অনুভবে রবীন্দ্রনাথ, কলকাতার পথে প্রান্তরে

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 30 Nov 2017, 06:39 PM
Updated : 30 Nov 2017, 06:39 PM

'কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া

তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া

চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি

গোপনে তোমারে, সখা , কত ভালোবাসি।

ঠিক কী কারণে কিংবা কার চরণে হৃদয়কে এভাবে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন কবিগুরু তা বোঝা বড্ড মুশকিল। কখনো কখনো তার লেখা গানে মনে হয়েছে তিনি প্রেয়সীকে ভালোবেসে সব উজার করে দিতে চেয়েছিলেন, কখনো বা মনে হয়েছে পরম করুনাময় স্রষ্টার কাছেই তার যতো আত্মসমর্পণ । মূলত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান-কবিতা বা ছোট গল্প যুগে যুগে পাঠককে এমন করেই আলোড়িত করেছে, পাঠক হিসেবে তাঁকে জানতে চাওয়ার ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেছে। এর বাইরেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন লেখা, গান, চিন্তা-ভাবনায় ছিল নারীমুক্তির চেতনার ছাপ ৷ আজ থেকে প্রায় দেড়'শ বছর আগে জন্মগ্রহণ করা এই বাঙালি কবির চিন্তা-ভাবনা ছিল সময়ের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক৷ সেই সময়েই তিনি তাঁর বৌদিদের ঘরের বাইরে বের হতে উৎসাহিত করতেন ৷ নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, ঘোড়ায় চড়িয়ে বেড়াতে নিয়ে যেতেন৷ এর মধ্যে তার বৌদি কাদম্বরীর নাম উল্লেখযোগ্য।

ছোটবেলায় হৈমন্তী, কাবুলিওয়ালা বা দেনা –পাওনা পড়ে বিস্মিত হয়েছি; জমিদার পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মানুষ কী করে অন্দরমহলের নারী চরিত্র ফুঁটিয়ে তোলেন এতোটা নিবিড়ভাবে ! সে বিস্মিত হয়ে জানতে চাওয়া আমাকে আজ অব্দি তাড়িত করে,আমি জানি এই ছোট্ট জীবনে একজন রবীন্দ্রনা্থকে জানতে চাওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই। তবু কবিগুরুকে উপলব্ধি করতে আমরা ক'জন রবীন্দ্র প্রেমী  বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের কর্মী; পাড়ি দিলাম পাশের দেশ কলকাতায় ।

কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, সংগীতস্রষ্টা, চিত্রকর, গল্পকার, আর কী কী বিশেষণ দেওয়া যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমার জানা নেই। তবে এমন কয়েক'শ  শব্দ ব্যবহার করেও এমন আধুনিক চিন্তা চেতনার একজন শিল্পীকে বন্দী করা যাবে না।

জোরাসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির রবীন্দ্রনাথ:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরী দেবীর চতুর্দশ সন্তান। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম 'আদি ধর্ম' মতবাদের প্রবক্তা। মাত্র চৌদ্দো বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ব্যস্ত থাকতেন দেশ ভ্রমণ নিয়ে । তাই ধনাঢ্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল এক 'ভৃত্যরাজক তন্ত্রে'। শৈশবে কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্ম্যাল স্কুল, বেঙ্গল অ্যাকাডেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে কিছুদিন করে পড়াশোনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বিদ্যালয়ের ধরাবাঁধা  শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর ভাল লাগেনি । স্কুলে যাওয়ার বদলে বালক রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে অথবা বোলপুর, পানিহাটি প্রভৃতি স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ঘুরে বেড়াতেই বেশি পছন্দ করতেন।

