এ কী এক টানাপোড়েন!!

রীতা রায় মিঠু
Published : 14 March 2012, 07:04 PM
Updated : 14 March 2012, 07:04 PM

আমিতো লেখিকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে প্রতিদিন শুধু লিখেই চলেছি। এটা করতে গিয়ে আমার এতোদিনের লাইফ স্টাইলে অনেক পরিবর্তন চলে এসেছে। ঘরে রান্না-খাওয়াও মোটামুটি বন্ধ। পরিবারের সদস্যরা রোজদিন দুইবেলা দুই মুঠো ভাতও পায়না। সেদিন পরিবার প্রধান হতাশার সুরেই বললেন, " এখন আমাদের ঘরে কোন খাবার থাকেনা। কাজ থেকে ফিরে একটু কিছু যে খাবো, সেই উপায় নেই'। সংসারের কনিষ্ঠ সদস্য স্কুল থেকে ফিরে তেমন কিছু খেতে চায়না। কারন সকাল-দুপুর-বিকেল পাউরুটি চিবাতে ভালো লাগেনা বলে।

হুম! লেখিকা হওয়ার এই প্রক্রিয়াতে আমিও যে খুব শান্তি পাচ্ছি, তা নয়। আগে আমি কত নাটক দেখতাম, গল্পের বই পড়তাম, বন্ধু-বান্ধব বাড়ীতে ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়াতাম। রান্না-বান্না করতে ভালো লাগতো বলে নানারকম আইটেম রান্না করে খাওয়াতাম পরিবারের সবাইকে। কিনতু এখন আমি এর কোনটাই করতে পারছিনা। আমি সারাক্ষণ মাথার মধ্যে নতুন কি লেখা যায়, তাই নিয়েই ভাবি। যখন কাজে যাই, সেখানেও একটা ডায়েরী নিয়ে যাই। ব্রেক টাইমে সবাই যখন গল্পগুজব করে, আমি ডায়েরী খুলে বসে থাকি। কত রকমের বিষয় নিয়ে লিখবো ভাবি, সেগুলোই পয়েন্ট করে রাখি। বাড়ী ফিরে এসে কোনরকমে একমুঠো ভাত একটা দুইটা 'বাসী-পুরানো' তরকারি মেখে খেয়ে নিই, বসে যাই কম্পিউটারে। ঘরের আর দুইজন সদস্যের জন্য মায়া লাগে। একটা সময় ছিল, আমি কতকিছু রান্না করে খাওয়াতাম এদেরকে। এখন সেই সময়টুকু ওদের জীবন থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু মেধাবী উজ্জ্বল তরুন তরুনী আছে, যারা এখানে এসেছে পিএইচডি করতে। আমি যেমন ওদেরকে ভালোবাসি, ওরা তার চেয়েও অনেক বেশী ভালোবাসে আমাকে। আমি প্রথমদিকে যাই লিখতাম, সবকিছু ওদের ওয়ালে পোস্ট করে দিতাম। প্রথম লিখার উত্তেজনাতেই এসব করতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি, ব্যাপারটা একটু ছেলেমী পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এরপর থেকে আমার লেখা আমি আমার ওয়ালেই পোস্ট করি। যাদের সময় হয় তারা পড়ে দেখে, যাদের সময় কম তারা পড়েনা। কিনতু ওরা জানে যে তাদের আন্টি/কাকীমা প্রতিদিন লিখে চলেছে। মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হলেই ওরা আমাকে শরীর কেমন আছে না জিজ্ঞেস করে জানতে চায় আমার লেখালেখির খবর কি? নতুন বই টই বের করছি কিনা! আমি লজ্জায় পড়ে যাই। কাউকে বলতে লজ্জা লাগে যে লেখাগুলো আমি লিখি, আমার লিখতে ভালো লাগে বলে। আমি প্রসংগ পাল্টাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

আমার লেখার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সংক্ষেপে কিছু লিখতে পারিনা। লিখতে গেলেই বিরাট ইতিহাস হয়ে যায়। আমি রেগুলার দুই একটি ব্লগে লিখি। সেখানে পাঠকের মন্তব্য পাই, বুঝতে পারি আমার লেখার ভুলত্রুটিগুলো। কিনতু আমার এখানের প্রিয়জনদের কাছ থেকে মন্তব্য নেয়া হয়না। তাই হঠাৎ করেই সেদিন আমি আমার সেই মেধাবী তরুনদেরকে একসাথে পেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, তাদের মতামত। ওখানে অনেকেই ছিলো, কিনতু মতামত রেখেছে মাত্র চারজন। তাদের মতামত শুনে আমার উপকার হয়েছে। খুবই হাসি ঠাট্টার মধ্যে তারা তাদের মতামত দিয়েছে। আমি খুব উপভোগ করেছি ওদের কথা। চারজনের মধ্যে একজন শুধু মেয়ে, বাকী তিনজন ছেলে। চারজনের মধ্যে তিনজন কাছাকাছি বয়সী, মানে তরুন, একজন শুধু মাঝ বয়সী।

মতামতগুলো সংক্ষেপে দিলামঃ

পাঠক #১ঃ আন্টি, আমি মনে করি আপনার লেখালেখি একটু কমানো উচিৎ। প্রতিদিনই একটা করে লেখা আপনি ব্লগে দিচ্ছেন, তাও আবার বিরাট বড় বড় লেখা। মানুষজন ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে আপনার লেখা পড়ে। এত বেশী লেখার দরকার কি?

