বাংলা সিনেমার ঈদ বাজার এবং যৌথ নির্মাণের দৌরাত্ব

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 30 August 2017, 06:58 AM
Updated : 30 August 2017, 06:58 AM

সাদা কালো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ।তখন আমরা খুব ছোট ,প্রাইমারীতে পড়ি  ।ঈদ আসলেই বাবাকে দেখতাম চারপাশে শা্লি-শালা বেষ্টিত হয়ে হল অভিমুখে যাত্রা করছে ।শালি গুলোও কম নয় ,একজন সুচন্দার মতোন গালে তিল এঁকেছে আবার তার ছোট জন দেখলাম ববিতার মতোন পেচিয়ে পেচিয়ে শাড়ি পড়েছে ।আমার মামারাও দেখেছি কম নয় ,জাফর ইকবাল আর রাজ্জাক ইস্টাইলের ডিভাইডার প্যান্ট আর চুলগুলো আঁচড়ে এক পাশ করে রাখা ।সেকী নায়ক নায়িকা ভাব তাদের ! আসলে সময়টাই তেমন ছিল ,৭০ দশকের বাংলা সিনেমার নায়ক নায়িকার প্রতিচ্ছায়া পড়ে যেতো তরুন তরুনীর হাঁটা চলা এমন কি পোশাকেও ।মাঝে মধ্যে আমি চান্স পেতাম সেটা অবশ্য ছুটির ঘন্টা টাইপ হলে ।ওই সময় শিশুতোষ চলচিত্রের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। গোটা গোটা চোখে চেয়ে থাকতাম বড় টেলিভিশনের দিকে।আজো এই বড় স্ক্রিনটার প্রতি আমি দূর্বার আকর্ষন বোধ করি ।খুব বেশী দিন আগের কথা নয় ,আমাদের মিরপুর ১ নম্বর সনি হলে আমরা স্বপরিবারে সিনেমা দেখতে যেতাম ,কিন্তু এখন সে কথা চিন্তাও করতে পারছি না। সেটা হতে পারে সিনেমার দোষ ,হতে পারে হলের দো্ষ ,হতে পারে দর্শক হিসেবে আমাদের দোষ ।কিন্তু ভারতীয় বাংলা সিনেমা বা যৌথ সিনেমা যখন মুক্তি দেওয়া হয় তখন দেখি হলের সামনে লক্ষ দর্শকের ভীড় ।

ছবিতে বাংলা সিনেমার স্বর্ণালী যুগ

এই যুগের সিনেমা প্রেমিকেরা বহু টাকা খরচ করে বসুন্ধরা সিনেপ্লেক্সে ইংলিশ থ্রিডি দেখে, কিন্তু বাড়ির কাছে ১০০ টাকা খরচ করতে তারা নারাজ। এর একটা বড় কারণ হতে পারে, সিনেমা সন্ধানীরা দেশি সিনেমার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অনবরত তামিল সিনেমার বাংলা ভার্সন দেখতে দেখতে এখনকার সিনেমা পাগল মানুষগুলো বড্ড ক্লান্ত। যে ছবি মোবাইলে দেখা যায় তার বাংলা অনুবাদ কেন হলে গিয়ে দেখতে হবে -এটাই তাদের মূল অভিযোগ। আর একটা কারণ অবশ্য দেখা যায়। ঈদে, নতুন বছরে বা পূজোয় কী কী ছবি বাংলাদেশের হলগুলোতে আসছে তার সঠিক প্রচারণা এই দেশে হয় না। ছবি মুক্তির আগে কেবল কয়েকটা টিজার আর পোস্টার ছাড়া হয়। তাও আবার অনলাইনে। আর পত্রিকার বিনোদন পাতায় ঘুরে ঘুরে ছবির প্রচারনা করা হয়,এতে কিন্তু মূল দর্শক ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। গ্রামে এক সময় সিনেমা আসলে মাইক দিয়ে ঘোষনা করা হতো। ওখানে ইন্টারনেট বা পত্রিকা সহজলভ্য নয় তাই এই পক্রিয়ায় যাওয়াটাই সমীচীন মনে হয়। কিন্তু আধুনিক গ্রামের বাসিন্দারা আজকাল এই প্রথা পছন্দ করছে না। এখনো অনেকের মতে সিনেমা মানেই পাপ, জাহান্নামে যাওয়ার পথ খুলে দেওয়া!