আমার হাতে তোলা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছবি

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা।পূর্বে ঠাকুর পরিবারের পদবি ছিল কুশারী, যা বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে আগত। পঞ্চানন ও শুকদেব নামে দু'জন কুশারী গোবিন্দপুর-এ বসত গড়ে তোলেন, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত কলকাতা শহরের একটি গ্রাম। তারা জাহাজ ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েন। ব্রাহ্মণ হবার কারণে প্রতিবেশীরা তাদের ঠাকুরমশাই বলে ডাকতেন। ব্রিটিশরা দেশের ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর 'ঠাকুর' তাদের পারিবারিক পদবীতে রূপান্তরিত হয়। ইংরেজদের সুবিধার্থে তা 'Tagore' বা 'ট্যাগোর' এ রূপান্তরিত হয়। দর্পনারায়ণ ঠাকুর (১৭৩১-১৭৯১), পরিবারের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। তিনি টাকা-ঋণ দিয়ে মুনাফা লাভ করেন এবং উপার্জনের সাথে সমানতালে খরচ করেন। দর্পনারায়ণের সাথে তার ভাই নীলমণি ঠাকুরের বিতণ্ডা হলে নীলমণি পরিবার নিয়ে মেছুয়াবাজারে চলে যান, যা পরবর্তীতে জোড়াসাঁকো নামে পরিচিত হয় ৷ নীলমণি অগাধ অর্থবিত্তের অধিকারী হয়ে জোড়াসাঁকোয় এক সুরম্য ভবন নির্মাণ করে সেখানে বসবাস করেন। ধারাবাহিকতায় পরিবারের আরো কিছু শাখা পাথুরিয়াঘাট, কাইলাহাটা ও চরবাগানে চলে আসে। এই এলাকাগুলো ছিল নবগঠিত মহানগরীর অঞ্চল, বিশেষ করে যখন ব্রিটিশরা গোবিন্দপুরকে নতুন ফোর্ট উইলিয়াম হিসেবে গড়ে তোলে।

আমার হাতে তোলা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ছবি

কলকাতার রাস্তায় বেশ ট্র্যাফিক ,তাই সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম জোড়াসাঁকোর উদ্দেশ্যে ।কিন্তু ট্যাক্সি আটকে ছিল ঘন্টার পর ঘন্টা। আমরা যখন চিতপুর পৌঁছি তখন মাথার ওপর তীব্র রোদ। জাকারিয়া স্ট্রিটের নাখুদা মসজিদ, চিতপুর রোড দিয়ে এগিয়ে গেলে হাতের ডান পাশে দেখা পাওয়া গেল বিশাল বড় পাকা তোরণে লেখা 'জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি এবং  ভেতরে মিউজিয়াম। ঠাকুর বাড়িতে যাবার রাস্তা ভীষন প্রশস্ত  আর লাল ইটের বাড়িটা দেখার মতোন। আমাদের আসার কথা আগেই  জানানো  হয়েছিল, তাই ভেতরে যেতে কোন অনুমতি নিতে হয়নি।

জোরাসাঁকো জাদুঘরের দায়িত্বে থাকা ইন্দ্রানী ঘোষ রবীন্দ্রভারতীর প্রদর্শন শালার অধ্যক্ষ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ।তার হাতে আমার ভ্রমণ গল্প "পিয়াইন নদীর স্রোতে" তুলে দিতেই তিনি চমৎকার হাসি উপহার দিলেন ।জাদুঘরের ভেতর ছবি তোলা নিষেধ ,কিন্তু ঠাকুর বাড়ির চারপাশ ঘুরে যা তুলে আনলাম তা ছিল অসাধারণ সম্পদ ।