পাঠক#২ঃ না না আন্টি, আপনি লিখবেন, অবশ্যই লিখবেন। আমার খুব ভালো লাগে, কত ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আপনি কি সুন্দর করে লিখে ফেলেন। তাছাড়া লিখতে লিখতে আপনার লেখার ফ্লুয়েন্সী এবং লেখার মান, দুটাই বেড়েছে অনেক। আপনার লেখাগুলো 'কমপ্রিহেনসিভ' হয়, লেখা পড়লে পড়ে মোটামুটি একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়।

পাঠক#৩ঃ আন্টি, আমার মতামত হচ্ছে ৫০:৫০। একেবারে না করবোনা আবার হ্যাঁও করবোনা। আমি বলতে চাই, খুব সিলেক্টিভ বিষয় নিয়ে লিখবেন। আপনাকে প্রয়োজনে তথ্য উপাত্ত দেবো। লেখা চালিয়ে যান।

পাঠক#৪ঃ আমি মনে করি এখন আর ব্লগে লেখা ঠিক না। আর এত বেশী লিখতে থাকলে টপিক সবই ফুরিয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতে লেখার জন্য আর কোন টপিক খুঁজে পাওয়া যাবেনা। এখন উচিত ব্লগে লেখা বাদ দিয়ে পত্রিকাতে লেখালেখি করা, বই লেখার জন্য প্রস্তুতি নেয়া। সারাক্ষন এই লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থেকে থেকে জীবনের আর বাকী সব বাদ হয়ে যাবে।

উপরের চারজন পাঠকই আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। ওরা আমার ভালো চায়। কিন্তু পাঠকের মতামতগুলো থেকে আমি কোনটা বেছে নেবো, তা নিয়ে একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি। আমার হয়েছে উভয় সঙ্কট। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবকে অনেক ভালোবাসি, তারা সাময়িক কষ্ট পাচ্ছে, এতেও যেমন আমি অস্বস্তি বোধ করছি, আবার লেখালেখি করতে গিয়ে দেখি লেখালেখিটাকেও আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এই অভ্যাসটাকেও বাদ দিতে পারছিনা, কোনভাবেই না। আমার ঘুম দরকার, অথচ চার ঘন্টার বেশী ঘুমাতে পারিনা! কারন সারাদিন আমি কাজে ব্যস্ত থাকি, একমাত্র রাতের বেলা আমি একটু সুযোগ পাই। ফলে রাত জেগে লিখতে হয়। আমি সাধারনতঃ ব্লগেই লিখি, বল্গে লিখার একটা সুবিধা হচ্ছে কাউকে তোষামোদ করতে হয়না, লেখাটি ছাপানোর জন্য, অথচ লেখাটি নিজের একাউন্টে জমা হয়ে থাকে। প্রয়োজনে লেখার মধ্যে পরিবর্তন আনা যায় এডিটের মাধ্যমে। তাছাড়া পত্রিকাতে লিখবোই বা কিভাবে, আমিতো কোন কেউকেটা নই, পত্রিকাতে কে ছাপাবে আমার লেখা। কেউ যদি নিজে থেকে আমাকে তাঁদের পত্রিকাতে লেখার সুযোগ না দেয়, এই বয়সে কারো দুয়ারে ঘুরে ঘুরে নিজের লেখা ফেরী করতে চাইনা। ব্লগে লেখার মধ্যে স্বাধীনতা আছে। তাছাড়া ব্লগের পাঠকেরাই আমার আসল সমালোচক। তাদের কঠিন সমালোচনা মাঝে মাঝেই লেখককে নতুন করে ভাবায়। আমি নিজে এই পাঠক শ্রেণীকে খুব সম্মান করি। পত্রিকাতে লেখার আমন্ত্রণ পাইনা, তাতে কি হয়েছে, কয়েকশ পাঠক আমার লেখা পড়ছে, এটাই কি কম নাকি! তাছাড়া ব্লগে লিখলে লেখাগুলো ইলেকট্রনিক্যালি সেইভড হয়ে থাকছে। লেখার মান নিয়ে চিন্তা করিনা, তা নয়। তবে লিখতে লিখতেই একেকটা লেখা মানোত্তীর্ণ হয়, আমার লেখাও একদিন মানোত্তীর্ণ হবে এমন আশা সবসময় পোষন করি।

সবচেয়ে বড় কথা, আমি যাই লিখিনা কেনো, এই লেখাগুলোই থেকে যাবে আমার স্মৃতি হয়ে। আমিতো থাকবোনা, আমার মৃত্যুর পরেও আমি আমার সন্তান, তাদের সন্তানের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই। এদের জন্য আমি ধন-সম্পদ রেখে যেতে পারবোনা, তাছাড়া ধন-সম্পদও একদিন ফুরিয়ে যাবে, টাকার গায়ে কারো নাম লেখা থাকেনা। কিনতু লেখার পরতে পরতে আমার স্পর্শ থেকে যাবে, অচেনা কেউও যদি কোন একদিন আমার একটি লেখা হাতে পেয়ে যায়, পড়তে পড়তে সে আমার একটি অবয়ব তৈরী করবে কল্পনাতে, আমি মরে গিয়েও আবার বেঁচে উঠবো সেই পাঠকের মনে। আমার এই ভাবনাটা কাউকে বুঝাতেও পারিনা, বুঝাতে চাইওনা, সঙ্কোচ লাগে। এ কী এক টানাপোড়েনের মধ্যে পার করছি আমার দিনগুলো!