মানের বিচারে নয়, তবু বই এখন কোটি টাকার ব্যবসা

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 3 March 2017, 03:55 PM
Updated : 3 March 2017, 03:55 PM

বইমেলার শেষ লগ্নে যখন ভিড় ঠেলে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম তখন পাশে থাকা বন্ধু জিজ্ঞেস করেছিল-এবার কতো টাকার বই বিক্রি করলে? প্রশ্নটা শুনে একেবারেই হকচকিয়ে গেলাম আমি, হেসে উত্তর দিলাম-আমি কেন বই বিক্রি করবো, বই প্রকাশ করেন প্রকাশক; সুতরাং সেটা তার দায়িত্ব। উত্তরটা তার মোটেও পছন্দ হয়নি, কারণ এটা সম্পূর্ণ সেলফ মার্কেটিং-এর যুগ। এখানে বই লিখেন লেখক, প্রুফ দেখেন লেখক, প্রচ্ছদের জন্য ডিজাইনারের পেছনে ঘোরাঘুরি করেন লেখক, বিজ্ঞাপন দেন লেখক এবং সব চাইতে মজার বিষয়- বইয়ের সমস্ত খরচা বহন করেন কতিপয় লেখক। অতএব, বই মেলায় স্টলের এক কোনায় দাঁড়িয়ে তাকে নিজ বইয়ের উপর অটোগ্রাফ দিয়ে পাঠক টানতেই হয়। এটা যে কেবল উঠতি লেখকরা করেন, তা নয়। অনেক পরিচিত মুখও এই ভিড়ের মধ্যেই আছেন।

অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্ভাবনের ইতিহাস ঘাটলে উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায় অনেক অজানা তথ্য। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিলো চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এই বইগুলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের প্রথম অবদান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমীকে মেলার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মেলার সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি; এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন সম্পন্ন করেন। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দু'জন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়, সেই ৩২টি বইয়ের ক্ষুদ্র মেলা কালানুক্রমে বাঙালির সবচেয়ে স্বনামধন্য বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দ্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।

উপরের গল্পটিতে এক নজর চোখ বুলালে আর ২০১৪ সাল অব্দি বইমেলার দৃশ্য অনুধাবণ করলে -এই বিষয় একেবারেই পরিষ্কার যে বইমেলা আদৌ কোনো বাণিজ্যিক ফায়দা নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো না তখন। তখন সেটা একেবারেই প্রাণের মেলাই ছিল, কিন্তু বছরের পর বছর মানুষের অতিরিক্ত চাহিদা এবং বৈষয়িক চিন্তা থেকেই বইকে এখন শুধুমাত্র একটা পণ্য ছাড়া বেশি কিছু ভাবছেন না বেশির ভাগ প্রকাশক। মনে হচ্ছে এটা একটা সিজন্যাল ব্যবসা, বছরের মাত্র একবার যেমন আম ধরে গাছে, সেটাকে জমিয়ে রেখে শীতের মৌসুমে বিক্রি করে অনেক লাভজনক বাণিজ্য করেন -ব্যাপারটা তাই। সারা বছর ধরে পান্ডুলিপি জমা হতে থাকে, এলেবেলে অনেক কথা লিখে কিছু কিছু উদ্ভট টাইপের সংলাপ জুড়ে দিয়ে পান্ডুলিপি তৈরি করে প্রকাশকের ই-মেইল এড্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রকাশক ভালোই জানেন-এই মানুষকে দিয়ে কী আর লেখা সম্ভব, তাই তারা সেটা পড়ে দেখবার প্রয়োজন মনে করেন না। দরকার হলে দু'চারটা প্রশ্ন করে নেন-সরকারের বিরুদ্ধে কিছু লেখা নেই তো? জগতের সমস্ত ধারা এখন একটি জায়গায় কেন্দ্রিভূত। আপনি সরকারের সমালোচনা করে লিখলে খুবই নিম্ন মানের লেখক  আর আরাম করে প্রেমের উপন্যাস লিখে দিন দেখবেন আপনার উচ্চতা কেমন বেড়ে যায়। শুধু প্রেম না, বেছে বেছে কিছু সরকার ঘেষা নেতাদের জীবনী নিয়ে সাত ফর্মা লিখে ফেলুন, দেখবেন প্রকাশক কেমন লুফে নেয়। আর লিখতে না পারলে, বিভিন্ন জায়গা থেকে কপি করে পেস্ট করে দেন। এই বই কেউ প্রকাশের আগে পড়ছে না, তাই না ছাপা হবার কোনই সম্ভাবনা নেই। কী দেশের ভেতর, কী দেশের বাইরে নগদে ভরে দিন প্রকাশকের পকেট -দেখবেন আপনার কাঁচা হাতের লেখা ছাপা খানায় কী দূর্দান্ত ভাবে পেকে পেকে বের হচ্ছে ।