ভারতে একটি সিনেমা রিলিজ দেবার আগের এক বছর চলতে থাকে মাঠ পর্যায়ের প্রচারণা। অনলাইন মাধ্যমে সিনেমার গান আগেই কোটি ভিউয়ারে চলে যায়, অতঃপর সিনেমার টিম দেশের বাইরে সিনেমার প্রোমো নিয়ে স্বশরীরে হাজির হয়। তারা একটা সিনেমার পেছনে যদি ৫ কোটি লগ্নি করে তার ১ কো্টি কেবল প্রচারনার পেছনেই খরচ করে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন স্টেজ শো অথবা রিয়েলিটি শোতে পুরো টিম নিয়ে হাজির হয়ে যায় বিভিন্ন চ্যানেলে। তাতে করে গানের বা নাচের দর্শক ঘরে বসে টের পেয়ে যায় আগন্তুক সিনেমার খবরাখবর। আর হল হাউজ ফুল দেখানোর টেকনিক কিন্তু  আমরা ভালোই রপ্ত করেছি। ছবি মুক্তির আগেই দুই -তিন সপ্তাহের জন্য নিজের সিনেমা নিজেই বুকিং দিয়ে দেওয়া – এটা মনে হয় এখন খুব প্রিয় পদ্ধতি সিনেমা হাউজ ফুল দেখানোর ।

আমাদের দেশের বড় আকারের পত্রিকাগুলো বিনোদন পাতায় যথাক্রমে- বলিউড, হলিউড এবং ঢালিউড -এই তিন ক্যাটাগরিতে নিউজ আপডেট করছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে কলকাতার বাংলা সিনেমার জন্য কোন আলাদা সেগমেন্ট এখানে নেই। কারণ, ওই বাংলার সব সিনেমার খবর আমাদের ঢালিউড পাতায় পাওয়া যায়। অনেকটা যৌথ প্রযোজনা সিনেমার মতোই, এইটার নাম দেওয়া যেতে পারে -যৌথ নিউজ। ওদের দেশের প্রায় সব সিনেমার নিউজ আমাদের পত্রিকাওয়ালারা খুব ঘটা করেই দিচ্ছেন। আর না দিয়ে উপায় তো নেই, প্রতি বছর ঈদের প্রায় সব ছবিই যৌথ উদ্যোগে নির্মিত থাকে। গত রোজার ঈদে তিনটি আলোচিত সিনেমার দুইটিই ছিল যৌথ প্রযোজনা ।

আর হবেই বা না কেন , সেই কবে থেকে থমকে আছে এফ ডি সি ।পরিচালক সমতি শাকিবকে নিষিদ্ধ করলেও হল মালিকরাতো করেনি ।শাকিবের সিনেমা ছাড়া ঈদের ছবি কল্পনাও করা যায় না ,শুধু এই দেশে নয় ।কলকাতাতেও শাকিব খান অভিনীত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা সর্বাধিক আয় করার রেকর্ড আছে । সবাই আশা করেছিল ,নায়ক রাজ রাজ্জাকের মৃত্যূর পর পরিস্থিতি বদলে যাবে ,কিন্তু জানা গেল একটা ফোন কলের মধ্যেই আটকে আছে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ । মনে বার বার শংকা জাগে -এইযে এত্তো এত্তো অভিনয় শিল্পী -পরিচালক, এফডিসি-তে ভোটাভুটি এইগুলোর আসলে ফায়দা কি যদি প্রতি ঈদে তিন চারটা ঝকঝকে সিনেমাই না উপহার দেওয়া যায়।

দুই ঈদের বাংলা সিনেমা পর্যবেক্ষন করলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে শাকিব-অপু-বুবলি এই তিন তারকা ছাড়া আর কোন শিল্পীই (মিম ছাড়া) নেই। অবশ্য গেল দুই মাসে এই তিন তারকা বাংলাদেশের সমস্ত দর্শককে যেভাবে টেলিভিশন দেখাতে বাধ্য করেছিলেন তেমনি যদি সব দর্শকদের হলে গিয়ে বাংলা সিনেমাও দেখাতে পারেন তাহলে কিন্তু হল মালিকদের  পোয়া বারো ।

এই বছর আলোচনার শীর্ষে তারকা জুটি শাকিব-পপি

এরপরো প্রশ্ন থেকে যায় ,বাংলাদেশে কি একক ভাবে কোন সিনেমা হচ্ছে না যেখানে শিল্পী থেকে সব কলা কুশলি কেবলই বাংলাদেশি। এবারের ঈদে মুক্তি পাচ্ছে -সোনা বন্ধু। মাহবুবা শাহরিনের কাহিনীতে মমম্বর রুবেল লিখেছেন সিনেমার গল্প। শুভ টেলিফিল্মের প্রযোজনায় ছবিটি পরিচালনা করেছেন জাহাঙ্গীর আলম সুমন। জানা গেছে, সোনা বন্ধু ছবিটিতে ভিন্নধারার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পরীমণি। এ ছবিতে আরো অভিনয় করেছেন ডি এ তায়েব ও পপি। পাশাপাশি ঘটা করে চলছে দীপংকর দীপনের "ঢাকা এটাক" সিনেমার প্রচারণা।