ছবিতে অধ্যক্ষ ইদ্রানী ঘোষের সাথে কামরুল ইসলাম এবং আমি 

সবুজ ছোট  বড় গাছ দিয়ে ঘেরা চারদিক। তারই ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লাল রঙের বিশাল আকৃতির একাধিক দালান। মাঝে বিশাল সবুজ চত্বর ,মাঝে সাজানো ছোট ছোট চারা । প্রবেশপথের ডান দিকের একটু ভেতরে একচালা গ্যারেজে রাখা আছে কবির ব্যবহৃত গাড়ি। খোলার দিন বলে ছাত্র ছাত্রীর উপস্থিতিতে মুখর হয় উঠেছে । ভেতরে প্রবেশের পর  শুনতে পেলাম সেই চির চেনা রবীন্দ্রনাথের গান মিহি সুরে বাজছে । দো'তলা থেকেই বিশাল এই জাদুঘরে হাঁটা আরম্ভ করলাম । কবিগুরুর  খাবার ঘর ,এরপর শোবার ঘর ,যেখানে তিনি ঘুমাতেন । প্রতিটি ঘরেই রয়েছে রবিঠাকুরের  স্মৃতিচিহ্ন। কোনো কোনো ঘরে তাঁর ব্যবহৃত পোশাক, আরাম কেদারা, বইপত্র, বিদেশ থেকে আনা নানা জিনিসপত্র। রয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের অনেক ধরণের  ছবি। একটি ঘরে রয়েছে রবিঠাকুরকে নিজ হাতে লেখা মৃণালিনী দেবীর চিঠি, তার ওপর মৃণালিনী দেবীর একটি বড় ছবি টানানো ।এই ঘরেই মৃণালিনী দেবীর শেষ শয্যা পাতা হয়েছিল।  কবি পত্নী রান্না করতে বেশ ভালোবাসতেন আর কবিও বাহারি পদের খাবার মেন্যু হাকতেন ,তারই প্রমাণ পাওয়া যায় রান্না ঘরে দুটো চুলো দেখে ।এর সাথের  খাবার কক্ষটিও দেখে মনে হবে কবি এখানেও খেতে খেতে গাইতেন। কারণ খাবার টেবিলের ধরনটাও সংগীত কক্ষের মতো করে সাজানো। পরের ঘরটিতে কবি শুয়ে কাটাতেন জীবনের শেষ সময়টা। ঠিক এর পাশের একটি কক্ষে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। মোট চারটি ভবনের ১৮টি গ্যালারি জুড়ে রবীন্দ্রভারতী মিউজিয়াম।১৯৪১-এর ৩০ জুলাই এ ঘরেই কবিগুরু তাঁর শেষ কবিতা, 'তোমার সৃষ্টির পথ'-এর ডিকটেশান দিয়েছিলেন। এর মাত্র সাতদিন পর তিনি পাড়ি  জমান  না-ফেরার দেশে।

ছবিতে আমি, ঠাকুর বাড়ির খোলা ময়দানে

রবিঠাকুর কবে কোন দেশে গিয়েছিলেন, সেখানে তাকে নিয়ে পত্রিকায় কি লেখা হয়েছে তা ছাপার অক্ষরে আছে। কবে কোন পুরস্কার পেয়েছিলেন  তার বিস্তারিত বর্ননা  আছে। বিশেষ করে চীন-জাপান এবং আমারিকায় অবস্থান কালের সময় চমৎকার ভাবেই নতুন প্রজন্মের কাছে বাস্তব সম্মত আকারে তুলে ধরেছেন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ।

কাদম্বরী দেবীর ছবির দিকে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম থাকলাম অনেকটা সময়, তার শেষ চিঠির সাথে মিলিয়ে দেখার এ এক অজানা আকাঙ্ক্ষা ।

রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:

রবীন্দ্রভারতীর প্রধান অংশ আমরা দেখেছি জোড়াসাঁকোতে, কাশীপুরে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ধারে অন্য একটি অংশ দেখবার জন্য পরদিন সকালেই ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম। হাওড়া রেল স্টেশান ফেলে এই রাস্তাটি বেশ ব্যস্ত হলেও তেমন জ্যামে পড়তে হয়নি। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম রবীঠাকুরকে নিয়ে অধ্যবসায়রত পাঠ ময়দানে। ১৯৬২ সালের ৮ মে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহচর্যে ঔপনিষদিক ভাবপরিমন্ডলে নির্মিত হয়েছিল রবীন্দ্র-মানস ভুবন, আর জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের মহৎ কর্মধারার  স্রোতে গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্র কর্মভুবন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমগ্র সাহিত্য জীবন ও কর্মজীবনের মধ্য দিয়ে যে মানব ধর্মের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন তা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আলোর দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখে। দেশাত্মবোধ থেকে দেশাতীত বোধের উত্তরণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন কালজয়ী এক ব্যক্তিত্ব যিনি মূঢ় ম্লান দেশবাসীর মুক্তিপথের দিশারী হয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকলেন।

