বাংলা গানের একজন নবীণ কাণ্ডারি সাবিনা লাকি

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 19 Nov 2017, 09:20 PM
Updated : 19 Nov 2017, 09:20 PM

বছর চারেক আগের কথা। মানবকন্ঠ অফিসের সভাকক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সন্মানির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই সাথে ছিল কবিতা পাঠ ও সংগীতের আয়োজন। স্বভাবতই শহীদদের নিয়ে লেখা কবিতা –প্রবন্ধ নিয়েই আমরা হাজির হয়েছিলাম বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক। একটানা কবিতা শুনতে কারোই ভালো লাগেনা। তাই মাঝে মধ্যে হারমোনিয়ামের সাথে সংগীত শিল্পীরা গেয়ে উঠছিলেন বেশ কিছু দেশাত্ববোধক গান। আমার চোখ বার বার চলে যাচ্ছিল একটি মিষ্টি মেয়ের দিকে। বেশ পরিপাটি করে সেজেছে মেয়েটা। চুলগুলো ব্লো-ড্রাই করে খুব পরিপাটি করে বাঁধানো। সঞ্চালক যখন ঘোষনা দিলেন –আধুনিক গান নিয়ে আসছেন সাবিনা লাকি, তখন অব্দি আমি ভেবেই নিয়েছিলাম  সাজগোজের ব্যাপারে যে মেয়েটা এতো পারদর্শি সে নিশ্চয়ই গানের প্রতি অতোটা মনোযোগি হবে না ।
আমার সমস্ত আশংকাকে গুড়িয়ে দিয়ে সাবিনা গেয়ে উঠলেন –যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে লক্ষ মুক্তি সেনা, দেনা তোরা দেনা, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না। মুহূর্তে আমার শরীরের রক্তপ্রবাহ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একে তো গানের কথামালা, তার ওপর সাবিনার অপরূপ কন্ঠ! আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। নিস্তব্ধ হয়ে রইলাম। আজো সেই মুগ্ধতা অটুট রেখেছে সে। এতোটুকু বদলায়নি তার গানের ভঙ্গিমা। আমি বুঝতে পারলাম- যে রাঁধে সে চুলো বাঁধে।

http://www.youtube.com/watch?v=P70HNzbQafs
গত ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ছ'টায় বংগীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংসদের আয়োজনে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে সাবিনা লাকির একক সংগীত আসরের আয়োজন করা হয়েছিল ।উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র ভারতীর চেয়ার মহুয়া মুখোপাধ্যায় ,আমাদের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী খোরশেদ আলমসহ আরো অনেক গুণী গুনী মানুষ ।সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা থেকে টানা সাবিনা গান করেছেন রাত সাড়ে ন'টা পর্যন্ত ।মাঝে ৩ মিনিট করে বক্তব্য ছিল ,একজন শিল্পী কতোটা মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারলে স্রোতারা টানা তিন ঘন্টা চেয়ারে বসে গান শুনতে পারেন তাই দেখলাম সেদিন ।প্রথম থেকে যারা ছিলেন ,তাদের কেউ চেয়ার ছেড়ে আর উঠে চলে যান নি বিশেষ কোন প্রয়োজন ছাড়া ।সে সন্ধ্যায় লাকি পরিবেশন করেছিল–-হারানো দিনের গান এবং দেশাত্ববোধক কিছু কালজয়ী সংগীত।


খুব ছোট বেলা থেকেই গানের সাথে সখ্যতা সাবিনার । বাবা ডা. এ কে এম শামসুদ্দীন আহমেদ চিকিৎসা দেবার পাশাপাশি সংগীত চর্চা করতেন। ছোট্ট সাবিনা বাবার হাতেই সংগীতের হাতে খড়ি নেন ।বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জে শৈশব ও কৈশর পার করা সাবিনা সংগীতে প্রথম শিক্ষা নেন ওস্তাদ শ্রী বিল্লেশ্বর সাহা এবং ও গৌরাংগ চন্দ্র কর্মকারের কাছে। স্কুল জীবনে একাডেমিক পুরস্কার এবং নতুন কুঁড়িসহ বেশ কিছু জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জাতীয় পুরস্কার পেয়ে সংগীত সাধনায় আরো মনযোগী হন সাবিনা লাকি। সেখানে ওস্তাদ শেখ আলী আহমেদ–এর কাছে নিবিড় প্রশিক্ষন নেন সঙ্গীতের নানান শাখায়। সংগীতে আরো উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় ছায়ানটে নজরুল সংগীতের উপর কোর্স সম্পন্ন করেন সফলভাবে।

