স্বর্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরে এক ‘শ্বাসরুদ্ধকর’ যাত্রা

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 28 May 2022, 07:10 PM
Updated : 28 May 2022, 07:10 PM

থাজিওয়াস গ্লেসিয়ার

গেল রোজার ঈদে বেশ লম্বা একটা ছুটি পেয়ে গেলাম হাতে। শুনেছিলাম দীর্ঘ দু'বছর পর জম্মু ও কাশ্মীর খুলে দেওয়া হয়েছে। তাই ভারতীয় ভিসা করে নিলাম হাজার হাজার মানুষের ভিড় উপেক্ষা করে।

শ্রীনগরে যাবার  আগে আমি অনলাইনে বেশ কিছু হোটেলে বুকিং দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। করোনা'র কারণে দুই বছর কাশ্মীরে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। টানা দুই বছর পর যখন সমস্ত হোটেল খুলে দেওয়া হয়েছে  তখন সেখানে হোটেল ভাড়া অনেক বেশি বেড়ে গেছে । তাই কলকাতায় যোগযোগ করাতে ওখানকার বন্ধু সাদিক ভাইয়ের কল্যাণে  আমি একটি গেস্ট হাউজে  থাকার সুযোগ পেলাম প্রতিদিন মাত্র এক হাজার রুপির বদৌলতে । এই সুবিধা যে সবাই পাচ্ছেন তা কিন্তু নয় । সে যাই হোক, আমি ম্যানেজার ভাইকে বলে তিন তলার ওপরে কোনায় একটি  রুম নিলাম। আমার টিমের অন্যান্যরা বাই রোডে শ্রীনগর পৌঁছে গেছে ।  আমার ইচ্ছে রাতে শ্রীনগরে থেকে সোনমার্গ, পেহেলগাম, গুলমার্গ দেখে নেওয়া । খুব ভোরে বের হয়ে প্রতিটি স্পট দেখে আবার এই রুমে ফিরতে চাই ।

আগের রাতে ড্রাইভারকে ভোর ছ'টায় আসতে বলেছিলাম রেস্ট হাউজের সামনে। ওরা যে এতো পাংচুয়াল হবে তা বুঝিনি। আমার টিমের সব্বাই বেশ পাংচুয়াল। ছ'টার মধ্যে আটজনে গাড়ি ভরে গেল। ড্রাইভার জোরে টান দিতেই পৌঁছে গেলাম দিল্লি এবং রাসুই  রেস্তোরাঁয়। ডাল লেকের পাড় ঘেঁষে যাবার সময় আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো – কোনো শহর এতো স্নিগ্ধ হয় কীভাবে !

দিল্লি রসুইতে ঢুকে জানতে পারলাম  এখানে ডিম ভাজি বা মামলেট  ধরনের কোনো খাবার হয় না । নাস্তা বলতে আলু-পরোটার সাথে আচার । কাশ্মীরিদের নিজস্ব একটি ভাষা আছে; এরা হিন্দী বলে না। আমাদের গ্রুপের রাসেল আবার দারুণ হিন্দি  বলে; মনে হয় সারা জীবন কেবল হিন্দী সিরিয়াল দেখে কাটিয়েছে । এই ছেলে সাথে না থাকলে আমরা সব কিছুতে ঠকে যেতাম। এখানে দশ টাকার জিনিসও চায় ৫০ টাকা। দফায় দফায় দামাদামি করতে হয়। আমরা খুব দ্রুত নাস্তা শেষ করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। সোনমার্গ দেখে আবার সন্ধ্যায় ফিরতে হবে।

সোনমার্গ

আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ে যাচ্ছি, না জানি রাস্তার মধ্যে কতবার ঝাঁকি খেতে হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিল কাশ্মীর। এতো চমৎকার পিচ ঢালা রাস্তা পাবো এটা আমি জন্মেও কল্পনা করিনি । শহর থেকে মাত্র তিন ঘন্টার দুর্দান্ত পথ। দুই ধারে পাহাড়। পাথরের বুকে আছড়ে পড়ছে জল। দূরে সবুজ পাহাড়। আহা এমন স্বর্গীয় অনুভূতি এর আগে কোনোদিন হয়নি । প্রায় ১০৮ কিলোমিটার লম্বা একটি নদী পাড় হলাম যা হলো ঝিলাম নদীর উপনদী । জম্মু-কাশ্মীরের একমাত্র নদী যেখানে তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আছে । অসম্ভব ঠাণ্ডা এর পানি । পাড়ে দাঁড়িয়ে অনেক ছবি তুলে নিলাম ।

উত্তর–পূর্বে গন্দারবাল এলাকার  হিল স্টেশন হচ্ছে সোনমার্গ। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ২৭৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। আকাশের বিপরীতে এটির তুষার ঢাকা পাহাড় রয়েছে। জোজিলা পাথ পৃথিবীর অন্যতম মারাত্মক রাস্তা।  আমরা যে রোডে যাচ্ছি এটাই মূলত লাদাখের রোড ।  লালচক থেকে সোনমার্গ প্রায় ৮৩ কিলোমিটার দূরে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় মিডো অব গোল্ড । চারিদিকের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য মনকে শীতল করতে লাগলো ধীরে ধীরে।  গান্দেরবল, কঙ্কন, গুন্দ বিভিন্ন পাহাড়ি জনপদ পেড়িয়ে গাড়ি এগুচ্ছে। এই উপত্যকার কোথাও একটা লেক আছে যার জল থেকে সোনালি রঙ ছড়িয়ে পড়ে । এই জন্যে নাম হয়েছে সোনমার্গ অর্থাৎ সোনালি উপত্যকা । সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় হিম পাহাড়ে; এটা আমি ট্রাভেল ব্লগে আগেই দেখেছি ।

