আধুনিক সাংবাদিকতায় ভরপুর আজকের ফেসবুক

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 8 July 2017, 09:19 PM
Updated : 8 July 2017, 09:19 PM

সাংবাদিকতা, খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পেশা। একটা সময় ছিল কলেজ জীবন পার করেই মেধাবি ছাত্র ছাত্রীরা জার্নালিজমে পড়ার জন্য খুব আগ্রহি হয়ে উঠতো তা সেটা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই হোক অথবা বেসরকারি। দিন দিন ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া যেমন বেড়েছে প্রেস মিডিয়াও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আর অনলাইন পোর্টালগুলো সাংবাদিকদের জন্য নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। অবশ্য অনলাইন পোর্টালের ব্যাপারে সরকারের সব সময় বাড়তি একটি দৃষ্টি থাকে, কারণ এখানে সমস্ত নিউজ খুব দ্রুত বিশ্বের যে কোন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে আজকাল নতুন একটি মিডিয়া এই দেশে চালু হয়েছে। সেটা হচ্ছে ফেইসবুক মিডিয়া ।এই ওয়েবের মাধ্যমে ঘরে বসে থাকা অনেক স্বঘোষিত সাংবাদিক নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে, পছন্দ -অপছন্দ সব কিছু শেয়ার করেই কেবল ক্ষান্ত হয়ে বসে থাকেন না; রীতিমতোন তার মনের মতোন করে ছবি সহকারে নিজস্ব মতামত লিখে ফেলেন  এবং সেই অনুযায়ী কী ধরণের পদক্ষেপ নিলে কী কী হতে পারে এই সংক্রান্ত বিস্তারিত আলাপ করতেও ভুলে যান না। সে দিন কে যেন বলছিল- নারে আপা, পত্রিকা পড়ার আর সময় পাই না, সব খবর তো ফেইসবুকেই পাই। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে, যারা এই সব মনগড়া কথা লিখে যাচ্ছে তারা সাংবাদিক আর ফেইসবুক তাহলে পত্রিকা। তারা যা লিখছে তাই আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? আশ্চর্য হলেও সত্যি শিক্ষিত মানুষ তাই বিশ্বাস করছে।

টিভি অভিনেতা কল্যানের  গাড়ির দূর্ঘটনায় প্রথম আলোর সাংবাদিক জিয়া আহত হয়েছিল কীনা সেটা আমরা তখন কেউ জানতাম না ।কিন্তু ফেইসবুক স্ক্রল করতেই দেখা গেল সাদা গাড়ির পাশে কল্যাণের ছবি দিয়ে ফেইসবুকের আধুনিক সাংবাদিক নাকি সাংঘাতিক (!!) ভরিয়ে ফেলছে পাতার পর পাতা। তার নীচে অশ্রাব্য গালিসহ আরো কতো কী যে কমেন্টস তা পড়ে শেষ করতে পারিনি। কিন্তু তারপর যা হবার তাই হলো, পুলিশ আজো সেই সাদা গাড়িকে শনাক্ত করতে পারেনি  আর কল্যাণ যে অপরাধী তাও কেউ প্রমাণ দিতে পারলো না।

এরই মধ্যে তাণ্ডব ঘটে গেল গুলশানের হলি আর্টিজনে, ডিজিটালে বুঁদ হয়ে থাকা মানুষগুলো কেউ জানতেই পারলোনা ভেতরে আসলে কি হচ্ছে। এই কথা সেই কথা, এই ভিডিও সেই ভিডিও এতো সবের মধ্যে ফেইসবুকে শেয়ার হয়ে গেল একজন বাবুর্চির ছবি যে ভুল করে জঙ্গি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়েছে। টেলিভিশন বা পত্রিকায় একটা ছবি যদি ভুল করেও আসে তার পরদিন ক্ষমা চেয়ে নেবার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু কোটি জনতার ফেইসবুক আইডি থেকে একজন নির্দোষ মানুষের ছবি যে হারে শেয়ার দেয়া হয় তাতে কে কার কাছে ক্ষমা চাইবে তা নির্নয় করবে কে? ঘটনা যা হয়; পরিবারের উপর অন্ধকারের তীব্র ছায়া নেমে আসে।

