দিঘীনালা থেকে সাজেক- নৈসর্গের রোমাঞ্চকর পথ…

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 7 August 2016, 04:17 AM
Updated : 7 August 2016, 04:17 AM

রাঙ্গামাটি জেলার একটি বড় ইউনিয়ন-সাজেক, কিন্তু যেতে সুবিধা খাগড়াছড়ি দিয়েই। তাই খুব সকালেই আমরা সি এন জি নিয়ে দিঘীনালার পথ ধরেছি। এমনিতেই খুব সরু রাস্তা, পীচঢালা পথের দু'পাশে নুয়ে পড়েছে বাঁশের সাড়ি, তার সাথে রিমঝিম বৃষ্টি-মন্দ না। ড্রাইভার সুমনকে আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম-এতো উঁচুতে সি এন জি যেতে পারবে। তার এখানেই জন্ম, তাই বিজ্ঞের সাথেই জানালো-তেলে চালিত সব যান-বাহনই সাজেক উঠতে পারবে। কিন্তু আর্মি বা পুলিশের সাহায্য ছাড়া কেউ যেতে পারবে না, সকাল ১০টার মধ্যে বাঘাইছড়ি আর্মি ক্যাম্পে সামনে সবাইকে এন্ট্রি নিয়ে এক সাথে সাজেক যেতে হবে আবার  ফেরার সময় এক সাথে ফিরতে হবে। এর অন্যথায় কেউ গেলে, পাহাড়িরা আক্রমণ করলে বা কোন দূর্ঘটনা ঘটলে কেউ দায়িত্ব নেবে না। বুঝতেই পারছেন, যাত্রার শুরুতেই নৈসর্গের অন্তরালে এক ভয়ংকর হাতছানি অপেক্ষা করছে। কিন্তু ঘুরতে চাওয়া মন-দমাবে কে?

ছোট ছোট পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পাহাড়ি বাজার আর ছনের ঘরের পাশ দিয়ে চলে গেছে কাচালং নদী। বাজারে নেমে এককাপ গরম চায়ে চুমুক দিলাম, আষাড় মাসের অঝর বৃষ্টি তখন কিছুটা বিরতি দিল যেন।

কিছুক্ষণের হাঁটাহাঁটি করে ছবি নিলাম, তারপর আবার যাত্রা শুরু। রাস্তার দুপাশের বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি ঘর। বাঘাইহাট বাজারের পর গঙ্গারাম মুখ। দুপাশ থেকে বয়ে আসা দুটি নদী এক হয়েছে এখানে। পাহাড়ের বুক চিড়ে বয়ে যাওয়া নদী চলে গেছে দূরের পথ ধরে। মুক্ত আকাশের নিচে বিশাল সমৃদ্ধ বনভূমি দিয়ে সাজানো পুরো সাজেক ভ্যালির পথ। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জুম চাষ হচ্ছে।

উড়োবাজার, গঙ্গারামমুথ, নন্দরাম এসব পাহাড়ি পাড়া পেরিয়ে আমাদের পুনরায় যাত্রা বিরতী নিলাম মাচালং বাজারে। পাশের সীমান্ত ঘেঁষা ভারত থেকে আসা মাচালং নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে ছোটখাট বাজার। এই এলাকা সাজেক ইউনিয়নের প্রধান কেন্দ্রস্থল। আদিবাসী আর বাঙালি— মিলেমিশে এই বাজারে ব্যবসা করে। দূরদূরান্তের পাহাড়িরা একদিন আগেই বাজারে আসতে শুরু করেন।

মাচালং বাজার থেকে সাজেকের পথের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। বন্ধুর পথ— দুপাশেই আকাশচুম্বী পাহাড়ের বুকে উদ্ধত শিখর তুলে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষরাজি। দীর্ঘজীবি বৃক্ষের দেখা মেলে এই পথে, মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন বসতি। দূরের পাহাড়ে মেঘের গড়াগড়ি দেখতে না দেখতেই আমরা পৌঁছে যাই সেই মেঘ পরিবেষ্টিত উপত্যকায়।পা রাখলাম রুইলুই পাড়ায়। এটা সাজেক উপত্যকার মূল কেন্দ্র। রুইলুই পাড়ায় লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাড়ার সবগুলো বাড়ির রং লাল-সবুজ।রুইলুই পাড়া থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ কংলাক পাড়া। পাংখোয়াদের বসবাস এখানে। সব মিলিয়ে ১৫ পরিবারের বসবাস হবে।

সামনে পেছনে চোখ রাখলাম -বিশাল একটা র‍্যালির মতোন গাড়িগুলো আগুচ্ছে। সামনের দিকের গুলো পাহাড়ের অনেকটা উপরে, মাঝে আমরা আবার পেছনে আছে আরো কিছু গাড়ি। যারা বাইকে এসেছে তারা সাই সাই করে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে।সাজেকের সব চাইতে মজার বিষয় এই রাস্তা,পয়সা দিয়ে অনেকে রাইডে চড়ে, এখানে কিছু পয়সা খরচ করলেই তার থেকে বেশি মজা পাওয়া যাবে।