সোনমার্গ ভ্যালি

দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সাদা পাহাড়ের ওপর তখন সোনালি রোদ পড়েছে। কেমন চকচক করে উঠলো পাহাড়গুলো মুহূর্তে। চারপাশে সবুজ আর সাদা পাহাড়ের অসাধারণ সমন্বয়। সারা জীবন শুধু সবুজ দেখে এসেছি। জীবনে এই  প্রথম এতো কাছ থেকে সবুজের মাঝে সাদা পাহাড় দেখছি। এতো সুন্দর! এতো সুন্দর! আমার তখন কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি  অবস্থা। আমরা উপত্যকার মাঝে চলে এসেছি ।

এরমধ্যে আমার গ্রুপের সাথে পোনির (ঘোড়া) রাইডারদের দর কষাকষি শুরু হয়ে গেছে। কাশ্মীরে এলে খুব শান্তভাবে দামের ব্যাপারটি ক্লিয়ার করে নিতে হবে। এখানে অনেক  উল্টোপাল্টা দাম বলে যদিও ; তবে এরা আবার বাংলাদেশিদের বেশ চেনে। কারণ ক্রীকেট দেখে বেশি  , সাকিব আল হাসানের ফ্যান সব।

এতোকাল থাজিওয়াস গ্লেসিয়ার নামে কেবল আকর্ষিত হয়েছি। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঘোড়ায় করে যেতে হবে এই হিম পাহাড়ে। খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছি বাইরে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক্ষণ দরদাম করার পর ঠিক হলো প্রতি ঘোড়ায় ৮০০ রুপি। সাত জন সাতটা ঘোড়া এবং সাথে তিন জন গাইড যাবে-আসবে হেঁটে । এই হিম পাহাড় বাদে সোনমার্গে দেখার আরো অনেক লেক আছে। কিন্তু সব জায়গার অনুমতি এখানকার সরকার সবাইকে দেবে না। আর সময়ও লাগবে আরো বেশি। আজ ঘোড়ায় চড়ার সুযোগ হয়েছে। যেখানে বাজরাঙ্গি ভাইজান সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে সেখানে যাবো; কোনো ভাবেই মিস করা যাবে না। তাই ঘোড়সওয়ারি হলাম; গন্তব্য  থাজিওয়াস গ্লেসিয়ার,  বরফ ঢাকা সাদা পাহাড় ।

আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি পথের  চারপাশের পরিবেশ কি হতে পারে! আমার কল্পনাতেও ছিল না সামনের  দিকে আমার জন্য কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে! আমার যে ঘোড়া ঠিক হয়েছিল তা নাকি সিনিয়র ঘোড়া অর্থাৎ সে জানে কোথায় যেতে হবে এবং কোথায় গিয়ে থামতে হবে । আমার সাথে কোনো গাইড থাকবে না সেটা আমি আগে বুঝিনি। ঘোড়া ৭২ কেজি নিয়ে সামনে এগুচ্ছে আর আমি আতংকে কুঁকড়ে যাচ্ছি । কিছুদূর যাবার পর আমি চোখের সামনে যা দেখলাম সেটা কোনো ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না । এমন সুন্দরও হয় প্রকৃতি! নিচে লেক , উপরে সাদা পাহাড়।  পাশে পাইন বন আর বিশাল খাদ পেড়িয়ে  আমার এগুচ্ছি । ঘোড়া উপরের দিকে উঠতে চাইলে আমি সামনে ঝুঁকে যাচ্ছি আবার ঘোড়া পেছনের দিকে যখন নেমে যাচ্ছিল আমি পেছনের দিকে হেলে পড়ছি । সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা । দেশে বোটানিক্যাল গার্ডেনেও ঘোড়াতে উঠিনি, পাহাড়ে এসে ঘোড়ায় চড়া অভ্যস্থ হয়ে গেলাম কয়েক মিনিটের মধ্যে।

থাজিওয়াস গ্লেসিয়ারে পর্যটকদের বরফ খেলা

ভয় রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে হিম পাহাড়ে পৌঁছলাম। শ'খানেক ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মাঝের খোলা জায়গায়। দূরে পাহাড়ের শরীর জুড়ে জমাট সাদা তুষার। পর্যটকেরা খুব মজা করছে। স্কেডিং করছে। একে অন্যকে বরফ ছুড়ে মারছে। চারপাশে সবুজ থাকলেও মাঝের কয়েকটি পাহাড় কেবল বরফ দিয়ে ঢাকা। এখানে তাপমাত্রা এই মে মাসের গরমেও বাড়েনি। আমি খেয়াল করলাম এখানে যত না ঠাণ্ডা তার চাইতে বেশি শীত লাগে রাতে শ্রীনগর শহরে ।

