প্রত্নতত্ত্ব আর ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহর কুমিল্লা

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 6 Sept 2016, 06:44 PM
Updated : 6 Sept 2016, 06:44 PM

জন্মাষ্ঠমীর ছুটি পেয়ে গেলাম হাতে,সাথে শুক্র-শনি বোনাস।তিন দিনের একটা সফর দিতে হবে।কলিগরা মিলে ভাবছিলাম ,কাছাকাছি একটা জায়গায় চলে যেতে যেখানে ঘোরাঘুরিটাও হবে আবার বাচ্চারা কিছু শিখতেও পারবে। আমিই প্রস্তাব করলাম কুমিল্লা শহরের নাম।তখন কেবল জানতাম ওখানে লালমাই পাহাড় আর বার্ড বলে একটা জায়গা আছে।তার চাইতে বেশি কিছু জানার উপায় ছিল না।কারণ সারাটা জীবন কুমিল্লাকে পাশ কাটিয়েই চলে গেছি চট্রগ্রামে।ফেরার সময় কিনেছি নকল রসমালাই।আসল রস মালাইয়ের স্বাদ কী এবারই প্রথম জানলাম।

ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব মাত্র ৯৭ কিলোমিটার।তাই কমলাপুর থেকে রয়েল বাসে করেই পৌঁছে গেলাম দুই ঘন্টার মধ্যেই।কুমিল্লা একসময় বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল এবং সেই সময় নোয়াখালীও এর অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব শুজাউদ্দিন ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এর সমতল অংশ সুবে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কুমিল্লা দখল করে। ১৭৮১ সালে নোয়াখালীকে কুমিল্লা থেকে পৃথক করা হয়। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি। ১৯৬০ সালে জেলার নাম করা হয় কুমিল্লা।কুমিল্লা নামকরণের অনেকগুলো প্রচলিত মত রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযাগ্য চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামক যে স্থানের বিবরণ রয়েছে সেটি থেকে কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শন‍াদি থেকে জানা যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল।

জেলাভিত্তিক জনশক্তি রফতানিতে কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে কুমিল্লার বাসিন্দাদের। মোট জনশক্তি রফতানির ১১ শতাংশের বেশি এখন এ জেলার অধিবাসী।বিগত কয়েক বছরে বেড়ে গেছে কুমিল্লার মানুষের চাকরি নিয়ে বিদেশ গমনের হার। গত ২০১৪ সালে জেলাটি থেকে চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন ৪২ হাজার ৫১১ জন। আর গত এক দশকে এ সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৭২ হাজার ১৪২, যা ওই সময়ে দেশের মোট জনশক্তি রফতানির ১১ শতাংশের বেশি।রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বলছে, বর্তমানে জনশক্তি রফতানিতে শিক্ষা ও দক্ষতা বেশি জরুরি। কুমিল্লায় শিক্ষিতের হার বেশি হওয়ায় জনশক্তি রফতানি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এছাড়া চ্যালেঞ্জ নেয়ার সাহসও কুমিল্লার মানুষকে অভিবাসী হতে উদ্বুদ্ধ করছে।

কুমিল্লা শহরকে এক নজরে রিক্সার শহরো বলা যেতে পারে।জনবহুল নগরীর বাসিন্দাদের প্রধাণ এবং প্রিয় মাধ্যম এই ব্যাটারী চালিত রিক্সা।ভাড়াটা খুব বেশি হলেও দ্রুত পৌঁছানোর অন্যতম সহজ মাধ্যম এটিই।কুমিল্লা শহরে থাকার মতোন বেশ কয়েকটি নামী দামী আবাসিক হোটেল রয়েছে।আমরা রাতে থাকার জন্য বেছে নিলাম রেড রুফ ইন রেসিডেন্ট হোটেল যেটা রেসকোর্সের মাঝেই অবস্থিত।আমার ছোট অদ্রি হোটেলের বাথরুমে প্রবেশ করেই ঘোষনা করলো-আমি এই বাড়িতেই থাকবো,ঢাকায় যাব না।বলতেই হয় শহরের মাঝখানে এমন নির্জন থাকার ব্যবস্থা ,এক কথায় অসাধারণ।পাশাপাশি দুটো বিছানা পাতা,রুম ভাড়া মাত্র ২৬০০ ।বেশির ভাগ সময় আমরা রুমেই খেয়েছি আর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেই রেস্টুরেন্ট।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (বার্ড)