এরপর এলো বনানীর রেইন্ট্রিতে দুই নারীর ধর্ষণ। এবার তো ভয়াবহ রূপ নিল ফেইসবুক। হোম পেইজে কেবল ধর্ষনকারীর ছবি, ভিডিও, আপন জুয়েলার্স, রেইন্ট্রি, চারজন নায়িকা, উপস্থাপিকা, ইউটিউবে আপলোড হতেই থাকলো ধর্ষিতার সাক্ষাতকার। সাংঘাতিকদের অধিক আগ্রহে বাড়িওয়ালা ধর্ষিতার পরিবারকে বলে দিল-আপনারা আর আমার বাড়িতে থাকতে পারবেন না, বাড়ির সামনে সাংবাদিক ঘোরাফেরা করে। আসলে একটি প্রয়োজনীয় খবর নেবার জন্যই সত্যিকার সাংবাদিক মানুষের বাড়ির কাছে কিংবা অফিসে গিয়ে ওঁত পেতে থাকে, এটাকে আমরা এসাইনমেন্ট বলি। কিন্তু বাড়িতে বসে বিনা এসাইনমেন্টে যারা এই ধরণের কাজ করে তাদের আসলে কী নাম দেওয়া যায় তা ভাব্বার বিষয়। শুধু কিউরিওসিটির জন্য অনেক লোকের ভিড় ছিল সেই বাড়ির সামনে। ঘটে যাওয়া ঘটনা সুরাহা হবার আগেই এতো বেশি এটাকে নিয়ে কচলানো হয় যে আসলে কোনটা যে অপরাধ সেটাই বোঝা যায় না। আপন জুয়েলার্সের চোরা সোনা আমদানি বেশি বড় অপরাধ নাকি তার সন্তানের ধর্ষণ ক্রিয়া সাধন বেশি গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল? কেউ কেউ তো লিখেই ফেলেছেন-ছিঃ আপন জুয়েলার্স দিয়ে মেয়ের বিয়েই দেব না।

রেইন্ট্রিতে কয় বোতল মদ পাওয়া গেছে তা নিয়েও এসেছে স্ট্যাটাস। আমি বুঝি না একটা আবাসিক হোটেলে মদ না, মধু বিক্রী হবার কথা ছিল কি? যে কাজগুলো পুলিশ বা ডিটেক্টিভ করা দরকার ছিল সেই কাজের চাইতে বেশি কাজ আমরা ঘরে বসে সোস্যাল মিডিয়ায় করে ফেলি। একবার পয়লা বৈশাখে নারীকে উত্যক্তকারী চিহ্নিত করে দিয়েছিলাম বলেই বার বার যে তা হবে ঘটনা তা নয় । মনে রাখতে হবে হাজার ছবি শেয়ার দিলেও কুমিল্লার তনুসহ আরো অনেকের বিচার হয়নি এই বাংলাদেশে। একটি ঘটনা ঘটে যাবার পর তার নিরীহ পরিবার এর সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে যায়। ভাবুন তো, আপনার ঘরের কোন ঘটনা সোস্যাল মিডিয়ায় ছবিসহ সয়লাব হলে কি আপনার তা ভালো লাগবে? সাংবাদিকতা তো সবার কাজ নয়, যে কাজটা যার যতোটুকু করা দরকার তাকে ততোটুক করতে দেওয়াই ভালো ।