এতো চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেবল সুন্দর উপভোগ করতে হয় । বরফে গড়াগড়ি  দিচ্ছে কেউ। কেউ টানা দিয়ে উঠছে উপরের দিকে। স্থানীয়রা একটি গাড়ি বানিয়েছে; ওতে পর্যটকদের বসিয়ে উপরে ওঠায় রশি দিয়ে টেনে আবার পেছনে বসিয়ে নিচে নেমে আসে দ্রুত ।  আমরাও ছোট বেলার বরফ পানি খেলায় মেতে উঠলাম। পাশেই লেকের পানিতে বরফ গলে পড়ছে। সেখানে পা ডোবাতেই  এক অদ্ভূত  ভালো লাগায় মজে গেলাম। পশ্চিমে সূর্য ডুবছে তার আভা এসে পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। রাতের মধ্যে ফিরতে হবে শহরে, কাশ্মীরি কাওয়া ( বিশেষ চা) পান করে রওনা করলাম। পেছনে রেখে এলাম হিম পাহাড়, সবুজ উপত্যকা।

পরদিন পেহেলগাম যাত্রা। তাই দিল্লী রসুইতে রাতের খাবার খেয়ে দিলাম ঘুম । ওরা কোনো চিকেন বা বিফ করে না। পনির দিয়ে সবজি আর ছোলা  ডাল; ভিন্ন স্বাদের মুখরোচক খাবার দিয়ে জম্পেশ ডিনার হলো । যারা ভাত খেতে চান তাদের কিছুটা কষ্ট করতে হবে এ শহরে। ডাল লেইকের ২ নম্বর গেটেই পাওয়া যায় সাদা ভাত –গো মাংস। এখানে মেন্যু চার্টের বাইরে দাম রাখা হয় না। সারাদিনের খাবার ৫০০ রুপির মধ্যে সেরে নিতে পারবেন । আমার সোনমার্গে গিয়ে ভেড়ার মাংস আর সাদা ভাত খেয়েছি ২০০ রুপির মধ্যে একজনের হয়ে গেছে আর পানি সাথে নিয়ে নিয়েছি বলে দফায় দফায় বাড়তি খরচ হয়নি ।

থাজিওয়াস গ্লেসিয়ারের পথে ঘোড়ায় চড়ে রোমাঞ্চকর যাত্রা

শ্রীনগরে ফেরার পথে আপেল  বাগানে ঢুঁ দিলাম। চেয়েছিলাম টিউলিপ ফুল দেখবো কিন্তু এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ সেই ফুল ঝড়ে গেছে। বাগানে এখন নানা রঙের গোলাপ আর নাম না জানা অনেক ফুল । মুখের সামনে আপেল ঝুলবে কল্পনাও করিনি। আমি আপেল বিক্রেতার কাছে জুস চাইলাম  পানি মেশানো ছাড়া। ভদ্রলোক হেসে পুরো প্রসেস আমার সামনেই শুরু করলেন । আস্ত আস্ত আপেল ব্লেন্ড করে কোনো চিনি ছাড়া দিলেন আমার হাতে। আমরা কিছু তরতাজা ফল কিনে নিলাম। ফেরার আড়াই ঘন্টার পথ নিমিষে ফুরিয়ে গেল ।

পেহেলগাম 

শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের দূরত্ব প্রায় ৯৭ কিলোমিটার। উচ্চতা সাত হাজার ফুটের কাছাকাছি । লিডার নদীর পাশ ঘেঁষে ১২ কিলোমিটার দূরে আরু ভ্যালির দিকে গাড়ি যখন উঠছিল মনে হচ্ছিল স্রোতের মধ্যে ডুব দিয়ে থাকি অনেকক্ষণ। গরমের দেশ থেকে শীতের দেশে যাওয়ার এ এক অনাবিল আনন্দ। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গাড়ি বদলাতে হলো। অন্য একটা গাড়িতে আমরা ঢুকে গেলাম আরু ভ্যালিতে । এখান থেকেই কোলাহই  হিমবাহ ও কারসার লেকে ট্রেকিং করতে যান পর্যটকরা।

চারদিকে সাদা পাহাড় আর মাঝে সবুজ খোলা প্রান্তর। পাইন গাছগুলো এমন ভাবে সাজানো আছে মনে হয় এরা ছোট বেলা থেকেই খুব নিয়ম মেনে বেড়ে উঠেছে। একটার পর একটা থরে থরে সাজানো। ভ্যালিতে পা রেখেই গ্রুপের ছেলে-মেয়েরা স্থানীয় কাপড় পরে নিল। বাহারি রঙের পোশাক, রানীর গহনা আর ফুল নিয়ে তারা বিভিন্ন  ভঙ্গিমায় ক্যামেরার সামনে প্রস্তুত।  এবার বুঝতে পারছি কেন এই চমৎকার জায়গাটি শ্যুটিং করতে বেছে নেওয়া হয়। এই ভ্যালি রেখে পয়সা খরচ করে সুইজারল্যান্ড বা ইউরোপ গিয়ে শুটিং করার কোনো দরকারই হয় না ।