বার্ড নামটা এতোবার শুনেছি যে সিএনজি ড্রাইভারকে বললাম আগে বার্ডে নিয়ে যেতে।অবশ্য দর্শনীয় যে ক'টা স্থান আছে তা খুব কাছাকাছিই।শহর থেকে বার্ডে যেতে সময় লাগলো মাত্র চল্লিশ মিনিট।বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বা বার্ড, বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণার মাধ্যমে পল্লী অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন তথা পল্লীর দারিদ্র্য বিমোচনে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ীতে অবস্থিত।

বার্ড ১৯৫৯ সালের ২৭শে মে তৎকালীন সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত বিএইড(VAID) প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সম্পৃক্ত মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গ্রামের অবহেলিত জনমানুষের সমস্যাসহ গ্রামের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান গ্রাম উন্নয়ন একাডেমী নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দেন প্রখ্যাত পল্লী উন্নয়ন গবেষক, দার্শনিক ও সমাজসেবক ড. আখতার হামিদ খান। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান নামে নামান্তরিত হয়। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ১৫৬ একর জমির উপর বিএআরডি ক্যাম্পাসটি অবস্থিত। ক্যাম্পাসের বেশীরভাগ অংশেই রয়েছে অর্কিড গাছ, সবজি বাগান, নার্সারি, পার্ক। এখানকার রাস্তাগুলোর পুরোটাই সবুজ গাছ দিয়ে ঘেরা। এলাকার ভৌগলিক চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এখানকার অফিস, বাংলো, ডরমিটরি ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাসভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এতোটা সাজানো গোছানো একটা এরিয়া ,পুরোটা ঘুরে আসতে পাঁয়ে হেঁটে অনেকটা পথ ঘুরে আসতে হয়।তবুও ঝিরঝির বর্ষায় ভেজা মাটির টিলাতে পা রাখতে ভালোই লাগছিল।

নয়নাভিরাম শালবন বিহার

বার্ড থেকে বের হয়েই পাশের সরু পথ দিয়ে কিছু দূর গেলেই শালবন বৌদ্ধ বিহার।শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লা জেলার লালমাই-ময়নামতি প্রত্নস্থলের অসংখ্য প্রাচীন স্থাপনাগুলোর একটি এই বৌদ্ধ বিহার । এটি ১২শ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। । বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এর সন্নিহিত গ্রামটির নাম শালবনপুর। ধারণা করা হয় যে খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে।আকারে এটি চৌকো। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ১৬৭.৭ মিটার দীর্ঘ। বিহারের চার দিকের দেয়াল পাঁচ মিটার পুরু। কক্ষগুলো বিহারের চার দিকের বেষ্টনী দেয়াল পিঠ করে নির্মিত। বিহারে ঢোকা বা বের হওয়ার মাত্র একটাই পথ ছিল। এ পথ বা দরজাটি উত্তর ব্লকের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষের মাঝে ১.৫ মিটার চওড়া দেয়াল রয়েছে। বিহার অঙ্গনের ঠিক মাঝে ছিল কেন্দ্রীয় মন্দির।বিহারে সর্বমোট ১৫৫টি কক্ষ আছে। কক্ষের সামনে ৮.৫ ফুট চওড়া টানা বারান্দা ও তার শেষ প্রান্তে অনুচ্চ দেয়াল। প্রতিটি কক্ষের দেয়ালে তিনটি করে কুলুঙ্গি রয়েছে। কুলুঙ্গিতে দেবদেবীর মূর্তি, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি রাখা হতো। এই কক্ষগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা থাকতেন। সেখানে বিদ্যাশিক্ষা ও ধর্মচর্চা করতেন।প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক বা টেরাকোটা, সিলমোহর, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলো বাংলাদেশের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর বহন করছে।

আনন্দ বিহার

কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং শালবন বিহার থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার উত্তরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের কাছে এটি অবস্থিত। এটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ছিল। প্রত্নতত্ত্বের মতে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। বর্গাকৃতি এই আনন্দ বিহারটির প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ৬০০ থেকে ৬৬০ ফুট। এই বৌদ্ধবিহারটির উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে প্রধান প্রবেশপথ। এই বিহারটির দেয়ালে বিভিন্ন ধরনের ফলক অঙ্কিত হয়েছে, যা বৌদ্ধদের অনেক নিদর্শন পাওয়া যায়। বৌদ্ধ রাজা আনন্দ রায়ের নামানুসারে এর নাম আনন্দ বিহার। বিহারের বহিঃপ্রাচীরটি বেশ পুরু এবং দেখতে খুব সুন্দর। কারণ এর দেয়ালে অফসেট ও ছাঁচের তৈরি নকশা রয়েছে। ভেতরের বারান্দার দেয়ালও ছাঁচ দ্বারা অলংকৃত। ভেতরের এই দেয়ালটি নকশা করা ইট দ্বারা সুসজ্জিত। খননকাজে যে অংশগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে, এগুলো দীর্ঘ কাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। বিশাল আকৃতির এই বিহারে প্রাপ্ত নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে; একটি তাম্রশাসন ,৬৩ টি রৌপ্য মুদ্রা ,অনেক গুলো ব্রোঞ্জ মূর্তি ,পোড়ামাটির ভাস্কর্য ফলক ,মঠের বাইরে মৃৎপাত্র পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত একটি ভাটির অস্তিত্ব ।

