দর্শকের সিনেমা রিভিউ: অঞ্জন আইচের ‘আগামীকাল’

রোদেলা নীলারোদেলা নীলা
Published : 5 July 2022, 11:11 AM
Updated : 24 July 2022, 07:34 PM

কোনো সিনেমা দেখার আগে সিনেমাপ্রেমীরা ট্রেইলার দেখে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করে। সেদিক থেকে অঞ্জন আইচ পরিচালিত 'আগামীকাল' সিনেমার ট্রেইলারের গান আর দৃশায়ন আমাকে টেনেছে হলমুখী হতে ।

এটা রহস্যময় সাইকোথ্রিলার  ঘরানার গল্প কি না তা নিয়ে আমার খুব একটা ভাবনা ছিল না। সিনেমায় পরিচিত অনেক মুখ, পরিচালক, প্রযোজকও পরিচিত;  তাই হয়তো এই সিনেমা দেখার আগ্রহ ছিল দ্বিগুণ।

যদিও  মাসুদ মঞ্চ ইন্টারন্যাশনালের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রটির 'আগামীকাল' নামকরণের সার্থকতা আমি কোথাও খুঁজে  পাইনি। অবশ্য এমন হতে পারে, পরিচালক সিনেমার পরের সিকুয়েলে রূপার জীবনের চতূর্থ অধ্যায় দেখাবেন। তাহলে আমি আগামীকালের জন্যে অপেক্ষা করতে রাজি আছি ।

পুরো সিনেমার দুর্দান্ত আকর্ষণের জায়গা হচ্ছে কক্সবাজার  এবং বান্দরবানের অসাধারণ কিছু দৃশ্যায়ন। অঞ্জন আইচ খুঁজে খুঁজে সুন্দর জায়গাগুলো বেছে নিয়েছেন ছবির দৃশ্য ধারণের জন্য। সেই সঙ্গে আছে ড্রোন শটের দারুণ কাজ । এক সিনেমায়  এতোবার ড্রোন  শটের ব্যবহার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি প্রথম দেখলাম ।

এই সিনেমা দেখার হিসেবে চোখের জন্য বেশ আরামদায়ক হয়েছে। আমার মনে হয়েছিল সনি স্টার সিনেমপ্লেক্সে আরো কিছু সময় বসে থাকি ।

১৬০ মিনিটের সিনেমা ইন্টারভেলের আগে যথেষ্ট ধীর গতিতে চললেও শেষে গিয়ে একদম তরল পদার্থের মতো গল্পটা গলে গলে পড়ে যায়। মনে হয়, শতাব্দী ওয়াদুদ হঠাৎ সিআইডি হয়ে আবির্ভাব হয়ে পুরো গল্পটা একদম ঝাড়া মুখস্থ করে বলে ফেললেন আর আমি দর্শক হিসেবে হলাম পুরোপুরি হতাশ ।

রূপা নামের একটি অনাথ মেয়ের জীবনের তিন অধ্যায়ের গল্প হচ্ছে আগামীকাল। যেখানে রয়েঠে শাফায়েতের সাথে সম্পর্ক, এক মাসে পুলিশ হয়ে যাওয়া অবন্তী  এবং রূপার  নিরব শত্রু , অত্যাচারী স্বামী টুটুল চৌধুরি।

তারপর কিছু পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শাফায়েত গায়েব, পাহাড় থেকে অদৃশ্য টুটুল, মনোবিজ্ঞানির বেশ ধরে সিআইডির প্রবেশ, পিআইবি রূপন্তী হাল ছেড়ে দিল এবং  অবশেষে  রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেল।

পুরো গল্পে আমি কোনো নতুনত্ব পাইনি, মনে হয়েছে হিন্দি চ্যানেলের ক্রাইম সিরিয়াল দেখছি। ২০২২ সালে এসে মদখোর স্বামীর হাতে বেল্ড দিয়ে রূপার মার খাওয়া খুবই চোখে লেগেছে । আজকাল দিনে অনেক আধুনিক উপায় আছে টর্চার করার। পরিচালক কেন বাংলা সিনেমার সেই আদি উপায় বেছে নিলেন তা আমি  বুঝিনি । মদ খাওয়া মানেই স্ত্রীকে প্রহার করা এটতো যুগে যুগে বাংলা সিনেমার অনেক পরিচালক দেখিয়ে গেছেন। আধুনিক পরিচালকের ফ্রেমে আমরা পুতা দেখতে চাই না ।

'আমার জীবনে সবকিছুই খুব নিখুঁত শুধু জীবনটা ছাড়া'; মমর কণ্ঠে এ আক্ষেপ থেকে ছবিটির সংলাপ সম্পর্কে পুরো ধারণা পাওয়া যায় । আগামীকাল সিনেমার মূল উপজীব্য সিনেমার সংলাপ ।

