লক্ষণ সেনের শহর থেকে নবাবের দেশে

রবি হোসাইন
Published : 16 April 2017, 10:10 PM
Updated : 16 April 2017, 10:10 PM

যাব হাজারদুয়ারী। কৃষ্ণনগর থেকে হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে যেতে হবে। অবশ্য এই ট্রেন কলকাতা রেলওয়ে স্টেশন থেকেই ছাড়ে।কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব দুশো কিলোমিটার।

মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র হাজারদুয়ারী প্রাসাদের নামে ট্রেনটির নাম রাখা হয়েছে। ট্রেনে চেপে বসলাম। মুর্শিদাবাদ যাওয়ার আগে থামল বেথুয়াডহরি, পলাশী , বেলডাঙা , বহরমপুর কোর্ট স্টেশনে। এরপর মুর্শিদাবাদ। পরের স্টেশন জিয়াগঞ্জ যেখানে অরিজিৎ সিং এর বাড়ি।

পলাশী স্টেশনে আসতে আসতে কথা হলো কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সাথে। এই প্রথম কেউ বুঝতে পারেনি আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বলল, কলকাতা কোথায় থাকো? বাহ কি আনন্দ! জয়নাল ভাইয়ার আধা ভারতীয় কথাটায় দেখি কাজ হচ্ছে।

পলাশী স্টেশন পার হবার পর এই চিত্র দুপাশে

পলাশী কৃষ্ণনগর থেকে ৫০ কিমি উত্তরে। লাল রঙের ফুল পলাশ থেকে পলাশী নামটি এসেছে । পাশেই ভাগীরথী নদী। পলাশী নেমে দেখা হয়নি। পরের বারে জন্যে তোলা থাকল। তবে গুগলে জেনেছি পলাশী যুদ্ধ যেখানে হয়েছে সেখানে পলাশী সুগার মিল আছে। এছাড়া পলাশী যুদ্ধ ক্ষেত্রের কিছু স্মৃতিস্তম্ভ পার্শ্ববর্তী ফসলী মাঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বহরমপুর কোর্ট স্টেশনের পরের স্টেশন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদাবাদের প্রতিষ্ঠাতা বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। মুর্শিদাবাদের আগের নাম ছিল মুকসুদাবাদ।

মুর্শিদাবাদ স্টেশন

স্টেশন থেকে নামতেই অনেক টমটম ডাকতে থাকে। ওরা বলে টুকটুকি। কয়েকটা ঘোড়ার গাড়িও দেখলাম। একটা টুকটুকি নেয়া হলো। সে বিকেল পর্যন্ত ঘুরে দেখাবে।

নবাব নেই আছে ঘোড়ার গাড়ি

প্রথমেই জাহান কোষা কামান। জাহান কোষা কামান যেখানে আছে সেটা মুর্শিদখুলি খাঁর আমলে ছিল ব্যাক্তিগত অস্ত্রাগার। জাহান কোষা শব্দটা আরবী। 'জাহান কোষা' শব্দের অর্থ হল 'পৃথিবীর ধ্বংসক'।

জাহান কোষা কামান

এই কামানটি তৈরী করা হয়েছিল অষ্টধাতু অর্থাৎ সোনা, রূপা, দস্তা, তামা, জিঙ্ক, টিন, লোহা ও পারদ দিয়ে। কামানটির ওজন ৭ টনের বেশী। কামানটি ১৭ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা ও ৩ ফুট চওড়া। কামানটি থেকে একবার গোলা দাগবার জন্য ১৭ কিলো বারুদের দরকার হত। কামানটি অষ্টধাতু দিয়ে তৈরী তাই এখনো মরচে বিহীন। ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে, বাংলার দারোগা মহম্মদের নির্দেশে ও হর বল্লভ দাসের তত্বাবধানে তৎকালীন বিখ্যাত অস্ত্র প্রস্তুতকারক শ্রী জনার্দন কর্মকার এই কামানটি নির্মাণ করেন। অশ্বথ গাছের বুকের সাথে জড়ানো অবস্থায় কামানটা ছিল। সেটি এখন উপরে তোলা হয়েছে। চারদিকে জঙ্গল ছিল। এখন অবশ্য আশে পাশে অনেক বাড়িঘর হয়েছে।