বিশ টাকা জনপ্রতি টকিটের দাম। প্রকৃতির সাথে ইট-বালি মাখিয়ে এক অদ্ভূত ভ্যালি বানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।সমতল পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ২৭০০  ফিট উচ্চতায় কিভাবে এমন নয়নাভিরাম ভুস্বর্গ বানানো সম্ভব তা চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না।সাাজেক মুলত একটি নদীর নাম যা বাংলাদেশ ও ভারতকে আলাদা করেছে এই অঞ্চলে। এটি মুলত কর্ণফুলির শাখা নদী। সাজেক  রাঙামাটি জেলার উত্তরে আর ভারতের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। এটি একটি ইউনিয়নের নামও বটে। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় অবস্থিত এই সাজেক মুলত একটি উপত্যকা। এটি খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৬৭ কিলোমিটার আর রাঙামাটি শহর থেকে ৯৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত ভারতের মিজোরাম সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।

খোলা চোখে হেলিপ্যেডে দাড়িয়ে দৃষ্টির শেষ সিমানা পর্যন্ত সাজেকের চার পাশের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখে যে কেউ তার রূপে আচ্ছন্ন হবেই। বর্ষার কোমল ছোঁয়ায় সবুজ গাছ গুলো আলাদা মাত্রা যোগ করেছে নীরবে।সাজেকের আই কন বি জি বি পরিচালিত রূন্ময় কটেজটি সাজেকের সৌন্দর্য্য আরো বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।পাহাড়ের গায়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পিচ ঠালা পথ গিয়ে শেষ হয়েছে বি জি বি ক্যাম্প পর্যন্ত।পাহাড়ের এতো উপরে বাংলাদেশের সব চাইতে বড় ইউনিয়ন,ভাবা যায়? সাজেক ইউনিয়নের আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। দূর্গম সাজেক আজ পরিনত হয়েছে সৌখিন ভ্রমন পিপাসুদের মেলা বন্ধনে । বিশাল পাথরখণ্ডের পাদদেশেই কংলাক পাড়ার অবস্থান। কংলাকের পাথরচূড়ায় দাঁড়িয়ে পুরো সাজেক উপত্যকা চমৎকারভাবে এক নজরে দেখা যায়।সাজেক থেকে মাত্র ১০ মিনিটের পথ কংলাক, এটি সাজেকের সব চাইতে উচু সিপ্পু পাহাড়ে অবস্থিত। শুধু সাজেক ভ্যালি নয় পুরো রাঙ্গামাটির জেলার মধ্যে সব চাইতে উচুতম পাহাড় , এর উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ২৮০০ ফিট উপরে।

কংলাকের প্রকৃতি যেন আরো একটু বেশিই উদার,হয়তো কংক্রীটের আলিঙ্গনে এখনো নিজেকে জড়ায়নি তাই। পাহাড়ের চূড়া থেকে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের বুকে এক পায়ে দাড়িয়ে থাকা সারি সারি কমলা গাছের বাগান ,যে কোন ভ্রমন পিপাসুকে পুলকিত করবে নি:স্বন্দেহে। নয়ণাভিরাম সৌন্দর্যের আধার সাজেক ভ্যালি বড় বড় পুরনো সেগুন হরেক প্রকারের বিশাল বাঁশের বন আর প্রাচীন বট বৃক্ষের মায়াবী পরশে ঘেরা।সাজেকের রুইলুই ও কংলাক পাড়ায় মোট ৯৬টি পরিবারের বসতি। এদের বেশির ভাগই লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জন গোষ্ঠি। প্রতিটি বাড়িই সাজানো গুছানো। বাড়ির আঙ্গিনায় ফুটে আছে নানান রংঙের ফুল ।সাজেকের হ্যেডম্যান লাল থ্যাঙ্গগা লুসাইর সঙ্গে কথা বলে আদিবাসিদের যাবিত জীবন সম্পর্কে জানা হল। রুইলুই ও কংলাক এই দুই পাড়ার আদিবাসিরা অধিকাংশই ইংরেজী শিক্ষিত। পাশেই ভারতের মিজোরাম প্রদেশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেশি। অধিকাংশ বসিন্দা পড়ালেখা সহ হাট বাজার পর্যন্ত মিজোরাম থেকেই করে থাকেন।