আসছে কোরবানি ঈদে -সোনা বন্ধু

এর বাইরেও এদেশে শুধুমাত্র বাংলাদেশী কলা-কুশলি নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারনে যা এখনো সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে।

রাজিবুল হোসেনের অ্যাডভেঞ্চার ভিত্তিক চলচ্চিত্র  হৃদয়ের রংধনু আটকে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি কারন উল্লেখ করে বলা হয়েছে এ বিষয়গুলো পর্যটন শিল্পের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। আরো বলা হয়, ছবিতে একই সংলাপ একাধিকবার একই সময়ে বা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ব্যবহার, অর্থহীন সংলাপের ব্যবহার ও নিম্নমানের অভিনয় দর্শকদের বিরক্তির উদ্বেগ করতে পারে।

বাংলাদেশে চাকমা ভাষায় প্রথম চলচ্চিত্র 'মর থেঙ্গারি' বা 'মাই বাইসাইকেল' নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সেনাবাহিনী৷ তাই ছবিটি শেষ পর্যন্ত সেন্সর বোর্ড পেরিয়ে প্রদর্শনের অনুমতি পায়নি । পরিচালক অং রাখাইন 'মাই বাইসাইকেল'-এর জন্য গত দশ বছর ধরে কাজ করলেও ছবির দৃশ্যধারণ শুরু করেন ২০১২ সালে৷ এরপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার একটি চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয় 'মর থেঙ্গারি'৷কিন্তু ,দেশের কোন প্রেক্ষাগৃহে এখনো সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়নি।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জগতের সমস্ত সেন্সর বাংলা সিনেমায় এসে ঠেকেছে। কী চাচ্ছে এই সেন্সর বোর্ড? যে দেশে নাটকের দৃশ্যে ধর্ষন -মারামারি , এমন কি কলকাতার গান ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানে কেন এই শেকল বাঁধার চেষ্টা? কেন হলে ভারতীয় বাংলা সিনেমা নিষিদ্ধ? টেলিভিশনে যদি ২৪ ঘন্টা আমাদের চ্যানেলের পাশাপাশি ইন্ডিয়ান চ্যানেল চলতে পারে তাহলে হলে ওই দেশের সিনেমা চালালে কি এই দেশের মানুষ বাংলাদেশি সিনেমা দেখা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু আয়নাবাজি সিনেমার রেকর্ডতো ভিন্ন কথা বলে ।ব্লকবাস্টার হলে টানা ছয় সপ্তাহ চলেছে আয়নাবাজি ,তার মানে দেশের মানুষ দেশের সিনেমা দেখতে চায়। কলকাতার ধ্যাৎতেরিকা কিন্তু সেভাবে কেউ দেখেনি, তার মানে ভালো সিনেমা দেখার দর্শক আসলেও আছে এই দেশে।

এই ২০১৭ সালেই বেশ ঘটা করেই চলচ্চিত্র নির্মানের একটি  বড় আকারের নীতিমালা করা হয়েছে ।এখানে চলচ্চিত্রে সরাসরি ধর্ষণের দৃশ্যসহ নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্যমূলক আচরণ বা হয়রানিমূলক কর্মকান্ডকে উদ্বুদ্ধ করে এমন দৃশ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে । এছাড়াও কোনো চলচ্চিত্রে রাষ্ট্র ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। সমুন্নত রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা ; পরিহার করতে হবে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা। কোনো অশোভন উক্তি, আচরণ এবং অপরাধীদের কার্যকলাপের কৌশল প্রদর্শন, যা অপরাধ সংঘটনের  ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতির প্রবর্তন ও মাত্রা আনতে সহায়ক হতে পারে, এমন দৃশ্য পরিহার করতে হবে। চলচ্চিত্রের সংলাপে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষা পরিহার করতে হবে ।