তারপর কাটরা মসজিদে। এটি মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে কাটরা বাজারের পাশেই। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধিস্থল এখানেই অবস্থিত।

কাটরা মসজিদ

এক তলা উচ্চ মঞ্চের উপর উত্থিত কাটরা মসজিদ মুর্শিদাবাদের প্রাচীন ইমারত। এটি ১৭২৩ সালে মুর্শিদাবাদের স্থপতি মুর্শিদকুলি খাঁ নির্মাণ করেছেলিন। উচ্চ মঞ্চ বিশিষ্ট মসজিদের প্রবেশ সিড়ির নিচের তলদেশে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি অবস্থিত। প্রতিরক্ষার জন্য আছে রন্ধ্র বিশিষ্ট দুইটি বৃহদাকার বুরুজ ও মিনার।

আমি আর অনিক ভাইয়া

মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দুটি গম্বুজ ভগ্নদশায় দাড়িয়ে আছে। গম্বুজের উপর থেকে মুর্শিদাবাদ নগরীর অধিকাংশ দেখা যেতো। মসজিদের চারদিকে অনেকগুলো ছোট ছোট খোলা ঘরে আছে কোরআন পাঠের জন্যে।

মসজিদের ভেতরের অংশ

নশিপুর রাজবাড়ির পাশে এলাকায় মনোরম একটি প্যালেস, বাগান ও পরেশনাথের মন্দির আছে যেটা কাঠগোলা বাগান নামে পরিচিত। সেখানে নবাবদের ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র আছে। প্যালেসের সামনেই একটা পুকুর আছে। দু তিন প্রজাতির মাছ এসে পুকুর ঘাটে জটলা করে বেশ সুন্দর লাগে দেখতে। এরকম ব্যাপার সিলেটে শাহজালালের মাজারে দেখেছিলাম।

নশিপুর রাজবাড়ি

এবার নশিপুরে জগৎ শেঠের বাড়ির দিকে। ১০ টাকায় টিকিট করতে হল। জগৎ শেঠ হলেন নবাবী আমলের ধর্নাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। বাড়িটিতে সেখানে জগৎ শেঠদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস ও আসবাবপত্র রয়েছে। বাড়ির ঠিক পিছনে রয়েছে ভূগর্ভস্থ গুপ্ত সুরঙ্গ, মাটির তলায় গুপ্তঘর।

জগৎ শেঠের প্রাসাদ

জগৎশেঠের টাকশালে তৈরি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, স্বর্ণ ও রৌপ্য শাড়ি, খাজঞ্চি খানা, ঢাকাই মসলিন ও আছে। বাড়ির আঙিনায় বিশাল একটি মন্দির আছে যেটা বের হবার পথে দেখা যায়। এরপর আরেকটু সামনেই নশিপুর রাজবাড়ি।এখানেও ৬ টাকার টিকেটে আছে। রাজবাড়িটি তৈরি করেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখ্যাত দেবি সিংহ। আদিবাড়ি পানিপথ থেকে দেবি সিংহ মুর্শিদাবাদ এসে ইংরেজ কোম্পানির অধীনে রাজস্ব আদায়কারীর পদে ভূষিত হয়ে ৭৬ এর ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের সময়ও প্রজাদের উপর অত্যাচার নিপিড়ন করে রাজস্ব আদায় করতেন। রাজবাড়িটি তৈরি করা হয়েছে হাজারদুয়ারী প্রাসাদের আদলে।

মীর জাফরের বংশধরদের কবর

ড্রাইভার বলল এরপর মীরজাফরের বংশধরের ১১০০ কবর দেখতে নিয়ে যাবে। না করলাম। পথ চলতেই দেখলাম জীর্ণ-ভগ্নদশা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাসাদ। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ লিখা আছে। এটাই ছিল মীরজাফরের প্রাসাদ। অনেকে এটাকে নিমকহারাম দেউড়ী বলে। জায়গাটা হাজারদুয়ারী থেকে দেড়-দুই কিমি দূরে জাফরাগঞ্জে। নবাবী আমলে আলীবর্দ্দি খাঁ তার বোন শাহখানমের জন্য ওই প্রাসাদটি তৈরি করেছিলেন। শাহখানমের স্বামী হলো মীরজাফর। এই নিমকহারাম দেউড়ী ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙ্গে পড়ে। এই প্রাসাদেই মীরনের নির্দেশে মোহাম্মাদী বেগ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করে।

নিমকহারাম দেউড়ীর পাশেই আছে মীরজাফরের কবর। ওই সমাধিক্ষেত্রে মীর জাফরের পুত্র মীরন, ফেরাদুন জা ছাড়া মীরজাফরের বংশধরের ১১০০ কবর রয়েছে। তারপর মুর্শিদকুলি খাঁর একমাত্র কন্যা আজিমুন্নেসা বেগমের সমাধি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ। এটি মহিমাপুর এলাকায়। একতলা পাকা মঞ্চের উপর মসজিদে উঠার সিঁড়ির নিচে আজিমুন্নেসার সমাধি।

আজিমুন্নেসা বেগমের সমাধি

কথিত আছে, একবার আজিমুন্নেসা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজ হেকিমের নির্দেশে সুস্থতার জন্য প্রতিদিন জীবন্ত শিশুর কলিজা দিয়ে তৈরি ঔষুধ খেতে হতো অত্যন্ত গোপনীভাবে। পরবর্তীতে তিনি সুস্থ হয়ে পড়লেও মানবদেহের কলিজায় আসক্ত হয়ে পড়েন। একথা পিতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ বা স্বামী সুজা খাঁ জানার পর তার নির্দেশে আজিমুন্নেসাকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়। এবং সাধারণ মানুষের পদধূলিতে তার পাপ মোচনের জন্য মসজিদে ওঠার সিঁড়ির নিচে তাকে সমাহিত করা হয়। আর এ কারণেই অনেকেই আজিমুন্নেসাকে 'কলিজাখালী' বলেন।

যার উপাধি ছিল কলিজাখালী

সবার শেষে হাজারদুয়ারী। প্রাসাদের ভেতর মোবাইল নেয়া যায় না। তাই প্রবেশ করার সময়েই ব্যাগ বা মোবাইলে যা থাকে রেখে টোকেন নিতে হয়। তারপর ভেতরে যাওয়ার টিকেট। ভেতরে না গেলে টিকেট না নিলেও চলে।

হাজারদুয়ারী প্যালেসের প্রবেশপথ

হাজারদুয়ারী প্রাসাদটি ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাসাদের জানালা থেকে দেখা যায় ভাগীরথী নদীর বয়ে চলা। প্রাসাদটি তিন তলা। প্রাসাদে এক হাজার দরজা থাকায় এমন নামকরণ হয়েছে বলেছিল ভারতীয় এক বান্ধবী। ওই এক হাজার দরজার মধ্যে ৯০০টি আসল দরজা আর বাকী ১০০টি নকল দরজা। নকল ১০০টি দরজা দেয়ালের সাথে এমন ভাবে সেট করা যাতে বোঝার উপায় নেই যে, কোনটি আসল আর কোনটি নকল।

হাজার দরজার প্রাসাদ

নবাব সিরাজ-উ-দৌলার মৃত্যুর প্রায় ৭২ বছর পর ১৮২৯ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিসের উপস্থিতিতে তৎকালীন পুতুল নবাব নাজিম হুমায়ুন জা এই প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন গভর্ণর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের সময়ে স্থপতি কর্নেল ডানকানের পরিকল্পনা ও তত্বাবধায়নে প্রাসাদের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়, যার খরচ পড়ে সেই সময়ের ১৮ লাখ টাকা।

প্রাসাদটি ত্রিকোনাকৃতির। কম্পাউন্ডের আয়তন ৪১ একর। প্যালেসের সামনে দুই পাশেই বাগান। একতলা প্যালেসের সামনের ভাগে বিশাল বড় একটি সিঁড়ি তৃতীয় তলার দরবার কক্ষ পর্যন্ত উঠেছে। ওই সিঁড়ির দুই পাশে সিংহমূর্তি ও ছোট কামান রয়েছে। নবাবের আমলে রাষ্ট্রীয় অতিথিরা সেখানে গেলে ওই কামানের গোলা বর্ষণ করে স্বাগত জানানো হতো।