লিডার নদীর পাশ দিয়ে পেহেলগাম যাওয়ার পথের চারপাশ

পেহেলগাঁওয়ের অর্থ প্রথম গ্রাম। জোজিলা পাস অতিক্রম করে লাদাখ পার হয়ে অমরনাথ দর্শন করে কাশ্মীর যাওয়ার পথে এটিই প্রথম গ্রাম; সেই অনুযায়ী জায়গারও নাম l ইতোমধ্যে দেখলাম কেও কেও  শাল বিক্রি করছে, কাশ্মীরি  শাল বাংলাদেশে ভীষণ পরিচিত। দেখলাম আগ্রহীরা সেই শাল বিক্রেতাকে ঘিরে রেখে শাল কিনছে। বিস্তর দামাদামি চলছে সেখানে। আমাদের জন্য ড্রাইভার দ্বারা নির্ধারিত চল্লিশ মিনিট কেমন করে যে কেটে গেল তা টেরই পেলাম না ।

পেহেলগামে নয়নাভিরাম আরু ভ্যালি

গাড়ি  আরো উপরে উঠছে আর তখনি শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। হঠাৎ চারদিকে প্রকাণ্ড অন্ধকার নেমে এলো। আমরা চন্দনওয়াড়ির খুব কাছাকাছি। দেখলাম  শ'খানেক গাড়ির লাইন আর ওপাশ থেকে কাশ্মীরি সেনারা বিশাল আকারের ট্রাকে করে আসছে । আর্মির গাড়ি চলে যাবার পর আমাদের যাত্রা আবার শুরু হলো। আমি শুনেছি, কাশ্মীর থেকে দুর্গম অমরনাথ যাওয়ার পথে চন্দনওয়াড়িতে বেস ক্যাম্প করে রাত কাটান পর্যটকরা।

পেহেলগামের চন্দনওয়াড়ি

এরমধ্যে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে আগে গরম কফি গলায় ঢেলে নিলাম। ক্যাফেইন খুব উপকারি এমন প্রতিকূল পরিবেশে। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম পাহাড় বরাবর। হিম পাহাড়ে বরফ গলে পড়া জল আছড়ে পড়ছে শরীরে। মাথার ওপর টিপটিপ বৃষ্টি। এমন দৃশ্যের মধ্যে চুপ করে ডুব দিয়ে বসে থাকা বড্ড শান্তির।

পেহেলগামে অনেকেই রাত কাটায়। কারণ আকাশের  বিভিন্ন রঙ দেখার জন্য একটা আস্ত দিন থাকাটা জরুরি । কিন্তু আমাদের শহরে ফিরতে হবে আর দুই দিন আছে অফিস ছুটি। তার একদিন চলে যাবে গুলমার্গের পথেই । তাই সাড়ে তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা বেশ ঝরঝরে মুডে হোটেলে ফিরলাম । ড্রাইভার সাড়ে তিনহাজার রুপির এক রুপিও কম নেয়নি। আর পাহাড়ের গাড়িতে খরচ হয়েছিল আরো ৩০০০ রুপি।

পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসা পাইন, দেবদারু, ফ্লোরা, আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে প্রীতম আমাদের গাড়ি নীচের দিকে নামছে। ওপর থেকে যা দেখলাম তাতে আমাদের চোখ সরানোর কোন উপায় থাকলোনা । পহেলগাঁও থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে এই জায়গার নাম বেতাব ভ্যালি। ১৯৮৩ সালে নির্মিত সানি দেওল ও অমৃতা সিং অভিনীত হিন্দি সিনেমা 'বেতাব' সিনেমার শুটিং হয়েছে ওই স্থানে। লিডার নদীর ধার বিশাল এলাকা শুধুমাত্র ওই সিনেমার জন্য সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে তা এখন রীতিমতো পার্ক । শতশত গাড়ি পেছনে ফেলে আমরা বাচ্চাদের মতো হৈ হৈ করে নীচের দিকে নেমে গেলাম। নদীর ওপাশে সুদৃশ্য গাছের সারি, আলো, সিমেন্টের রাস্তা, চেয়ার, কাঠের সেতু পুরো ভ্যালিকে অসামান্য করে তুলেছে। মাথার ওপর বৃষ্টির জল আর পা ডুবে আছে লিডার নদীর জলে, আহা! এমন জীবন যদি শেষ না হতো আর!

দেখতে দেখতে সেই নির্ধারিত চল্লিশ মিনিটও শেষ হল ।ফিরতে হবে শ্রীনগর। আমরা প্রচন্ড ক্ষুধা ভুলে বসে আছি  এমন সুন্দরের কাছে বুঝি মানব অনুভূতিগুলো একেবারেই বিলীন হয়ে যায়।

বেতাব ভ্যালিতে লিডার নদীর স্রোত

গুলমার্গ

শ্রীনগর থেকে খুব ভোরে আমরা রওনা দেই। ট্যাংমার্গ থেকে গুলমার্গের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এই রাস্তাটি মনে হচ্ছে কোনো এক সীমা রেখার মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার পথ। সামনে যতোটা এগুচ্ছি সামনে সাদা পাহাড়ের ভেতর ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি। জীবনে কখনো রোপওয়েতে উঠিনি। আজ সেই অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে। গ্যান্ডোলার টিকিট দুই দিন আগেই অনলাইন থেকে কেটে নিয়েছি। কারণ  রোজার ঈদের ছুটিতে লাখ খানেক পর্যটক  এসেছে এই রাজ্যে;তাই আর রিস্ক নেইনি ।