ব্যতিক্রমী চরিত্রে ছিলেন আশীষ খন্দকার। তার সংলাপ ডেলিভারি যথেষ্ট প্রাণবন্ত এবং মজার ছিল। টুটুল চৌধুরীর কন্ঠে  'হানি, আমার টিয়া পাখি' শুনতে মজা পাচ্ছিলাম ।

সব চাইতে আকর্ষণীয় ছিল সাবেরী আলমের সংলাপ। জমিদার রানি  চরিত্রে তাকে দুর্দান্ত মানিয়েছে  এবং যেখানে যতটা অভিনয় দেওয়ার তিনি সেই পরিমিত রোধ ধরে রেখেছেন ।

সিনেমায় পোশাক, সাজস্বজ্জা ঠিক ছিল। অবন্তী চরিত্রটিকে প্রেমিকা সাজের চাইতে পুলিশের পোশাকে বেশি সাবলীল লেগেছে। এক্ষেত্রে  অভিনেত্রীর আরও ওজন কমানো দরকার।  প্রেমিকা অবন্তীকে রোমান্টিক লাগেনি। সাদা লাল শাড়িতে মেকআপ ছিল খুব চড়া, তাতে লাবণ্যতা হারিয়েছে। অভিনেত্রী মমর বিপরীতে অভিনয় করবার জন্যে সূচনাকে আরো অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

সাবেরী আলম এই সিনেমায় আনপ্যারালাল। কিন্তু শতাব্দী ওয়াদুদ আমাকে দারুণ হতাশ করেছেন। অভিনয়ের কমতি তো বটেই,  ক্যামেরায় তার বাড়তি ওজন ছিল স্পষ্ট।  বাংলাদেশের সিআইডি অফিসারদের মনে হয় না এতোটা ভারী শরীর আজকাল দেখা যায় । যেহেতু এটা সিনেমা সেক্ষেত্রে চরিত্রের সাথে ওজন মিলিয়ে নেওয়াটা খুব জরুরি ।

ফারুক আহমেদের মতো অভিনেতার  চরিত্রের কেো ব্যবহার করা হয়নি। এটা হতাশাজনক । ইমন বরাবরের মতো চমৎকার নায়ক; অভিনয় দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন। টুটুল চৌধুরী প্রয়োজনের বাইরে চিৎকার করেছেন, তার কপাল কুঁচকে সংলাপ বলাটা বেশ চোখে লেগেছে । সুজত শিমুলের কমেডি অভিনয় সত্যি দর্শকদের মধ্যে মৃদু হাসি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে । অঞ্জন নিজে অল্প সময়ের জন্যে স্ক্রিনে এসে নিজেই অভিনয় করে পয়সা বাঁচিয়ে নিয়েছেন । আর  জাকিয়া বারী মম ছিলেন এই সিনেমার প্রাণ। প্রথম থেকে শেষাবধি প্রতিটি দৃশ্যে তিনি পরিস্থিতির শিকার একজন নারীর ভূমিকা স্ক্রিনে ধরে রাখতে শতভাগ সফল হয়েছেন।

গান রিলেটেড সিনেমার গল্প এই দেশে খুব কম হয় কিন্তু অঞ্জন তার সিনেমার গল্পের সাথে গানের কথার অসাধারণ সমন্বয় করতে পেরেছেন। নিজের লেখা গান চিত্রনাট্যে দারুণ ভাবে প্রকাশ করতে তিনি সফল হয়েছেন।

সুজন আরিফের সুরে, কোনালের কন্ঠে অক্সিজেন বিহীন গান বেশ  শ্রুতিমধুর লেগেছে। ইমন সাহার 'ছায়ার মধ্যে আছি আমি' গানটিও  ভালো লেগেছে । কমল সরকার সিনেমাটোগ্রাফির জন্যে আলাদাভাবে সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  চিরচেনা 'হৃদয়ের একূল অকুল দূকুল ভেসে যায়' গানের যথার্থ ব্যবহার করেছেন পরিচালক ।

নাট্যজীবনের একটা বড় সময় অঞ্জন আইচ নাটক নির্মাণে সফলতার সাথে ব্যয় করেছেন। পরিচিত অনেক পরিচালকের সাথে তার নামও উচ্চারিত হয় । 'আগামীকাল'  তার ক্যারিয়ারের নতুন অধ্যায়ের শুরু মাত্র।

আমার বিশ্বাস, যতটা অসঙ্গতি দর্শক হিসেবে আমাদের চোখে পরেছে সেগুলো কাটিয়ে নিলে অঞ্জন আইচের পরবর্তী সিনেমায় সব ঠিক হয়ে যাবে।

আপাতত আগামীকাল সিনেমার জন্য আমার ব্যক্তিগত রেটিং ৭/১০।