প্রবেশ করার পর প্রথমেই অস্ত্রাগার। এটি প্রথম তলায়। অস্ত্রাগারে ২৬০০টি বিভিন্ন অস্ত্র আছে। পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল এমন অস্ত্রও আছে। নবাব আলীবর্দি, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ব্যবহৃত তলোয়ার, বহুনল বিশিষ্ট বন্দুক, নাদির শাহের শিরস্ত্রান, মীর কাশিমের ছোরাও আছে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে যে ছোরার সাহায্যে মোহাম্মাদী বেগ হত্যা করেছিল সেটিও আছে।
আরেকটু সামনে গেলেই অফিস-কাছারি, রেকর্ডরুম। উপরে উঠার যে রুম সেটার দুই কোণে দুটি জাদু আয়না আছে যেটাতে দর্শক তার নিজের মুখ দেখতে পাবে না কিন্তু উপস্থিত অন্যদের মুখ দেখতে পায়। উপরতলায় আছে আছে নবাবদের পোশাক, জুতা ও ব্যবহারিক বস্তু। তার পরের কক্ষে আছে আসামের  ঊনবিংশ শতাব্দির ২ ফুট ব্যাসের বিশালাকৃতির বড় বাঁশ। হুমায়ুন জার শিকার করা বিশালাকৃতির কুমির। আছে সম্রাট আওরঙ্গজেব ব্যবহৃত হাতির দাঁতের পালকি, সম্রাট শাহজাহানের হাতির দাতের তাজাম, নবাব হাসান আলী মির্জার রৌপ্য তাজাম, হাওদা নামের গদি আটা আসন যা হাতির পিটে ভ্রমণের জন্য ব্যবহৃত হতো।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আছে আর্ট গ্যালারি ও লাইব্রেরি। আর্ট গ্যালারিতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা ও তৈলচিত্র আছে। কয়েকটি গ্যালারিতে দেওয়ান, ইংরেজদের ছবি আছে। কেন্দ্রীয় গ্যালারিতে আছে নবাব মুর্শিদকুলি খা, সিরাজ-উ-দৌলা থেকে শেষ পুতুল নবাব পর্যন্ত ১৮জন নবাবের ছবি। লাইব্রেরি ফ্লোরে ছোট-বড় বহু ধর্মগ্রন্থ, কয়েক হাজার চুক্তিপত্র, নাটক, নভেল, তা¤্রলিপি, ইতিহাস, দলিল দস্তাবেজ, বিভিন্ন ভাষায় লিখিত নানান গ্রন্থ রয়েছে। আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরীর গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, বাগদাদের তৎকালীন লেখক হারুন-আল-রশিদের হস্তলিখিত বিশালাকৃতির কোরআন শরীফ আছে।

আরো একটু হেটে যেতেই ডান পাশেই দরবার হল। বর্তুলাকার ও খিলানের ছাদে আচ্ছিদ দ্বিতীয়তলার বিশালাকৃতির দরবার হলটি গোলাকৃতি-চারদিকে চারটি দরজা রয়েছে। দরবার কক্ষের গামলার মতো বৃহৎ ছাদটি ৭৮ফুট উচু। যা আমাবস্যার রাত ছাড়া সবসময় আলোকিত থাকবে প্রাকৃতিক ভাবে। ফেরাদুনজাকে প্রদত্ত ভিক্টোরিয়ান কাঁচের ১০১ টি বাতি সম্বলিত বিশালাকৃতির ঝাড়বাতি। ফেরাদুনজার ১০১ জন পুত্র থাকায় ১০১ টি বাতি জ্বলে। ওই কক্ষে রক্ষিত নবাব নাজিম হুমায়ুন জার সিংহাসনটি সোনা ও রূপার তৈরি।

হাজারদুয়ারী প্যালেসের ঠিক সামনে চারকোনাকৃতির সাদা রং-এর যে ঘরটি আছে সিটি মদিনা। এ ঘরে মূল্যবান রত্ন সামগ্রী রক্ষিত থাকতো। নবাব সিরাজ-উ-দৌলা নিজে এই মদিনার জন্য কারবালা হতে পবিত্র মাটি মাথায় করে বয়ে এনেছিলেন। কথিত আছে, সিরাজের মা আমিনা বেগম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তার পুত্র নবাব হলে মদিনার পবিত্র মাটি এনে বহু মূল্যবান রত্ন সামগ্রী দ্বারা দরজা প্রস্তুত করবেন।

