কত রকমের মানুষ, তাদের কত রকমের গল্প!

রীতা রায় মিঠু
Published : 29 March 2012, 07:45 AM
Updated : 29 March 2012, 07:45 AM

স্যামির গল্প!

স্যামি বর্তমানে রিটায়ার্ড এয়ার ফোর্স অফিসার। থাকেন আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যে। এসেছিলেন ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারের কানেকশান সেন্টারে। স্যামি গতদিন একটি মোবাইল ফোন কিনেছে ১২০ ডলার দিয়ে, সাথে কিনেছে ৫০ ডলারের মিনিট কার্ড। সমস্যা হয়েছে, ফোন একটিভেট করতে গিয়ে। ফোনের সাথে আসা একটিভেশান কোড খুঁজে পাচ্ছিলনা কোথাও। তাই আমাদের কাছে এসেছে সমস্যা সমাধানের আশায়। সাধারনতঃ এই ধরনের সমস্যা নিয়ে কেউ এলে আমার সহকর্মীরা আমাকে দেখিয়ে দেয়। গ্রাহকদের সামনে আমি সাধারণতঃ কিছুই বলিনা, পরেও বলিনা। আমি এমনই। যাই হোক, স্যামিকে সাহায্য করতে উদ্যত হলাম। ততক্ষনে লক্ষ্য করেছি, স্যামির বাম পা নেই, বদলে একটি আর্টিফিশিয়্যাল পা ফিট করা আছে। আর্টিফিশিয়্যাল পা বুঝা যেতোনা, যদি স্যামি হাফ প্যান্ট না পরে ফুলপ্যান্ট পড়ে আসতো।

স্যামির সমস্যা সমাধান করে দিলাম, ওর ফোনের সাথে আসা ছোট্ট বুকলেটটি বের করে দিলাম যা স্যামির নজর এড়িয়ে গেছিল। স্যামির ফোনটি খুব সুন্দর বলেই সে ফোন কেইস কিনতে চাইল। আমাদের কাছে ঐ ব্র্যান্ডের ফোনের জন্য কোন কেইস ছিলনা। তাকে বললাম অন্য স্টোরের নাম। আমার মুখের উচ্চারণ শুনেই সে একটু থামলো, জিজ্ঞেস করলো আমাকে, আমি ভারতীয় কিনা। আমি পালটা জানতে চাইলাম, সে ভারত চিনে কিনা! উত্তরে সে জানালো, সে ভারত গিয়েছে কয়েকবার। বাংলাদেশ যাওনি? জানতে চাইতেই স্যামি বললো যে সে ভারতে যতবার গেছে, ততবারই বাংলাদেশেও গেছে। ট্রেইনার হিসেবে। স্যামি এয়ার ফোর্সে প্যারা রেসকিউয়ার ছিল, তার স্নাইপারের ট্রেনিং নেয়া আছে। সে সম্মুখযুদ্ধে অস্ত্রহাতে লড়াই করতেও জানে। সে ভারত ও বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সে ট্রেইনার হিসেবেই যেতো।

বর্ত্তমানে স্যামি বাধ্য হয়ে চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছে, কারন ইরাক যুদ্ধে গিয়ে বোমার আঘাতে তার বাম পা উড়ে গেছে, ডান হাতের গোড়ার দিক থেকে ১২-১৪ ইঞ্চি পর্জন্ত জায়গা জুড়ে গভীর ক্ষত। মাংস উড়ে গেছে। যুদ্ধকালীন সময়ে মাথায় হেলমেট পড়া ছিল বলে মাথাটি উড়ে যেতে পারেনি। তবে মাথায় প্রচন্ড চোট লেগেছিল। সবকিছু দেখে আমার খুব মায়া লাগলো, তার উপর সে আবার বাংলাদেশে কয়েকবার গিয়েছে জেনে আরেকটু বেশী মায়া লাগছিলো।

আমি অবাক বিস্ময়ে একজন যুদ্ধাহত সৈনিককে দেখছিলাম। বার বার স্যামিকে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলাম যে সে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তার প্রধান কাজ ছিল প্যরা রেসকিউয়ার হিসেবে ইরাকযুদ্ধে আহত বা নিহত আমেরিকান সৈনিকদের দেহ মাটি থেকে তুলে বিমানে করে নিয়ে নিজেদের জোনে নিয়ে আসা, এছাড়া সে স্নাইপার হিসেবেও অনেক যুদ্ধ করেছে। সম্মুখ সমরে যেতে হয়েছে তাকে অনেকবার। সেদিনও সে রনাঙ্গনে কিছু একটা দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় বোমার আঘাতে আহত হয়। ২৪ বছরের সৈনিক জীবনে সেদিনই শুধু তার উপর এসে বোমার আঘাতটা লাগে এবং তাকে বাকী জীবনের জন্য পঙ্গু করে দেয়।

আমি তাকে বললাম, " স্যামি, কোন সৈনিককে আমি এই প্রথম সামনাসামনি দেখলাম। স্নাইপারদেরকে মুভিতে দেখেছি, কিনতু একেবারে চোখের সামনে এই প্রথম দেখলাম। যুদ্ধাহত যোদ্ধা টিভিতে অনেক দেখেছি, জানোতো, আমাদের বাংলাদেশেই কত যুদ্ধাহত বীর এখনও বেঁচে আছে, তাদেরকে সামনা সামনি দেখিনি, কিনতু আজকে তোমাকে দেখেই সবাইকে দেখলাম। তুমি অনেক ভাগ্যবান, এখনও বেঁচে আছো, এতবড় আঘাতের পরও। ঈশ্বর তোমাকে আরও অনেককাল বাঁচিয়ে রাখুক। তোমার পরিবারও নিশচয়ই অনেক খুশী যে তোমাকে ফিরে পেয়েছে। তোমাকে আর যুদ্ধে যেতে হবেনা। আমার এই কথা শুনে কি জানি কেনো তাকে খুব একটা উৎসাহিত হতে দেখলামনা। শুধু বললো, "রীটা, আমার ২৪ বছরের কর্মময় জীবন হঠাৎ করেই যেনো থেমে গেলো। যাক, ওসব নিয়ে ভাবিনা। তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি তোমাদের দেশে কতবার গিয়েছি, আর যাওয়া হবেনা।" আমি স্যামীর নকল পায়ের দিকে আরেকবার তাকালাম, তারপর আবার জোর দিয়ে বললাম, ' তুমি আমার দেশে কয়েকবার গেছো, আমাদের দেশের তরুন এয়ারফোর্স অফিসারদেরকে ট্রেনিং দিয়েছো, তারা নিশ্চয়ই তোমার কাছ থেকে যে কোন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার মন্ত্রটাও শিখে নিয়েছে। আমিও খুব খুশী তোমার মত একজন বীর সৈনিকের সাথে কথা বলতে পেরে। তুমি ভালো থেকো। আবার দেখা হবে।