প্রকাশকদের আর কিবা দোষ, ডিজিটাল সময়ে ফেসবুকের কল্যাণে এখন সবাই কবি, সবাই প্রাবন্ধিক, আবার কেউ কেউ কলামিস্ট। আমি এমন একজন কলামিস্টকে বলেছিলাম – ভাই তারাশংকরের পথের ডাক বইটা কি আপনার কাছে আছে? তিনি বিস্মিত নয়নে উত্তর দিয়েছিলেন – তিনি কই থাকেন? আমি চোখ বুজে খুঁজতে লাগলাম তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ -এমন আরো অনেক সাহিত্যিকের বাড়ির ঠিকানা।

আমি এতো দূরে কেন যে যাচ্ছি, হুমায়ূন আহমেদ, আনিসুল হক, জাফর ইকবাল এই গণ্ডির বাইরে যাদের চিন্তা কোন দিন যায়নি তাদের যদি জিজ্ঞেস করি মহাদেব সাহার কোন কবিতাটা আপনাকে বেশি ভাবিয়েছে লেখার সময়, তাহলে আমার নিজের গালেই চপেটাঘাত করা উচিৎ। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিদের নাম এখন অনেক উঠতি কবি জানেন না। ছোটবেলা থেকে শিখে এসেছি – লিখতে হলে পড়তে হবে। এখন কেবল জানছি- লিখতে হলে নেট থাকতে হবে ।

এবার মাসব্যাপি বইমেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ড. জালাল আহমেদ বলেন, ২৮ দিনের মেলায় নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৬৪৬টি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মোট ৮৬৭টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন ৩৬৪৬টি বইয়ের মধ্যে ৮৫৮টি মানসম্পন্ন বই এবার মেলায় এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি আশার কথা। এক মাসের গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে ৮৫৮টি মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকাশ সহজ কথা নয়।

বাকী ২,৭৮৮টি বইয়ের কাহিনী তাহলে আমরা কিভাবে নির্ণয় করবো জালাল আহমেদ তা বলেননি। আর ঐ যে ৮৬৭টি মানসম্মত বই কি কমিটি পড়ে দেখেছেন, নাকি কেবল লেখকের মানের উপর নির্ভর করছে বইয়ের মান? যেই লেখকের ওজন যতো বেশি বইয়ের ওজনটাও ততো বেশি।একজন লেখকের সব বছর যে মানসম্মত লেখা হবে তার কিন্তু  নিশ্চয়্তা নেই। আমার অনেক প্রিয় প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের সব উপন্যাস কিন্তু আমার সমান ভালো লাগেনি। বইয়ের মান নির্ভর করছে -বিষয়বস্তু এবং কাগজ-প্রচ্ছদ এই সব কিছু মিলিয়ে অন্তত আমার চোখে।একটা বই হাতে নিয়ে বিচক্ষন পাঠক বুঝে যান বইয়ের ভেতর কী আছে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি না পড়ে কি কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব ছাপার পর তা আদৌ মান সম্মত হবে কীনা! আর ২,৭৮৮টি বই কারা পড়ে দেখবে?

আমার তো মনে হয়, বইমেলা কেবল এক মাসের টার্গেট দিয়ে কমিটি গঠন করা মোটেও ঠিক নয়। মেলার অন্তত তিন মাস হাতে রেখে সব প্রকাশনার কাছ থেকে পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে কমিটির সদস্য নির্নয় করতে হবে সেগুলো পড়ে দেখবার জন্য। ছাপার যোগ্য হলে ছাপতে বলবেন, আর যদি মনে হয় অযোগ্য তবে অবশ্যই জানিয়ে দেবেন লেখা পরার উপযুক্ত করে লিখতে। না হলে একটা সময় দেখা যাবে -এই দেশে সবাই লেখক হয়ে বসে আছে, কেউ কারো লেখা পড়ছে না। বই বেশি বিক্রি হচ্ছে তার মানে এই নয় যে মানসম্মত পাঠক বৃদ্ধি পেয়েছে, জনসংখ্যা ও মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বাড়ছে- এটা তার একটা সাংঘাতিক প্রমাণ। আর যারা আসলেই বই কিনে পড়েন তারা তেমনি আছেন, তারা বইমেলার আগেই কাগজে কলমে লিখে নেন কার কার নতুন বই এসেছে এবং কোন স্টলে পাওয়া যাবে।এই দেশে আর প্রিয় লেখকের পোস্টার মেলা প্রাঙ্গণে দেখা যায় না।

