বছরজুড়ে কলকাতার দিনগুলি

রবি হোসাইন
Published : 21 April 2017, 06:52 AM
Updated : 21 April 2017, 06:52 AM

অামিও ভাবতাম কলকাতা অাসতে লাখ টাকা লাগে। তা না লাগুক অত দূরের কলকাতায় অাসব ভাবা যেত না। বাঙালির বিদেশযাত্রা অামার কাছে সবসময় কঠিন কিছু ছিল। বিভাগপূর্ব বাংলার অনেক ইতিহাসের জন্ম কলকাতায় তাই একটা দুর্বলতা ছিলই অাগে থেকে।

অারেকটা ব্যাপার ছিল যে কলকাতা বাংলার রাজধানী ছিল এবং অামার বাংলার চেয়ে সব দিক থেকে এগিয়ে ছিল তারা এখন কতটা এগিয়ে এসব কাছ থেকে দেখা। জয়নাল ভাইয়া থেকে জানলাম অত খরচ হয় না অাসতে।এরপর এসেই পড়লাম কলকাতায়।

জয়নাল ভাইয়ার সাথে বালিগঞ্জ, কলকাতা

যদি কলকাতা অাসাটা খুব জরুরী না হয় তাহলে কাল গিয়ে বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে দিন।এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে পাসপোর্ট পাবেন খরচ পড়বে তিন থেকে সবোর্চ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। পাসপোর্ট কিভাবে করবেন?

তো পেয়ে গেলেন পাসপোর্ট এবার ভিসা। যেহেতু বেড়াতেই অাসবেন তাই ট্যুরিস্ট ভিসা লাগবে। ট্যুরিস্ট ভিসার জন্যে অনলাইনে অাবেদন করতে হয়। নিজে অাবেদন করলে কখনোই ই-টোকেন পাবেন না। অ্যাম্বাসির সামনে গেলেই দালাল পেয়ে যাবেন তাদের তিন থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা দিলে অানুৃামানিক ২০ দিনের মধ্যে ভিসার কাজ ও শেষ হবে। কিভাবে ভিসা করবেন?

এবার যাবার পালা। অামি যেটা করেছি ভিসা পাবার রাতেই ঢাকা চলে অাসি। এরপর বাসের টিকেট করার পালা। কমলাপুর ট্রেন স্টেশনের পাশেই অাছে বিঅারটিসি শ্যামলী ঢাকা টু কলকাতা বাস সার্ভিস। এসি বাস খরচ পড়বে ১৭০০ টাকা অার যাবার একদিন অাগে টিকেট করা ভাল।

এরপর এসির বাতাস সহ্য করতে না পেরে গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুম। মধ্যরাতে ঘুম ভাঙার পর নিজেকে অাবিষ্কার করলাম পদ্মার মাঝে। বাস থেকে ফেরীর কিনারায় গিয়ে দাড়ালাম। পদ্মা এই রাতেও ঘুমায়নি সে শব্দ করে বয়ে চলেছে।মধ্যরাতে পদ্মার বুকে ফেরীতে জীবন ব্যাস্ত হয়ে উঠে। ওই বহমান পদ্মার দিকে তাকালে মনে হয় জীবন অনেক বেশি সুন্দর অার এই পদ্মার ধারেই কাটিয়ে দেয়া যাবে রাতের পর রাত।

দৌলতদিয়া ফেরীঘাট

পদ্মা পেরোতেই চোখে অাবার ঘুম।ঘুম ভাঙলো একদম বেনোপোল বর্ডারে এসে।

যে কোন কাউন্টারে পাসপোর্ট জমা দিলে হয়

কাস্টমস পার করলেই ভারত

বাস কাউন্টার থেকে ওরকম স্টিকার লাগিয়ে দিবে

বাস থেকে নেমে এ পাড়ের কাউন্টারে বসতে হলো এক ঘণ্টা।৬০০ টাকার সাথে পাসপোর্ট বাস কতৃপক্ষ নিয়ে যাবে। অার কাজ শেষ হলে বাংলাদেশী ইমিগ্রেশনে পাঠাবে।

বাংলাদেশ কে বিদায়

না মানুষি জমিনে অপেক্ষা

ওপাড়টা বাংলাদেশ এপাড়টা ভারত

ভারতে ঢুকে পরলেই যেতে হবে  ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে। পাসপোর্ট দিলে অাপনার ছবি তুলে একটা সীল দিবে। ব্যাস হয়ে গেলো। এখানে কোন প্রশ্ন করেনা বা টাকা লাগেনা। যাবার সময় ভারতীয় ইমিগ্রেশনে আপনার ব্যাগ চেক করতে পারে তবে সেটা অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার মতোই। আমার দুটো ব্যাগে সেমাই, জেল, বডি স্প্রে , বই আর কাপর চোপড় আছে বললাম ব্যাগ ধরেই দেখেনি। জানতে চাইল ভারতীয় টাকা কত আছে। মানিব্যগ থেকে বাংলাদেশের ১৫০ টাকা দেখালাম। ব্যস এই হলো চেকিং।

বাসে উঠতেই বাংলাদেশীরা যেটা খেয়াল করেন বাস খুবই নিন্মমানের বাংলাদেশী বাসের তুলনায়। তো গতবার এক ভারতীয় বান্ধবী বলছিল, ইশ বাংলাদেশের বাস কি সুন্দর। পাশ থেকে ওর দাদা বলল, ওদের বাস সব তো বিদেশ থেকে আনা তাই সুন্দর। আমাদের তো নিজেদের বাস। বুঝেন তাহলে অবস্থা। আমরা অন্যের পণ্য কিনে সেটার গুণকীর্তন গেয়ে নিজের অক্ষমতার লজ্জা ঢাকতে অন্যকে ছোট করতে ভালবাসি।

