গারো পাহাড়ে মধুচন্দ্রিমা!

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 22 Sept 2016, 11:11 AM
Updated : 22 Sept 2016, 11:11 AM

হাতের কাছে মাটির ক'খানা গহনাই ছিল, বিয়ে শাদির ব্যপার। কিন্তু মায়ের সোনার গহনায় হাত দেবার আর সাহস দেখালো না মিতা। যদি টের পেয়ে যায় তবে সব প্ল্যান ভেসতে যাবে। শান্তকে বলা আছে মহাখালি কাজি অফিস, ব্রীজের নীচেই থাকতে সকাল  দশটায়। এতো সকালে কাজিরা বিয়ে করাবে কীনা সেটা অবশ্য তাদের জানার কথা না। সদ্য চাকরীতে ঢোকা যুবকের হাতে কতোই বা টাকা থাকে, তাই মিতা বুদ্ধি করে কিছু টাকা হাতে নিয়ে নিল। স্মাক্ষী ছাড়াতো বিয়েও হয়না, কিন্তু মিতার পক্ষ থেকে স্বাক্ষ্য দেবার সাহস কারো নেই। বাবা টের পেলে একদম জানে মেরে ফেলবে।

বাড়ি থেকে শাড়ি পড়ে বের হওয়াও মুশকিল, তাই মিতা ওটা নিয়ে নিল কলেজের ব্যাগে। কোন একটা পার্লারে ঢুকে পড়ে নেওয়া যাবে। দুই দিন বাদে যার অনার্স ফাইনাল সে কীনা বিয়ের আয়োজন করছে ভাবতে একটু ভয় লাগছে। কিন্তু একটা অজানা ভালো লাগা সারাক্ষণ ঘিরে রেখেছে মিতাকে। আর সেই অজানা ভালো লাগার টানেই এবার সে অজানার উদ্দেশ্যে রওনা  দিল। কারণ, সে জানেই না বিয়ের পর আসলে শান্ত তাকে নিয়ে কোথায় থাকবে। বাড়ি থেকে বের হবার সময় বেশি কাপড়ও আনা গেল না, মাত্র দুটো স্যালোয়ার কামিজ সম্বল। আর সাথে কিছু টাকা।

মহাখালি রেল ক্রসিং-এ এসে যথারীতি সি এন জি আটকে গেল, মোবাইল সাথে আনার প্রশ্নই ওঠেনা। তাই শান্তকে কিছু জানানো যাচ্ছেনা। ট্রেন চলে যাবার পর  মিতা  খুঁজে খুঁজে হাজির হয়ে গেল অচেনা সেই কাজি অফিসে, ভেতরে  উঁকি দিতেই শান্তর  চোখে চোখ পড়লো। সে পড়েছে সাদা কালো স্ট্রাইপের ফুল শার্ট আর জিন্স। পাশে দু'জন বন্ধুকে দেখা গেল। বয়স্ক একজন ভদ্রলোক আছেন তাকে মিতা চিনলো না। শান্তই পরিচয় করিয়ে দিল-ইনি আমার সিনিয়র বস, তোমার উকিল বাবা হবেন।

উকিল বাবাকে মিতার ভালোই লাগলো-বেশ হাসি খুশি চেহারার মানুষ। লোকটি মিতাকে একটু আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-তুমি, এই কালো মতোন ছেলেটাকে বিয়ে করছো কেন? মিতা বুঝতে পারলো না কী বলা উচিৎ। কিছুক্ষণ ভেবে বললো-অনার্স পরীক্ষা হয়ে গেলেই বাবা আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে, তাই বিয়ে করে ফেলছি। লোকটা মনে হয় খুব বিরক্তই হলেন-তাহলে পরীক্ষা দিয়ে নিতা।

মিতা আমতা আমতা করে উত্তর দিল-আসলে, ওর পোস্টিং হয়ে গেছে ঢাকার বাইরে, কোন রিক্স নিতে চাচ্ছিলাম না। লোকটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো-অল্প রিক্স ছেড়ে দিয়ে আবার বিরাট রিক্সে ডুবে গেলে কীনা মেয়ে, কে জানে।