অনেকেই রাতে থাকার পরিকল্পণা নিয়ে এসেছেন।পূর্নিমা আলোয় পুরো পাহাড়টাকে অসাধারণ লাগবে তা নিশ্চিত, কারন এখন সেনাবাহিনীর কল্যানে জেনারেটরে রান্না হচ্ছে।কিন্তু ঘুমানোর সময় এই আলোর প্রয়োজন পড়বেনা ,চাঁদের আলোয় থেমে যাবে কৃত্রিম আলোর দৌরাত্ব্য ।খোলা জায়গা পেয়ে বাচ্চারা ছুটছে এদিক ওদিক,বড়রাও কম যায় না,কেউ দোল খাচ্ছে দোলনা আবার কেউবা খোলা আকশের নীচে শুয়ে পড়েছে।আমরা ভাত খাওয়ার জন্য টিকিট নিলাম- ভাত ডাল (১৫০ টাকা) মুরগী (২৫০ টাকা) গরু (৩০০টাকা) ,রক প্রশান্তি রেস্টুরেন্টে।সেনাবাহিনী পানির ব্যবস্থা করেছে ,তাছাড়া পানি কিনতেও পাওয়া যায়।

বেলা তিনটার আগে কোন গাড়ি খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে ছাড়তে পারবেনা,তাই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে একটু চোখ বুজে নিলাম স্বর্গীয় বাতাসের আবেসে।এখানে সবচাইতে আকর্ষনীয় লেগেছে -রুম্ময় রিসোর্ট।স্থনীয় লুসাই ভাষায় এটির অর্থ-সুন্দর ঘর।সুন্দর ঘরে সবাইকে ঢুক তে দেওয়া হয়না,কিন্তু আমি আবার বারণ মেনেছি কবে।অনেক্টা জাহাজের আদলে গড়া রিসোর্টে আবার ঝুলন্ত দোলনাও আছে।ক্যামেরার অবিরত ক্লিক ক্লিক হয়তো তার পুর সৌন্দর্য্য তুলে আনতে পারেনি, তবে চখের ক্যামেরায় সাজেক ভ্যালি আমৃত্যূ বেঁচে থাকবে।

ফেরার পথে আমাদের গাড়ি বহরকে পাহাড়ের মাঝপথেই একঘন্টা আটকে রেখেছিল বি ডি য়ার আর আর্মি।কারন একটি পাহাড়ি ছেলে আহত হয়েছিল।ভয় যে পাইনি তা না,যদি সে কোন বাঙালি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতো তবে সে রাত ক্যাম্পেই কাটাতে হতো।যাই হোক,এ যাত্রা অল্পেই রক্ষা পেলাম।মনে মনে তৈরি হলাম কোন এক শীত সকালে মেঘের রাজ্যে আবার গা ভেজাবো বলে।

যারা সাজেক যেতে চান //

ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দূরত্ব ৩১৬ কিলোমিটার। ছয়-সাত ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন খাগড়াছড়ি। রাতে রওয়ানা দিলে সকালে পৌঁছবেন আর দিনের সকালবেলা রওয়ানা হলে বিকেলে পৌঁছবেন। ঢাকার কমলাপুর, ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ, কল্যাণপুর, কলাবাগান থেকে খাগড়াছড়ির বাস পাওয়া যায়। শ্যামলী, শান্তি পরিবহন, ইকোনো, ঈগল, সৌদিয়া, সেন্ট মার্টিন, এস আলমসহ অনেক রকমের বাস পাওয়া যায়। দিনে অথবা রাতে যেতে পারেন। শান্তি পরিবহনে গেলে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। অন্যান্য পরিবহন হলে খাগড়াছড়ি শহর পর্যন্ত।

খাগড়াছড়ি থেকে পিকআপ, চান্দের গাড়ি বা সিএনজি রিজার্ভ করে যেতে হবে সাজেকে। তবে, এসব পরিবহণের মধ্যে চান্দের গাড়ি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। ভাড়া পড়বে ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। আবার মোটরসাইকেলেও যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা। তবে যে গাড়িতেই আপনি যান যেতে হবে সেনাবাহিনীর পাহাড়ায় তাদের স্কট। সেটি অবশ্য সবার জন্যই ভালো।

থাকার ব্যবস্থা //

কম টাকায় বিশাল বহর নিয়ে থাকতে চাইলে সাজেক ক্লাব হাউস, ভাড়া মাথা পিছু ২০০/- টাকা তবে পুরো হাউস রিজার্ভ করতে চাইলে অল্প কিছু টাকা বেশি গুনে থাকা যাবে আয়েশি ঢংয়ে। এছাড়া আরো রয়েছে সেনাবাহিনী পরিচালিত সাজেক রিসোর্ট ও বিজিপি পরিচালিত সাজেকের আইকন রুন্ময় কটেজ । অগ্রীম বুকিং ও মৌসুম অনুযায়ী রুম ভাড়া জানার জন্য নেটে সার্চ দিলেই যাবতীয় তথ্য মিলে যাবে।

খানা-খাদ্য //

যদি সাজেকে দু-তিনদিন থাকার ইচ্ছে থাকে তাহলে খাগড়াছড়ি দিঘীনালা হতে বাজার সদাই করে নেয়া ভাল এছাড়া বেশ কিছু রেষ্টুরেন্টও রয়েছে।

তথ্য-কৃতজ্ঞতা-