ছবি সূত্র: rbu-professor-gherao.jpg

১৩৪৮ বঙ্গাব্দে ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়ানের পর পরাধীন দেশবাসী অনুভব করেছিল রবীন্দ্র ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা। যদিও পরাধীন দেশের বিদেশী শাসক ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষার কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষার ব্যাপারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার তদানিন্তন সম্পাদক সুরেশচন্দ্র মজুমদার। রবীন্দ্রস্মৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য অল ইন্ডিয়া রবীন্দ্র মেমোরিয়াল কমিটি গঠন করে তিনি অর্থ সংগ্রহের ভান্ডার খুললেন। এই উদ্যোগে সামিল হয়েছিল বাংলাদেশের সব জেলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর যিনি প্রথম উপাচার্য হয়েছিলেন, সেই হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায় এক সময় পাবনাতে জেলা জজ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনিও এই উদ্যোগে সামিল হয়ে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্র নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এই অভিনয়ের দ্বারা প্রায় তিন-চার হাজার টাকা সংগৃহীত হয়, যা সুরেশচন্দ্র বাবুর তহবিলে দান করা হয়েছিল। এইভাবেই সমস্ত রবীন্দ্রপ্রেমী মানুষের আগ্রহে তিল তিল করে অর্থ সংগ্রহের কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল, প্রায় পনের লাখ টাকা পর্যন্ত সংগৃহিত হয়েছিল রবীন্দ্র স্মৃতি রক্ষা কমিটিতে, আর এই অর্থের সাহায্যেই রবীন্দ্রভারতীর প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হয়েছিল, যা পরবর্তী কালে রবীন্দ্রভরতী সোসাইটিতে পরিণত হয়।

আমাদের স্মরণে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ঠাকুর বাড়ির কিছু অংশে বহিরাগতদের প্রবেশ ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ও সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরদের অর্থাৎ পাঁচ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়ির  আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদের কাছে। ছয় নম্বর ঠাকুর বাড়ির একতলার বেশ কিছু অংশে ভাড়াটে বসে গেছিল, যারা বাড়িটিকে প্রায় কারখানায় পরিনত করে ফেলেছিল। ফলে এই অবস্থায় সব থেকে যেটা প্রধান কাজ ছিল তা হল জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িকে বহিরাগতদের হাত থেকে মুক্ত করা। রবীন্দ্রস্মৃতি রক্ষা কমিটির সংগৃহীত অর্থে জোড়াসাঁকোর সম্পত্তি  যেমন, মহর্ষি ভবনের সামনের মাঠ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের বিক্রি হয়ে যাওয়া পাঁচ নম্বর বাড়ি, মদন চ্যাটার্জী লেনের দিকে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরদের দক্ষিণের অংশ প্রভৃতি ক্রয় করা হয়। এই সমস্ত কাজ করতে গিয়ে দেখা যায় সংগৃহীত অর্থে সব কাজ করা সম্ভব নয়। তখন স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধান চন্দ্র রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ড. বিধান চন্দ্র রায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে স্থাপন করলেন একাডেমি অব ডান্স এন্ড মিউজিক। এই একাডেমি-র কাজের প্রসারের জন্য জোড়াসাঁকোয় সঙ্গীত ভবন স্থাপিত হয়। ইতমধ্যে রবীন্দ্র জন্মশত বর্ষ আগত প্রায়, এমন সময় জানা গেল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো বাসভবনের নিজের অংশ বিক্রি করে দিতে উদ্যোগী হয়েছেন, তখন ড. রায় সিদ্ধান্ত নেন সমগ্র মহর্ষিভবন অধিগ্রহণ করে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করবেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে বক্ষে ধারণ করে পাঠদান করবে।

ছবি: p/00/01/19/80/84_big.jpg

রবীন্দ্রনাথ ভিন্নপথের পথিক ছিলেন তিনি মনে করতেন না যে শিক্ষা শুধু সাহিত্যের পুঁথির পাতায় আবদ্ধ থাকে, শিক্ষার আলো যেমন থাকে রক্তের রেখায় তেমনই থাকে সুরের ধারায়, আবার তা নৃত্যভঙ্গীর তালে তালেও বিকশিত হয়। এই আদর্শকে সামনে রেখেই ড. বিধান চন্দ্র রায় গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে  সেকারণেই কলা বিভাগ ছাড়াও, চাকুকলা বিভাগ ও দৃশ্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রভারতীকে স্বাতন্দ্র দান করেছে।

