দেখলাম একুশের প্রথম প্রহর!!

রীতা রায় মিঠু
Published : 21 Feb 2012, 00:08 AM
Updated : 21 Feb 2012, 00:08 AM

আজকের দিনটি আমার ছুটির দিন ছিল। এমনিতে তিন সপ্তাহের কাজের অটো জেনারেটেড স্কেজিউল (শিডিউল) আমাদের যার যার নিজেদের একাউন্টে গেলেই দেখতে পাই। আমি প্রথমে খেয়াল করিনি আজকের তারিখটিতেই বাংলাদেশে ২১শের প্রথম প্রহর উদযাপিত হওয়ার কথা! অনেকদিন ধরেই টিভিতে আমাদের জাতীয় দিবসগুলোর প্রোগ্রাম দেখার সুযোগ হয়না। কাজেই আজকে ছুটি থাকাতে আমি আগে থাকতেই ঠিক করে রেখেছি, আজকের দিনটি আমি শুধু টিভি সেটের সামনে বসে থাকবো। সকাল থেকে বইমেলার অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু করেছি আমার টিভি দেখা। এনটিভিতে 'বইবসন্ত' নামের দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান দেখলাম, আজকে আমার আনন্দের সীমা ছিলোনা, 'বইবসন্তের' উপস্থাপিকা ছিল আমার প্রিয় ভাগ্নী অদিতি পাল (ওর মা আমার অধ্যাপক স্বামীর ছাত্রী ছিলেন)।

এরপর এনটিভিতে 'সন্ধ্যার সংবাদ' এ দেখলাম আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম পাঁচ বছর কাটিয়ে আসা বহু স্মৃতিময় গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উপর ছোট একটি খবর। বেগম খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হয়ে গেছিলেন গনস্বাস্থ্যের এক অনুষ্ঠানে। সেই ছোট ভিডিও ক্লিপেই দেখলাম আমার প্রিয় মায়া মামীকে (প্রাক্তন সহ অধ্যক্ষ, ঢাকা কলেজ, বর্তমানে বোধ হয় গনস্বাস্থ্য ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান হয়ে থাকবেন) খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড়ানো অবস্থায়, বেগম জিয়ার আরেক পাশে দেখলাম 'সন্ধ্যা'দি কে( মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যা রায়), দেখলাম 'গনপাঠশালার' ছোট বাচ্চাদের প্যারেড। দেখামাত্র স্মৃতির কোঠায় ভেসে উঠলো ২৪ বছর আগের নতুন সংসার জীবনের শুরুর সেই দিনগুলো। আমাদের বাসাতে যেতে হলে এই পাঠশালার পাশ দিয়েই যেতে হতো। কতদিন থেমে স্কুলে ঢুকে যেতাম, বাচ্চাদের 'কলমল' শুনতাম, ভালো লাগতো। এই গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে থাকাকালীন আমার দুই মেয়ের জন্ম হয়। এক মেয়ে জন্ম নেয় গনস্বাস্থ্য হাসপাতালে, অন্য সব সাধারন প্রসূতি মায়েদের সাথে থাকার এক অভিজ্ঞতা হয় আমার! অন্য রকম অভিজ্ঞতা।

এর পরেই আমার পছন্দের খবর 'একুশে পদক' ঘোষণা। এবার পদকপ্রাপ্তদের নামের তালিকা দেখে মনটা ভালো লেগেছে। যাঁরা একুশে পদক পেয়েছেন বলে আমি বিশেষভাবে খুশী হয়েছি, তাঁরা হলেন ডঃ করুণাময় গোস্বামী, ডঃ ইনামুল হক, শুদ্ধানন্দ মহাথেরো, মরণোত্তর তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর, আরও ভালো লেগেছে অধ্যাপক অজয় রায় পদক পেয়েছেন বলে। একই সময়ে জানলাম যে মুঠোফোনে বাংলা কীপ্যাড বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে, এটা শুনে আমার প্রথম যে কথা মনে এসেছে, তাহলো আমার ফেসবুক বন্ধুরা এখন থেকে আমার বাংলায় লেখা পড়তে পারবে, নিজেরাও আমাকে বাংলায় লিখতে পারবে।

