আধুনিকতার ফ্রেমে বন্দী সময় এবং অচেনা মিরপুর 

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 21 April 2017, 07:26 PM
Updated : 21 April 2017, 07:26 PM

শহুরে সকালগুলো বড্ড বেশি একঘেঁয়ে, প্রতিদিন সেই ময়লাওয়ালার ডাকাডাকি। এই ডাকাডাকির মধ্যেও কোন বৈচিত্র নেই, দরজার বাইরে প্রতিদিন ঝুড়িতে ময়লা দেওয়াই থাকে। তাও তারা কেন জানিনা দরজায় সজোরে একটা ধাক্কা দিয়ে অদ্ভূত কন্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠে-এই ময়লা দেন। প্রায়ই আমি দরজা খুলে চোখ বড় বড় করে রাগত দৃষ্টিতে তাকাই, কিন্তু আজ আর উঠলাম না। এমনিতেই রাতে বৃষ্টি হয়েছে খুব, চট্টলা ভেসে যাচ্ছে দেখলাম টেলিভিশনের বদৌলতে। তার কিছু রেশ এই রাজধানীতেও আছে, সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার।

শুক্রবার বলে কাজে যাবার এমন কোন তাড়া নেই। বাড়ির বাচ্চারা সকাল সাতটা বাজতেই নাচানাচি শুরু করেছে। স্কুলে যাবার জন্য  তৈরী না হতে হলেও, ভোরে আধ ঘুম পেড়ে ওঠাটা এখন তাদের মগজে। আমি যতোই বলি-ঘুমাতো, আজ স্কুল নাই। আরা ততোই আন্দোলন করে-বেড়াতে যাব, বেড়াতে যাব। এ আর এক বিরাট হুমকি – এই শহরে আবার বেড়ায় কোথায়। এমন কোন জায়গা আছে যেখানে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে গায়ে দিব্যি হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো যায়!

শহরের মাঝখানে যে সমস্ত উপাদান দিয়ে চিত্তবিনোদন করার পাঁয়তারা করা হয়েছে তার নাগাল অব্দি পৌঁছতেই বাবা মায়ের চিত্ত জ্বলে যাবার দশা। আজকাল সিএনজি হয়েছে সোনার হরিণ আর উবার নামক এক খানা সার্ভিস চালু হয়েছে যা কীনা আবার ঢাকার আশেপাশের এলাকাতে যায় না। আর বাসের কথা নতুন করে কীবা লিখবো, ওটায় এখন কেবল বাদুররাই চড়তে পারে, মানুষ পারে না। আর যদিও বা প্রাইভেট কার নিয়ে কোথাও যাবার কথা একবার কেউ ভাবে তবে তার গাড়ির তেল কেবল শেষ হবে ওই বড় রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে। চিত্ত আর বিনোদিত হবে না, ভূপতিত হবে।

আজ একটা কথা খুব মনে পড়ছে, তখন আমার মেঝখালা আমেরিকা পিএইচডি করতে  যাবে; বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে স্কলারশিপ পেয়ে গেছে। আমি বোধহয় এইট কি নাইনে পড়ি, ঠিক মনে নেই। আমি খুব করে খালামনিকে ধরলাম – আমাকে জাদুঘর দেখাও। আন্টি মনে মনে কিছু হিসেব কষে নিল, হয়তো রিক্সা ভাড়া আছে কীনা তাই চিন্তা করে নিল। তারপর সেজ খালাকে সাথে নিয়ে একটা রিক্সায় উঠে বসলাম, দুই কন্যা রিক্সার সিটে আর এক কন্যা উপরে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মিরপুর থেকে শাহবাগ পৌঁছতে মাত্র সময় লেগেছিল আধ ঘন্টা। আর এই যে তিন জন মেয়ে একসাথে রিক্সায় ঘুরছি পাশ থেকে কোন উটকো ছেলেকেও দেখিনি কোন বাজে কথা বলতে। ওই সময় বাজে লোক জন্মায়নি এমন তো নয়, কিন্তু আমাদের চলাফেরা খুব স্বাভাবিক ছিল কিংবা হামলে পড়ার মতোন লোকের অভাব ছিল। আমি নিজেই বড় রাস্তায় সাইকেল চালাতাম বিকেলে, কিন্তু আমিই আমার মেয়েকে এখন দেব না।