ভারতের বাস ধরে কলকাতা
এখান থেকে অটো ধরে কলকাতা

পকেটে টাকা থাকলে রুপি করে নিতে পারেন সেখানেই। অামার কাছে ৯৯ টাকা ছিল সেটার বদলে ৮৩/৮৪ রুপি দিল। যদি অাপনার বাংলাদেশী সিমে টাকা থাকে সেটা বেনোপোল থেকে ভিতরে দুই কিলোমিটর পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারেন। এখান থেকে সিম না কেনায় ভাল কারণ দাম বেশি নেয়।

এবার বাসে চব্বিশ পরগণা হয়ে শুরু। তবে এখান থেকে অটো ধরে বনগাঁও স্টেশন থেকে শিয়ালদহের ট্রেন ধরেও কলকাতা যাওয়া যায়। সময় ও কম লাগে আর খরচ ও।

যেটা ভাবতাম এদিকে কাঁচা ঘর নেই অথবা কিছুই বাংলাদেশের মত হবে না। চব্বিশ পরগণা চিটাগং এর পটিয়া হয়ে যে রাস্তাটা কক্সবাজারের দিকে গেছে সেটার মতোই। সরকারী অফিসের সাইনবোর্ডে কঠিন বাংলা দেখে পার্থক্য করা যায়। অার এটা মূ্লত সাইকেলের শহর। মেয়ে থেকে ছেলে বুড়ো সকলের কাছে সাইকেল বেশ জনপ্রিয়। রাস্তার দু ধারে বহু বছরের পুরোনো গাছ হেলে পড়েছে নিজেদের উপর।

এ পথ ধরে যেতে অাসতে অাসতে গাছের সারি কমতে থাক। বারাসাত পর্যন্ত এলাকাটা বাংলাদেশের মতোই।বারাসাত থেকে বেশিরভাগ দোকানের নামই ইংরেজীতে লেখা। এককালে ধারণা ছিল অামরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি বললেও অামরা সেটাকে ধারণ করিনা যা টিকে অাছে পশ্চিমবঙ্গে সেটাও দেখি ষোলঅানা মিথ্যে। পশ্চিমবঙ্গে ভোট ছিল। অামাদের নির্বাচন মানেই পোস্টারে অার কিছু দেখা যাবেনা। এখানে পোস্টার নেই অাছে সাইনর্বোড। অামাদের নেতারা নিজে পোস্টার ছাপিয়ে নিজেই লিখে প্রচারে সর্বস্তরের জনগণ। এদিকে অবশ্য তারা নিজ দলের নামই লিখে।

এরপর বাস চলে অাসলো নিউমার্কেট। প্রথম দেখাতেই মনে হলো কলকাতা পুরোনো বিল্ডিং এর শহর।ব্রিটিশ অামলের অনেক বিল্ডিং দাড়িয়ে অাছে এখনো।ভূমিকম্প ঝুঁকি থাকার পর ও এসব বিল্ডিং এ মানুষ থাকে গরম কম লাগার কারণে। কলকাতার কাছে যত অাসা হয় তত মেয়েদের বুকের কাপর কমতে থাকে।প্রথমে ভাবলাম কলকাতায় গরম বেশি তাই ওরা ওড়না পরে না। কিন্তু পরে জানা গেলো এখানকার হিন্দু মেয়েরা ওড়না না পরতেই অভ্যস্ত। ওরা একা ফুটপাতে দাড়িয়ে খেতেও অভ্যাস্ত। অার এদিকে মায়েরা বাচ্চদের নিজে বাইক চালিয়ে স্কুলে দিয়ে অাসে।

একটা শহর বলতে যেভাবে হাঁকডাক থাকে ভীড় থাকে নিউমার্কেট এলাকায় সেটা নেই। অামি এতটাই অবাক এটা অাসলে শহর কিনা সন্দিহান হয়ে পড়লাম।অামদের ঢাকা অার চিটাগং নিউমার্কেট ঘিরে যে ব্যস্ততা থাকে এখানে তা নেই। হয়ত গরমের কারণেই। এখানে ব্যক্তিগত গাড়ি খুব বেশি দেখিনি। রাস্তায় গাড়ীর অত চাপ নেই তাই জ্যাম ও নেই। ঢাকার মতোই ফুটপাত দেখে বুঝলাম বরাবরের মত বাঙালিরা একই হয়। অার ওপারের মত এ পারেও বাবাদের বেশ কদর।হরেক রকমের জ্যোতিষীর সাইনবোর্ড।

নিউমার্কেট থেলে ট্রামে চড়ে অাাসলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। এই ট্রাম চলে খুব ধীরে।এটাও রেখে দেয়া হয়েছে উপনিবেশিক অামলের ঐতিহ্য হিসেবে। ট্রাম দেখতে ট্রেনের বগির মতো। দুটো অংশ জোড়া লাগানো থাকে।কলকাতার যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ট্রেন।

ট্রাম

শিয়ালদহ হলো পশ্চিমবঙ্গের প্রধান স্টেশন।শিয়ালদহ স্টেশনের বাথরুম দেখে অামাদের ঢাকা অার চিটাগং স্টেশনের বাথরুমের কথা মনে পড়ল।চিটাগং স্টেশনে বাথরুম সুবিধে সীমিত অার অধিকাংশ সময় সেটা তালাবদ্ধ থাকে। অার শিয়ালদহে বাথরুম একদম চোখের সামনেই।তারপর ও অামরা অামাদের অপ্রতুল সুবিধার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে ভারতকে খোলা টয়লেটের দেশ বলে অাত্মতৃপ্তি পাই।