এই সময় যেটা হয় মেয়েরা ইমোশনালি রেগে যায়। কিন্তু মিতা মোটেও রাগ করলো না। খুব হাসি মুখেই তিন বার কবুল বলে গেল। দেন মোহর ধরা হয়েছে তিন লক্ষ টাকা, উশুল করাতো অনেক দূরে। শান্তর পকেটে আছে দু'হাজার টাকা। বন্ধুরাই মিলে ঝিলে কাজির  টাকা পরিশোধ করে দিল এবং শান্তর হাতে আরো কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলে দিল-যা, এবার হানিমুন করে আয়।

সারা জীবন হানিমুন নিয়ে  ছেলে মেয়েদের মধ্যে নানান রকম স্বপ্ন থাকে। মিতার স্বপ্ন ছিল মরিসাস যাবে, যেভাবেই হোক সমুদ্র জলে মাখামাখি করে স্বামীর হাত ধরে বসে থাকবে। কিন্তু এই কয়টা পয়সায় মরিসাস কেন মেঘনা ঘাটেও যাওয়া সম্ভব না। তাহলে এখন কী করা যায়, দু'জন প্রাপ্ত বয়স্ত সদ্য বিবাহিত দম্পতি এই ভাবতে ভাবতে মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে এসে হাজির হলো। কতো ধরণের বাস ছেড়ে যাচ্ছে এখান থেকে, কেউ যাচ্ছে ময়মনসিংহ,কেউ নেত্রকোনা, কেউ কেউ টাঙ্গাইল।

স্বপ্নের মধ্যেই যেন ড্রীমল্যান্ড নামে একটি বাস এসে ওদের সামনে থামল। সাথে সাথে শান্ত মিতার চোখ ঢেকে দিল-শোন, এই বাস কোথা থেকে আসছে কোথায় যাবে কিছু পড়তে পারবা না। আমিও জানিনা এটা কোন জায়গার বাস। জাস্ট উঠে পড়ো। সদ্য স্বামী খেতাব প্রাপ্ত কর্তার কথা কী আর অমান্য করা যায়। অবশ্য প্রস্তাবটা মিতার মন্দ লাগেনি। সে চোখ বুজেই উঠে পড়লো, বাসের হেল্পার বা ড্রাইভার কা্রো দিকেই তাকালো না তারা। চোখ দিয়ে রাখলো বাইরের দিকে, লোকাল সার্ভিস হলেও হেল্পার একবারো কোন যাত্রীকে ডেকে তুললোনা। সবাই যার যার মতোন বাসে উঠছে, নামছে। ওরা খেয়াল করছে বাস গাজীপুর ছেড়ে বায়ের রাস্তা ধরেছে। মানে এটা টাঙাইল-ভূয়াপুর-শেরপুরের রাস্তা। কিন্তু বাস  শেষ পর্যন্ত কোথায়  থামবে সেটাই দেখার অপেক্ষা।

প্রায় চার ঘন্টা চলার পর ভর দুপুরে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। বাস এসে থেমেছে শেরপুরে। দুশো দুশো করে মোট চারশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে শান্তর পকেটে আছে আর ছয়শো টাকা। নববধূর কাছে পয়সা চাইতেও তার খুব ইতস্থত লাগছে। এতো দিনের প্রেমিক চোখ, মিতা বুঝে ফেলল। ইশারায় বোঝালো- টাকা আছে। এবার যেন কিছুটা সাহস ফিরে পেল শান্ত। দোকানে নেমে একটা সিগারেট ধরালো- ভাই, এই এলাকায় ঘোরার জন্য সুন্দর জায়গা কী আছে?

দোকানী চায়ে চিনি দিতে দিতে বললো-জমিদার বাড়ী দেখবার পাইড়ুন, আর যদি মেলা টাইম থাকে তাইলে গজনী চইলা যান। গজনী নামটা একদম নতুণ শোনাল ওদের কাছে। প্রশ্ন করলো-কীভাবে যাব?