একজন লেখক যদি পেশায় ডাক্তার বা উকিল হন তাহলে প্রতি বছর তার ক্লায়েন্ট বাড়বেই -এটাই স্বাভাবিক। আর তারা লেখকের বই কিনে ধন্য করবেন এটা অস্বাভিক কিছু নয়। আমাদের দেশের এমন একজন লেখক তৈরি হননি -যিনি কীনা কেবল লেখার পেশায় নিজেকে তৈরী করতে পেরেছেন। আমাদের যদি এতো মানসম্মত বই থাকতো তবে নিশ্চই বই প্রকাশ করেই লেখকরা পেটে ভাতে সংসার চালাতে পারতো। তাদের পেট চালানোর জন্য অন্য পেশার আশ্রয় নিতে হতো না। বিশ্বের বহু দেশে বই আসার আগেই সেটা নিয়ে পত্রপত্রিকায় আলোচনা হয়, লেখকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আর এখানে নিজের বইয়ের রিভিউ নিজেই লিখে পত্রিকাওয়ালাদের পেছন পেছন চা খাওয়ানোর দাওয়াত দিতে হয়। এতো লেখক! পত্রিকাওয়ালারা তাল সামলাতে পারছে না। আর টিভি মিডিয়া ছুটছে কন্ট্যাক্ট লেখকদের পেছনে। হুম! এদেশে চুক্তিভিত্তিক লেখকও পাওয়া যায়, এই গল্প আর একদিন করবো।

কাহিনী যা হোক, আমার এবারের ভ্রমণ গল্প -পিয়াইন নদীর স্রোতে যা কীনা বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে ঘিরে লিখেছিলাম সেটা প্রকাশ করতে করতে জয়তী প্রকাশনীর ২০ দিন পার হয়ে গেছে । আমি এই বইতে এমন কোন তথ্য বা ছবি দেইনি যা কীনা প্রেসে উঠতে এতো সময় লাগবে। গত বছরের ডিসেম্বরেই পান্ডুলিপি পায়েলকে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু বেচারা এতো বইয়ের দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছিল যে সেটা দেখার অবকাশই পায়নি। আর দেড়শো বইয়ের এডভান্স করেছি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই, প্রতি বছর আমি নিজের জন্য বই কিনে রাখি। কারণ, মেলা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো আর পাওয়া যায় না। তাই বলে এটা ভেবে নেবার কোন অবকাশ নেই যে আমার বই ডজন ডজন বিক্রি হয়ে গেছে। মনে রাখবেন, পুরো বইমেলায় আপনার ক'খানা বই বিক্রী হয়েছে সেটা জানতে হলে আপনাকে একজন স্পাই বসাতে হবে। তাই আমি এখন কিছুই জানতে চাই না, নিজের বইয়ের অর্ধেক খরচ নিজেই দিয়ে রাখি।

কিছু ভালো খবর পেয়েছি কালের কন্ঠ থেকে, তাই দিয়ে শেষ করছি । ২০১৬, ২০১৫ ও ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি যথাক্রমে বই বিক্রি করেছে ১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা, ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৫৮ টাকা ও ১ কোটি ১৮ লাখ ৯ হাজার ১৭৬ টাকা। নীতিমালা ভঙ্গের জন্য ১৯টি স্টল চিহ্নিত করা হয়েছে উল্লেখ করে ড. জলাল বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলার নীতিমালা ও নিয়মাবলি লঙ্ঘন করায়, টাস্কফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির বিরুদ্ধে নীতিমালার ৬.১ ধারা অর্থ্যাৎ বিদেশি বই বিক্রির এবং ৯টির বিরুদ্ধে নীতিমালার ১৩.১৩ ও ১৩.১৪ ধারা লঙ্ঘন অর্থাৎ পাইরেটেড বই বিক্রির অভিযোগ টাস্কফোর্সের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।

আমি এখনো আশা করে আছি যে এদেশে পাঠক সংখ্যা বাড়বে ।সবাই সেলফি করতে বই মেলায় ভিড় করবে না, লেখকরা কেবল ফেসবুকে দু'চার কলম লিখেই ক্ষান্ত হবে না। বই বিক্রির জন্য গ্রুপ বানিয়ে বিরানি খাওয়াবে না, বই প্রকাশের আগেই বইটি সম্পর্কে আমরা তথ্য পাব, আরো অনেক কিছু স্বপ্ন আমার দু'চোখে। কারণ লেখকদের স্বপ্ন দেখতে জানতেই হয় ।

বইমেলা নিয়ে গত বছরে আমার লেখা –http://blog.bdnews24.com/rodela01/181287

পিয়াইন নদীর স্রোতে -মোড়ক উন্মোচন করেন নাট্যকার ও পরিচালক-ফেরদৌস হাসান এবং বাংলাদেশ অনলাইন মিডিয়া এসোসিয়েশনের আহবায়ক মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ ।