মাত্র ২ রানে পরাজয় = মাত্র ২ রানে জয়!!

রীতা রায় মিঠু
Published : 23 March 2012, 02:42 AM
Updated : 23 March 2012, 02:42 AM

আমার এই লেখার শিরোনামই বলে দিচ্ছে, এশিয়া কাপ ফাইনালের রেজাল্টকে আমি কিভাবে দেখছি। এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশকে পরাজিত বলতে আমি রাজী নই। পরাজয় তখনই হতো, যখন দুই দলের জয়-পরাজয়ের ব্যবধান কমপক্ষে ২০ রানের হতো। যে কোন প্রতিযোগীতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীর যোগ্যতার মান মোটামুটি একই স্কেলেই থাকে। যে আজ প্রথম হলো, সে-ই আবার আগামীকাল তৃতীয় স্থানে চলে যেতে পারে। কাজেই চ্যাম্পিয়ন বা রানার্স আপ পজিশন দিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে মাপা যাবেনা। আজকে শেষের চার আসেনি রাজিবের ব্যাট থেকে, তার মানেই ঐ মুহূর্তটুকু বাংলাদেশের জন্য ছিলনা, আজকের ঐ মুহূর্তটুকু পাকিস্তানের জন্য তোলা ছিল, আজকে না হয়ে আগামীকাল যদি ম্যাচটি আবার হয়, তাহলেই দাবার দান উলটে যেতে পারে। পরাজয় ভাবলেই পরাজয়, জয় ভাবলেই জয়। কাজেই সহজ সমীকরণ হচ্ছে, বাংলাদেশ দলের 'মাত্র ২ রানে পরাজয়' = পাকিস্তান দলের 'মাত্র ২ রানে জয়'। মাত্র দুইটি রান কখনওই শ্রেষ্ঠত্ব মাপার মাপকাঠি হতে পারেনা। তার উপর আবার পাকিস্তানের মত এতো অভিজ্ঞ ক্রিকেট দলের সাথে। তাই বলতে ইচ্ছে করে, 'তবুও বাংলাদেশই শ্রেষ্ঠ'।

কান্নাকাটিতো আমাদের করার কথা নয়। কান্নাকাটি করবে ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সাউথ আফ্রিকাসহ বিশ্বের নামী দামী ক্রিকেট টিমের ওরা। কারন ওরা চোখের সামনেই দেখতে পেয়েছে বাংলার বাঘদের। ভারত, শ্রীলঙ্কা তো পরাজয়ের ভেতর দিয়েই দেখেছে বাংলার হুঙ্কার, আর পাকিস্তানের কথা পাকিস্তানের প্রতিটি খেলোয়ারই বলতে পারবে, চোখে সর্ষেফুলে দেখা কাকে বলে। এশিয়া কাপ শুরুর পর থেকেই ক্রিকেট বিশ্বের সকলেই নিজেদের মতো করে হিসেব নিকেশ করতে শুরু করেছে। খেলাতে জয় বা পরাজয় আছে, কিনতু খেলা শুরু হওয়ার আগেই শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, বিরেন্দর শেভাগের মত পাক্কা ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয়ধ্বনি করে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সমীহ করতে শুরু করেছে। ফাইনাল খেলা শেষে পাকিস্তানের বর্তমান কোচ, বাংলাদেশের প্রাক্তন কোচ ডেভিড হোয়াটমোর পর্যন্ত আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। বর্তমান দলের সাফল্যের পেছনে অবশ্যই প্রাক্তন গুরুর অবদান আছে। যে কোন শিক্ষকই ছাত্রের উন্নতিতে গর্ব বোধ করে থাকেন, ডেভিড হোয়াটমোরও গর্বিত হতেই পারেন। এক সময়ের শিক্ষাগুরু যখন শিষ্যদেরকে আগামীর বিশ্বকাপ হাতে দেখতে পান, শিষ্যদের জন্য এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে!

আমাদের প্রিয় সৌরভ গাঙ্গুলী আগাম বলে দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্বকাপের শিরোপা অর্জন করবে একদিন। সেইদিন বাঙ্গালী হিসেবে নিশচয়ই সৌরভ দাদার মাথাটাও উঁচু হবে। সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে বাংলাদেশের এক নিবিড় সম্পর্ক আছে। আজকের ফাইনাল খেলার আগেই 'দাদা' কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নিয়ে দারূন সুন্দর একটি ফিচার লিখেছেন। সৌরভ গাঙ্গুলীর এমন আন্তরিকতাকে সম্মান করি। আমরা সৌরভ বা শচীনকে নিয়ে কম উচ্ছাস দেখাইনা, তাদের প্রত আমাদের ভালোবাসায় কোন খাদ নেই বলেই শচীন টেন্ডুলকারও দেশে ফিরে যাওয়ার আগে বাংলার ক্রিকেটারদেরকে আশীর্বাদ করতে ভুলেননি। সবাই আমাদের বর্তমান ক্রিকেট দলের টগবগে তরুণদেরকে নিয়ে আন্তরিকভাবেই সোনালী স্বপ্ন দেখছে। তাহলে আমরা কেনো কান্না কাটি করে আমাদের ছেলেদের এমন অর্জনকে বিষাদময় করে তুলছি! আমাদের ছেলেরা আমাদের জন্য বিজয়ের পুরোটাই এনে দিয়েছে। ক্রিকেট বিশ্বের বরেণ্য যাঁরা আছে, তারা কেউ ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি, ফাইনালের আগেই বাংলাদেশের নামে জয় জয়কার শুরু করে দিয়েছে।

পাকিস্তান শিরোপা পেয়েছে ঠিকই, কিনতু যে কালঘাম ঝরেছে এদের প্রতিটি খেলোয়ারের শরীর থেকে, শেষ রাজীবকে ঠেকাতে, একমাত্র পাকিস্তানের খেলোয়ারেরাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে, এবারের এশিয়ান কাপ ছিনিয়ে নেয়া কতটা কঠিন ছিলো। যাই হোক, আর যে যা ভাবে ভাবুক, আমি ভাবি এশিয়া কাপ বাংলাদেশই জিতেছে। কাপটা শুধু হাতে আসেনি, কাপের বদলে বাংলাদেশের ষোল কোটি মানুষ চলে এসেছে হাতের মুঠিতে। এই খেলার ভেতর দিয়েই প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রীসহ সকলেই যত মতভেদ ভুলে গিয়ে কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও এক কাতারে, এক সারিতে, সর্বোপরি একটি স্বপ্নবিন্দুতে এসে মিলেছে। কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টানসহ বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে একটাই প্রার্থণা করেছে, 'বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শুধুই বাংলাদেশ' বলে।

বাঙ্গালী আবেগে ভাসে, বাঙ্গালী আবেগে হাসে, বাঙ্গালী আবেগে ভাঙ্গে, বাঙ্গালী আবেগে গড়ে। আমরা গড়তেই চেয়েছি, আমরা গড়তেই চাই। মত পথ ভুলে আমাদের একবিন্দুতে আসার প্রয়োজন ছিল, প্রয়োজন ছিল আরেকবার পরখ করে নেয়ার, দেশের প্রয়োজনে আমরা এক হতে পারি কিনা। আমরা পেরেছি, আমরা সকলেই এক কাতারে আসতে পেরেছি, এটা এখন দিনের আলোর মত সত্য। স্বাধীনতার মাসে এটুকুই প্রয়োজন ছিল, বাকীটা অদূর ভবিষ্যতে হবেই হবে। বাংলাদেশের তারুণ্যই পারবে সকল জরা-জীর্ণতা ভেদ করে সোনালী স্বপ্নকে ছুঁতে!