-বাস আছে, অটো আছে। যেইটা মুন চান লয়া লন। রাস্তা বেজায় ভালা।

ত্রিশ কিলোমিটার পথ অটোতেই দু'জন গুটি শুটি বসে কাটিয়ে দিল, দুপুরের খাবার বাজারেই সেড়ে নিয়েছে। এখন রাত যেখানে সেখানেই হবে কাত। মেঘালয় সীমান্তের দিকে ছুটে চলা রাস্তাটিতে কেউ যেন কার্পেট মুড়িয়ে দিয়েছে। তার দু'ধারে শারি শারি গাছ। যেন এক স্বপ্নমণ্ডিত রাস্তার মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে অজানা কোন দিগন্তে।

গারো উপজাতি ভরপুর গারো পাহাড়ের পাদদেশে স্বচ্ছ পানির হ্রদ ও দিগন্ত ছোঁয়া সবুজ বনানী ঘিরে রেখেছে পুরো এলাকা। সদ্য বিবাহিত দম্পতি হাতে হাত রেখে বিস্ময় চোখে মুগ্ধতার আবীর রঙ্গে চেয়ে দেখছে। গজনী নামক অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ছয় কক্ষের তিনতলা রেস্টহাউস। সমতল ভূমি থেকে অবকাশভবনে ওঠানামা করার জন্য পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় আঁকাবাঁকা 'পদ্মসিঁড়ি'। আরো আছে  হ্রদের পানির ওপর সুদৃশ্য দ্বিতল 'জিহান অবসরকেন্দ্র', লেকের মাঝে কৃত্রিম দ্বীপ ও দ্বীপের ওপর 'লেকভিউ পেন্টাগন'।

গারো পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য আছে আকাশচুম্বী 'সাইট ভিউ টাওয়ার'। কৃত্রিম হ্রদে নৌবিহারের জন্য আনা হয়েছে 'প্যাডেল বোট'। দেশি 'ময়ূরপঙ্খি নাও'ও আছে। আরও আছে  দোদুল্যমান ব্রিজ ও সুড়ঙ্গ পথ। শিশুদের খেলাধূলার জন্য  শিশুপার্ক আছে, তার সাথে আছে  চিড়িয়াখানা,  বন্য হাতির ভাস্কর্য 'মিথিলা' আর মৎস্যকন্যা 'কুমারী'। কৃত্রিম জলপ্রপাতও তৈরি হয়েছে এখানে।

গজনী অবকাশকেন্দ্র থেকে দুই কিলোমিটার দূরে সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এলাকা হিসেবেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। গজনী অবকাশকেন্দ্রে নির্মিত হয়েছে 'স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ'।

গজনীর ভেতরে যখন ওরা পা রাখে তখন সূর্য পাহাড়ের গায়ে নুয়ে পড়েছে। সবুজ সীমান্ত দিয়ে ঢাকা এই জায়গাটি দেখার পর ওদের মনে হলো-পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মধুচন্দ্রিমা এখানেই সম্পন্ন করা উচিৎ। যেমন নির্জনতায় ছেয়ে আছে চারপাশ তেমনি সুস্বজ্জিত সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চল। কিন্তু,এখানে পূর্ব প্রস্তুই ছাড়া  রাত কাটানো সম্ভব না। না হলে রাতে থাকতে হবে শেরপুর শহরে। শেরপুর জেলা শহরে হোটেল সম্পদ প্লাজা, কাকলি গেস্টহাউস, হোটেল বাগানবাড়ি অথবা সার্কিট হাউসে রাত যাপন করা যাবে মাত্র ৫০০ টাকায়। গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রেষ্ট হাউজ রোম ব্যবহার করতে চাইলে (কেবল দিনের বেলার জন্য) জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নেজারত শাখা থেকে অনুমতি ও বুকিং নিতে হয়। প্রতি কক্ষের জন্য ভাড়া ৫শত টাকা। নতুন করে সংযোজন করা হচ্ছে "পবিত্র গজনী কুন্ড"। মাধব কুন্ডের আদলে তৈরি হচ্ছে এটি।

সেখানে যাতায়াতের জন্য রয়েছে দোদ্দুল্যমান ব্রীজ। পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে ৬ কক্ষ বিশিষ্ট বৈদ্যুতিক সুবিধাসহ আধুনিক "দো'তলা রেষ্ট হাউজ"। যে রেষ্ট হাউজ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে নামার জন্য আঁকা-বাকা "পদ্মাসিড়ি" রয়েছে। অবকাশের পাদদেশে সান বাঁধানো বেদীসহ বট চত্বর। পাতাল পূরীর প্রবেশ পথ, পাহাড়ের নীচ দিয়া পাতালপূরীর এই সুরঙ্গ অপর পাশ দিয়ে বের হয়েছে, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রথমটা মিতার খুব ভয় করে, ধীরে ধীরে সেই ভয়টা তার কেটে যায় কারণ শান্তর বিশ্বস্ত হাত তার সামনে।

