপ্লব' ঘটিয়েছিলেন! তারা স্বর্ণালংকার এর পরিবর্তে 'ফুলের গয়না' পড়ে বিয়ে করেছিলেন, এই একটিমাত্র ঘটনা আমার চোখে এক অন্য ধরনের ছবি এঁকে দেয় মানুষটি সম্পর্কে! উনি কতটাই আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন, তা উনার মেয়ের নাম থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। সেই ৩০ বছর আগে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া একটি শিশুর নাম 'দেবযানী' রাখা অথবা সেই ৩০-৩৫ বছর আগে ফুলের গয়না পড়ে বিয়ে করার মত মানসিকতা কেবল হুমায়ুন ফরিদীর মত মানুষেরই হতে পারে, আর সেই জন্যই সেলিম-আল-দীন যেমন একজনই হয়, হুমায়ুন ফরিদীও একজনই হয়।

হুমায়ুন ফরিদী ও সেলিম-আল-দীন জুটির ধারাবাহিক নাটক 'ভাঙ্গনের শব্দ শুনি' দেখেছিলাম, তখনই চিনেছিলাম 'সেরাজ তালুকদারেরা' কেমন হয়! শহরে মানুষ হওয়ার কারনে গ্রাম বাংলার 'সেরাজ তালুকদার' দের সাথে পরিচয় ছিলোনা, যারা শুধু ' জমি না কিনে পানি কিনতো', এই সেই হুমায়ুন ফরিদী, যাঁকে অনেকদিন সেরাজ তালুকদার ভেবেছি যতদিন রঙ্গমঞ্চে 'কানকাটা রমজান' এর আবির্ভাব হয়নি। আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় 'সংশপ্তক' এর কানকাটা রমজান এসেই আমার চোখের পর্দা আরেকটু সরিয়ে দিলো, আমি জানলাম, কানকাটা মানুষেরা কেমন হতে পারে! এরপর আর কোন চরিত্র মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি, সেরাজ তালুকদার বা কানকাটা রমজানদের চিনতে পারার পর আর কাউকে চেনার প্রয়োজন হয়না।

আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা, হুমায়ুন ফরিদী আর নেই, এই পৃথিবীর কোথাও নেই। সাত দিন আগেই আরেক কিংবদন্তী হুমায়ুনের পরিচালিত 'শ্যামল ছায়া' ছবিটি দেখছিলাম! সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফরিদীকে দেখলাম, তাদের অপারেশানের সময় যে মেয়েটি গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো (শাওন), তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফরিদী যখন 'মাগো' বলে পরম মমতায় সম্বোধন করলো, তখন আমার চোখ থেকে সেরাজ তালুকদার বা কানকাটা রমজান অথবা দূর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা সরে গিয়ে 'দেবযানীর বাবা' চলে এলো। সেই দেবযানীর বাবাটাই রয়ে গেলো আমার স্মৃতিতে, গত সাতদিনে অন্যকোন হুমায়ুন ফরিদীকে দেখার সুযোগ হয়নি বলে।

শিল্পীদেরও ব্যক্তিগত জীবন থাকে, তাদেরও হৃদয়জুড়ে ভালোবাসা থাকে, হাহাকারও থাকে। আমরা যারা দর্শক, তারা খুব স্বার্থপর হয়ে থাকি। আমরা শিল্পীদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে ভাবতে রাজী নই, আমরা নায়ককে নায়ক হিসেবেই ভাবি, ভিলেনকে ভিলেনই ভাবি। আমরা ধরেই নেই, যে ছবিতে ভিলেন সে বাস্তবেও বুঝি ভিলেন। হুমায়ুন ফরিদীর ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল তা একমাত্র তিনিই বলতে পারতেন। তবে খুব যে সুখের বা স্বস্তির ছিলনা, তা আমরাও ধারনা করতে পারি পত্রিকাতে প্রকাশিত নানা মুখরোচক গল্প থেকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামাইনা। সব সময় মাথায় রাখি, আমার নিজের জীবনেও যেমন উঠতি পড়তি আছে, শিল্পীদের জীবনেও তা থাকবে। আমার যেমন ভালো লাগতোনা আমার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্যগুলো সবার সামনে উন্মোচিত হয়ে গেলে, তাঁদেরও ভালো লাগার কথা না। হুমায়ুন ফরিদী ও সুবর্ণা মোস্তফার দাম্পত্য জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে এত মুখরোচক কথা ছাপা হয়েছে পত্র পত্রিকাতে, যে কোন সংবেদনশীল মানুষের জন্যই তা হজম করা কঠিন। দাম্পত্যসুখ না থাকাটাই যে কারো জীবনে এক বিরাট অভিশাপ, তার উপর যোগ হয় সামাজিক বিদ্রূপ, একজন সৃজনশীল মানুষকে তিলে তিলে ক্ষয় করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।

হুমায়ুন ফরিদী কয়েকদিন আগেই মাত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন সুস্থতার সনদ হাতে নিয়ে, এই মানুষটি পড়ে গিয়ে মরে গেলেন, এটাও উনার অভিনয় বলেই ভ্রম হয়! উনি ব্যক্তিগত জীবনে সুখী ছিলেন কিনা জানিনা, তবে একেবারে নিঃসঙ্গ ছিলেননা, এই পৃথিবীতে উনার আত্মার একটি টুকরা ছিল, উনার 'দেবযানী' ছিল উনার পাশে, জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটুকু দেবযানীর বাড়ীতেই ফেলতে পারলেন, এটাই বা কম কি। 'শ্যামল ছায়ার' সেই শেষ দৃশ্যটুকুই একটু উলটে দিলাম, যেখানে মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন ফরিদী গুলিবিদ্ধ মেয়েটির মাথা কোলে তুলে নিয়েছিলেন পরম মমতায়, আজকে দেবযানী কোলে তুলে নিয়েছে তার জীবনযোদ্ধা পিতার মাথাটিকে পরম আদরে, পরম ভালোবাসায়!
হে ঈশ্বর! আমরা পৃথিবীর মানুষ খুবই স্বার্থপর, বেঁচে থাকতে কাউকে শান্তি দেইনা। হুমায়ুন ফরিদীও বেঁচে থাকতে শান্তিতে ছিলেন না, এখন মানুষটি তোমার কাছেই চলে গেছেন, তাঁর আত্মা যেনো শান্তি পায়!