চিরশায়িত সৈনিক আত্মা -ওয়ার সিমেট্রি

কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত ওয়ার সিমেট্রি দেখতে সেদিন খুব ঝামেলাই হচ্ছিল,কারণ দিনটা ছিল শুক্রবার।তবু সাংবাদিক পরিচয়ে ঢুকে গেলাম স্মৃতি বিজড়িত শীতল কবর স্থানে।২য় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি যা কুমিল্লা শহর হতে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ।এই সমাধিক্ষেত্রের ৭৩৬টি কবর আছে। এর মধ্যে অধিকাংশ হলেন সেসময়কার হাসপাতালের মৃত সৈনিকরা। তাছাড়াও যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থান থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে এর মধ্যে রয়েছেন ৩জন নাবিক, ৫৬৭জন সৈনিক এবং ১৬৬জন বৈমানিক। সর্বমোট ৭২৩ জন নিহতের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছিল।সমাধিক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর, যার ভিতরের দেয়ালে এই সমাধিক্ষেত্রে ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে একখানা দেয়াল ফলক লাগানো রয়েছে। ভিতরে সরাসরি সামনে প্রশস্থ পথ, যার দুপাশে সারি সারি কবর ফলক। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ করা যায়- খ্রিস্টানদের কবর ফলকে ক্রুশ, মুসলমানদের কবর ফলকে আরবি লেখা (যেমন: হুয়াল গাফুর) উল্লেখযোগ্য। প্রশস্থ পথ ধরে সোজা সম্মুখে রয়েছে সিঁড়ি দেয়া বেদি, তার উপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্টধর্মীয় পবিত্র প্রতীক ক্রুশ। বেদির দুপাশে রয়েছে আরো দুটি তোরণ ঘর। এসকল তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরো বহু কবর ফলক। প্রতি দুটি কবর ফলকের মাঝখানে একটি করে ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে। এছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে প্রচুর গাছ। সমাধিক্ষেত্রের সম্মুখ অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে।

অতি আকর্ষনীয় কাপড়-খাদি

এতো ঘোরাঘুরির পর কিছু কেনাকাটা করবোনা তা কী করে হয়।কুমিল্লার খাদির সাথে আমার পরিচয় সেই ছোট বেলা থেকেই,তাই খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম খাদির দোকানে। এখানে খাদি কাপড়ের দোকান রয়েছে শতাধিক। কুমিল্লার খাদি কাপড়ের প্রবীণ ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা শাখা থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে খাদি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। তবে খাদি শিল্পের এ বিপর্যয় বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে সমবায় আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্ণর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লার অভয়াশ্রমে দি খাদি এন্ড কটেজ ইন্ডাষ্ট্রিজ এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা মহানগরের 'অভয় আশ্রম' একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। অভয় আশ্রমের কর্মীদের প্রচেষ্টায় কুমিল্লার আশ-পাশের গ্রামগুলোতে হাতে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতের ব্যবহার ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। বিশেষ করে কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া। দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, সাইতলা, বাখরাবাদ, বেলাশ্বর, ভানী, হারং, গুনঞ্জর। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর। মুরাদনগর উপজেলার রামচন্দ্রপুর, রামকৃষ্ণপুর, ঘোড়াশাল, ময়নামতি, জালালপুর, মইনপুর এলাকায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পের প্রসার ঘটে।যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খাদির সব ধরণের পোষাকে আধুনিকতা আসলেও খদ্দরের সেই মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবি এখনও আগের জৌলুস ধরে রেখেছে। খাদির পোষাক যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি পরতেও আরামদায়ক।কুমিল্লার খাদি পণ্য বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর চেতনাকে লালন করছে শতবর্ষ ধরে।আমিও তাই উঠিয়ে নিলাম কয়েক গজ খাদি কাপড় একদম সস্তা দরেই।

