‘তুমি+আমি’ একটি পূর্ণাঙ্গ ঈদ নাটক

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 10 Sept 2017, 03:42 AM
Updated : 10 Sept 2017, 03:42 AM

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত ঈদের দিন রাত ৯ টায় চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুঁজে নিত প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের নাটক; উদ্দেশ্য একটাই- সারাদিন ব্যস্ততার পর পরিবারের সদস্যদের সাথে আরো একটু মেতে ওঠা আরো একটু ভালো লাগা অনুভূতির বিনিময়। হাসির নাটক বলতে আমরা সেই সময় হুমায়ূন আহমেদের নাটককেই বুঝেছি। তার নাটকের সংলাপে যেমন হাসি ছিল, নাটকের শেষে থাকতো মেসেজ।

বাংলা নাটকের এই শক্ত অবস্থানে হুমায়ূন আহমেদের পাশাপাশি যিনি নিজের মেধা এবং সৃজনশীল কাজ দিয়ে সেই সময়ি দর্শকের মনে অনেকখানি জায়গা করতে পেরেছেন তিনি ফেরদৌস হাসান রানা। বাংলা চ্যনেলে এই দুই পরিচালকের নাটক পাশাপাশি রেখে দর্শক উপভোগ করেছে একই সময়ে। চরিত্রের মুখ দিয়ে সহজ সংলাপ বলিয়ে কঠিন একটি বাস্তবতাকে খুব সহজ ভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ফেরদৌস হাসান রানার নাটকের মুন্সিয়ানা।

ঈদের বিশেষ দিনগুলিতে দর্শক ছুটির আমেজ নিয়ে রিমোট হাতে টিভির সামনে বসে কেবল বিনোদন নিতে। এই সময় খুব সিরিয়াস দৃশ্য সব ধরনের দর্শক টানে না। কিন্তু হাসির নাটক সবাইকেই কম বেশি আনন্দ দেয় আর এই ধরনের নাটক বানানো আসলেই কঠিন। দেশে অনেক নির্মাতাই এখন হাসির নাটক বানাচ্ছেন যেগুলো দেখলে বোঝাই যায় পরিচালক অনেকটা সুড়সুড়ি দিয়ে লোক হাসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ঈদের এই ৭ম দিতে গাজী টিভিতে প্রচারিত 'তুমি+আমি' নাটকটি দেখার পর আমি উপলব্ধি করেছি- ফেরদৌস হাসান রানা সংলাপ ও দৃশ্যায়নের মাধ্যমে দর্শকদের হাসাতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে ভাড়ামী বলতে কিছু ছিল না, আমাদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে যা ঘটে তার একটা পূর্নাঙ্গ চিত্র বহন করে 'তুমি+আমি' নাটকটি।

ছবি-১: দিলারা জামান এবং জিয়াউল হাসান কিসলু

সন্দেহ বাতিক স্ত্রীর ভূমিকায় মোমেনা চৌধুরীর অভিনয় ছিল অনবদ্য, তাকে দেখে মনেই হচ্ছিল স্বামীকে অন্য নারীর সাথে এসএমএসে লিপ্ত হতে দেখেই তিনি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে স্বামীকে ডিভোর্স দেবার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। আজকাল  কথায় কথায় ডিভোর্স দেবার যে মাত্রা অনেকটাই বেড়ে গেছে, এখান থেকে এই মেসেজটাও আমরা পেতে পারি বলে আমার মনে হয়। অন্যদিকে স্বামীর চরিত্রে শাকিল আহমেদকে দেখলে আপাত বাধ্যগত স্বামী মনে হলেও আদতে তা নয়। তিনি তার চিরায়ত কঠিন রূপকে ঝেড়ে ফেলে একজন মধ্যবিত্ত হাইড এন্ড সিক টাইপের স্বামীর চরিত্রে দূর্দান্ত অভিনয় করেছেন।

বিশেষ করে দিলারা জামানের মতো একজন বয়োজ্যেষ্ঠ অভিনেত্রীর  সাথে তার পুতুপুতু দৃশ্যটির জন্য তাকে আমি সাধুবাদ জানাই। এটা নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। স্বজল তার ছোট ভাই সুলভ চরিত্রে মানিয়ে গেলেও ঈশানার চোখে মুখে কোন অভিব্যক্তি ছিল না। মনে হয়েছে, সে শুধু সংলাপ আওড়ে যাচ্ছে।