এই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ই ড. রায়ের নির্দেশক্রমে পূর্বতন রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি নাম যুক্ত করে রবীন্দ্রভারতী সোসাইটিতে পরিণত হয়। ড: বিধান চন্দ্র রায়ের স্বপ্ন ছিল রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় পরস্পরের পরিপূরক হয়ে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ও চিন্তাধারা প্রচারের কাজ করবে। মুখ্যমন্ত্রীর আগ্রহ ও উদ্যোমে ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ শতবর্ষ তিথিতেই রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলো জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে । প্রধানমন্ত্রী জহর লাল নেহেরু জোড়াসাঁকো বাড়ির রবীন্দ্রমঞ্চের পাশে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। ড. বিধান চন্দ্র রায় দায়িত্ব দিলেন হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায় মহাশয়কে, আসলে দক্ষ প্রশাসক ও রবীন্দ্রদর্শন বোদ্ধা একজন ব্যক্তিকেই দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। দায়িত্ব অর্পনের সময় ড. রায় হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়কে বলেছিলেন "এমন ব্যবস্থা করো যে তাঁকে ভাল ভাবে জানবার ব্যবস্থা যেন হয়"। এর পরের বছর  ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের (১৯৬২)-র পঁচিশ বৈশাখ বেলা দশটার সময় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার খোলা হয়। দীর্ঘদিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে পঠন পাঠনের কাজ চললেও পরবর্তীতে মরকতকুঞ্জ প্রাঙ্গনে ৫৬-এ বিটি রোডের ঠিকানায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে তা স্থানান্তরিত হয় ।

ছবিতে হৃত্বিক ব্যাণার্জীর হাতে বই তুলে দিচ্ছি

রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে বক্ষে ধারণ করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আলোকে অমলিন রেখেছে।  এখানে যে লাইব্রেরী আছে তা ভীষন সমৃদ্ধ, বঙ্গীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম ভাই একটার পর একটা বই কিনতে থাকলেন ,যেন রবীন্দ্রনাথকে এক নিমিষেই পড়ে ফেলার চেষ্টা , তারপরো তার ইচ্ছে ছিল আরো বই কেনার। কিন্তু আমাদের ট্রেনে ফিরতে হবে, বোঝা বইবার ভয় তাকে এ যাত্রা বিরত রাখলো। ভারী ভারী বই নিয়ে যখন আমি উদবিগ্ন তখনই রবীন্দ্রভারতীর সিকিউরিটি অফিসার হৃত্বিক ব্যাণার্জী আমাকে আস্বস্ত করে বললেন-আপনারা আমার গাড়িটিই নিয়ে যান । উবার না পেয়ে মনে মনে এই প্রথম বেশ খুশীই হলাম আমি ।

তথ্যসূত্র:

বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:

তৃতীয় দিন বেশ ভোরেই শিয়ালদাহ রেলস্টেশন ধরে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম বোলপুর যাব বলে। সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল বেশ ঢিম লয়েই ,এসি বাথ হওয়াতে স্বচ্ছ কাঁচের গা ঘেসে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছিল। চোখ যতোখানি আটকে যায় তার সীমানা জুড়ে কেবল ঘন সবুজ মাঠ, খোলা প্রান্তর। রবিঠাকুরের বাবা দীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জায়গাটি আবিষ্কার করেন।

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য যাচ্ছিলেন। পথে ভুবনডাঙা নামক গ্রামের কাছে একটি দিগন্ত প্রসারিত মাঠের ভিতর দুটি মাত্র ছাতিম গাছ দেখতে পান। সেই ধূসর প্রান্তরের ভিতর এই ছাতিম গাছ দুটি দেখে তিনি এক ধরনের আত্মিক আকর্ষণ অনুভব করেন। এরপর এখানে থেমে ছাতিম গাছের ছায়ায় তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন। এই স্থানের আকর্ষণ থেকেই তিনি  ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ রায়পুরের জমিদার প্রতাপ নারায়ণ সিংহের কাছ থেকে ভুবনডাঙা গ্রামের বাঁধ সংলগ্ন এই ছাতিমতলাসহ বিশ বিঘা জমি বার্ষিক পাঁচ টাকা খাজনায় মৌরসী-স্বত্ব গ্রহণ করেন। পরে এখানে একটি আশ্রম গড়ে তুলেন।

আমার ক্যামেরায় শান্তিনিকেতনের দর্শনীয় জায়গা

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে এখানে একটি  দালান বাড়ি করেন।  প্রথমে এটি ছিল একতলা, পরে দোতলা করা হয়। বাড়ির উপরিভাগে খোদাই  করা আছে― সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং মহর্ষির প্রিয়, উপনিষদের এই উক্তিটি। তিনি নিজে বাড়ির একতলায় ধ্যানে বসতেন। তাঁর অনুগামীরাও এখানে এসে থেকেছেন। কৈশোরে বাবার সঙ্গে হিমালয়ে যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কিছুদিন বাস করেন। ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় স্থাপনের সময়ও রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল সপরিবারে এই বাড়িতে বাস করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ এখানে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে কালে এখানে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শম্পা লা রয় , ডাঃ দেবাশিস চক্রবর্তী ,সুলতানা ,আমি ও কামরুল ভাই