শিয়ালদহ স্টেশন
শিয়ালদহে খাবারের দোকান

শিয়ালদহ থেকে কল্যাণীর টিকেট করলাম ১৫ রুপিতে। ট্রেনে উঠার অাগে টিকেটের লাইন দেখে ভেবেছি টিকেট ছাড়া গেলে টিটি চেক করে বোধোহয়। কিন্তু না টিটির ভয় ছাড়াই এ পারের বাঙালীরা টিকেট করে সেটা বুঝলাম ট্রেনে উঠে। এত ভীড়ে নিঃশ্বাস নেয়াই কঠিন। অানন্দবাজার পত্রিকা নিয়ে কোথাও অান্তর্জাতিক খবর খুঁজে পেলাম না। পশ্চিমবঙ্গে ভোট ছাড়া এ জগত সংসারে যেন অার কিছুই ছিল না। ট্রেনে উঠার একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলাম।

রাস্তার দু ধারে অাবারো বাংলাদেশ। খোলা মাঠ,ধানক্ষেত থেকে সব। প্রকৃতির বিচারে ওই বাংলা এই বাংলার পার্থক্য নেই বললেই চলে। কত মোটা মাথা হলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করে। অামার কাছে দেশের সীমান্ত ততটাই যতটা অামার দেশের মত সবুজের মাঠ অাছে। দুই বাংলা অালাদা এটা কি করে ৪৭ এর বাঙালিরা মেনে নিয়েছিল জানিনা। কল্পনার জগত অামি দুটোকে একসাথেই দেখি।

ট্রেন থেকে কল্যাণী নেমে অাবার অবাক।কল্যাণী নদীয়া জেলার একটি পৌরসভা। এই এলাকাটা থাকার জন্যে যে কারো পছন্দ হবে।চারদিকে গাছ অার গাছ।এই এলাকাটা তৈরি করা হয়েছে থাকার জন্যেই।একটা বাড়ি থেকে অারেকটা বাড়ি দূরে।সবুজের পথ এদিকে ওদিকে চলে গেছে।

ছিমছাম গোছালো কল্যানী। যাদের কোলাহল ভাল লাগে না বা হাপিঁয়ে গেছেন ঘুরে আসতে পারেন। শহর গ্রাম দুটোর ফ্লেভার পাওয়া যাবে।

রাস্তার পাশেই তরকারী বিক্রেতা বসে বাজার এলাকায়। অার সব দোকান ও থাকার এলাকা থেকে বাইরে।পরিচ্ছন্ন একটি শহর। এদিকের বাঙালিরা অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। যেখানো যেটা থাকার কথা সেটা সেখানেই অাছে। এলাকাটা ঠিক না শহর না গ্রাম। যারা এপার বাংলায় চলে অাসতে চায় তাদের জন্যে এলাকাটা বেশ দারুণ হবে।

কল্যাণীতে ছিলাম দেড় মাসের মত । দারুণ একটি এলাকা। শুধু থাকার জন্যে খুব পছন্দের একটি জায়গা।

কোন রিকাশা নেই বা গাড়ির ব্যস্ততা নেই। সাইকেল, বাইক, অটো আর ব্যক্তিগত গাড়ি তাও অত বেশি না । অনেক রাতে ও মেয়েরা সাইকেলে ফিরছে। কোথাও আতঙ্ক নেই। যে যার মত দিন কাটায়।

শুধু সাইকেল চালানোর জন্যে তাও রাত ১২ টার দিকে সাইকেল চালিয়ে ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখার জন্যে কল্যাণীতে যেতে চাই বহুবার।

রুজভল্ট নগরের হলুদ পথ

ভোর হবার অাগেই পাখিদের ঘুম ভাঙে।যে বাড়ীতে ছিলাম এটাকে বাগান বাড়ী বলা চলে।ঘরের চার পাশ অামগাছে ঘেরা।একটা ফুলের গন্ধ অাসছে জানালা দিয়ে।এ বাড়িতে একা থাকলে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে নাকে ফুলের গন্ধ অাসলে গা ছমছম করা অনুভূতি হবে।

কল্যাণীর অধিকাংশ বাড়ীই এমন।অাগে বাড়ী করা হয়েছে।এরপর পরিকল্পনা মতো গাছ লাগানো হয়েছে।ওই বাংলায় এত বিশাল প্রকৃতি ঘেরা শহর চোখে পড়েনা।যদিও এটা নদীয়া জেলার প্রধান প্রশাসনিক শহর।বাংলাদেশে প্রশাসনিক শহর মানেই ইট পাথরের দালান নয়তো ঢাকায় অনেক নদী না থাকার পর ও ঢাকাতে নদী মন্ত্রাণালয় বানিয়ে রাখা।

এই বাড়ির মালিক একটি হিন্দু পরিবার।পুরো কল্যাণীতে কোন মসজিদ নেই।তার মানে, যে মুসলিমরা অাছে তারা একটা কারণে এখানে থাকে।বাড়ীর হিন্দু পরিবার অার মুসলিম ভাড়াটিয়ায়া একি বাড়িতে থাকছে অার খাবার জল ও একই।কোথাও পার্থক্য করার সুযোগ নেই।

 

গতকাল দেখলাম গভীর রাত অবধি ছেলে পড়ছে মা বাবা পাশে বসে অাছে। অার তার অাগে ছেলে খাতা লাগবে বলাতে বাবা রাতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।দেখে মনে হলো এদিকটায় পড়ালেখা নিয়ে সিরিয়াস। মেয়েরা রাতে পড়ে একাই বাইকে বা সাইকেলে বাসায় ফেরে।রিকশা একদমই নেই। কাজের দিদিও অাসে সাইকেলে।অদ্ভুত সুন্দর একটা ব্যাপার।

দেশে যা দেখেছি যোগাযোগটাকে একদম গুরুত্ব দেয়া হয়না। রিকশার জ্যাম ও তৈরি হয়। এখানে সময়ের মূল্য অাছে। পরিকল্পিত নগরায়নের সুফল বেশ চমৎকার। ওই এক ঢাকা শহরে সাইকেল লেইন করে দিলেই ঢাকা বাস অযোগ্য হওয়ার থেকে বেচেঁ যেত।

এখানে বাইরেরর জেলা থেকে ছেলে মেয়েরা অাসার অন্যতম কারণ পড়ালেখা। কল্যাণী পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। এভাবেও বলা যায় শিক্ষার জন্যেই শহরটি তৈরি করা। এখানে অাছে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে কল্যাণী কলকাতা থেকে ৫০ কি.মি দূরে। ওদের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মত গর্বের শাটল নেই। কলকাতা থেকে ১৫ রুপিতে দ্রুত গতির ইলেকট্রিক ট্রেনে কল্যাণী এসে অাবার ফিরে যাওয়া যায়।
অার সারদিন ট্রেন থাকেই তাই ট্রেন মিস করা বলতে কোন ব্যাপার নেই।

এখানে কেউ ছাদে উঠেনা বা ঝুলে যায়না। তাই চবি শাটলে যেভাবে ছাত্ররা প্রাণ বা পা হারায় এসব এখানে নেই। যেটা মনে হলো ধীর গতির শাটল যেভাবে রিফিউজির মত করে ছাত্র বোঝাই করে অার প্রাণ নেয় সেটার চেয়ে নিরাপদ এবং দ্রুগগতির ট্রেন বেশি দরকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা ছিল আমেরিকান বিমান ঘাঁটি। কিছু স্থাপনা কল্যাণী স্টেশন এবং ঘোষপাড়া এলাকায় অাছে। তখন এলাকার নাম ছিল রুজভেল্ট নগর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত আর্মি হসপিটাল কল্যাণীর প্রাচীনতম হাসপাতাল। গান্ধী মেমোরিয়াল হ্দরোগের চিকিৎসার জন্য বিখ্যাত।  সব মিলিয়ে কল্যাণী শিক্ষা অার চিকিৎসার জন্যে বিখ্যাত।

ভারতীয় ভাইয়া অনিকের সাথে কল্যাণীতে কেটেছে দেড় মাস

কল্যাণী থেকে একটু পশ্চিমে গেলেই গঙ্গা। শান্তা গঙ্গা।

গঙ্গায় শৈশব

গঙ্গা কল্যাণী থেকে আরেকটু দক্ষিণে এসে হয়ে গেছে হুগলী নদী।

হুগলী নদী

এ পাড়ে নদীয়া ও পাড়ে হুগলী জেলা

অামি কল্যাণীতে ছিলাম মাস দেড়েকের বেশি। এটা কলকাতা থেকে ৫০ কি.মি দূরে। এখানে মেডিকেল কলেজ অাছে সাথে স্টেডিয়াম অার দুটো বিশ্ববিদ্যালয়। এদিকের মানুষের খুব একটা কলকাতা যেতে হয় না। কারণ অামরা যেভাবে রাজধানীতে সব কেন্দীভূত করি বা উন্নয়নের জোয়ারে রাজধানীকে বাস অযোগ্য করি এখানে সেটা না করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় অথবা উন্নয়ন করা হয় সবখানেই।

অাবার যদি যেতে হয় বা যাদের কর্মক্ষেত্র দূরে তাদের কথা বলি। ডাক্তার দেখাতে কল্যাণী থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে দেখি প্রত্যেকদিন হাজার হাজার মানুষ কলকাতায় যাচ্ছে কাজের উদ্দ্যেশ্যে এবং ফিরছে। কারো কলেজ কলকাতা হলে সে ৫০ কি ৬০ কি.মি দূরের এলাকা থেকে এসে পড়ালেখা করতে পারে। দুটো কারণে এটা সম্ভব তার একটা দ্রুত এবং নিরাপদ যোগাযোগ অন্যটা কম খরচ।

একই অবস্থা নৈহাটি, বারাসাত, হুগলীর ব্যাণ্ডেল-চুঁচুড়া, শান্তিপুর, চাকদা, রাণাঘাট, ব্যারাকপুর, ইছাপুর স্টেশনে। এসব দেখে নিজের শহরের কথা মনে পড়ল। অামার সীতাকুন্ড থেকে বা পাশের মীরসরাই থেকে চিটাগং যাওয়া অাসার চেয়ে অামরা শহরে থেকে যেতে বেশি অাগ্রহী।অাবার মাণিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চাঁদপুর জেলার মানুষজনও ঢাকায় বাড়ি করে, জমি কেনেন! অথচ পশ্চিমবঙ্গের মত যোগাযোগ ব্যবস্থাটা উন্নত হলে তা হলে ঢাকার উপর এমন চাপ পড়তো না। ঢাকার জমির দামও আকাশচুম্বি হতো না।

ট্রেন আসার অপেক্ষা

কলকাতার পাবলিক বাসে দম বন্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয় না। অাসলে কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা অনেক ভাল। রাস্তায় প্রচুর টেক্সিক্যাব, বাস এবং বেবীটেক্সী চলে।কলকাতাকে ফাঁকা লাগার সবচেয়ে বড় কারণ মেট্রোরেল ১৯৮৫ সালে মেট্রো চালু হয় কলকাতায়। দমদম থেকে ট্রেন মাটির নীচে।কলকাতা শহরে দ্রুত যাতায়াতের জন্যেই মেট্রো। টিকিট করবেন এরপর কার্ড প্রেস করে প্লার্টফর্মে ঢোকা অার বের হওয়া।ফলে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণের সুযোগ নেই। সাধারণত মেট্রো রেলে ধনীরা চড়ে যাতে তাদের প্রাইভেট কারের চাপ রাস্তায় না পড়ে অার খুব দ্রুত পৌছানো যায়। তবে এখানে দেখলাম মেট্রোরেলে সবাই যাতায়াত করছে। এই মেট্রোরেল ও কলকাতার বিশেষ পর্যটন অাকর্ষণ।