গুলমার্গ জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকার বারমুলা জেলার অবস্থিত। পাকিস্তান সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার এবং শ্রীনগর থেকে গুলমার্গের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার । কোনো ব্রেক ছাড়া দেড় ঘন্টায় পাড়ি দেওয়া সম্ভব। গুলমার্গ নামকরণ নিয়ে নানান মত রয়েছে । কারও কারও মতে, হিন্দু দেবতা শিবের স্ত্রীর নামে এই পর্বতের নাম রাখা হয় গৌরিমার্গ যা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে গুলমার্গ হয়। আবার অনেকে মনে করেন, কাশ্মীরের সুলতান ইউসুফ শাহ চক ১৫৮১ সালে এই উপত্যকায় আসেন। পাহাড়ের ঢালে ফুলের বাহার দেখে তিনি এর নাম রাখেন গুলমার্গ। কাশ্মীরি ভাষায় গুলমার্গ মানে ফুলের উপত্যকা। শীতের সময় দিগন্ত জোড়া বরফে ঢাকা থাকে এই উপত্যকা । মে মাসের গরমে আমরা দেখলাম দূর পাহাড় বরফ দিয়ে ঢাকা আর ফুলের অপার সমাবেশ ।

বিস্ময়কর গুলমার্গ

ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে গুলমার্গে রঙ ও রূপের চমৎকার পরিবর্তন দেখা যায়। স্কিয়িং করার জন্য ভারতের শ্রেষ্ঠ জায়গা হল এই গুলমার্গ। গুলমার্গের মূল আকর্ষণ দু' টি। একটি হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্যাবল কার আর অন্যটি হলো এশিয়ার চতুর্থ স্কিয়িং অঞ্চল। এখানে ব্রিটিশ শাসনের সময়েই স্কিয়িং ক্লাব তৈরি করা হয়। শীতকালে এখানে অনেকে শুধু স্কিয়িংই করতে আসেন। এখানকার বরফের ঢালগুলো খুব একটা কঠিন নয়। তাই যারা স্কিয়িং করতে অনভিজ্ঞ  তারাও সহজে পেরে যান ।

আজ আমি অপেক্ষা করে আছি গন্ডোলায় উঠে ফেজ ওয়ান দেখার জন্যে। তিনটি ফেইজ রয়েছে; ফেইজ  এক, ফেইজ  দুই এবং চেয়ার লিফটের এর ফেইজ তিন। ফেইজ  এক যায় গুলমার্গ থেকে কংডোরি পর্যন্ত যা প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচুতে। ফেইজ  দুই যায় কংডোরি থেকে আফারওয়াত পিক পর্যন্ত যা প্রায় ১৩ হাজার ফুট উঁচুতে । আর ফেইজ  তিন তথা চেয়ার লিফট যায় কংডোরি থেকে মেরি সোল্ডার পর্যন্ত। ফেইজ এক অব্দি যেতেই আমাদের কাছে জন প্রতি ১২০০ রুপি নিয়েছিল। ফেজ দুই যেতে লাগবে আরো ৮০০ রুপি । গ্যান্ডলার ওপর আসা যাওয়া মাত্র ১৯ মিনিট বসে থেকে আমার মন হয়েছে,  যে অনুভূতি আমি পাচ্ছি তা কোনো রুপি দিয়ে হিসেব করলে চলবে না।

ফেইজ এক থেকে ফেইজ দুই যাত্রা

এই সময় তেমন বরফ নেই এখানে। তবে সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণে গুলমার্গের ভেতরের রূপ যেন ঠিকরে বের হচ্ছে । শত শত পর্যটক দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্যাবল গাড়ির অপেক্ষায়; এটাকেই গ্যান্ডোলা বলা হয় । গুলমার্গ যাবার যে রাস্তা এটার সৌন্দর্য বর্ণনা করবার ভাষা আর আমার নেই।

এখানেও একই নিয়ম। গাড়ি  ট্যাংমার্গ বাজারে  থেমে যাবে। ওখান থেকে পায়ের বুট ভাড়া করতে হবে ১০০ রুপিতে।  ঠকতে চাইলে আরো বেশি কিছু দেওয়া হয়ে যাবে। ফেইজ টুতে যাবার জন্যে কেউ কেউ কোট নিয়ে নিচ্ছে । আমার কাছে এই বুট একেবারেই অসহ্য। কিছুতেই হাঁটা যায় না। তবে বরফে পা রাখার জন্যে এটি খুবই দরকারি জুতো । প্রায় তিন ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ভীষণ বোর লাগতে লাগলো । ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকেও অনেক পর্যটক এসেছেন কাশ্মীরের অপার সৌন্দর্যে ভাসতে। কেরালা থেকে এসেছেন একটি কলেজের কিছু নারী শিক্ষক; তাদের সাথে ভাব বিনিময় করে অনেক ছবি তুলে নিলাম। একঘেয়েমি দূর হয়ে গেল।