বোলপুর রেলস্টেশন পৌঁছে গেলাম সাড়ে তিন ঘন্টা বাদেই ।নেমেই পড়লাম বৃষ্টির মুখে ।তবে তিন চাকা প্রস্তুত ছিল বলেই রক্ষা।আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতন কটেজে রাত কাটাবার ,কিন্তু আগ থেকে বুকিং দেওয়া হয়নি বলে একটি প্রাইভেট হোটেলে কিছুটা সময় কাটিয়ে শাড়ি পড়ে ঘুরতে বের হলাম। রবিঠাকুরের আশ্রমে এসেছি, দেশি শাড়ি না পড়লে কি হয়!

বিশ্বভারতীর উপচার্য তখন ছিলেন দেশের বাইরে, শুনেছি তাঁর আদি বাড়ি সিলেটে। তাই নিজের লেখা কিছু বই তাঁকে দেবার ইচ্ছে থেকেই প্রথমে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলাম। লাল কাঁকড় বিছানো পথ , দুই পাশে গাছ গুলো এমন করে সাজানো যেন তারাই শৃংখলার সাথে বিদ্যা পাঠ করছে। সিঁড়ি বেয়ে অফিস রুমে প্রবেশ করতেই দু'জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে দেখা হয়ে গেল –শম্পা লা রয়, ডেপুটি রেজিস্টার  এবং ডাঃ দেবাশিস চক্রবর্তী ,জয়েন্ট রেজিস্টার ।কিছুটা সময় তাদের সাথে আলাপচারিতা শেষে নেমে এলাম পুরো শান্তিনিকেতন দেখতে। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এসেছে তখন।

শান্তিনিকেতন মূলত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আশ্রম। ১৯২১ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বিকেলের দিকে বিশ্বভারতী ক্যাম্পাস ঘুরে উত্তরায়ন কমপ্লেক্সে চলে এলাম আমরা। ভিতরে কড়া নিরাপত্তা।  সময় খুব কম হাতে ,জাদুঘর বন্ধ হয়ে যাবে । তাই দ্রুত টিকিট কেটে প্রথমে বিচিত্রা ভবনে ঢুকেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। এটি কবিগুরুর স্মৃতি সংবলিত সমৃদ্ধ জাদুঘর। জাদুঘরে রবীন্দ্রনাথের ফুলদানি, তার নির্মিত কাঠের বাক্স, জাপানের উপহার, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.লিট প্রদানকালে কবির ব্যবহৃত পোশাক, শিশুকাল থেকে পৌঢ়ত্ব পর্যন্ত কবির নানা বয়সের ছবি, গুরুত্বপূর্ণ দলিল, কবির চিত্রকর্ম, রাষ্ট্রপ্রধানদের দেয়া উপহার সামগ্রী, নোবেল পুরস্কার (প্রতিকৃতি) দেখে অভিভূত হলাম। এরপর চলে এলাম উদয়নে। এটি কবিগুরুর বাসভবন। এই ভবন তৈরিতে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এখানে বসেই কবি আশ্রমবাসী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে কবিতা পাঠ, নাটক ও জলসার আয়োজন করতেন।

ছবিতে চোখ জুড়ানো শান্তিনিকেতন

ঝুপ করেই সন্ধ্যা নেমে এলো,আজতো আর তেমন কিছু দেখা হবে না।তাই কচুরী খেতে ঢু দিলাম একটি টিনের হোটেলে । কবিগুরু রসগোল্লা খেতে পছন্দ করতেন খুব,তার নিবিষ্ট পাঠক ; তাই আমরাও বাদ দিলাম না ।চার চার খানা রসগোল্লা মেড়ে দিলাম। সে রাতে শান্তিনিকেতনে  অধ্যক্ষ দম্পতির  (ডঃ উৎপল মন্ডল এবং রিতা মন্ডল ) বাড়িতে আড্ডা দিয়েই কাটিয়ে দিলাম।পরদিন ভোর হতেই বেরিয়ে পড়লাম বাকীটা দেখতে ।

