পিলখানা হত্যা – একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ

তারিক রিজভী
Published : 25 Feb 2018, 05:33 PM
Updated : 25 Feb 2018, 05:33 PM

আমরা তখন বাবার চাকরি সূত্রে যশোরের বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে থাকতাম। সেখানে ছিলো বেশ কটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়কার বাংকার । আট ফিটের নিরেট দেয়ালের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর অসংখ্য পেঁচানো গলির সেই সব বাংকারে আমরা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতাম। একদল লুকাতাম আরেক দল লুকিয়ে থাকা দলকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। বিপরীত দলকে মুখ দিয়ে গুলি করে, মেরে ফেলতাম। এটাই ছিলো খেলা। তবে কে আগে কাকে গুলি করেছে এই নিয়ে এতো বেশী ঝগড়া হতো যে, কেউ  মরতে চাইতো না। শুধু ব্যতিক্রম ছিল, মনি। তাকে আমরা কেউই খুঁজে পেতাম না । কোথায় যে সে লুকিয়ে থাকতো ! হঠাৎই সে বের হয়ে এসে আমাদের গুলি করতো । এতো নিশ্চিত গুলি যে, আমরা ঝগড়া করতে পারতাম না, মরতে বাধ্য হতাম । তাই সবাই চাইতো মনিকে দলে নিতে । তার দলের জয় ছিলো অনেকটাই নিশ্চিত।

২৬ ফ্রেবুয়ারি'২০০৯ রাত ৯টা । আমি মেজর আসাদের বাসায়। তার স্ত্রী সাইকী উন্মাদের মতো কাঁদছে। আড়াই বছরের একমাত্র মেয়ে সুহা ছোটাছুটি করে খেলছে । গতকাল পিলখানার ঘৃণ্য ঘটনার  সময় আসাদ দরবার হলে ছিলো । তখনো তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি না। আমরা কেউ সাংবাদিকদের  সাথে কথা বলছি, একদল পিলখানার সামনের রাস্তায়, কেউবা সিএমএইচ-এ। হঠাৎ একজন ফোন করে জানালো, সম্ভবত আসাদকে পাওয়া গেছে। সে পিলখানার নর্দমায় লুকিয়ে ছিলো। ভীষন আহত, সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাথে সাথে আমার ছেলেবেলায় বাংকারে গুলি গুলি খেলার কথাটা  মনে হলো। আমি আশাবাদি হলাম, ছেলেবেলা থেকেই মেজর আসাদ (যার ডাক নাম, মনি) লুকিয়ে থাকায় ওস্তাদ। হতেই পারে এটা আমাদের মনি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর আসাদ। সাথে সাথে ছুটে গিয়েছিলাম সিএমএইচ-এ। না, ওখানে মনি ছিলো না। আমরা তখনো জানিনা, সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে চিরজীবনের জন্য। আমি যখন সিএমএইচ-এ যাচ্ছি মেজর আসাদ তখন মাটির নীচের কোন অন্ধকার গণকবরে আরো ১৫জন যোদ্ধার সাথে অবহেলিত, নিষ্প্রাণ পরে আছে ।

মনি, গণকবর কী আমাদের ছেলেবেলার বাংকারের চেয়েও বেশি অন্ধকার? তোর আড়াই বছরের ফুটফুটে মেয়ে সুহা জানেনা সে কী হারিয়েছে । সে দুষ্টুমি আর খেলা নিয়ে ব্যস্ত। ওর দিকে তাকালে আমি তোকে দেখতে পাই । যেন তোর মুখটাই লাগানো আছে সুহার মুখে । বাবা মেয়ের চেহারার এত মিল আগে কখনো দেখিনি । শুনেছি বাবার মত চেহারা পেলে মেয়েরা নাকি ভাগ্যবতী হয় । আসলেই কী সুহা ভাগ্যবতী? তোর মেয়ের চাইতেও কম বয়স থেকে আমরা দুজন বন্ধু। একসাথে বেড়ে উঠা, একমাঠে খেলা, এক স্কুলে লেখাপড়া… .. তোর আর্মি জীবন শুরু হবার পর শুধু আমরা শারীরিকভাবেই দূরে সরে গেছি । কত নিযুত স্মৃতি আমাদের ! তোর মনে পড়ে- মনি, খালাম্মা (তোর মা) আর্মি ভীষন পছন্দ করতেন । আমি যখন ক্যাডেট কলেজে গেলাম তিনি ধরেই নিলেন তার এই ছেলেটা আর্মি অফিসার হবে । ছুটিতে আসলে তাই তোর চেয়ে আমার আদর ছিলো বেশী।