আইস্ক্রিম থেকে শুরু করে আচার সবই বেচা কেনা চলছে। আমরাও কিছুক্ষণ পরপর এটা ওটা খাচ্ছি আর গল্প করছি ইংরেজি ভাষায় । অনেক উন্নত দেশ থেকেও এসেছেন পর্যটকেরা। তাই গল্পের বিষয়গুলোর ব্যাপকতা ছাড়িয়ে গেল । ইউরোপ থেকে একজন ভদ্রলোক তার মা আর খালাকে সাথে এনেছেন। তাদের বয়স ৮০ বছরের উপরে। এখানে সিনিয়রদের ভ্রমণের জন্য বিশেষ চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। মা-বাবাকে কাশ্মীর দেখানোর এই চমৎকার আয়োজন সত্যি প্রশান্তি এনে দিল ।

বুট ফেরত দেবার জন্য ট্যাংমার্গ বাজারটিতে আবার ফিরে এলাম। খুব ক্ষুধা পেয়ে গেছে তাই ভাত খুঁজতে বের হলাম। ভেড়ার মাংস ঠিকই পাওয়া গেল তবে দুপুরের খাবারটা আর সেই সোনমার্গের ভেড়ার স্বাদ ফিরিয়ে আনতে পারলো না। ক্লান্ত শরীর অপরূপ গুলমার্গ পেছনে ফেলে এগিয়ে চললো শ্রীগরের পথে । পথের বাঁ পাশেই সাজানো  গোছানো কারখানা। এখানে কাশ্মীরি শাল বিক্রি হচ্ছে। তাই নেমে গেলাম মনের মতো শাল কেনার যুদ্ধে; চলতে থাকলো দর কষাকষি ।  ফেরার পথে শাল, আখরোট, খেজুর, কাশ্মীরি সাবান,  জাফরান, চেরি ফল কিনে নিতে ভুল হলো না । মাত্র ৪৫ মিনিটের রাস্তা আমরা দুই ঘন্টা ধরে পার করলাম ।

শ্রীনগর শহরে

কাশ্মীর শহরের শেষ সকাল। আগামীকাল ভোর সাতটায় বিমান। তাই বের হতে হবে ভোর ৫টায়। এমন নিরিবিলি সকাল আর পাওয়া যাবে না সহসা। অনেক আরাধনার সকাল এটি । আরাম করে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছি। মেঘেদের উড়োউড়ি দেখছি। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। পাখিদের ডাক কানের কাছে আলাদা সুর তুলেছে। সব মিলিয়ে এমন অভূতপূর্ব সকাল ছেড়ে কে যেতে চায়!

আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার এক করে 'ব্রাঞ্চ' করে নেব আজ । এভাবেই শুয়ে-বসে গল্প করে বেলা ১২টা বাজিয়ে ফেললাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে । ডাল লেকের চারপাশে অনেক মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। এই স্ট্রিট ফুডে ধূলোবালি নেই কারণ শ্রীনগর শহর ধূলোবিহীন শহর । ব্রাঞ্চ শেষ করে সাইট ভিউ করে নেওয়া যাবে। তাই ঠান্ডা পানিতেই শাওয়ার নিয়ে নিলাম । দেশে ফিরলে তো সেই একই গরম জল।

পাহাড় ঘেরা শালিমার বাগ

কাশ্মীরি শালের পাশাপাশিই কাশ্মীরি বিরানীর প্রতি প্রবল আগ্রহ আমার বরাবরই। খুঁজে খুঁজে একটা বিরানীর দোকান বের করলাম ডাল লেইকের ১৫ নম্বর গেটের ধারে; শাহ ক্যাফেটেরিয়া নাম। প্রবল আগ্রহ নিয়ে চিকেন বিরানী মুখে দিলাম এবং প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে তা ফেরত দিলাম । এতোটা বিদ্ঘুটে স্বাদ এই বিরানির, আমি কোনোভাবেই আর খেতে পারিনিভ একটা কুলফি আইসক্রিম মুখে দিয়ে কাটিয়ে দিলাম দুপুরটা । ক্ষুধা  নিয়ে কি আর বিশ্ব ভ্রমণ চলে! তাই ডাল লেকে গিয়ে আগে পানিপুরী খেলাম। সেটাও যে খুব মজা ছিল তা কিন্তু ন; জাস্ট পেট ভরানো । আসলে কাশ্মীরে এসে খাবারের আসল স্বাদ আমরা পাইনি। কারণ আমরা এসেছি তো খাদ্য রসিক বাংলাদেশ থেকে ।

আমরা দুটো ট্যাক্সি নিয়ে নিলাম শহর ঘুরবো বলে। ডাল লেইকের পাশের চমৎকার রাস্তা দিয়ে প্রথমে চলে গেলাম ফুল দেখার উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধী টিউলিপ গার্ডেনে। ডাল লেকের কাছে  জাবারওয়ান পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত বাগানটি  বার্ষিক টিউলিপ উৎসবের জন্য প্রসিদ্ধ। এর কাছাকাছি জায়গায় আরোও বিভিন্ন উদ্যান আছে;  শালিমার গার্ডেন, নিশাত গার্ডেন, অছাবল বাগ, পরী মহল এবং চশমে শাহি গার্ডেন।