আরেকটি খবর শোকে ও ভালোলাগায় মেশানো ছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদের মৃত্যুসংবাদে ব্যথিত হয়েছি, সকল ভালো মানুষগুলো কেনো যে একই সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, কে জানে! তবে এই শোকের সংবাদেও ভালোলাগার যে কথাটি জড়িয়ে ছিলো তা হলো, এই মহৎপ্রাণ মানুষটি উনার দেহ ও চোখ মানুষের গবেষনার কাজে উৎসর্গ করে গেছেন! উনার চোখ দুটো বেঁচে থাকবে আরেকজনের চোখের জ্যোতি হয়ে, কি মহৎ ছিলো উনার শেষ ইচ্ছেটুকু, এমন সব মহৎপ্রাণ মানুষের আরো কিছুদিন বেঁচে থাকাটাই দেশের জন্য প্রয়োজন।

এরপর আমাদের বেলা বারোটা, বাংলাদেশে রাত বারোটা, একুশের প্রথম প্রহরের শুরু। শহীদ মিনারের বেদীতে পুস্প স্তবক দেয়ার সংস্কৃতি আমার আগেও ভালো লাগতো, এখনও ভালো লাগে। অনেকেই রবীন্দ্রনাথ বা 'মঙ্গলদীপ' জ্বালানোর সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেনা, এই সংস্কৃতিকে তারা সরাসরি ভারতীয় সংস্কৃতি অথবা হিন্দু সংস্কৃতি হিসেবে দেখে থাকে। কিনতু তারা জানেনা, নিজের অজান্তেই তারা বাংলার এই সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে কোন না কোনভাবে রক্ষনশীলরাই প্রশ্রয় পেয়ে যায়। ফুল, দীপ, হিন্দুরা তাদের আরাধনা, প্রার্থণা কাজেই ব্যবহার করে, অন্যের ক্ষতি করার কাজেতো ব্যবহার করেনা! তাছাড়া ফুল প্রকৃতির দান, প্রদীপও অন্ধকার দূর করে আলো দান করে, কাজেই ফুল বা দীপ কোনভাবেই একটি সম্প্রদায়ের সম্পত্তি হতে পারেনা! এটা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অংশ, যেখানে আমরা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান, সকলেই আছি এবং থাকবো।

মাননীয় রাষ্ট্রপতি শহীদ মিনারে পুষ্প স্তবক অর্পন করলেন, প্রধান মন্ত্রীও পুষ্প স্তবক অর্পন করলেন। বিরোধী দলের নেত্রীও পুষ্পস্তবক অর্পন করলেন। অনেক বছর পর এই অনুষ্ঠান দেখছি, চোখ খুলে তাকিয়ে ছিলাম, যেনো কিছুই মিস না করি। এভাবে তাকিয়ে থেকেই দেখে ফেললাম বেগম মতিয়া চৌধুরী 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী' গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছেন। ভাবলাম ভুল দেখেছি, আবার তাকালাম, তখনও মন্ত্রীসভার সব সদস্যদের সাথে মতিয়া চৌধুরীও হেঁটে যাচ্ছেন, কিনতু গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছেন। এরপরের সীনেই দেখালো, মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাও গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছেন। আমার শরীরে একটু ঠান্ডা লাগতে লাগলো, গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠলো, স্মৃতিতে ভেসে উঠলো অনেক দিন আগের একটি ঘটনা।