ঢাকাতেও মেট্রোরেল অাাসছে ২০১৯ সালে। এতদিন ধারণা ছিল অামাদের রাজনীতিবিদেরা বিদেশে গেলে কিছু শেখেন না।কলকাতা যেটা ১৯৮৫ সালে করেছে অামরা সেটা করছি ৪৪ বছর পরে। এই ব্যবধান কি থেকেই যাবে? ঢাকা মেট্রো রেল উত্তরা আর দক্ষিণ ঢাকাকে যুক্ত করবে। মানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলবে। (যদিও প্রশ্ন অাসে ঢাকা কি উত্তরা থেকে মতিঝিল?) এই পথে ১৬টি স্টেশন বা প্ল্যাটফরম থাকবে। মেট্রো ট্রেনটি ঢাকা উত্তরা থেকে শুরু হয়ে মিরপুর, ফার্মগেট হয়ে মতিঝিল যাবে। মোট ৫৬টি মেট্রো ট্রেন ১৮ টা স্টেশনে থামবে, প্রতি ৪ মিনিট পর পর আসবে এবং প্রতিটি মেট্রো
১৮০০ যাত্রী বহন করতে পারবে। সুতরাং, ১ ঘন্টায় মোট ৬০০০০ যাত্রী।

ভারতীয় উপহাদেশে ট্রাম এখনো টিকে অাছে কলকাতায়। ট্রেনের মতোই চলার জন্যে নিজস্ব পথ অাছে। ট্রেনের তুলনায় ট্রাম অনেক হালকা ও ছিমছাম। রাস্তার মাঝখানে কখনো পাশে খুব ধীরে চলে ট্রাম।চলার জন্য রাস্তার পাশে যে লাইন বসাতে হয় সেখান দিয়েই অন্যান্য যানবাহন অবলীলায় যাতায়াত করতে পারে। তার মানে ট্রাম এক চিলতেও বাড়তি জায়গা দখল না করেই প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষকে সার্ভিস দিতে পারে।এই ধীরে চলা ট্রামে জীবনানন্দ দাশ কিভাবে মারা গেল বুঝলাম না। ওটা কি দুর্ঘটনা ছিল না অাত্মহত্যা সন্দেহ থেকে যায়।

ঢাকায় দুটো কারণে ট্রাম থাকলে ভাল হতো। বিশেষ করে পল্টন থেকে বামে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। একটু পর পর ট্রাম রাস্তার পাশ দিয়ে চললে রাস্তা দখলের কোন সুযোগ থাকত না।অার অন্য কারণ হলো রিকশার জ্যামকে জাদুঘরে পাঠানো। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে ঢাকার ধানমন্ডি, গুলশান, মিরপুর এবং উত্তরাতে এই ট্রাম সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। যেমন, সায়েন্স ল্যাব থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত ধানমন্ডি জোন। প্রতিটা ট্রাম ৫০০ থেকে ১০০০ জন যাত্রী নিতে পারে (ট্রাম সাইজের উপর নির্ভর করে) এবং প্রতি ১০ মিনিট পর পর ট্রাম থাকলে এই জোনে কোন রিক্সার প্রয়োজন হয় না। মেট্রোর সাথে সাথে এই সার্ভিস চালু হলে ঢাকা শহরের জ্যাম প্রায় অর্ধেক নেমে আসবে।
যাত্রীরা কম সময়ে এবং কম খরচে যাতায়াত করতে পারবে। কারণ, ট্রামের রাস্তায় জ্যাম থাকেনা এবং সময়ও নির্দিষ্ট।

কলকাতার ঐতিহ্য হিসেবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে হাতে টানা রিকশা তাও গুটিকয়েক। তবে ট্রাম অার রিকশায় দরকারের চেয়ে মজা করতেই মানুষ উঠে।কারণ কম গতি।

হাতে টানা রিকশা

কদিন পরে গেছি আবার কলকাতা। নিউ মার্কেটের চারপাশে ঘুরলেই বোঝা যায় কেন কলকাতাকে 'সিটি অফ জয়' মানে আনন্দনগরী বলা হয়। নানান দেশের মানুষ বিকেল হতেই ভীড় করে এই এলাকায়।

ফাকাঁ কলকাতা

নিউ মার্কেটের আশেপাশে একেকটা গলির নাম আলাদা। তবে বেশিরভাগ স্ট্রিট আর কোনটা স্মরণী। আমি ছিলাম কলিন স্ট্রিটে এর সামনে মির্জা গালিব স্ট্রিট আরেকটু সামনে গেলে মার্কুইস স্ট্রিট। সবই ব্রিটিশদের দেয়া নাম।বাংলাদেশেও ওয়ারীতে কিছু স্ট্রিট আছে। তবে বাংলাদেশে অনেক জায়গার নামই নেতার নামে বদলে গেছে। মার্কুইস স্ট্রিট এর চারপাশটা বাংলাদেশী পাড়া।এখানে হাজী সাহবের দাওয়াত এ মোটামুটি ভাল খাবার পাওয়া যায়।দেশ থেকে কেউ আসলে এদিকটায় থাকে কারণ অল্প টাকায় ভাল হোটেল আছে।

মার্কুইস স্ট্রিট এর চারপাশটাকে মুসলমান পাড়া বলা চলে। একটু এদিক ওদিক হাটলেই দেখবেন গরু জবাই হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ স্থানীয় মুসলিমই হিন্দী বলে। কলকাতার বেশিরভাগ মুসলিমের ভাষা হিন্দী। কলকাতা যাওয়ার পর থেকেই দেশের খাবারকেই শুধু মিস করছি। কলকাতায় রাস্তার পাশেই দেশের চেয়ে অনেক কম দামে ফরমালিন ছাড়া সব ফল পাওয়া যায়। ফল খেয়ে থাকার আইডিয়া Joinal ভাইয়ার।

ঈদের বাজার অথবা এমনিতেই শপিং সবই কলকাতা থেকে করতে পারেন।দেশের চেয়ে অনেক কম দামে ভাল জিনিস পাবেন।নিশ্চিত খরচ পুষিয়ে যাবে।