শ্রীনগরে ডাল লেক

টিকেট কাটলাম প্রতিজন ২০ রুপি করে নিশাত বাগের জন্যে । পাহাড়ের ঢালে চমৎকার বাগান ফুল দিয়ে ভরপুর। টিউলিপ না দেখার কষ্ট নিমিষে হাওয়া হয়ে গেল । আমরা বিকেলের ঠাণ্ডা বাতাসে খোলা মাঠে শুয়ে পড়লাম। কেউ কেউ ফোয়ারায় ভিজতে আরম্ভ করলো। মনে হলো কৈশরে ফিরে গেছি সবাই।

পাহাড়ের ঢালু বেয়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আমরা তড়িঘড়ি ডাল লেকে চলে  এলাম। বিকেল থেকে রাত পুরো সময়টা আমরা শিকারা (কাশ্মীরে নৌকোকে এই নামে ডাকা হয়) চড়ে কাটাতে চাই। কিন্তু মাঝিরা এমন দাম হাঁকাচ্ছে যা নাগালের বাইরে । এইসব শিকারায় করে যাত্রীর লাগেজ নিয়ে পানির ওপর ভেসে থাকা হাউজ বোটে থাকার ব্যবস্থা আছে। আরো আছে চা পান থেকে আরম্ভ করে ফল, কাশ্মীরি শাল কেনার ব্যবস্থাও। একটা আস্ত জীবন এমন নৌকোয় করে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব।

শিকারা হলো ছোট প্যাডেলযুক্ত ট্যাক্সি নৌকো প্রায়শই প্রায় ১৫ ফুট লম্বা এবং একটি ক্যানোপি এবং একটি কোদাল আকারের নীচে কাঠের তৈরি। এটি কাশ্মীরের সাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এটি কেবল দর্শনার্থীদের ফেরি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। আবার ফল , শাকসবজি এবং ফুল বিক্রয় এবং জলজ উদ্ভিদের মাছ ধরা ও সংগ্রহের জন্যও ব্যবহার করা হয়। নৌকাতে  একটি শিকারায় প্রায় ছয় জন বসতে পারে। সমস্ত হাউজবোটের মালিকরা তাদের বাড়ির অতিথিদের বিনামূল্যে শিকারা পরিবহন সরবরাহ করে বলে জানলাম।

শ্রীনগরে ফুলে ফুলে সাজানো বাগানে

প্রতি  ট্রিপ  ৮০০ রুপি করে শিকারা ভাড়া  করে চললাম সীমানা ছাড়িয়ে। আমরা জানি না সামনে কতদূর যাওয়া যাবে। বোটম্যান বললেন,  সাতটা স্পট দেখাবেন। আমরা তৈরি হয়ে আছি জলের বিস্ময় দেখার অপেক্ষায়। জুলাই ও অগাস্ট মাসে পদ্ম ফুল ফোটে এখানে। এখন ভেসে বেড়ানো ফুলের দেখা মিললো না ।

ভারতীয় 'যাব তাক হ্যায় জান' সিনেমায় নায়িকা আনুশকা শর্মার অভিনীত 'জিয়া জিয়ারে' গানটি  বেশ সাড়া ফেলেছিল। এই সেই ডাল লেক যেখানে গানটির দৃশ্যায়ন করা হয়েছিল । ডাল লেইকের অবস্থান শ্রীনগর শহরের ঠিক মাঝখানে । লম্বায় ডাল লেক প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার আর প্রশস্ত সাড়ে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত । তবে পুরো ডাল লেক দেখতে আমাদের ঘুরতে হবে ১৫-২০ কিলোমিটার। গভীরতা প্রায় পাঁচ ফুট থেকে কোথাও কোথাও ২০ ফুট পর্যন্ত। ডাল লেকের শেষ প্রান্ত ঘেঁষে রয়েছে বিখ্যাত হজরতবাল মসজিদ।

শিকারা উপত্যকার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলির জন্য, বিশেষত ঝিলাম নদীর তীরবর্তী একটি ক্রুজ, পীর পাঞ্জাল পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য উপস্থাপন এবং বিখ্যাত সাতটি সেতু এবং পথে প্রবেশের পিছনে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। ডাল লেকে সাতশোর বেশি হাউসবোট আছে। এর ভেতরে অত্যাধুনিক হোটেলের মত নানান ব্যবস্থা করা। শোবার ঘর, বসার ঘর, বাথরুম সবই আছে। সবকিছুই সুসজ্জিত। সুন্দর কার্পেট বিছানো,পর্দা টানানো। আরো আছে বারান্দা, যেখানে বসে অনায়াসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করা যায়। হাউসবোটের ভিতরে কাঠের জাফরি কাটা দেয়াল অনিন্দ্য সুন্দর। মোট কথা এই হাউসবোটে পাওয়া যাবে সবধরনের ব্যবস্থা যা একজন পর্যটকের একান্ত প্রয়োজন।