পাতালপুরী ক্রস করার পর দুই জন দুইজনকে খুব করে জড়িয়ে রাখে কিছু সময়। পরম নিশ্চিত, নিবির বিশ্বাসের আলিঙ্গন।

ক্রিসেন্ট লেকের পাশ দিয়ে দু'জন হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে। এই লেকের রয়েছে একটা দ্বীপ। দ্বীপে যাবার জন্য রয়েছে ঝুলন্ত ব্রীজ, যার নাম রংধনু ব্রীজ, কৃত্রিম জলপ্রপাত, আর লেকে রয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য পানসিতরী নৌকা, প্যান্ডেল বোড ,পাথরকুমারী। একটা সাইট ভিউ টাওয়ার রয়েছে  ৮০ ফুট উচ্চতায়। দু'জন টাওয়ারের উপর উঠে গেল, বিস্ময়ে দু'চোখ যেন স্তম্ভিত। পাহাড়ি টিলা আর চারপাশের নিঝুম দৃশ্য যেন মিলেমিশে একাকার। একদিকে পাহাড়ী ঝর্ণার ঝিরঝির শব্দ আর অন্য দিকে পাখির কলকাকলি। উত্তরে তাকালে তুরা পাহাড় স্পট দেখা যাচ্ছে ।মনে হবে, তুরা পাহাড় যেন, হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

পাহাড়ের গায়েই হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু অন্ধকার নেমে আসছে ক্রমশ। শহরে ফিরতে হবে। গারো পাহাড়ের বুকে একটি কপোত-কপোতী যে স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে তা যেন থাকে আজীবন।

আপনারা যারা এখনো গজনী যাবেন ভাবছেন, তাদের জন্য কিছু তথ্য।

যারা ঢাকা থেকে যাবেন তারা মহাখালী থেকে সহজেই এসি বাসে উঠে যেতে পারেন। মহাখালী থেকে দুপুর ২টায় ছাড়ে এসিবাস। ভাড়া ৪-৫শত টাকা। শেরপুর নেমে নিউমার্কেট থেকে ভাড়ায় মাইক্রোবাস ৫শত থেকে ১হাজার টাকায় সোজা গজনী যাতায়াত করা যায়। শেরপুর থেকে লোকাল বাসে অথবা সিএনজিতে ঝিনাইগাতী আবার ঝিনাইগাতী থেকে সিএনজি অথবা অটোরিক্সায় গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যাওয়া যায়।

শেরপুর শহরে রাত যাপনের জন্য ৫০ থেকে ৫শত টাকায় গেষ্ট হাউজ রুম ভাড়া পাওয়া যায়। শহরের রঘুনাথ বাজারে হোটেল সম্পদ, বুলবুল সড়কে কাকলী ও বর্ণালী গেষ্ট হাউজ, নয়ানী বাজারে ভবানী প্লাজাসহ আধুনিক মানের থাকার হোটেল রয়েছে। এ ছাড়া অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে পারেন সার্কিট হাউজ, সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, পল্লী বিদ্যুৎ কিংবা এটিআই রেষ্ট হাউজে। ঝিনাইগাতী ডাকবাংলো অথবা বন-বিভাগ ডাকবাংলোতেও থাকতে পারবেন। তবে থাকা-খাওয়ার জন্য ঝিনাইগাতী সদর অথবা শেরপুর শহরে চলে আসাই উত্তম। আর ভাল মানের খাবার পাবেন ঝিনাইগাতীর হোটেল সাঈদে, শেরপুর শহরের নিউ মার্কেটে হোটেল আলিশান হোটেল শাহজাহান, হোটেল আহার কিংবা কাকলী মার্কেটের হোটেল প্রিন্সে। এসব হোটেল অগ্রিম বোকিং ও অর্ডার সরবরাহ করা হয়।

পুনশ্চ: যারা হুট করে বিয়ে শাদি করে ফেলেন তাদের প্রতি অনুরোধ, শান্ত আর মিতার মতোন এমন আচমকা সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। আগ থেকে যদি বুকিং দেওয়া থাকতো তবেতো গারো পাহাড়ের বুকেই কাটানো যেত জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। শান্ত আর মিতার ছবি দেওয়া সম্ভব নয় বিধায় গুগল থেকে ছবি দিলাম।