আমার খালা বুয়েটে ক্লাস করতে যেত শার্টপ্যান্ট পড়ে যদিও তিনি এখন হিজাব করেন ওই দেশে চলে যাবার পর। আমরা এখন বাসে উঠতে দশ বার দাঁড়িয়ে চিন্তা করি- এই বাসে ওঠা যাবে কীনা। কিংবা উঠলে কী কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। অনেক মেয়েরা ব্যাগে ব্লেড পর্যন্ত রেখে দেয় নিজেদের সেইফটির জন্য, আর আমি নিজে একলা কোথাও গেলে সিএনজিতে চড়ি না, দূরে গেলে সাথে কাউকে নেই। আমিই নিজেই যখন নিজের নিরাপত্তা দিতে পারি না, সেখানে বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কোন সাহসে বের হবো।

শুক্রবার হলে কন্যাকে নিয়ে ঘুরতেই হয়, এটা এখন একটা নিয়ম হয়ে গেছে। সারা সপ্তাহ সে আশা করে থাকে। মেট্রোগাড়ি চলার উপযুক্ত করবার জন্য পানি- গ্যাস সব বন্ধ হয়ে আছে, তাই ভাবলাম আমি-আম্মা-অদ্রি তিন কন্যা বাইর খেয়ে নেব। কোথাও পিকনিক হচ্ছে কীনা সেই খবরো নিয়ে নিলাম ফেইসবুকে। এই গ্যাস না থাকাটা সবার জন্য এতো আনন্দদায়ক ছিল না। যে জীবন ধারন করে চুলোর আগুন পুড়িয়ে তার পক্ষে তো আর খাবার দোকানের ভিড়  ঠেলা সম্ভব নয়। সব চাইতে ভয়ংকর বিপদে পড়েন বাড়ির গৃহকর্তীরা ,সাহেবরা আজ নামাজ শেষ করেই টেবিলে খাবার চান; কিন্তু বেলা বারটার গ্যাস যখন বেলা তিনটায় আসে তখন কর্তা বাবুর রেস্টুরেন্টে ছোটা ছাড়া আর গতি থাকে না। মাসিক বিলের সাথে আর একটা বিল যোগ হয় ।

চোখের সামনে আমার খুব চেনা শহরটি ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কলেজে যাবার সময় যে রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে যেতাম সেখানে এখন বাসের ডিপো হয়েছে ।আগে পাড়ায় বের হলে চাচাদের সালাম দিতে দিতেই মুখ ব্যাথা হয়ে যেত আর এখন কেউ জানেই না-এখানেই জীবনের  ত্রিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। বৃষ্টি হলেই ছাদে গিয়ে ভেজার নেশা আমার চিরকালের ,আগে যেতাম কেবল একটি তাওয়াল হাতে করে আর এখন বৃষ্টি হলে ছাদে উঠি মোবাইল হাতে। কারণ বৃষ্টিতে ভিজলে চারপাশ থেকে হাজার মুখ উঁকি দেয় অ্ট্টালিকা থেকে, আমাদের বাড়ি আমরা ডেভেলপারকে দেইনি। পাঁচ তলাতেই এখনো আটকে আছি, তাই বৃষ্টির ফোটা ক্যামেরা বন্দী করি। এই পূর্ণ বয়সে আমি আর বৃষ্টিতে বন্দী হতে পারি না, নিয়ম আমাকে অনেক আগেই বন্দী করে ফেলেছে।

আমি বার বার অযথাই এই সব নিয়ম থেকে বের হবার চেষ্টা করেছি ,বার বার আধুনিক হবার চেষ্টা করেছি ,অনলাইন খুলে দেখতে চেয়েছি -প্রগতিশীল মানুষের মুখ ।কিন্তু এখনো সেই একই সাম্প্রদায়িকতা রয়ে গেছে ইথারের পাতা জুড়ে যেখানে এখনো ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ চলে, আজান নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়, তারকাদের ব্যক্তিগত জীবন হয় স্পটলাইট। আমি আমার এই মান্ধাত্তার জীবন থেকে আর বের হতে পারি না। এই বারশো স্কয়ারফিটের  ভেতরেই আটকে থাকে আমার ভাবনা। কেবল চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলার বন্ধুদের মুখ-সুরভী, বিনু, সীমা বা স্নিগ্ধা – কে নামাজ পড়তো বা কে বিয়ের পর সিঁদুর চড়িয়েছে কপালে আমার কোন দিন জানতে ইচ্ছে করেনি। কন্যাকে ঠিক মতোন কি শেখাবো, আমি নিজেকেই নিজে শেখাতে পারিনি না এক বিন্দুও।