আমরা শিকারায় বসে চা খাচ্ছি আর চারপাশের সুন্দর উপভোগ করছি , কেউ কেউ শখ করে আবার দেখলাম চুরুট টেনে নিল যেন নিজের  মধ্যে রাজা রাজা ভাবটা চলে আসে । শিকারায় বসে সন্ধ্যা হতেই বড় পর্দায় হিন্দি মুভি দেখলাম; এটা আমাদের জন্যে বাড়তি আকর্ষণ ছিল । সম্প্রতি জম্মু-কাশ্মীরের মূখ্য সচিব এই প্রেক্ষাগৃহ চালু করেন । এরপর আবার কাশ্মীর এলে হাউসবোটে রাত কাটিয়ে পূর্ণিমা দেখার সাধ রেখে মধ্যরাতে ফিরে এলাম রেস্ট হাউজে । ডাল লেকের শান্ত জলের স্পর্শে গভীর ঘুম চলে এলো ।

ফেরার পালা

খুব কম খরচে কাশ্মীর ভ্রমণ করা যায় বলে আমার কাছে মনে হয়নি। কারণ  শ্রীনগর এয়ারপোর্ট থেকে ডাল লেক অব্দি যেতেই এক হাজার রুপি লেগেছিল, ফিরতেও তাই। সময় লেগেছিল মাত্র ২০ মিনিট। ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলাম বলে ঢাকা থেকে দিল্লি হয়ে শ্রীনগর ফ্লাইট আসা-যাওয়া ভাড়া পরেছিল ৪২ হাজার টাকা । এক সাথে ঢাকা থেকে ছয়জনের টিম নিলে হয়তো গাড়ির খরচ বাঁচানো যেত। বিশেষ দিনে কাশ্মীর ভ্রমণ করতে চাইলে অন্ততপক্ষে পাঁচ দিন ছয় রাত হাতে রাখতে হবে । আরো বেশি করে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে আরো বেশি সময় লাগবে এতে কোনো সন্দেহ নেই । এপ্রিল আর মে কাশ্মীর ভ্রমণের দারুণ সময়। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি এতো তুষার পরে যে কোনো সবুজ দেখা যায় না । ঝরনার পানির প্রবাহ দেখতে চাইলে জুলাই মাস ভালো হবে ।

যারা বাসে বা ট্রেনে যেতে চান অনায়াসে ঢাকা থেকে কলকাতা চলে যাবেন। সেখান থেকে চন্ডিগর হয়ে জম্মু। তারপর শ্রীনগর অর্থাৎ কাশ্মীর । শিয়ালদহ ষ্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজধানী এক্সপ্রেস সপ্তাহের সাতদিনই চলাচল করে। হাওড়া থেকে চলাচলকারী রাজধানী এক্সপ্রেস রবিবার ব্যতীত বাকি ছয়দিন চলে। রাজধানী এক্সপ্রেস বিকেল ৪:৫০ থেকে ৪:৫৫ মিনিটে কলকাতা থেকে ছেড়ে গিয়ে পরদিন সকাল ১০টা  থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে দিল্লি পৌঁছে যায়। দিল্লী থেকে প্রায় ১৪টি ট্রেন যায় জম্মুর উদ্দেশ্যে। সবচেয়ে ভাল রাজধানী এক্সপ্রেস। সপ্তাহে সাতদিন চলাচল করে, দিল্লি থেকে ছেড়ে যায় রাত ৮টা ৪০ মিনিটে। জম্মু পৌঁছে পরদিন সকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে। এছাড়া দুপুরে আছে শালিমার এক্সপ্রেস এবং শ্রিশক্তি এক্সপ্রেস; রাতের দিকে ঝিলাম এক্সপ্রেস, টাটা তাওয়াই এক্সপ্রেসও রয়েছে।

শ্রীনগরে ডাল লেকের আশেপাশে একটু খোঁজ করলে ৫০০-১০০০ রুপিতে থাকার জন্য ডবল রুম পাওয়া যায়। প্রতিবেলা খাবার ১০০-১৫০ রুপি আর সকালের নাস্তা ৫০-৭০ রুপি। সোনমার্গ–পহেলগামে চমৎকার রেস্ট হাউজ আছে। যাবার আগে অবশ্যই অনলাইন থেকে দেখে বুকিং নিতে হবে। কারণ সরকারি ছুটিতে মনের মতো রুম পাওয়া খুব মুশকিলহবে । শীতের কাপড় অবশ্যই সাথে রাখতে হবে। এখানে গ্রীষ্মকালেও বেশ ঠাণ্ডা পড়ে ।

সকাল সকাল এয়ারপোর্টে  ঢুকে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। এতো সুন্দর জায়গা ছেড়ে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। তার ওপর শ্রীনগর কাস্টমস আমার ১০০ মিলি হারবাল শ্যাম্পু নিতে দিল না হাত লাগেজে । খুব  আফসোস নিয়েই প্লেনে উঠলাম। অবশ্য আখরোট, বাদাম, চেরি ফল হাতে করেই নিয়ে উঠেছি। যখন পাইলট  শক্ত করে সিট বেল্ট বেঁধে নিতে ঘোষণা দিলেন, আমার মনে হলো আমাকেও কেউ এই স্বর্গরাজ্যে বেঁধে রাখলে বেশ হত !