এরপর হিন্দোল থেকে ওস্তাদ জাকির হোসাইন ও খলিল হোসাইনের কাছে নজরুল ও ক্লাসিক্যাল গানে তামিল নিয়ে নিজেকে আরো পোক্ত করেন। সংগীত ভুবনে নিজের নামের স্বাক্ষ্য রাখতে ২০১১ সালে প্রথম একক এলবাম করেন–পরদেশী বাবু ,দশটি গান নিয়ে ভিন্ন স্বাদের পরদেশী বাবু এলবামের গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন শরীফ শাহ ।

বাবা ছাড়াও মা খাদিজা শামসুদ্দীন এবং বড় বোন তামান্না জেসমিন তাকে গানের প্রতি অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন ।আর যে মানুষটির কথা উল্লেখ না করলেই নয় ,তিনি তার স্বামী জাকির হোসাইন ।সেই ছোট বেলায় যার ঘর আলো করে সাবিনা বৌ হয়ে গিয়েছিলেন , তার সান্নিধ্যেই আজ সাবিনা একজন পরিপূর্ণ শিল্পী । প্রতি অনুষ্ঠানেই সাবিনার মুখে জাকির হোসাইনের ভূয়সী প্রশংসা বুঝিয়ে দেয় জাকির হোসাইনের উৎসাহেই সাবিনা এখনো দুই ছেলে মেয়েকে বড় করেও গান করতে পারছেন  । বিভিন্ন  সাংগঠনিক মঞ্চে গান গাওয়া ছাড়াও  সম্প্রতি নিজের করা পাঁচটি মিউজিক এলবামের উপর কাজ শেষ করেছেন সাবিনা  ।এ ছাড়া খুব শীঘ্রই বাজারে আসছে রবীনের কম্পোজিশনে আরো একটি নতুন এলবাম ।শিল্পী সাবিনা নজরুল এবং রবীন্দ্র ছাড়াও আধুনিক ও মডার্ণ ফোক গান করে থাকেন ।আমি তার গান গাওয়ার অপরিসীম ধৈর্য্য দেখে মাঝে মধ্যে বিস্মিত হয়েছি ।এই শিল্পী একাধারে ত্রিশটির অধিক গান নিভুল গাইতে পারেন ।সুর বা লয় এদিক-ওদিক হতে শুনিনি কখনো ।

;

সাবিনা লাকি ইতিমধ্যে নিয়মিত সংগীত শিল্পী হিসেবে বেতারে এবং টেলিভিশনে নিজের নাম লিখিয়েছেন। তিনি সরগরম শুভজন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ওমেন বিজনেস ওনার্স এসোসিয়েশন-এর নির্বাহী সদস্য, কুক এন্ড ফুড ক্যাটারিং সার্ভিস ও মুভ্যস এন্ড শপার্স জিম-এর সত্বাধিকারী এবং ওয়েস্টার্ন মিউজিক একাডেমির শিক্ষক। সংগীত ভুবনে যাদের গান তিনি কন্ঠে ধারণ করেন-সাবিনা ইয়াসমিন, সামিনা চৌধু্রি , লতা মুংগেশকর, মান্না দে প্রমুখ। আমি এই অতি মিষ্টি সুকন্ঠি শিল্পীর গান বার বার মুগ্ধ হয়ে শুনতে চাই। তিনি যেন হঠাৎ সেলিব্রেটি বনে যাওয়াদের কাতারে নিজেকে বিলিয়ে না দেন।