সময়টা ছিলো ২০০১ এর আগস্ট-সেপ্টেম্বারের কোন একটা সময়। ডেইলি স্টার থেকে একটা আন্তঃস্কুল ডিবেট কম্পিটিশান স্পন্সর করা হয়েছিলো (অবশ্যই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল)। আমাদের বড় মেয়ে ডিবেট কম্পিটিশানে আগা খান স্কুল ডিবেট টিমের সদস্য ছিল এবং ওরা পুরস্কার পেয়েছিল। সেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের যে গ্রুপকে নির্বাচিত করা হয়েছিল, আমাদের বড় মেয়ে সেই গ্রুপের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল (আমার এই মেয়ের বাংলা উচ্চারণ খুবই সুন্দর এবং শুদ্ধ)। মেয়ের মা বাবা হিসেবে আমরা নিমন্ত্রিত ছিলা্ম ঐ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে গিয়েছি, বিরাট গ্যালারী ভরে গেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছেলেমেয়েতে, সাথে বেশ কিছু অভিভাবকও ছিলেন (আমাদের মত সাধারন কেউ নন, অনেক হাইফাই শ্রেণীর)। জাতীয় সঙ্গীত শুরু হতেই সকলেই আসন ছেড়ে দাঁড়ালো, জাতীয় সঙ্গীত চলছে, নিজের অজান্তেই আমিও ঠোঁট মেলাতে শুরু করেছি, এরপরে আওয়াজ করেই গাইতে শুরু করলাম। আমার মনে হচ্ছিলো, আমি বুঝি আমার সেই ছোটবেলার স্কুলের এসেম্বলীতে দাঁড়িয়েই জাতীয় সঙ্গীত করছি।

হঠাৎ করেই আমার স্বামী আমাকে আলতো করে একটু নাড়া দিতেই আমি খেয়াল করলাম, আমি আসলে অঝোরে কেঁদে চলেছি। অনেকেই আমাকে দেখছিলো, তাই আমার স্বামী আমাকে একটু নাড়া দিয়ে সচেতন করতে চেয়েছেন। আমি ভদ্রতার মুখোশ এঁটে ফেলতে চেষ্টা করলাম, 'কিছু হয়নি, চোখে ময়লা পড়েছে' টাইপ ভাব করতে যেতেই ধরা পড়ে গেলাম। আমার কান্না বেড়েই গেলো, আমার কেবলি মনে হতে লাগলো, আর কিছুদিন পরেই এই দেশটা ছেড়ে চলে যেতে হবে, দেশটার জন্য এতো মায়া , এতো টান, সব ছেড়ে আমি থাকবো কিভাবে! অবশ্য আছি, অনেক বছর ধরেই আছি বিদেশের মাটিতে, এতোদিনেও আমার মনের কোন উন্নতি হলোনা, এখনও 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসির' একটা লাইন , ' মা তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে, পিদিম জ্বালিস ঘরে, তখন সকল খেলা ফেলে রেখে তোমার কোলে ছুটে আসি' মনে পড়লেই দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে। মনটা কেবলই পোড়ে, বাকী জীবনই হয়তো পোড়াবে। হয়তো মনটা এতোটা পোড়াতোনা যদি দেশটা ভালোভাবে চলতো। কিনতু চলছেনা, দেশটা ভালোভাবে চলছেনা, অথচ দেশটাকে সবাই ভালোবাসে। ভালোবাসাতে কোন কমতি নেই, দেশপ্রেম এর ঝলকানি দেখা যায় নানা ওয়েব সাইটগুলোতে ঢুকলেই।

আরেকটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশের সব জাতীয় দিবসেরই নিজস্ব একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস মানেই লাল সবুজের মেলা। তেমনি শহীদ দিবস হচ্ছে সাদা কালোর ইমেজ, শোকের ও পবিত্রতার মিশেল। প্রধান মন্ত্রী সাদা জমির উপর কালো নকশী পাড়ের দেশী শাড়ী পরে এসেছিলেন। বিরোধী নেত্রী বেগম জিয়া পড়ে এসেছিলেন কালো জর্জেট শাড়ী। আমরা জানি বেগম জিয়া জর্জেট শাড়ি পছন্দ করেন এবং সব অনুষ্ঠানেই পড়েন, সব সময়। জর্জেট শাড়ীর আলাদা একটা মাদকতা আছে, সবাই তা জানে ও বুঝে, তাছাড়া কারো ব্যক্তিগত রুচী বা পছন্দের ব্যাপারেও অন্যের কিছু বলা শোভা পায়না, এটাই গনতন্ত্রের একটি সুবিধা। তবে এখানে আমার একটু বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, যে দিনগুলোর সাথে শোকের মত ব্যাপার জড়ানো থাকে, সেই সকল অনুষ্ঠানের মেজাজ ধরে রাখার জন্য আমাদের সকলেরই একটু সচেতন হওয়া উচিত। জর্জেট শাড়ির বদলে মাননীয় বিরোধী নেত্রী যদি কালো ঢাকাই, বা টাঙ্গাইল অথবা জর্জেটের কাছাকাছি আদরনীয় শাড়ী রাজশাহী সিল্ক পড়তেন, অনুষ্ঠানের মেজাজের সাথে বেশী মানানসই হতো।

তাছাড়া আরেক বয়স্ক মহিলাকে দেখলাম,( কোন উচ্চপদে কর্মরত কেউ হবেন, শুরুতেই পুষ্পস্তবক দেয়ার সুযোগ যখন পেয়েছেন), ক্যামেরা ধরতেই সচেতন হয়ে গায়ের ওড়না ধরে টেনে টুনে ঠিকঠাক করছেন। ভালো লেগেছে, উনার সচেতনতা ছিল, ক্যামেরায় যখন দেখাচ্ছে তখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গায়ের কাপড় যথাস্থানে থাকাটা বাঞ্ছণীয় মনে করেছেন। কিনতু যেটা ভালো লাগেনি, আজকের দিনে উনি শাড়ী পরে আসেননি বলে। আমাদের জাতীয় পোষাক শাড়ী, অথচ আমরা এখন শাড়ী না পড়ে সালোয়ার কামিজ পড়তেই বেশী পছন্দ করি ( বাহানা দেখাই সালোয়ার কামিজ পড়ে অফিস কাচারী করা অনেক সহজ বলে), মাঝ বয়সী মহিলাগুলোকে যখন দেখি পাকিস্তানী স্টাইলে সালোয়ার কামিজ পড়ে ঘরে-বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি রাজনীতির মঞ্চেও আজকাল এদের সংখ্যা বাড়ছে, এগুলো দেখে মনটা একটু হলেও খারাপ হয়। দেশপ্রেমতো কোন সস্তা জিনিস না, দেশপ্রেমকে নিজের চলনে বলনে, পোষাকে পরিচ্ছদে, প্রতিদিনের কথায়, আচারে ব্যবহারে ধারন করতে হয়, লালন করতে হয়। আমরাতো একটু হলেও মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তাই আমাদের মধ্যে দেশের জন্য আবেগ যতখানি থাকার কথা, বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাতো কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কাজেই আবেগ ব্যাপারটা ওদের মধ্যে আনতে হলে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। অন্ততঃ বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে আমরা যদি সচেতনভাবে দিবসের গুরুত্ব অনুযায়ী দিবসটিকে উদযাপন করি, সেটাই এই প্রজন্মের তরুনদের মনে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। এখানে পোশাকের গুরুত্ব কিনতু ফেলনা নয়, জাতীয় দিবসে জাতীয় পোশাক পরেই দিনটি শুরু করা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য করণীয় হওয়া উচিত। নাহলে পাকিস্তানী কায়দায় সালোয়ার কামিজ পড়ে অথবা ফরাসী জর্জেট পড়ে শহীদ মিনারের বেদীতে গিয়ে দাঁড়ালে দৃষ্টিতে এক ধরনের বিভ্রম সৃষ্টি হয়, সেই বিভ্রম থেকেই বিভ্রান্তি আসে। দেশ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার পরিনতি খুব খারাপ।