বিদ্রোহী কবির দৌলতপুর

কুমিল্লায় ঘুরতে গেলে অবশ্যই বিদ্রোহী কবির দৌলতপুর দেখে আসা উচিৎ ।আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছু সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবি। মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুনের গভীর প্রেমে পড়লেন কবি। তিনি আদর করে ডাকতেন নার্গিস। কবি যে ঘরে থাকতেন তার পাশেই ছিল কামরাঙ্গা গাছ। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন 'কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে/ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের/তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে/হায় কে দেবে দাম।' সে সেথায় একডজন কামরাঙ্গা গাছ ছিল। এখন পুরো বাড়িতে ঘুরে মাত্র দুটি কামরাঙ্গা গাছ দেখা যায় যার একটি গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে।

দুটি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এ পুকুরটি ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী। কবি এখানে নিয়মিত সাঁতার কাটতেন।নজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। আর এ গান ও কবিতার বিষয় শুধুই নার্গিস। এখানেই ১৮ জুন ১৯২১ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। বর্তমানে সেখানে আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল স্কুলের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এর পশ্চিমপাশে নজরুল-নার্গিসের বাসর হয়েছিল। বাসর ঘরে ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক ও নজরুল ব্যবহৃত কাঠের সিন্ধুকটিও এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। নজরুলের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নজরুল মঞ্চ পালন করা হয়েছে। পাশে একটি পাঠাগারও রয়েছে।

বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন

১৮৮৫ হালড় ৬ মে প্রতিষ্ঠিত এই ভবন কুমিল্লার গনপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন, যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত।পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, রাজমালা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মনীষীদের রচনাসমগ্র রয়েছে। এখানে  বাংলা ভাষার ২৪ হাজার বই ও ইংরেজি ভাষার ছয় হাজার বই রয়েছে। ৩০ হাজার বই দিয়ে ৬৩টি আলমারি সজ্জিত। টাউন হল ভবনের দ্বিতীয় তলায় যে কেউ গেলে সেখানে অধ্যয়ন করতে পারবেন। টাউন হলের নিচতলায় সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে ৪৪টি জাতীয় আঞ্চলিক, স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকী। যে কেউ চাইলে পুরোনো পত্রিকার কপি দেখতে পারেন।

রসে ভরা রসমালাই

কুমিল্লা শহরের আনাচে কানাচে অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায় রসমালাই।কিন্তু একদম খাঁটি মিষ্টি পেতে হলে আপনাকে ঢু দিতে হবে মাতৃভান্ডারেই।এই নামেই কম করে হলেও পঞ্চাশটি দোকান আছে ।কুমিল্লা রসমালাইয়ের আদি উদ্ভাবক ত্রিপুরা রাজ্যের ঘোষ সম্প্রদায়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তারা অর্ডার অনুযায়ী বাহারি রকমের মিষ্টি সরবরাহ করতো। সেই সময় রসগোল্লার সঙ্গে মালাইকারির প্রলেপ দেয়া এক প্রকার মিষ্টির প্রচলনও ছিল। কেউবা এটাকে মালাই রসগোল্লা বলতো। পরবর্তী সময়ে দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানিয়ে তার মধ্যে শুকনা রসগোল্লা ডুবিয়ে তৈরি করা হয় ক্ষীরসহ রসগোল্লা। এর নাম দেয়া হয় 'ক্ষীরভোগ'। রসমালাইর প্রথম নাম ক্ষীরভোগ। ত্রিশ দশকে এই রসগোল্লার আকার ছোট করে দুধের ক্ষীরের মধ্যে ডুবিয়ে পরিবেশন করা শুরু হয় এবং এর নামকরণ হয়ে যায় রসমালাই । কুমিল্লার কান্দিরপাড় মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী ও কুমিল্লার বিভিন্ন মিষ্টি দোকানগুলোতে রসমলাই, অন্যান্য মিষ্টি ও দধি পাওয়া যায়। তবে উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু রসমলাই পেতে হলে আসতে হবে মনোহরপুরে অবস্থিত মাতৃভান্ডার, ভগবতী দোকান।

এমন ঐতিহ্যে ভরা শহরটিকে কি আর দুই দিনে দেখে শেষ করা সম্ভব ! এখানে কালের স্বাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক নাম করা মসজিদ। শাহ-সুজা মসজিদ, উটখাড়া মাজার , বায়তুল আজগর জামে মসজিদ, নূর মানিকচর জামে মসজিদ ,আরো আছে কুমিল্লার জাহাপুর জমিদার বাড়ি।যদি আবার একটু সময় পাই তবে ঘুরে নেব ধর্ম সাগর, জোড়কানন দীঘি , জগন্নাথ দীঘি , নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ী আর গোমতি নদীর পাড়ে বসে মা-মেয়ে বসে বসে  বাদাম খাব।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া

ছবি কৃতজ্ঞতা কিছুটা গুগল মামার।এতো বড় ফাইল ছোট করতে কষ্ট লাগে তাই…