‘জনগন’ নামক মরিচের ঝাল ক্রমশঃ বাড়ছে!

রীতা রায় মিঠু
Published : 12 March 2012, 04:51 AM
Updated : 12 March 2012, 04:51 AM

মার্চ মাসটি আমাদের মহান স্বাধীনতার মাস, আমাদের বাঙ্গালীদের জীবনে এই মাসটির গুরুত্ব কতখানি তা বাঙ্গালী মাত্রেই শুধু জানে। আমরা যারা প্রবাসে আছি, তাদের কাছে মনে হয়, এর আবেদন আরও অনেক বেশী। তা অনুভব করি প্রতিটি দিন, প্রতিটি পল। ৪১তম স্বাধীনতা দিবসটি যতই এগিয়ে আসছে, আমাদের নিজেদের হিসেব নিকেশও নানাভাবে বদলে যাচ্ছে। পত্র পত্রিকাতে, ব্লগে একেকজনের লেখা পড়লেই তা আরও বেশী হৃদয়ঙ্গম করা যাচ্ছে। একটা ভালো লক্ষ্মণ হচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম, যারা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্মেছে, যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা কি জানেনা, তারা দেশকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। তাদের ভাবনাগুলো উঠে আসে তাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষনে, তাদের লেখা কবিতায়, তাদের লেখা গল্পে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমের সুযোগে লেখাগুলো সাথে সাথে পাঠকের কাছে চলে আসছে। তবে সকলেই গঠনমূলক লেখা লিখছে তা ঠিক না, অনেকেই খুবই বিপদজনক কথাবার্তাও লিখে, যা পড়লে পড়ে মাথা ঝিম ঝিম করে, ভয়ানক কিছুর সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায় মনে। কিনতু পরক্ষণেই তারুণ্যের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা পড়ে মনে ভরসা জাগে। লেখাগুলো পড়লেই বুঝা যায়, এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চিন্তাশক্তি অনেক বেশী স্বচ্ছ, অনেক বেশী যৌক্তিক। তারা আমাদের মত আবেগে চলেনা, আবেগে চলেনা বলেই তাদের কথায় যুক্তি থাকে অনেক বেশী।

মুক্তিযুদ্ধের সময় একেবারেই শিশু ছিলাম, তাই রাজনীতির ব্যাপার স্যাপার কিছুই বুঝতামনা, চোখের সামনে বাবা মায়ের উদ্বিগ্ন ও ভয়ার্ত মুখগুলোকেই দেখতাম। আরও অনেকের মত আমরাও এ জায়গা সে জায়গা ঘুরে ঘুরে একসময় ভারতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অতিথি হয়ে যাইনি, শরণার্থী হয়ে গিয়েছিলাম। যতই শিশু থাকিনা কেনো, অতিথি হয়ে গেলে মনে যে আনন্দ থাকে, শরণার্থী হয়ে গিয়ে আমাদের মনে কোন আনন্দ ছিলনা। বুঝতে পারতাম, সময়টা আমাদের আহ্লাদের সময় ছিলোনা। সময়টাকে শুধু পার করে গিয়েছি, একসময় বাবা মায়ের মুখেই শুনেছি, দেশ স্বাধীন হয়েছে, এবার নিজের দেশে ফেরার পালা। আমাদের অনুভবে টের পেয়েছিলাম 'এবার সব পাব' জাতীয় উচ্ছাস। কারো আশ্রিত হয়ে থাকা এক ধরনের কষ্টের অনুভূতি সৃষ্টি করে অন্তরে, সেই কষ্টের থেকে মুক্তি পাব, এই বোধটাও এক ধরনের প্রশান্তি এনেছিল সকলের মনে।

স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছিলাম রিক্তহস্ত বাবা মায়ের হাত ধরে। সর্বস্বান্ত বাবা মা নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিলেন, চারটি শিশুকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচার। শূণ্য থেকে শুরু করতে গেলে যতটা ধৈর্য্যের প্রয়োজন, তার সবটুকুই ছিলো আমার বাবা মায়ের মধ্যে। তাঁদেরকে সহযোগীতা করেছিলাম আমরা। শিশু বয়সের কোন বায়নাক্কা ছিলোনা, বাবা যেমন করে বলতেন 'অবুঝ হয়োনা, একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে গেলে সবাইকেই কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয়, আমরাও করবো, কারন আমাদের তা করতে হবে", আমরা বুঝে হোক, না বুঝে হোক, মেনে চলেছি। আমরা জানতামনা, কতদিন কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে, ততদিন আমাদের শৈশব কি থেমে থাকবে! এভাবেই আমরা আমাদের শৈশব পার করেছি কৃচ্ছ্রসাধন করতে করতে।