শ্যামলীর পথ ধরেই হাঁটা আরম্ভ করলাম । ১৩৪২ সালের ২৫শে বৈশাখ জম্মদিনে কবি এই গৃহে প্রবেশ করেছিলেন। এর পাশেই পুনশ্চ। কবি ১৯৩৬ সালে শ্যামলী থেকে পুনশ্চতে এসে ওঠেন। এ বাড়ির ছাদহীন খোলা জানালা দেয়া বারান্দা কবির বিশেষ প্রিয় ছিল। এ বাড়িটির কাছেই উদীচি নামে দোতলা মনোরম বাড়ি। ১৯১৯ এর শেষদিকে এই বাড়িতেই কবি বসবাস করেছেন। একটু এগোলেই কোর্নাক। ১৯১৯ সালে নির্মিত এই বাড়ি নানা বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। শান্তিনিকেতনের ঐতিহাসিক এই পাঁচটি বাড়িই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত। দৃষ্টিনন্দন পাঁচটি বাড়ির ছবি তোলার অনুমতি না থাকায় ছবি তোলা হয়নি।

ছবিতে রবি ঠাকুরের গাড়ি এবং বেলজিয়াম কাঁচের উপাসনালয়

কিছু দূর এগুতেই যে জায়গাটিতে এসে আমার মুগ্ধতা বিস্ময়ে রূপ নিল তা হচ্ছে উপাসনালয় । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে উপাসনা গৃহ ভবন প্রতিষ্ঠা করেন। রঙিন বেলজিয়াম কাঁচ এবং মার্বেল পাথরে উপাসনা গৃহের চারপাশ অলংকৃত। এখানে সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার। মঙ্গলবার অর্ধদিবস ছুটি। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম কবির বাড়ির দক্ষিণ পাশে। এদিকটায় অনেক আম গাছ রয়েছে। একটি আম গাছের তলায় বড় বেদী দেখে থমকে দাঁড়ালাম। পরে জানলাম মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এখানে 'ছাতিমতলায়' বসে উপাসনা করতেন।  আবার বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেল ,এখানে ছবি তুলতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই ।অনবরত চলতে থাকলো আমাদের হাতের মোবাইল  এবং ডি এস এল আর।

হাঁটতে হাঁটতে বকুল বীথির দিকে চলে গেলাম । গাছের নিচে যে জায়গাগুলো  চোখে পড়লো সব ক্লাশ রুম। এখানে ক্লাশ হয়। গাছের তলায় যে বেদীগুলো দেখা যাচ্ছে তাতে বসেই চলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকার্যক্রম।

খোলা ময়দান পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেবলি মনে হয়েছে –আহা ! যদি একটা ডিগ্রী অন্তত এখান থেকে নেওয়া যেত ।জাহাঙ্গীরনগর আর শান্তিনিকেতন দু'টো এক করে দিতে চাইলো মন ।এরপরেই দেখলাম কালো বাড়ি। মাটির তৈরি, দেয়ালে রয়েছে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু ও ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজের বিভিন্ন কারুকাজ। রবিঠাকুরের সহজপাঠে রয়েছে দেয়ালের সেইসব চিত্র। যেমন, তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে, অমল ও দইওয়ালা ইত্যাদি।

কলকাতার খুব কাছে এতো শান্ত একটি শহর রয়েছে তা নিজ  চোখে না দেখলে আসলে বিশ্বাসই হয় না ।শহুরে জীবনের সমস্ত সুবিধা এখানে আছে ,আছে বিদ্যুৎ, ২৪ ঘন্টা গাড়ির সুবিধা, হাসপাতাল, ওয়াই –ফাই। তারপরো কি এক নির্জনতা যেন ছেয়ে আছে পুরো শহরে ।কোন বড় বড় বাড়ি বা অফিস নেই,উঁচু উঁচু অট্টালিকা নেই ,চারদিকে কেবল সবুজের উৎসব । ইচ্ছে করছে কোন এক বসন্ত দিনে এখানে এসে কবির কন্ঠে গান ধরতে –আহা আজি এ বসন্তে,এতো ফুল ফোটে, এতো বাঁশি বাজে, এতো পাখি গায় …।

ছবিতে জাদুঘরের ভেতরের দৃশ্য (অনুমতি সাপেক্ষে )

পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানকে ৷  বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গান, নাচ, এশিয়ার বিভিন্ন ভাষা নিয়ে গবেষক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষা এবং বিভিন্ন গবেষণার ব্যবস্থা রয়েছে ৷ এই বিশ্ববিদ্যালয়টির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, প্রথম থেকেই এখানে মেয়েদের ভর্তি এবং নারীশিক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হতো এবং এখনও সেই ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়েছে ৷ শান্তিনিকেতনে যে ছাত্র নেই তা নয়, তবে উল্লেখযোগ্যভাবে ছাত্রীদের সংখ্যা অনেক বেশি৷