ঈদের সময়ের কথা। যশোহর রোডের গুমেতে যেতেই শুনলাম মসজিদের মাইকে উচ্চস্বরে গজল চলছির। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে গরুর মাংস ঝুলিয়ে রাখা। আর বাচ্চাদের ছুটোছুটি। এসব আর কলকাতায় চোখে পড়ে নি।  ছুটির দিনে কলকাতার ট্রেন গুলোতে ভীড় ছিল আর মুসলমানপাড়া ছাড়া ঈদের আমেজ কোথাও নেই। বারাসাত হয়ে সামনে যেতেই কোথাও কোথাও মুসলিমদের একত্র হয়ে স্টেজে নাচানাচি করতেও দেখা গেলো। সব বয়সী ছেলে বা পুরুষ প্রায় সবার জামা পাজামা পাঞ্জাবী। তবে আমাদের দেশের তরুণীদের মত উগ্র সাজে নতুন জামায় কাউকে দেখিনি। ব্যাপারটা পুরনো। এ পাড়ের মুসলিমদের ধর্মের মূল জায়গাটার চর্চা বেশি।

বারাসাত পেরিয়ে কলকাতা আসতেই এ শহর হয়ে যায় বিলবোর্ডের শহর। কোথাও মমতা ব্যানার্জী ঈদ মোবারক জানিয়েছে তো আর কোথাও বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপন। পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতেই মনে হতে পারে এ পাড়েও যত্রতত্র ময়লা ফেলা হয় আর কলকাতা পুরোটাই পুরোনো বিল্ডিং এ ঘেরা। এ ধারণাটা আমার ও ছিল। মুদ্রার ও পিঠ টা তো দেখা হয় নি।Kanchan দা ফেসবুকে পরিচিত। আসব আগেই জানিয়ে রেখেছি। বাস থেকে নামি উল্টাডাঙা। ওখান থেকে নিউ টাউনের বাসে। বাস একটু যেতেই ভুলটা ভাঙল। জয়নাল ভাইয়া বলছিল কলকাতা আধুনিকতায় ঢাকার চেয়ে পিছিয়ে। এই উল্টাডাঙা হয়ে যে রাস্তাটা নিউ টাউনের দিকে গেছে সেটা ঢাকার চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক। সব কিছু গোছানো। কোথাও যানজটের সুযোগই নেই। নিউ টাউনের নারিকেল তলা টাটা মেডিকেলের সামনে বাস থামে। ভেতরে যেতেই দেখা কাঞ্চন দার সাথে। এবারই প্রথম দেখা। রক্ত দিয়ে বেরিয়েছেন। একটু পর ভাইয়ার বান্ধবী মৌমিতা ও এলো। নিয়ে গেলেন টাটা মেডিকেলের জেনারেল বেডে। আট দশ বছর বয়সী বাংলাদেশী একটা বাচ্চার ক্যান্সার। মৌমিতা দি একটা কিশোর উপন্যাস দিল আর কাঞ্চনদা দিল চকোলেট। আরো দুটা বাচ্চাকে গিফট দিলো। সে কি খুশি ওরা। ওদের বাবা মার সাথে কথা হলো। আরো পরিচয় হলো সূর্যদা আর অঙ্গনার সাথে যারা এই অচেনা বাচ্চাগুলোর পাশে দাড়িয়েছে। কখনো টাকা দিয়ে, কখনো বা রক্ত দিয়ে আবার কখনো মানসিক সাপোর্ট দিয়ে।

একজন গার্জিয়ান তো বলেই ফেললেন, এখানে আসার আগে ভারতকে খুব ঘৃণা করতাম। আমার ধারণা বদলে গেছে। কথা বলছিলাম ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ঐশির সাথে। কাঞ্চন দা পরিচয় করিয়ে দিলেন এই ছেলেটা বাংলাদেশ থেকে এসছে। ওদের পুলিশে ধরেছিল। মেয়েটা চোখ বড় বড় তাকিয়ে বলল, জয়নাল আবেদীন আর আপনি না? আমরা ফেসবুকে পড়েছি। Joinal ভাই আপনার লেখা এইটে পড়ুয়া ঐশী হাসপাতালে থেকেও পড়ছে। ঐশির বাড়ীতে যাব ঠিক হলো। ঐশির বাড়ী মানে হাসপাতাল থেকে দেড় কিলোমিটারের মধ্যে যেখানে ঐশির মা, দাদী ও ঐশি থাকে। রাস্তায় এসে দেখি অটৌ নেই। ট্যাক্সি অত অল্প পথ যেতে চাইল না। কাঞ্চন দা পুলিশে রিপোর্ট দেয়ার ভয় দেখাতেই ট্যাক্সি স্ট্যার্ট। এই না হলো পুলিশ। ঐশিদের বাসার উপরতলায় আরেক বাংলাদেশী আপু সেমাই রেঁধে খাওয়ালেন। সেই দিনের চারটায় ঈদের স্বাদ।

ঐশির বাসা থেকে ফিরব। কাঞ্চনদা এপস এ দেখলেন কাছাকাছি কোথাও ট্যাক্সি আছে কিনা। পাওয়া গেল না। ব্যাপারটা প্রথম জেনেছি। আমি ঘরে বসেই দেখতে পাবো আশে পাশে কোথায় ট্যাক্সি আছে আর ঘর থেকেই এপসে ডাকতে পারব। নিউ টাউন আসলেই নতুন শহর। অত ব্যস্ততা না থাকায় শহরটা প্রাণহীন। ব্যস্ত হওয়ার আগেই ফ্লাইওভাবের মত করে তৈরি হচ্ছে মেট্রোপথ যেটা তৈরি হতে হতে এ নিউ টাউন মোটামুটি ঢাকার গুলিস্তান মোড় হয়ে যাবে।

রাজারহাট থেকে বাসে বিধাননগর স্টেশন থেকে ট্রেন দক্ষিণেশ্বর নেমে গেছি হেটে গঙ্গাটা দেখতে। বাইকে বসে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে হাত ধরে প্রম চলছে। হাটতে হাটতে হাওড়া। হাওড়া কাঞ্চনদার বাড়ী। এখানে ব্যাঙের ডাক চলছে অবিরাম। এটা গ্রাম এলাকা তবে চিটাগং এর কলকা সিএনজি হয়ে ভেতরে এলাকাটা যেমন তেমনই। কাঞ্চনদার কাকু বিয়ে টিয়ে কিছু করেন নি। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে। ওই নিরামিষ নিজে রেঁধে একার জীবন। সামনের রুমে কাকু টিভি দেখছে। পেছনের রুমে আমি শুয়ে। এই যে একটা এলোমেলো ঈদ আমার কাছে অবশ্যই দেশে কাটানো ঈদের চেয়ে কোন অংশে কম না।

বালি স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে হাওড়া স্টেশন। এটা পশ্চিমবঙ্গের সবচেয় বড় আর ব্যস্ত স্টেশন। এই হাওড়া থেকেই পুরো ভারতের সবখানে যাওয়া যায়। ইশ আমার বাংলাদেশে এরকম কোন স্টেশন যদি থাকত !

হাওড়া থেকে সাবওয়ে হয়ে গঙ্গার ঘাটে। এই ঘাট থেকে হাওড়া ব্রিজ পুরোটা দেখা যায়।

ঘাট থেকে লঞ্চে গঙ্গার ওপারে কলকাতায় যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। লঞ্চে গঙ্গা পাড় হয়ে এসেছি বাবু ঘাট।

বাবু ঘাট থেকে সামনে একটু হাটলেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা বামে কলকাতা হাইকোর্ট। রাজ্যসভার সামনে ইডেন গার্ডেন আর ইডেনের একটু সামনে আকাশবাণী কলকাতা।

কাঞ্চন দা কাজ করেন রাজ্য বিধানসভায়। রাজ্যসভার ভেতরটা ও ঘুরে দেখালেন। অন্ধকারে ফাঁকা বিধানসভার স্পিকারের আসনের সামনের আলোটা দেয়া হলো। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আসনটা দেখে ইচ্ছে হলো উনাকে পেলে কয়েকটা লাইন শুনিয়ে দিতাম। বাঙালি হয়ে বাঙালির এতটা ক্ষতি কি করে করেন?

কলকাতা হাইকোর্ট ঘুরে দেখলাম। অত ভীড় চোখে পরে নি। হয়ত ঈদের পরের দিন ছিল বলেই ফাঁকা ছিল। হাইকোর্টের সামনে মাষ্টারদা সূর্যসেনের একটা প্রতিকৃতি আছে। আহা আমার চট্টগ্রামের মাষ্টারদা সূর্যসেন। আমরা উনাকে মুছেই দিয়েছি। বাংলাদেশের ইতিহাস যেন শুধু ৭১। ৪৭ বলে কিছু ছিলই না। হাইকোর্টের ছাদে উঠে উপর থেকে পুরো এলাকাটা দেখলাম। এরপর গেছি ইডেন গার্ডেনে।

রাজ্যসভার ক্যান্টিনে দুপুর খেয়ে ধর্মতলা পর্যন্ত হেটে মেট্টো স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন কাঞ্চন দা। মেট্টোর ওদিকে শেষ স্টেশন দমদম। কলকাতা শহর উপরে যতটা ফাঁকা লাগে এই মেট্রোর কারণেই। একটু পর পর মেট্রো আছেই। জীবন এখানে খুব গতিময়।

এর কদিন আগে জয়নাল ভাইয়ার সাথে গিয়েছিলাম হাওড়া বিজ্রে।

জয়নাল ভাইয়ার সাথে হাওড়া

হাওড়া ব্রিজ

সেদিন কোন একটা পুজো ছিল। কলকাতার বেশিরভাগ গাড়িতেই ফুল আর কলাপাতা। দেব আর জিৎ এর দুই পৃথিবী ছবিতে বাইককে ঘিরে যেভাবে সাধু বাবা মন্ত্র পড়েছে সেভাবে করতে দেখলাম পার্ক স্কোয়ারের একটু আগে চিত্তরঞ্জন হসপিটালের সামনের মন্দিরে।


শিয়ালদহ থেকে আর দুই স্টেশন পরেই কলেজ স্ট্রিট। Tasnim ভাইয়া যেখান থেকে বই নিতে বলেছে। কার লেখায় যেন জেনেছি কলেজ স্ট্রিটের পাশেই সেই বিখ্যাত কফি হাউজ। তখন তুমুল বৃষ্টি।

বামের গলিতেই ঢুকতেই রাস্তার দু পাশে বইয়ের দোকান। কে যেন বলেছিল কোন দেশ সম্পর্কে জানতে তারা কি খায় আর কি পড়ে দেখতে। কোন দোকানের সামনে যেতেই শুরু দাদা কি লাগবে। আরে কি মুশকিল। এখানে কি কি বিক্রি করে দেখার জন্যে দাড়াতে চাইছি আর তারা আছে বিক্রির চিন্তায়। এভাবে যা দেখেছি আহামরি কিছু চোখে পড়ল না। আমাদের মত গাইড বইয়ে বাজার সয়লাব। তবে আমি তো আর পুরোটা দেখিনি তাই অনেক কিছু না দেখা থাকতেই পারে।

আরেকটু ডানে যেতেই রাস্তার ওপারে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়।ডান পাশে পুরোনো কালচে ভবনের দ্বিতীয় তলায় কফি হাউজ। উপরে ইংরেজীতে লিখা 'ইন্ডিয়ান কফি হাউজ"। পুরাতন এক হল রুম।