মনি, আমাদের বেড়ে উঠার সেইসব সময়গুলোতে কখনো কী এমন হয়েছে, কোন ভালো খাবার আমাদের দুই পরিবার কেউ কাউকে ছাড়া খেয়েছি? কখনো কী কোন ঈদে আমরা দুই রকম  পোশাক পরেছি? আমার বড় বোন আর ছোট ভাইয়ের অভাবটা কখনো বুঝতে পারিনি লাকী আপা আর বাবুর জন্য । তারাও কখনো শুধু তোকে তাদের ভাই ভাবেননি । কী অসম্ভব মমতাময় ভালোবাসায় আমরা বেড়ে উঠেছি!। অথচ দেখ, জীবন কী ভীষন অদ্ভুত!  আমি ক্যাডেট কলেজে পড়েও আর্মিতে গেলাম না, আর তুই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও আর্মিতে চলে গেলি।  খালাম্মার সেই সময়ের আনন্দিত চোখ আমি আজো দেখতে পাই । লম্বা, চওড়া শক্ত শরীরের রাশভারী খালু মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু তার চোখেও ছিলো খুশির ঝিলিক ।

তারপর তুই হয়ে গেলি একজন সৈনিক । তুই চলে গেলি তাদের দলে যারা অস্ত্র হাতে জেগে থাকে বলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি । বাংলাদেশের অল্প ক'জন ট্যাংক চালনায় পারদর্শী অফিসারদের মধ্যে তুই একজন ছিলি। বারবার মনে পড়ে সেই দিনটির কথা । তোর ফোন পেয়ে আমি ছুটে গেলাম সিএমএইচ-এ। ডান পা কোমর পর্যন্ত প্লাস্টার করে, উচুঁতে বেঁধে রাখা । তুই হাসতে হাসতে আমাকে বললি , "দোস্ত ট্যাংকের সাথে  এ্যকসিডেন্ট হয়েছে। ট্যাংকও আমাকে মারতে পারেনি। দেখিস্ আমি বেঁচে থাকবো  অনেকদিন!"

হ্যাঁ, মনি তোর অনেকদিন বেঁচে থাকারই কথা ছিল । আমার মতো একজন সাধারন মানুষ চলে গেলে দেশের ক্ষতি-বৃদ্ধি  হয় না । কিন্তু তোরা দেশের সম্পদ । এই দেশকে তোদের দেবার আছে অনেক কিছু, দেশেরও তোদেরকে । আগে ভাগে চলে যাওয়া তাই তোদের জন্য  নয় । অথচ, এই মেজর আসাদকেই আমরা ক'জন খুঁজে পেলাম মর্গের মেঝেতে।  এতোটাই ক্ষত বিক্ষত আর বীভৎস যে, একজন মেজর আসাদকে সনাক্ত করতে হিমসিম খেতে হলো তার জীবনের প্রথম বন্ধুকে । এমন মৃত্যু তো তোর প্রাপ্য নয় । মনি বল তো- কে বেশী অপরাধী -৭১'র গোলাম আযমরা নাকি আজকের তথাকথিত বিডিআর'র পোশাক পরা একদল পশুরা; যারা সরাসরি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে?  রাষ্ট্রের সবচেয়ে দামী মানুষদের নৃশংসভাবে খুন করেছে?

মেজর আসাদ, আমরা তো এদেশের নগন্য সাধারন মানুষ। ডরপুকের মতো ভয় পেয়ে, মাথা নীঁচু করে শুধুমাত্র নিজের নিরাপত্তা ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না! কিন্তু তোরা এদেশের সূর্য সন্তান, এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতি তোরা। তোদের হত্যার কী বিচার আমরা দেখবো না? রাষ্ট্র কি খুঁজে বের করবে না, সেইসব ঘৃণ্য পশুদের যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে কলকাঠি নেড়েছে? আমরা সবাই তাকিয়ে আছি সেই সুদিনটির দিকে।