যারা একসময় বছরের তিন তিনটে সিনেমার পিছনে অর্থ লগ্নি করতো তারাও এখন একটা সিনেমার জন্য টাকা ঢালতে পিছ পা হচ্ছে ।নতুন চিত্রনাট্যকারদের সমাজের সব নেতিবাচক ঘটনা এড়িয়ে গল্প লিখতে হবে এখন, এর চাইতে ঢের ভালো তামিল সিনেমা কপি করে দিয়ে যৌথ প্রযোজনায় যাওয়া যাতে কোন ভাবেই সেন্সরের কাঁচির দখলে না পড়ে পরিচালকের কপি-পেস্ট মস্তিষ্ক।

কথা হচ্ছে, যৌথ প্রযোজনা নিয়ে কী কোনই নীতিমালা থাকবে না তথ্য মন্ত্রণালয়ের? বাংলাদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দু'দুটি চলচ্চিত্রে দাপটের সাথে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করে গেলেন যথাক্রমে -পরমব্রত এবং বরুন চন্দ ।ভুবন মাঝি আর রিনা ব্রাউন দেখে বুঝে গেছি এই দেশ আর কোন শক্তিমান শিল্পীর সঠিক মূল্যায়ন করবে না ।শেষ অব্দি মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রটাও যদি অন্য দেশের অভিনেতাদের দিয়ে করাতে হয় তবে আর কীবা বলার থাকে! আমাদের অভিনয় শিল্পীরাও যে ওই দেশে অভিনয় করছে না তাতো নয়, কিন্তু শাকিব খান এবং জয়া আহসান ছাড়া কারো নাম এমন উচ্চস্বরে শোনা যায়নি।

https://www.youtube.com/watch?v=LCjJhWYS0Hg

'বস টু' এবং 'ইয়েতি অভিযান' ছবিতে শিল্পী নেয়ার ক্ষেত্রেও প্রচারের ক্ষেত্রে মানা হয়নি যৌথ প্রযোজনার নিয়ম। এমন আভিযোগ উঠেছে ছবি দুটিকে ঘিরে। সম্প্রতি চলচ্চিত্র ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সেন্সর প্রিভিউ কমিটিকে একটি চিঠি দেয়া হয়।  বিএফডিসিতে সেন্সর প্রিভিউ কমিটি বস টু ছবিটি দেখেন। সে সূত্রে এই ছবিটির অধিকাংশ শিল্পী কলকাতার বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে প্রিভিউ কমিটির সদস্য নাসিরউদ্দিন দিলু মানবজমিনকে বলেন, দুই দেশের শিল্পীদের মধ্যে সমতা কম মনে হয়েছে আমার কাছে। সবাই মিলে মতামত জানিয়ে দিয়েছ আমরা। এরপর সেন্সরবোর্ড বাকি সিদ্ধান্ত নেবেন।

তর্কের মুখে দুটি যৌথ নির্মাণের সিনেমা

অন্যদিকে প্রায় তিন মিনিটের ইয়েতি অভিযান'র ট্রেলারে এক সেকেন্ডের জন্য বাংলাদেশের ফেরদৌসকে স্পষ্ট দেখা গেলেও বিদ্যা সিনহা মিমকে খুঁজতে গেলে ভিডিওটি পজ করে করেই দেখতে হবে। এছাড়া ছবিটিতে বাংলাদেশের আর কোনও শিল্পী-কুশলী নেই, ট্রেলার সেটিই ঈঙ্গিত করছে। ফেরদৌস ও মিমের কেবল নামোল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন সংবাদ বিবরণীতে। এ ছাড়া আর একজনও নেই যিনি বাংলাদেশি। ছবিটির নির্মাতা, গীতিকার, সুরকার, গায়ক-গায়িকা, রূপসজ্জাকর, সংলাপ রচয়িতা, সহকারি পরিচালক, এডিটর প্রভৃতি ভূমিকার সবাই ভারতীয়ই। সেজন্যই বোধ করি যৌথ প্রযোজনা এখন যৌথ প্রতারনা নামে সুপরিচিত।

সম্প্রতি মুক্তি প্রাপ্ত বাংলাদেশি সিনেমা ভয়ংকর সুন্দর নিয়ে সমালোচনার ঝড় চলছে সোস্যাল মিডিয়াতে ।এর অন্যতম কারন হিসেবে বলা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টিভি নাটক নির্মানে যে সব পরিচালক সফল তারা পূ্র্ণ দৈর্ঘ্য সিনেমা বানিয়ে সুনাম কুড়াতে পারেননি। হয়তো প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ব্যতিক্রম ছিলেন, কারন তার সিনেমার মূল উপজীব্য বিষয় ছিল বাংলার মাটি ও মানুষ। কিন্তু আধুনিক শহুরে জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে গিয়ে নতুন ও পুরাতন অনেক নির্মাতাই রীতি মতোন ভিমড়ি খেয়ে যাচ্ছেন। এই যুগের তরুণ দর্শক অনেক তুখোড়, তারা শকুনের চোখ নিয়ে সিনেমা দেখতে বসে, তাই উড়ে গিয়ে জুড়ে দেওয়া গল্প এরা নিতে পারছে না। আর সিনিয়র সিটিজেন কবেই হল বিমুখ হয়ে গেছেন, তাদের সেলুলয়েডের ফিতে তো কবেই সেই সাদা-কালোতে আটকে গেছে।