এখন আসছি ফরহাদ মজহার প্রসঙ্গে। এই ঘটনা নিয়ে স্বয়ং আইজিপি নিজেই কনফিউজড। তাহলে আমি বা আমরা কেন তার পরিবারের ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিচ্ছি- সবটাই কবির নাটক? সে নাটক করলেই কী এতে তার পরিবার সম্পর্কিত কোন ছবি আমরা দিতে পারি? এতে তার স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে, তাদের আলাদা সামাজিক মর্যাদা আছে। বনানীতে আবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; মেয়েদের রাতে জন্মদিনে যাওয়া ঠিক না তা আপনার বোনকে বোঝান, বৌকে বোঝান, সোস্যালি আপনি তো জোর করে অন্য কারো ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। সবার আলাদা আলাদা মত থাকবেই, ঘটনা যার তাদের আগে বুঝতে দিন, তারাই আগে সামলাক। এতো জ্ঞান দিতে থাকলে কখোন না আবার আপনার নিজের ঘরের বৌটাই হাত ছাড়া হয়ে যায় অথবা আপনার ছেলেটাই না আবার জন্মদিনের পার্টি করে বসে কে জানে!

একবার ভাবুন, আমরা সঙ্গীর সাথে যখন সহবাসে লিপ্ত হই তখন কি লিখে দেই -মধুচন্দ্রিমায় বিছানায় ব্যস্ত? তাহলে, মানুষ হিসেবে আমাদের কতোটুকু অন্যের কাছে তথ্য পৌঁছানো উচিৎ সেটা ভাবতে হবে। মৃত বাবা -নানা-চাচা যেই হন না কেন তার নিথর দেহের ছবি আমরা শেয়ার দিতে পারি না, দিতে হলে তার একটি হাসি মাখা সুন্দর ছবি দেই। তিনি বেঁচে থাকলে তার কুৎসিত বা অসুস্থ অবস্থার ছবি নিজেই শেয়ার দিতেন না। তবে আমরা কী হিসেবে দিচ্ছি? একজনের প্রতি আর একজনের অধিকার মানে কিন্তু তার আত্মসন্মান কিনে নেওয়া নয় কখনোই, জীবিত থাকতে আমি আপনি নিজে কোন দিন ফেসবুকে অসুন্দর ছবি দেই না, তাহলে অসুস্থ মানুষ যে আইসিইউ-তে পড়ে থাকে তার ছবি শেয়ার দিয়ে বন্ধুদের কাছে দোয়া চাওয়া এ কোন ধরণের তথ্য পাচার?

সাংবাদিক হিসেবে যেমন তথ্য ভেরিফিকেশনের একটা সুযোগ থাকে, অনলাইন একটিভিস্টদেরও কিছু দায় আছে সমাজের কাছে। চোখের সামনে কোন নিউজ পড়া মাত্র নিজের মনের মতোন ক্যাপশান দিয়ে তা ছেড়ে দেওয়া ঠিক না। অনেক বোকারাই এটাকে সঠিক নিউজ বলে মনে করে। দেশে মোবাইল কোম্পানিগুলো হয়তো ইন্টারনেট সহজলভ্য করে দিয়েছে, কিন্তু শিক্ষিতের হার এতো বাড়েনি যে কোন ছবি শেয়ার দেওয়া যায় আর কোন ছবিতে বন্ধুকে ট্যাগ করতে হবে সেটাও গ্রামীণ শিখিয়ে দেবে। তারা বাণিজ্য করতে এসেছে  করুক,আমরা কেবল আমাদের মনুষত্বকে কাজে লাগাই। নিজের ছোট বাচ্চার এমন কোন ছবি শেয়ার দেওয়া ঠিক নয় যা দেখে শিশুটি পরবর্তিতে বিব্রত হয়। আপনার জন্য যা মজার তার জন্যে তা নাও হতে পারে ।

মাঝে মাঝে আমি এমনিতেই ভয়ে থাকি কবে আবার বাড়ির কেয়ারটেকার ফেইসবুকে এড রিকুএস্ট দিয়ে কোন উত্তর না পেয়ে বিরাট একটা নিউজ লিখে ফেলে নিজের টাইমলাইনে-বাড়ির ম্যাডামের সারাদিনের কর্মকাণ্ড (এক্সলুসিভ)! মোবাইলে সাংবাদিকতা করতে তো আর কোথাও চাকরি করতে হয় না ।এটা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সিং! সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার স্যাপার।