৪১ বছর পার হয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের, আমাদের বাবা মা এখনও বেঁচে আছেন। আমরা মাঝামাঝি বয়সে চলে এসেছি, সুদিন এখনও এসে হাতে ধরা দেয়নি। আশার আলো যেমন দেখা যায়, তেমনি হতাশার অন্ধকার এসে গ্রাস করে আমাদের চেতনাকে। বাবাকে প্রশ্ন করেও কোন লাভ নেই, বঙ্গবন্ধুর মতানুসারী আমার বাবা ভাবেন, সকলেই যদি দেশটাকে ভালোবেসে দেশের উন্নতিকল্পে কাজ করতো, তাহলে আজকে এমন অবস্থা হতোনা। আমার বাবার ধারণা, আমাদের মধ্যে সততার অভাব ছিল, আমাদের মধ্যে ধৈর্য্যের অভাব ছিল, আমরা আখের গুছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, আমরা মোটা কাপড়, মোটা ভাতের বদলে রাতারাতি চিকন চালের ভাত খেতে চেয়েছি। ফলে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি ঢুকে পড়েছে।

বাবার সাথে মাঝে মাঝেই আমাদের কথা হয় দেশ নিয়ে। আমার বাবা এখনও অনেক আশাবাদী, আমিও আমার বাবার মতোই আশাবাদী হতে চাই। কিনতু আমার চাকুরীজীবি ভাই হতাশ। সে বলে, বাবা এখন ঘরেই থাকেন, তাই বাইরের খবর রাখেননা, আমার ভাই আরও বলে, আমি নাকি বিদেশে থাকি বলে দেশের সত্যিকারের খবর পাইনা, তাই আমি আর আমার বাবা এখনও ভাবের জগতে থাকি। হয়ত আমার ভাইয়ের কথাই সত্যি। প্রবাসে বসে বসে কতটুকুই বা টের পাই দেশের অশান্তির তাপ কেমন করে ঝাপ্টা দিচ্ছে আমার ভাইদের শরীরে।

তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির খবর যে একেবারেই পাইনা, সেটা সত্যি না। আমি সরকারের আসনে বসে নেই, তাই উটপাখীর মত বালিতে মুখ গুঁজে থাকিনা। আমি দেশকে ভালোবাসি, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ভালোবাসি, তাই সবসময় একটা টানাপোড়েনে থাকি। আমি মনে প্রাণে চাই, দেশে দুধের নহর না বয়ে যাক, শান্তির বাতাস বইতে শুরু করুক। একেক সময় মনে হয়, এই বুঝি সব ঠিক হয়ে যাবে! কিনতু বার বার হোঁচট খাই ভাবনাতে। '৮৩ তে যে শেখ হাসিনাকে দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অথবা '৯১ এ যে নেত্রীকে দেখেছিলাম মানিক মিয়া এভিনিউতে বিশাল মিটিং-এ গিয়ে (আমি শুধু আমার প্রিয় মানুষটিকে কাছে থেকে দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনের সেই মিটিং-এ, আমি একেবারে তাঁর কাছাকাছি চলে গেছিলাম, আমার সাথে কোন কাগজ ছিলোনা, কোন এক কর্মীর কাছ থেকে নেত্রীর ছবি সংবলিত একটি ছোট্ট কার্ড চেয়ে নিয়েছিলাম, সেই কার্ডে নেত্রীর হাতের স্বাক্ষর নিয়ে ্বাড়ী ফিরে এসেছিলাম), সেই মানুষটি এখন আমাদের মত সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন। একদল মানুষ তাঁকে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।

এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর যারা শুভাকাঙ্খী, যারা কোন না কোনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেশের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে, তারাই শত্রু বনে যাচ্ছে। কি বিপুল পরিমান জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন আমার প্রিয় মানুষটি, অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছরে পরিস্থিতি পালটে গিয়েছে। পরাজিত শক্তি মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। এবং তারা দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কিনতু ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যেনো তাঁরা বাদে সকলেই ভুল দেখছে, সকলেই ভুল বলছে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, অথচ দেশে খুন খারাবী প্রতিদিন ঘটেই যাচ্ছে। খুনখারাবী এমনই জলভাত হয়ে গেছে যে সুরক্ষিত বাড়ীর শয়নকক্ষে পর্যন্ত খুনী ঢুকে যাচ্ছে, খুনী ধরা পড়েনি বলে খুনীর রক্ত পিপাসা আরেকটু উঁচু মাত্রায় পৌঁছে গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ঘুমে রেখেই খুনী এবার হানা দিয়েছে কুটনৈতিকপাড়ায়। খুন করে ফেলেছে খোদ সৌদি কর্মকর্তাকে! এ যে কি বিরাট বিপদ সংকেত ডেকে এনেছে আমাদের দেশটার ললাটে, তা প্রবাসে থেকেও আন্দাজ করতে পারি। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে রিপোর্ট দিয়েছে, তারা নাকি আগাম সতর্ক রিপোর্ট দিয়েছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে, কুটনৈতিকপাড়াতে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। কিনতু খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিশ্বাস করেন যে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি আগের চেয়েও ভালো, তখন গোয়েন্দাদের পাঠানো রিপোর্টতো ভিত্তিহীন মনে হতেই পারে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে ধেয়ে এসেছে ১২ই মার্চ! বিরোধী দলের 'চলো চলো ঢাকা চলো' কর্মসূচী। এমন মার্চ জাতীয় কর্মসূচী তারা আগেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কারণ এটাই আমাদের দেশের রাজনৈতিক কালচার। কিনতু সরকারী দলকে কেনো পালটা কর্মসূচী দিতে হবে, সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছেনা। এমনিতেই দেশে কত রকমের অশান্তি লেগে আছে, এর উপর যদি এমন আরোপিত অশান্তির কবলে পড়তে হয় জনগনকে, কতদিন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে দেশের রোগা ভোগা মানুষগুলি। পেটে দুইবেলা দুই মুঠো ভাত দিতে যাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে, তারা কি বুঝবে দুই নেত্রীর রশি টানাটানি খেলার মজা! দুই রাজনৈতিক দলই জনগনের দোহাই দিয়ে পাল্টাপাল্টি রেষারেষি খেলা খেলে যাচ্ছে, আর এই খেলা খেলতে কত লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে, সেই হিসেব মনে হয় আদৌ কেউ করছেনা। জনগনের ভাগ্য উন্নয়নে দুই দলই জান বাজী রেখে রাজনীতি করছে! তারা যদি রাজনীতির খেলাতে সাময়িক বিরতি দিয়ে এই অর্থ 'জনগন' নামের মানুষের কল্যানে ব্যয় করতো, তাহলে কিছু মানুষের জীবনে সত্যিকারের উপকার হতো।

কিনতু জনগনের মাঝে হায় হুতাশ বাড়ছে দিনে দিনে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুজনকেই ইদানিং খুবই অসহায়ভাবে বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। যা কিনা দেশের জন্য বিরাট অশনিসংকেত দেখাচ্ছে। আমাদের সাধারণ জনগনের ভাগ্য কি দিয়ে তৈরী করেছেন বিধাতা পুরুষ, কে জানে! সেই কবে কোনকালে ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে দেশভাগ নামের কাটাকুটি খেলা খেলে গেল, এরপর থেকেতো আমাদের অবস্থা হয়েছে মরিচের মত। পাটা আর পুতা নামক দুই যোদ্ধা আমাদেরকে মাঝখানে ফেলে পিষেই চলেছে, পিষেই চলেছে। পিষতে পিষতে আমাদের ঝাল বের করছে। কিনতু যিনি বা যারা পাটা পুতা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, ভুলে যদি তাদের হাতটা একবার চোখে স্পর্শ করে ফেলেন, তাহলে আর দেখতে হবেনা, নাকের জলে চোখের জলে এক হতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছিলো '৭১এ । পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগন নামের মরিচকে পাটায় ফেলে পিষেই যাচ্ছিল। ক্রমাগত পেষণের ফলে মরিচ নামক জনগনের ঝাল ক্রমাগত বাড়ছিলো, বাকীটা ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। এমনটা '৯০ এও হয়েছিল। ইদানীং জনগন নামক মরিচের ঝাল আবার বাড়ছে, ক্রমাগত বাড়ছে। পেষাপেষির যন্ত্রণায় তারা অস্থির, একবার সুযোগ পেলে হয়, কাঁদিয়ে ছাড়বে সব্বাইকে, যারাই পাটাপুতায় জনগনকে পিষে চলেছে।