সমালোচনায় ঠাসা অনিমেষ আইচের ভয়ংকর সুন্দর

এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী', দিপু নাম্বার টু, দূরত্ব এমন অনেক সুন্দর সুন্দর শিশুতোষ  চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে আমাদের দেশের পরিচালকদের হাতেই। তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ বেশ ক'টি শিশুতোষ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে শিশুদের ভাবনার জগতকে সমৃদ্ধিদানের পাশাপাশি তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। মাটির ময়না তারেক মাসুদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। এটিতে তিনি ষাটের দশকের একজন মাদ্রাসা ছাত্রের শিক্ষা গ্রহণের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। ভয়েজ অব চিল্ড্রেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ নির্মিত আরও একটি উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ প্রামাণ্যচিত্র। এমিলের গেয়েন্দা বাহিনী থেকে বর্তমান শিশুতোষ চলচ্চিত্রের অবস্থা একদমই আগায়নি বরং ব্যস্তানুপাতিক হারে বেড়েছে অশ্লীল চলচ্চিত্র নির্মাণের হার। আইটেম সং নামে চলছে অশ্লীল চিত্র প্রদর্শন। এর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখানো হয় আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে জনগণের মন-মানসিকতার পরিবর্তন। অপর দিকে হলে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগের হার কমে যাওয়া। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশে সরকার যেভাবে অর্থিক সাহায্য করতে পারে তেমন আশার বানীও আমরা দেখত পারছি না। শেষ অব্দি তারেক মাসুদের প্রয়াণের সাথে সাথেই সমাপ্তি ঘটেছে বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্রের।

পরিচালক তারেক মাসুদ ঃ শিশুতোষ বাংলা সিনেমার পথিকৃৎ(বাংলাদেশ)

বাংলা চলচ্চিত্রে সব থেকে ব্যবসা সফল ছবির প্রথম তালিকায় রয়েছে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত 'বেদের মেয়ে জোসনা'। ১৯৮৯ সালে নির্মিত এই সিনেমার আয়ের রেকর্ড ভাঙতে পারেনি কোন ছবি। এরপর রয়েছে 'স্বপ্নের ঠিকানা' ও 'সত্যের মৃত্যু নাই'। তবে তিনটি ছবির মধ্যেই দুটি ছবি প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ অভিনীত ছিলো ।একটা ছবির সফলতার পেছনে প্রয়োজন, পরিচালকসহ, কলা কুশলি এবং একজন প্রোডাকশন বয় পর্যন্ত জড়িত থাকে। 'স্বপ্নের ঠিকানা' ১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশী বাংলা ভাষার রোমান্টিক চলচ্চিত্র। ছায়াছবিটি পরিচালনা করেছেন এম এ খালেক। সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তৃতীয় অবস্থানটিও সালমান অভিনীত চলচ্চিত্রের । ১৯৯৬ সালে ছটকু আহমেদ পরিচালিত 'সত্যের মৃত্যু নাই' আয় করে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সিনেমাটি মুক্তি পায় সালমানের মৃত্যুর পর। এরপর ঢাকাই চলচ্চিত্রে আর কোন ছবি আয় করেনি ১০ কোটি টাকার বেশি।

বাংলা সিনেমার ব্লক বাস্টার হিট- বেদের মেয়ে জোসনা

ওই সময়টাকে বাংলা সিনেমার স্বর্নালী যুগ বলা হতো ।আমাদের অনেক সিনেমার স্বত্ত কিনে নিয়ে ভারতে সেই ছবির রিমেক হয়েছে। তার মানে ,মেধার দিক থেকে আমাদের শিল্পীরা মোটেও পিছিয়ে নেই। শুধু একটু স্বদিচ্ছার অভাব, সবাই যদি যার যার অহমিকা ভেঙে  নিজের জায়গা থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসে তাহলে বাংলা সিনেমার সেই হারানো দিনগুলোকে আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস।