এক লড়াকু নাচিয়ে আলিফের গল্প

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 21 Dec 2017, 01:51 AM
Updated : 21 Dec 2017, 01:51 AM

ছেলেরা আবার নাচ করে নাকি? এমন পুরনো বাক্য বহুবার উচ্চারিত হয়েছে এদেশের পুরুষ নৃত্যশিল্পীদের প্রতি। যারা এই ধরণের কটাক্ষকে পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তারাই নাচের ইতিহাসে নিজের নাম লেখাতে পেরেছেন। বাংলাদেশের নৃত্যাঙ্গনে এমনি এক নতুন নাম মোফাসসাল আল আলিফ। নাচই তার ধ্যান-জ্ঞান, একমাত্র স্বপ্ন। আমার সামনে বসে আছে দর্শক মাতানো ২৪ বছরের তরতাজা তরুণ, তার মুখেই জেনে নিলাম নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠার গল্প।

আলিফের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ভালুকার হোসেনপুর, তাই শুরুটা হয়েছিল বেশ প্রতিকূল পরিবেশে। সারা গ্রামে ছেলে তো দূরে, একটা মেয়েও তখন নাচ করতো না। কিন্তু নাচের প্রতি আলিফের আগ্রহ তৈরী হয়েছিল বিটিভিতে নাচের অনুষ্ঠান দেখে। নিজ গ্রামে নাচ করবার মতোন তেমন কোন অনুষ্ঠান হতো ন, তাই ২০০৮ সালে আলিফ তার জায়গাটা পরিবর্তন করে টাংগাইল শখীপুর চলে যায়। তার অবশ্য ইচ্ছে ছিল ঢাকাতে থেকে নাচ শেখার, কিন্তু বাবা বেঁচে না থাকায় একমাত্র মায়ের পক্ষে ঢাকায় রেখে লেখাপড়া চালানো বেশ কঠিন ছিল। কলেজে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলিফ ফ্রিহ্যান্ড এবং হিপ-হপ শেখা শুরু করে ঘরে বসে মিউজিক সিস্টেমের সাহায্যে।

সেরা নাচিয়ে ২০১৫ তে আলিফ

এলাকায় প্রায় সময়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় আর সেখানেই ডাক পড়ে আলিফের। আলিফ যে ভালো কন্টেম্পোরারি করতে পারে তা ইতিমধ্যে সবার মুখে মুখে প্রচারিত। ২০০৯ এর দিকের কথা, একবার স্টেজ মাতিয়ে সে সন্মানীও পেয়ে গেল। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি, ছেলে বলে যারা তাকে অবহেলা করেছিল তারাও বাহবা দিয়ে দিল তার চমৎকার নাচের পরিবেশনা দেখে। তখন পর্যন্ত আলিফ ভেবেছিল যে সে ডাক্তারী পড়বে, কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজিতে ভর্তি হয়ে তার চিন্তায় পরিবর্তন এলো।

সারাদিন ক্লাশ করার পর নাচ চর্চা করবার একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দরকার হয়ে পড়লো, কিন্তু পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরেও শুধু নাচ শেখার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেল না। উপয়ান্তর না দেখে আলিফ জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের সাথে যোগ দিয়ে মঞ্চে অভিনয় করা আরম্ভ করে দিল, কিন্তু নাচ তার রক্তে মিশে আছে; শুধু অভিনয় তাকে তৃপ্ত করতে পারলো না। তাই ২০১৩ সালে মর্ডান নাচে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে ভর্তি হয়ে গেল ঈগল ড্যান্স কোম্পানী-তে। সেই বছর ডিসেম্বরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির উপর একটি বড় অনুষ্ঠান হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। এম আর ওয়াসেক-এর তত্বাবধানে আলিফ উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে ক্লাসিক্যাল নাচের প্রতিও আলিফ ধীরে ধীরে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

সেরা নাচিয়ে ২০১৫ তে আলিফ

নন্দন কলা কেন্দ্রে শিক্ষানবিশ হয়ে আলিফ বেশ কয়েকটি শো করতে থাকে, পাশাপাশি জাবিতেও নাচ করে দর্শক মাতিয়ে রাখে। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে মাটি সিদ্দিকীর সাথে পারফর্ম করার মধ্য দিয়েই শুরু হয় আলিফ ও মাটি জুটির যাত্রা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে অধ্যয়নরত গাজীপুরের মেয়ে মাটির সাথে চমৎকার সমন্বয় করে ফোক, আধুনিক, রাবিন্দ্রীক নানান ধরনের ফিউশন উপহার দিতে থাকে দর্শকদের। ওই বছরই ইউজিসি আয়োজিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় নৃত্য বিভাগের গ্রুপ পর্বে দল চ্যাম্পিয়ন এবং একক নৃত্যে ফার্স্ট রানারআপের মুকুট ছিনিয়ে আনে আলিফ। এরমধ্যে বেশ ক'টি দেশে কালচারাল ফেস্টিভালে বাংলাদেশের হয়ে নৃত্য পরিবেশন করেও সম্মাননা লাভ করে বেশ কয়েকবার।

বিটিভির নাচের অনুষ্ঠানে আলিফ ও মাটি

বর্তমানে আলিফ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য সংগঠন 'কালবৈশাখী'র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। নাচ শেখা, শেখানো এবং বিভিন্ন নাচের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা তার রুটিন বাঁধা জীবন। আশ্রম নামে একটি আর্ট পারফর্মিং স্কুল খুলেছে কিছু দিন হলো। দলীয় নৃত্যে তার নেতৃত্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একাধিকবার পুরস্কার জিতেছে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। বিটিভির সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০১৫ সালে দলীয় নৃত্য বিভাগে প্রথমস্থান অধিকার করে সে। ওই বছরই চ্যানেল আই সেরা নাচিয়ে ২০১৫- তেও পুরস্কার জিতে নেয়। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ২০১৬- এর সৃজনশীল একক নৃত্যের পুরস্কারো যায় তার থলিতেই।

বিইউপি ইন্টার ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ন ২০১৭, ২০১৪  এবং ২০১৬ পুরস্কার নিচ্ছে আলিফ

বিইউপির আয়োজনে দুই দুই বার আলিফ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সন্মাননা নিয়ে আসে জাবি গ্রুপ হিসেবে। কিন্তু জাবির প্রশাসন থেকে তাকে বা তার দলকে সেভাবে সহায়তা করা হয় না বলে এই নাচিয়ের চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কষ্টের প্রতিচ্ছবি। বরং শিক্ষকরাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে আলিফের গ্রুপকে উৎসাহ দিয়ে আসছে বলে সে জানায়। জাবির ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র তার দলের ব্যাপারে যত্নশীল হলে কালবৈশাখী গ্রুপ সহজে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম লেখাতে সক্ষম হবে।

আসছে জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতে ওড়িষ্যায় অনুষ্ঠেয় ইন্টান্যাশনাল ড্যান্স ফেস্টিটিভালে অংশ নেবে আলিফ ও তার দল। এছাড়া একই মাসের ২০ ও ২১ তারিখে পুনেতে অনুষ্ঠেয় 'ড্যান্স ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কানেক্ট' ড্যান্স ফেস্টিভালে অংশ নেবে। এখানে আলিফ ও মাটি দ্বৈত নাচ পরিবেশন করবে। এই ফেস্টিভালে ভারত, রাশিয়া, পোল্যান্ডের নৃত্যশিল্পীরা অংশ নেবেন।

ছবিতে বিভিন্ন মোহনীয় ভঙ্গিমায় আলিফ ও মাটি

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘন হয়ে এলো, সাভার ফিরতে হবে দেখে উঠে যাচ্ছিল আলিফ। আমি কৌতহলবশত শেষ প্রশ্নটা করে ফেললাম- এতো ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে যদি খুব বড় স্যালারির জব পেয়ে যাও তখন কি আর নাচ করবে?

দীপ্ত কন্ঠেই উত্তর দিল আলিফ- আমি এমন কাজ করতে চাই যেন দিন শেষে ঠিকঠাক নাচ চালিয়ে যেতে পারি। ইচ্ছে আছে দিল্লী থেকে নাচের উপর দু'বছরের কোর্স শেষ করে নিজেই দেশে একটি ইন্সটিটিউট খুলবো, সেখানে সাধারণ ছেলে-মেয়েরা যেন নাচ শিখতে পারে।

ছবিতে নান্দনিক চিত্রে আলিফ

নাচের প্রতি এমন নিবেদিত শিল্পী এই যুগে খুব দেখা যায় না। টেলিভিশন খুললে যতো নাটক আর গানের অনুষ্ঠান সেই মতো নাচের অনুষ্ঠান নেই বলা চলে। এই বিলুপ্ত প্রায় শিল্পকে এভাবেই আজন্ম বাঁচিয়ে রাখবে এমন লড়াকু নাচিয়েরাই। এমন বলিষ্ঠ নৃত্যযোদ্ধার জন্য আমাদের শুভকামনা থাকবে সব সময়।