এই জায়গায় আমি যোগ করতে চাই- বিশেষ দিনের নাটকে চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার কোন যুক্তি নেই। কারণ, এই নাটকগুলো সাধারণ দর্শক থেকে সমালোচক ঘরানার সবাই দেখে। তাই প্রধান কিছু চরিত্র নির্বাচনে- তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ টাইপের প্ল্যাটফর্ম থেকে আসা স্টার না নিয়ে মঞ্চ থেকে উঠে আসা দক্ষ অভিনয় কর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ বেশি। এতে কষ্টের নাটক সার্থকতা পায়।

ছবি-২: মোমেনা চৌধুরী এবং শাকিল আহমেদ

এখন যার কথা লিখবো সেই অভিনেত্রীর নাম জল। তার বয়স এখন সম্ভবত ছয় চলছে। এইটুকুন মেয়ে ক্যামেরার সামনে এমন কঠিন কঠিন সংলাপ কিভাবে বলে গেল তাই ভেবে অবাক হচ্ছি। পরিচালক কন্যা বলে যে পরিচালক তাকে ছাড় দিয়েছেন তাতো নয়, আলাদা আলাদা সংলাপে জলের আলাদা আলাদা অভিব্যক্তি দেখে পুরোই বোঝা গেল পরিচালক বাবা তার কাছ থেকে পুরো কাজ আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। নাটকের শেষের দৃশ্যে জলকে জিজ্ঞেস করা হয়- তুমি কার কাছে থাকতে চাও? এটা খুব নির্মম একটা দৃশ্য এখন সমাজে। এই অবস্থায় যে সব বাচ্চারা দূর্ভাগ্যক্রমে পড়ে যায় তারা নিজেদেরকে খুব অসহায় বোধ করে। তাদের চোখে মুখে একটা অজানা ভয় এবং রাগ কাজ করে। জল ঠিক এই জায়গাটা এতো চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলবে আমি এতোটা আশা করি নি। তার মুখে- কারো সাথে না, এই একটি সংলাপ যেন বুকের ভেররটা ভেঙে দু'টুকরো করে দিল। আমি তার জীবনের প্রথম অভিনয় দেখেই তার ফ্যান হয়ে গেছি, পর্যাপ্ত চর্চা করলে জল অনেক দূর যাবে।

ছবি-৩: শিশু শিল্পী জল

ফেরদৌস হাসান রানার নাটক দেখবো, অথচ গান থাকবে না তাতো হতে পারে না। আছে, এই নাটকে কেবল গান না; নাচও আছে। হাজার দর্শক মন মাতাইয়া নাচেগো সুন্দরী কমলা- বাংলা গানেও যে ইচ্ছে হলে নাচা যায় এই গান তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ। মোমেনা চৌধুরী এবং জিয়াউল হাসান কিসলু বেশ উপভোগ করেই এই নাচে ঠোঁট মিলিয়েছেন। এখন বাংলা নাটকে বেশির ভাগ পরিচালক কলকাতার গান যোগ করায় ব্যস্ত থাকেন, এই নাটকে একটি বিশুদ্ধ বাংলা গান দেখতে পেয়ে দর্শক হিসেবে আমার বেশ ভালোই লেগেছে।

এখন প্যাকেজ নাটক মানেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বাইরে গিয়ে চমৎকার দৃশ্যের ফুটেজ ক্যামেরায় বন্দি করা। কিন্তু 'তুমি+আমি' নাটকে সেই ধরনের কোন বাহুল্যতা নেই। যারা ফেরদৌস হাসান রানার নাটক দেখেন তারা জানেন- একটি ঘরের ভেতর প্রয়োজনীয় আসবাব দিয়ে চমৎকার ভাবে দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। এই নাটকেও তাই করা হয়েছে, এই জন্য যিনি অঙ্গসজ্জায় ছিলেন তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চরিত্র রূপদাতাদের পোশাকে সাবলীলতা ছিল। দিলারা জামানের মেকাপ দেখে আমিতো ধরেই নিয়েছি তার বয়স বুঝি আরো ২০ বছর কমে গেছে। শাকিল আহমেদের মুখে মার খাবার পরের অভিব্যক্তিও মেকাপম্যান চমৎকার ভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন।

ছবি-৪: নাটকের কিছু খন্ড চিত্র

পরিশেষে, বাংলা নাটক বাঙালির ঘরের একটি নিটোল বিনোদন। সবাই রাত ৯-১০টায় টিভির সামনে বসে নির্মল আনন্দ নিতে। তাই পড়ন্ত বিকেলে না হয়ে ওই সময়টায় যদি গাজী টিভি নাটকটা প্রচার করতো তাহলে আরো বেশি দর্শক দেখতে পেত। একজন নাটক সমালোচক বা লেখক হিসেবে নয়, একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি– ৪১ মিনিটের 'তুমি + আমি' নাটকটি এবারের ঈদের একটি পূর্নাঙ্গ ঈদ নাটক।