মাত্র ১২ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে প্রথম এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপর থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষের পায়ের ধুলোয় ধন্য হয়েছে এই স্থানটি। এই স্থানে বেশীক্ষন দাঁড়ালে কবিগুরুকে খুব নিবিরভাবে উপলব্ধি করা যায় । মৃত্যুর কিছুদিন আগে কবি এই শান্তিনিকেতন সম্পর্কে লিখেছিলেন- 'যখন রব না আমি/মর্ত্যকায়ায়/তখন স্মরিতে যদি হয় মন/তবে তুমি এসো হেথা নিভূত ছায়ায়/যেথা এই চৈত্রের শালবন।'

তথ্য কৃতজ্ঞতা: http://www.risingbd.com/agriculture-news/60284

ভারত ভ্রমণ বিড়ম্বনা:

এ অব্দি যতোবার ভারতে এয়ারে গিয়েছি তেমন কোন অসুবিধায় হয়নি। তবে সুন্দরী বিমানবালারা যখন জিজ্ঞেস করেন –ভেজ নাকি নন ভেজ ,উত্তর দেবার আগেই ও প্রান্তের এয়ারপোর্ট চলে আসে।তাই এবার ভাবলাম , লোকের পরিমান বেশী ; বেশ আড্ডা দিয়েই মৈত্রী এক্সপ্রেসে যাব ।কিন্তু ওটা কাটতেও পাসপোর্ট সাথে নিতে হয়, এবং তা কমলাপুর রেলস্টেশান না গেলে পাওয়া মুশকিল। আমরা একটি এসে বুথ নিয়ে নিয়েছিলাম ঠিকি,কিন্তু বাংলাদেশের গেদে স্টেশান ক্রস করবার সময় সবাই বলাবলি করলো –ল্যাগেজ নিয়ে নামতে হবে।তখনিতো গেল মেজাজ চড়ে, ট্রেনের বগিতে ঢু মারলেই তো ল্যাগেজ চেক হয়ে যায় ।কয়েক'শ যাত্রী ,খুব সময় লাগার কথা নয় ।কিন্তু যাবার পথে দু'বার আর ফেরার পথে দু'বার এই মোটমাট চারবার ভারী ভারী ল্যাগেজ টেনে নিতে যা কষ্ট হয়েছে তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। কামরুল ভাইয়ের বকাটা খেয়েছি আমি,কারণ রেল ভ্রমণের আগ্রহটা আমারি ছিল।

ট্রেন ছাড়াও এখন বেশ কয়েকটা ভালো ভালো বাস সার্ভিস হয়েছে। ইচ্ছে করলে বাসেও বেশ ইকোনমি হতে পারে। ঘোরাঘুরির মাঝ পর্যায়ে একদিন দেখলাম কামরুল ভাই তার মোবাইল খানা ট্যাক্সি ক্যাবে ফেলে চলে এসেছেন ।ওখানে যে বিদেশীদের জন্য সিম তোলা সহজ নয় তা আমরা বুঝতেই পারিনি ।বাংলাদেশেতো কেজি দরে সিম পাওয়া যায়, কিন্তু পাসপোর্ট দেখিয়েও আমরা সাতদিনে একটা ইন্ডিয়ান সিম তুলতে পারিনি। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতোন বিনা ইথারে ঘুরে বেড়িয়েছি। তাই যারা ভারতে যাবেন আগ থেকেই বন্ধুদের বলে রাখবেন আপনার জন্য একটা সিম তুলে রাখতে ।

সে যাক, বিড়ম্বনা  যতো খানিই হোক, দিন শেষে যুব রাজ্যের খোলা ছাদ থেকে যখন কালি পূজোর আলোক স্বজ্জা আর ঢাক ঢোলের আওয়াজ শুনেছি বেশ অন্যরকম লেগেছে। রাস্তা আটকিয়ে এই আনন্দ যাত্রা অনেক খানি অমানবিক মনে হলেও শিশু কিশোরদের আনন্দ উল্লাশ প্রাণ ছুঁয়ে গেছে। আমি তো এই বসন্তেই আর একবার শান্তিনিকেতন যেতে চাই যেখানে রবী ঠাকুরের ফাগুন ফুলের আগুন খেলা করে।