টর্নেডো ও আমাদের তাসের ঘর!

রীতা রায় মিঠু
Published : 6 April 2012, 08:06 AM
Updated : 6 April 2012, 08:06 AM

আমরা আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যে এসেছি ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে।। এর আগের তিন বছর ছিলাম ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে। আমাদের জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখেছি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে। প্রথম যেদিন তুষারপাত দেখি, সেদিনের অনুভূতি একেবারেই আলাদা। তিন বছরে প্রচুর তুষারপাত দেখেছি, কখনও কখনও রাস্তায় থেমে থাকা গাড়ীগুলো চার পাঁচ ফুট স্নো এর নীচে ঢাকা পড়ে গেছে। রাস্তাঘাটে বা বাড়ীর সামনে তুষার জমে যেনো বরফ না হয়ে যায়, তার আগাম ব্যবস্থা হিসেবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী এক ধরনের সল্ট ছড়িয়ে দেয়া হয় রাস্তায় ও বাড়ীর সামনে। এটা একটি কঠিন ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ। এর চেয়েও কঠিন কাজ হচ্ছে দুই তিন ফুট স্নো বা জমাটবাঁধা বরফ সরিয়ে নিজের গাড়ীটাকে পরিস্কার করা। কাজগুলো অবশ্যই কঠিন, কিনতু তুষারপাতে ঘর-বাড়ী উড়িয়ে প্রানহানি বা ঠিকানাবিহীন হওয়ার ভয় নেই। কিনতু মিসিসিপিতে এসে তুষারপাতের মত প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্য হারিয়ে, বদলে পেয়েছি প্রকৃতির ভয়ংকর রূপ, 'টর্নেডো'।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া একটি পাহাড়ঘেরা অপূর্ব সুন্দর রাজ্য। তবে পাহাড়ী রাস্তায় হাঁটার সময় সৌন্দর্য্যের চেয়ে শারীরিক কষ্টটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে যখনই শুনেছি মিসিসিপি হচ্ছে সমতল এবং একেবারেই বাংলাদেশের মতই আবহাওয়া, অপূর্ব সুন্দর ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ছেড়ে যেতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। মিসিসিপির ছোট্ট শহর কলম্বাস, আমরাই একমাত্র বাঙ্গালী পরিবার। প্রথম পনেরো দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজে থেকে নিজেদের ভাড়া করা এপার্টমেন্টে এসে উঠেছিলাম। ক্যাম্পাসে একটি মাত্র সাউথ ইন্ডিয়ান ফ্যামিলিকে পেয়েছিলাম, যারা আমাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করেছে। এপার্টমেন্ট হাউজে আসার সাত দিনের মধ্যেই এক গভীর রাতে বুক হিম করা সাইরেনের শব্দে আমাদের সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ধড়মড় করে বিছানার উপর বসেই কিছু না বুঝেই ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম সবাই। সেই গভীর রাতেই সাউথ ইন্ডিয়ান মেয়েটি আমাদেরকে ফোন করে জানালো, যে এটা 'টর্নেডো' ওয়ার্নিং। সাইরেন যতক্ষন বাজবে ততক্ষন যেনো আমরা সবাই বাথরুমে ঢুকে গিয়ে চুপ করে বাথটাবের মধ্যে বসে থাকি। সবার হাতেই যেনো একটি করে বালিশ থাকে যা দিয়ে মাথা ও ঘাড় ঢেকে রাখা যায়। একেতো গভীর রাতের সাইরেন, তার উপর এমন অদ্ভুত সতর্কতা ব্যবস্থা, বুঝিনি বলে আমরা কিছুই করিনি। সাইরেন এক সময় থেমে গেছে।

পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার স্বামী কলিগদের সাথে কথা বলে জেনে এসেছে, মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া টর্নেডো যে কোন সময় এসে আঘাত হানতে পারে, যে কোন কিছুর উপর। তাই টর্নেডোর সময় নিরাপদে থাকার জন্য বেসমেন্ট (মাটির নীচে ঘর) হচ্ছে সবচেয়ে ভালো জায়গা। (নিউইয়র্কে প্রতিটি বাড়ীতেই বেসমেন্ট থাকে, মিসিসিপিতে কোন বাড়ীতেই বেসমেন্ট নেই)। বেসমেন্ট না থাকলে ঐভাবে বাথরুমে গিয়ে কাঁথা কম্বল দিয়ে মাথা ঢেকে বসে থাকতে হবে। কারন সারা বাড়ীতে বাথরুম হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ। ছোট্ট পরিসরের রুমটিতে জানালা থাকেনা, বাতাস ঢুকতে পারেনা বলে টর্নেডোর আঘাতে সম্পূর্ণ বাড়ী উড়িয়ে নিয়ে গেলেও বাথরুমগুলো হয়তোবা আড়ালে থাকে। ঘর-বাড়ী উড়িয়ে নিয়ে যায় শুনে আমার একটু অবিশ্বাস হতেই জানলাম, আমরা আসার তিন চার বছর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়টির জিমনেসিয়ামের ছাঁদ টর্নেডোর ছোবল খেয়ে উড়ে গেছে। কোন প্রানহানি না ঘটলেও একটি জিমনেসিয়ামের ছাঁদ উড়ে যাওয়া, ভাবতেই ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো। আমেরিকাতে বাড়ী-ঘরগুলো দেখতে সুন্দর, বাড়ীর সামনে ফুলের বাগান তারও চেয়ে বেশী সুন্দর। কিন্তু বাড়ীর কাঠামো যে কি পলকা থাকে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে। বাড়ীগুলোর বাইরের চাকচিক্য আছে, অথচ হালকা পলকা কাঠামোর উপর দাঁড়ানো। রুমের দেয়ালগুলোতে আঙ্গুলে টোকা দিলেই ফাঁপা আওয়াজ পাওয়া যায়। সলিড কিছু নেই ভেতরে, হার্ডবোর্ড দিয়ে মনে হয় বানানো। টর্নেডো যেখানে শক্তপোক্ত জিমনেসিয়াম উড়িয়ে নিতে পারে, সেখানে মানুষের বাড়ীগুলোকে ধূলায় মিশিয়ে দেবে, এতে আর বিচিত্র কি!

সেই থেকে আজ অবধি টর্নেডোর মাঝেই বসবাস আমাদের। প্রথম কয়েক বছর আমার স্বামী পাত্তা দিতনা এইসব টর্নেডো ফর্নেডোকে। গ্রামে বেড়ে উঠা মানুষ সে, কালবোশেখী, ঝড় ঝঞ্ঝা, বন্যা সাইক্লোন দেখেই বড় হয়েছে, আর আমেরিকাতে এসে টর্নেডো নিয়ে মাথা ঘামাবে!! আমাকে ভীতু বলে অনেক উপহাস করেছে সে। বাংলাদেশের এই বীর শেষ পর্যন্ত টর্নেডোকে ভয় পেতে শুরু করলো। ইদানীং প্রায়ই টিভিতে দেখাচ্ছে, রাস্তায় চলতে থাকা আঠারো চাকার ট্রাকগুলো পর্যন্ত উলটে যায়। ভয় না পেয়ে উপায় কি!

২০১০ সালের ৩১শে ডিসেম্বার রাতে আমাদের বাড়ীতে বাংগালী ছাত্রছাত্রীদের নিমন্ত্রন করেছিলাম। তাদের মধ্যে শাহীন-নিশোও ছিল। ছিলোনা শুধু গার্গী-জীবনানন্দ। ওদের নেমন্তন্ন ছিল ওদেরই আরেক আমেরিকান বন্ধুর বাড়ীতে। আমাদের বাড়ী থেকে রাত একটা দেড়টার দিকে সকলে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই টর্নেডো সাইরেন বাজতে শুরু করেছিল। আমাদের বর্তমান বাড়ীটির নীচের ফ্লোরেই (বেসমেন্ট নয়) আমি মেয়েদেরকে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি, যতক্ষন সাইরেন বাজে। আর বাংলাদেশের বীর ঐ সময়ে টিভি অন করে ওয়েদার চ্যানেল দেখে একবার, জানালার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখে একবার। পরদিন খুব সকালেই জানলাম, ঐ টর্নেডোটি যাওয়ার সময় শাহীন-নিশো এবং গার্গী-জীবনানন্দদের এপার্টমেন্টের ছাঁদ উড়িয়ে নিয়ে গেছে। বিরাট বড় এপার্টমেন্ট কম্পলেক্সে সব দেশের ছাত্রছাত্রীরাই থাকে, বাইরে থেকে দেখলে বুঝার উপায় নেই, দালানগুলো এমন পলকা! গার্গী-জীবনানন্দ তখনও বাড়ী ফেরেনি বলে প্রানে বেঁচেছে, আর শাহীন-নিশো পাশের রুমে থাকাতে বেঁচে গেছে।

২০১১ তেই আরেক টর্নেডো এসে আঘাত করেছে আমাদের কলম্বাস শহরের কাছের শহর টাস্কালুসাতে। আমি ছিলাম ঐ মুহূর্তে ওয়াল মার্টে কর্মরত অবস্থায়, বিকেলের দিকে ঘটনা। ওয়ালমার্ট হচ্ছে সুপার সেন্টার, যে কোন খবর মুহূর্তে চলে আসে সবার কাছে। ওয়েদার চ্যানেলে শোনাচ্ছিল, কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের শহরের উপর দিয়ে টর্নেডোটি আঘাত হেনে যাবে, সকলেই শুধু ভয়ার্ত চোখে সর্বনাশের অপেক্ষায় ছিলাম। কর্মী থেকে শুরু করে সেন্টারে আসা শত লোককে একটি জায়গাতে এনে জড়ো করা হয়েছিল। সবার হাতের সেল ফোন বেজে চলেছে। সকলেই যার যার আপন মানুষের খোঁজ নিচ্ছে। দোয়া দরুদ পড়ছে, আমিও ঘরে ফোন করে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে সাবধানে থাকতে বলে, বীরপুরুষটিকে বিশেষ অনুরোধ করলাম একটু সাবধানে থাকতে। কারন আমেরিকার মানুষ এগুলোর সাথে পরিচিত, সেই মানুষগুলোই এমন ভয় পাচ্ছে, তার মানেই এটা কোন ছেলেখেলা নয়। সেদিন টর্নেডোটি আঘাত হেনেছিল, ভয়ঙ্কর আঘাত হেনেছিল, বিকেলের সেই টর্নেডোতে কত বাড়ীঘর উড়ে গেছে, কত দালান মাটির সাথে শুয়ে গেছে, আর ১৬০ জনের প্রানহানি হয়েছে। আমাদের শহরের উপর দিয়ে যে টর্নেডোটি যাওয়ার কথা ছিল, মুহূর্তের খেয়ালে একটু বাঁক নিতেই তা গিয়ে আঘাত করেছে পাশের শহরটিকে। মাত্র চল্লিশ পঞ্চাশ মাইল দূরের শহরটি ১০-১৫ মিনিটে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমেরিকাতে সাধারন মানুষগুলোও খুব এডভেঞ্চারপ্রিয় হয়ে থাকে। অমন শক্তিশালী টর্নেডোর ভিডিও পর্যন্ত করে ফেলেছে কিছু মানুষ। সাথে সাথে ইউটিউবে আপলোড করে দিয়েছে। টাস্কালুসা টর্নেডো টাইপ করলেই অনেক ভিডিও ক্লিপ দেখা যায়। হাতির শুঁড়ের মত দেখতে ঘূর্ণীকে সত্যি সত্যি উন্মাদ হাতীর মতই লাগে!

এরপরেও নিয়মিত টর্নেডো হচ্ছেই। আজ এখানে তো কাল ওখানে। যেখান দিয়েই যাক, তার প্রলয় নাচনে ঘরবাড়ী গুলো উড়ে যায়, মাটির সাথে শুয়ে যায়, রাস্তার গাড়ীগুলো খেলনা গাড়ীর মত উড়ে গিয়ে হয়তো অন্য কোথাও আছড়ে পড়ে। এই বছরে টর্নেডো শুরু হয়েছে। গত পরশু মানে ৩রা এপ্রিল তারিখে বড় শহর ডালাসে টর্নেডো আঘাত হানলো। নিজে টিভি অন করে রাস্তার উপর বিশাল বিশাল ট্রাকগুলোকে উলটে থাকতে দেখে কেমন এক ধরনের অস্থিরতা টের পাই। ডালাস অনেক বড় শহর, দালান কোঠা বাড়ীঘর, লোকজন ভরপুর শহরটি অনেক বছর পরে আবার স্তব্ধ হয়ে আছে। মুহূর্তের টর্নেডো এসে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে বিশাল এক এলাকা। অন্য জায়গাতেও টর্নেডো হচ্ছে, কিনতু ডালাসের কথা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কারন এই ডালাসেই যাচ্ছে আমাদের বড় মেয়ে ডাক্তারীর ইনটার্নশীপ করতে। নিজের প্রানের জন্য আর ভয় করিনা, কিনতু সন্তানের জন্য চিন্তা হয়। মানুষের হাত থেকে যদিওবা পরিত্রান পাওয়া যায়, প্রকৃতির হাত থেকে পরিত্রান পাবো কি করে! যাবোটা কোথায়! আমার কেবলই মনে হয়, আমার ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোন রাস্তা খোলা নেই। কোথায় যাবো, সবখানেইতো বিপদ! তবে ইদানিং একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছি আমার স্বামীর মধ্যে। সে এখন আর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়না ( জানালার কাছে দাঁড়ালে কাঁচ ভেঙ্গে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্কতা বাণীতে এটা করতে মানা করা হয়)। চুপচাপ নীচের ঘরেই বসে থাকে। তাছাড়া আরতো কিছু করার নেই। মেয়েরাই এখন এক ধমকী দিয়ে বসিয়ে রাখে।

পৃথিবীর আবহাওয়া পালটে গেছে। গ্রীন হাউজ ইফেক্ট বলে যে গালভরা শব্দগুলো শুনতে পাই, এর ইফেক্ট যে কি ভয়াবহ হচ্ছে দিন দিন, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কোথায় গেলে শান্তি পাই তাও জানিনা। ভুমিকম্প, সাইক্লোন তো আছেই। তুষারপাত দেখতে যতই মোহনীয় হোক না কেনো, এটাও দিন কে দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে আমেরিকা নামের শক্তিশালী দেশের বাড়ী ঘরগুলোকে সত্যি সত্যি তাসের ঘরই মনে হয়। ইদানিং টিভিতে নানা রকম বিজ্ঞাপন দেখি, টর্নেডোর হাত থেকে বাঁচতে হলে বাড়ীতে নতুন করে বেসমেন্ট বানানোর বিজ্ঞাপন, আমার আর সাড়া দেওয়ার উপায় নেই। আমাদের বাড়ীগুলোতে বেসমেন্ট নেই। কারো বাড়ীতেই বেসমেন্ট নেই, কারন মিসিসিপিতে মাটির লেভেল সমুদ্রের লেভেলের নীচে বলেই নাকি মাটির নীচে ঘর বানানো হয়নি। কি জানি, ভূগোলের এইসকল বিষয় আমার মাথায় ঢুকেনা। সমুদ্র লেভেলের নীচে বলেই হ্যারিকেন ক্যাটরিনা নিউ অর্লিন্স নামের বড় শহরটিকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। (যদিও মানুষই দায়ী সব কিছুর জন্য)। আসলে মৃত্যুভয় এমনই এক অনুভূতি, মৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তত্বকথা শুনতে ভালো লাগেনা, অসহায় মানুষ প্রকৃতির রুদ্ররোষের শিকার হয়ে কপাল চাপড়ায়, নিজের কর্মফল নিয়ে চিন্তা করার বোধটুকুও লোপ পেয়ে যায় তাসের ঘরের ভেতর বসবাস করা মানুষগুলোর।