পঞ্চাশ-ষাটটার মতো টেবিল সারি সারি সাজানো। দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারতবর্ষের বিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্ম। ডান পাশটায় আলো বেশি আর বাম পাশটায় হালকা আলো। উপরে বনেদি আমলের ফ্যান ঘুরছে। বসেই রইলাম। সাদা পোশাকের শেরওয়ানি ও মাথায় পাগড়ি পরা ষাটোর্ধ একজন বেয়ারাকে দেখলাম। কোন বেয়ারা আমার আশেপাশে ও আসে না। কফি হাউজের আড্ডা তখনো চলছিল প্রতিটি টেবিলে।

এই ভর দুপুরেও অনেক ভিড়।প্রবীণদের আনাগোনা বেশি। আমাদের দেশে এ ধরনের দোকানে সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ই থাকে বেশি। সেখানে নবীন-প্রবীণদের মিশ্রণে জমজমাট আড্ডা। সামনের টেবিলে দুজন প্রেমিক প্রেমিকা কথার খুনসুটিতে ব্যস্ত। ক্লিক করে ফেললাম তারা হেসে দিল। একে তো একা গেছি কোন ওয়েটার ডাকছে না দেখে বেরিয়ে পড়লাম।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন রোববারে খোলা থাকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। এছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে।

অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউজটির নাম।

ব্রিটিশ-ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল এ কফি হাউজ। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাতও হয়েছিল এ কফি হাউজ থেকেই

বেরিয়ে সামনেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় হিন্দু কলেজ নামে স্থাপিত হয়।

নিরাপত্তাকর্মীরা বলল, আজ বন্ধ সোমবার আসতে। আর ভেতরে যেতে হলে পাসপোর্ট জমা দিয়ে যেতে হবে। অনুমতি নিয়ে ভেতরটা ঘুরে দেখলাম।

ডানে দুই মিনিট হাটলেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যার চার জন প্রাক্তন ছাত্র নোবেল পুরস্কার পেয়েছে।

এবার ও অনুমতি নিয়ে ভেতরটা ঘুরে দেখলাম।

দুটোতেই অত সবুজ নেই। শুধু মনে পড়ল আমার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। কোনটা র‌্যাংকিং এ কত সেটা আমার কাছে অত দামী কিছু না। বিশ্ববিদ্যালয় তাও আবার প্রকৃতির বাইরে এটা আমার কাছে খাপছাড়া লাগে।

চবির প্রবেশদ্বারের সৌন্দর্যের কাছেই বাকী সব বিশ্ববিদ্যালয় রঙ হারাবে। এরকম পথ আছে কি আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে?

আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেই রাস্তার দুই পাশে পাহাড়। যেন সবুজের পৃথিবী আমাদের ডাকছে। আমাদের কলা অনুষদের পাশে ও বিশাল পাহাড়। অধিংকাংশ ক্লাসে বৃষ্টির সময় আমি জানালা দিয়ে পাহাড় দেখি।ইট, পাথরের দালানে অত উচ্চমার্গীয় লেকচারে সবার মনোযোগ না ও থাকতে পারে। আমরা পাহাড় দেখি। Obelar তোমরা ফইন্যিরা কি দেখতে?

চবির কয়েকটি হল পাহাড়ের মধ্যেই। পাহাড়ে থেকে সূর্য উঠা আর সূর্য ডুবতে দেখার কতখানি আনন্দ সেটা সবাই জানে না।হল লাইফে সবাই তো পড়ালেখা না ও করতে পারে। কেউ কেউ উচুঁ জারুল গাছের নীচে মন খারাপ করে একটা কবিতা ও লিখতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কত জাতের পাখি আছে।কোন এক ক্লাস ফাকিঁর বিকেলে প্রেমিক যদি প্রশংসা করতে ভুলে যায় সে পাখি দেখে প্রেমিকাকে পাখির মত সুন্দর বলার জন্যে হলেও তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখি থাকা চাই।

কোন দিন পাগলামো মাথায় চাপলে বৃষ্টিতে ভেজার জন্যে বিশাল একটা ক্যাম্পাস চাই। পথ শেষ কি শেষ হয় না দেখার জন্যে বিশাল রাস্তা চাই। সব আমার চবিতে আছে।

দুজন মিলে ঝর্ণার শব্দ উপভোগ করার জন্যে হলেও তো পানির ধার থাকা চাই।

না! এসবের কিছুই নেই পেসিডেন্সি আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যা আছে সব আমার চবিতে।

তবে জানি চাইলেই সব বিশ্ববিদ্যালয় পাহাড়ে করা পসিবল না। আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী এরকম ব্যাপার শুধু কল্পনাতেই ঘটে। এত কিছু থাকার পরও আমার চবিতে লাশ পড়ে। যা আছে পুরোটাই মাটি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ওসব না থাকলেও পড়ালেখাটা দারুণ ভাবেই আছে।

ফেরার আগে আবার শিয়ালদহ স্টেশনে। সুব্রত দাদা আর মঞ্জিল দাদা দুজনে একি সময়ে দেখা করতে হাজির।

সুব্রত দাদার সাথে শিয়ালদহ

মঞ্জিল দাদার সাথে শিয়ালদহ

কদিন পরে যেদে হয়েছিল কোটারি হসপাতালে। ভাইয়ার শ্বশুড়কে দেখতে। ব্যাস  এরপর ফিরে আসা। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে বনগাঁওহয়ে আমার বাংলাদেশ।

আমার পা থেকে চুল পর্যন্ত যা পরা আছে সবই ভারতীয় পণ্য। কাধেঁর ব্যাগটা ছাড়া। প্রতিবারের মত এবার ও ভারতীয় পুলিশ চিনে নিল। বাংলাদেশি চেনার ক্ষেত্রে ওদের দক্ষতার জন্যে নতুন ক্যাটাগরিতে নোবেল পাওয়ার দাবি রাখে।

(২০১৬ সালে কলকাতায় ঘুরে এসে লেখা ফেসবুক স্ট্যাটাস গুলো একত্রিত করে নিলাম)।