শোনা যায়, মীর কাশিম নবাব হলে, তিনি মুঙ্গেরে রাজধানী স্থানান্তরিত করার সময় ওই মদিনার সব ধনরত্ন মুঙ্গেরে নিয়ে যান। মহরমের সময় ছাড়া মদীনার দরজা সারা বছর বন্ধ থাকে। তাই আর দেখা হলো না। মদিনার পাশে আছে ঘড়ি ঘর। একটি উঁচু টাওয়ারের চারদিকে বড় একটি ঘড়ি আছে।

ইমামবাড়া

হাজারদুয়ারী প্যালেসের ঠিক বিপরীতে বিশাল দ্বিতল ভবনটির নাম ইমামবাড়া। এর দৈর্ঘ্যে হাজারদুয়ারীর চেয়েও বেশি। প্রতিবছর মহরম উপলক্ষ্যে মহরম মাসের প্রথম দশদিন ইমামবাড়ায় জাকজমক মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন মহরমপর্বে যোগ দেন ও হাসান-হোসেনের জন্য শোকাতুর হয়ে মাতম করতে থাকেন। মহরমের ওই সময় ছাড়া এটি বছরের বাকী সময় বন্ধ থাকে। তাই এটিও দেখা হলো না।

শেষ! প্রাসাদ দেখা। এবার প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেছি। পাশেই ভাগীরথী নদী। প্রাসাদের একটা মসজিদ একেবারে ভাগীরথীর সাথে লাগোয়া। নদীর পাড়েই আছে হস্তশিল্পের দোকানগুলো।

ভাগীরথী নদী

সেখান থেকে নৌকায় মতিঝিল আর খোশবাগ যাওয়া যায়। খোশবাগে আছে নবাবদের কবরস্থান। সময় কম থাকায় ওদিকে ‍যাওয়া হয়নি। টুকটুকি ধরে মতিঝিল। এটা নতুন করে করা হয়েছে। ১৫ টাকা টিকেট। তৎকালীন সময়ে ঐ ঝিল হতে প্রচুর পরিমাণে মতি বা মুক্তা সংগৃহীত হতো বলে এ ঝিলের নামকরণ করা হয় মতিঝিল। এটি অশ্ব-খুরাকৃতির হৃদ। এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে ছিল। তখন কেম্পানিবাগ নামেও পরিচিত ছিল।

মতিঝিল পার্কের প্রবেশপথ

মূলত নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে অট্টালিকা তৈরি করার জন্য ইটের প্রয়োজনে যে সমস্ত খাদ কাটা হয়েছিল সেগুলোই মতিঝিলে পরিণত হয়। মতিঝিল পার্ক নবাব মুর্শিদকুলি খান তৈরি করেছিলেন। এটাও কথিত আছে, মুক্তা চাষের মতিঝিলে লেক খনন করে ঘষেটি বেগম ও তার স্বামী। লেকের মাঝখানে ছিল তাদের প্রাসাদ। মতিঝিল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলীবর্দী খাঁর জামাতা নৌজেস মহম্মদ ঝিলের তীরে বা স্ত্রী ঘসেটি বেগমের বসবাসের জন্য 'সঙ্গ-ই-দালান' নামে পাথরের প্রাসাদ তৈরি করেন।

এখানেই এক সময় ছিল ঘষেটি বেগমের প্রাসাদ

১৭৫৮ সালে মীরজাফর বড়দুয়ারী নামে এখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিল যেখানে ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ কয়েকদিন বাস করেছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসও এই প্রাসাদে থাকতেন।
এখন কোন প্রাসাদ আর নেই।

সেখানে দরজা-জানালা বিহীন একটি বদ্ধ ঘর বা প্রকোষ্ঠ ছিল। কথিত আছে, ওই ঘরে ঘসেটি বেগমের ধনভান্ডার ছিল, আবার অনেকে মনে করেন- সিরাজ যখন মতিঝিল থেকে ঘসেটি বেগমকে তার প্রাসাদে নিয়ে যান তখন ঘসেটির সহচরীদের ওখানে কবর দিয়ে চতুর্দিকে প্রাচীরদ্বার-ছাদ দ্বারা বন্ধ করে দেয়া হয়। জেলা গেজেটে উদ্ধৃতি অনুযায়ী, একজন ইংরেজ উৎসুকবশত কয়েকজন মজুর নিয়ে ওই প্রকোষ্টটি ভাঙতে আরম্ভ করলে কয়েকজন মজুর রক্তবমি করে মারা যায়। কিছুদিন পর ওই ইংরেজও আত্মহত্যা করে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ওই প্রকোষ্টের ভগ্নাংশ এখনো পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে মতিঝিলে স্থানীয়রা মাছ শিকার করে থাকে।কয়েকটি নৌকা ও দেখলাম। শেষের দিকে নতুন ঘাট বাধানো হয়েছে। জলাশয়ের ওপারে পাড় বাধানোর কাজ চলছে।

এখানে প্রচুর লোক বেড়াতে আসে। বাচ্চাদের জন্যে খেলাধুলার আলাদা জায়গা আছে। সময় কম থাকায় যে স্থানগুলো দেখা হয়নি ইমামবারা (বন্ধ ছিল), নৌসেরি বানুর সমাধি মসজিদ, চক মসজিদ, আস্তাবল, ত্রিপোলিয়া গেট, ওয়াসেফ মঞ্জিল বা নিউ প্যালেস, বাচ্চাওয়ালী তোপ, তোপখানা, আজিমুন্নেসার সমাধি, জাফরাগঞ্জ মোকবারা,, নশিপুর আখরা, ফুটি মসজিদ, নেমিনাথের মন্দির, সরফরাজ খাঁর সমাধি, নবাব সিরাজ-উ-দৌলার সমাধিক্ষেত্র 'খোসবাগ', , সুজাউদ্দিনের বাগান বাড়ি, ফার্হাবাগ, নদীগর্ভে বিলীন সিরাজের প্রাসাদ হীরাঝিল, কদম শরীফ, হুমায়ুন মঞ্জিল, রাধামাধব মন্দির, জগদ্বন্ধু ধামা ডাহাপারা, কিরীটেশ্বরী মাতার মন্দির, রাণী ভবানী মন্দির, ভট্টবাটির শিব মন্দির, বঙ্গাধীকারি ভিটা, মোহনলালের ভিটা, উমিচাঁদের মন্দির, আর্মেনিয়ান গীর্জা, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, ইংরেজদের সমাধি, ডাস সমাধি, মীরমদনের সমাধি, কুঞ্জঘাটা মহারাজ নন্দকুমারের বাড়ি, পলাশী মনুমেন্ট।

বাহ! বিশাল কিছু মিস করে ফেললাম তো।

সেই পুরোনো জৌলুশ নেই। একটা সময় বাংলার (বর্তমানে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ) সমস্ত বিষয় এই শহরে থেকে পরিচালিত হত এটা কেউ বিশ্বাসই করবে না। পুরাটাই অজপাড়াগাঁ হয়ে গেছে। নবাবের ক্ষমতা না থাকলে জায়গাটাও সাধারণ হয়ে পড়ে। তবে মুর্শিদাবাদের আম, রেশমের সিল্ক কাপড়, কাঁসার বাসন, হাতির দাতের বিভিন্ন কাজ ও ছানাবড়া মিষ্টি এখনো বেশ প্রসিদ্ধ।

কীভাবে আসবেন? পাসপোর্ট তো আগেই করা চাই। কিভাবে করবেন পাসপোর্ট ও ভিসা তার বিস্তারিত দুই লিংকে।

এবার বেনাপোল থেকে যেতে চাইলে প্রথমে বনগাও যেতে হবে টেম্পুতে। বনগাও থেকে বাসে দত্তপুলিয়া এবং দত্তপুলিয়া থেকে বাসে কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর থেকে ট্রেনে বা বাসে পলাশী যেতে পারবেন অথবা ট্রেনে বহরমপুর (মুর্শিদাবাদ) পারবেন। বাহারামপুরে থাকা মত অনেক হোটেল ও লজ আছে। বাহারামপুর থেকে টেম্পুতে যেতে পারেন লালবাগ, ১২ রুপি ভাড়া। লালবাগ থেকে হেঁটেও যেতে পারেন। নয়তো কলকাতা রেলওয়ে স্টেশন থেকে হাজারদুয়ারী এক্সপ্রেসে এসে নামবেন মুর্শিদাবাদ।